বৌপ্রিয়া পর্ব ১৭ + ১৮

0
774

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১৭|

কুসুম কিছুটা ভয়ে আছে। প্রথমবার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে একঘরে! এই ছোট্ট বিষয়টা কুসুমের হৃদয় নাড়িয়ে তুলছে ক্রমাগত। এইতো ঘামে মুখ, গলদেশ ভিজে সে এক বিশ্রী অবস্থা। উচ্ছ্বাস এখনো ঘরে আসেনি। কুসুম শুনতে পারছে দরজার বাইরে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তার বন্ধু এবং বোনদের তর্ক হচ্ছে। বাসর ঘরে প্রবেশ করতে হলে টাকা দিতে হবে। উচ্ছ্বাসের নাছোড়বান্দার মত কথাবার্তা কুসুমের কানে আসছে। তাতেই কেমন শীতল বরফের ন্যায় জমে যাচ্ছে কুসুমের ছোট্ট মন। আজ কি করে উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হবে সে? কুসুম যদি আতঙ্কে, লজ্জায়, ভয়েই মারা যায়, তবে? ইশ! বিছানায় বসে ছটফট করছে কুসুম।

অবশেষে ১০,০০০ টাকায় উচ্ছ্বাস মানাতে পারল সবাইকে। সবাই টাকা পেয়ে হৈ হুল্লোর করে দরজার সামনে থেকে সরে গেল। ভাই, বোন, বন্ধুরা চলে যেতেই মৃদু হাসল সে। ক্লান্ত হাতে ঘাম মুছল কপালের। দরজা খুলে ঘরে ঢুকবে তার আগে পেছন থেকে উচ্ছ্বাসের ফুপাতো ভাইয়ের বৌ ডেকে উঠল। সম্পর্কে উচ্ছ্বাসদের বংশের সবচেয়ে বড় ভাবি হয়। ভাবির ডাক শুনে দরজার হাতলে থাকা উচ্ছ্বাসের হাত আপনাআপনি নেমে আসে। পেছন ফেরে সেদিকে তাকায়,

‘ কি ভাবি, কোনো দরকার? ‘

সৃষ্টি এগিয়ে আসে। উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হয়ে বলে,

‘ একটু জরুরি কথা বলতে হবে। সময় হবে? ‘

উচ্ছ্বাসের হেসে বলে, ‘ সময় হবে না কেন? অবশ্যই হবে। কি বলবে বলো। ‘

সৃষ্টি দরজার দিকে চেয়ে ঠাট্টা করে বলে, ‘ আমি আরো ভাবলাম বাসর ঘরে ঢুকার জন্যে তোমার মনেহয় বড্ড তাড়াহুড়ো। ‘

উচ্ছ্বাসের মাথা চুলকে হেসে বলে, ‘ কেন শুধুশুধু লজ্জা দিচ্ছ ভাবি। কি বলবে বলে ফেলো। ‘

সৃষ্টি গলার স্বর এবার নামায়। কতগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে,

‘ দেখো উচ্ছ্বাস, তোমার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার বয়স খুবই কম। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সোজা কথায় আসি। তোমার সঙ্গে কথা বলে মেহমানদের চা দিতে হবে আমার। কুসুমের মা বিয়ের আগে শর্ত দিয়েছেন, কুসুম যেন এখন এই বয়সে গর্ভধারণ না করে। কুসুমের অল্প বয়স সেটা হ্যান্ডেল করতে পারবে না। বুঝেশুনে চলবে। কুসুম হয়ত কখনো ফোর্স করতে পারে এটা নিয়ে। তুমি ডাক্তার যেহেতু। তোমার এই সম্পর্কে সচেতনতা আছে নিশ্চয়ই। বউকে মানানোর দায়িত্বটাও নিতে হবে। আর তুমি তো এসব জানোও। যথেষ্ঠ বুঝদার একটা ছেলে তুমি। এসব নতুন করে বলার মত কিছু নয়। তবুও আমাকে বলা হয়েছে এই কথাগুলো বলার জন্যে তাই বললাম। রাগ করো না আবার। ঠিকাছে? ‘

উচ্ছ্বাস সব শুনে সৃষ্টিকে আশ্বস্থ করে বলে,

‘ চিন্তা করো না, ভাবি। তুমি না বললেও এদিকটা আমি খেয়াল রাখতাম। ওদেরকে বলে দিও, তাদের ছেলে আর বোনের ছেলে এতটা আহাম্মক নয়। ‘

সৃষ্টি মৃদু হেসে বলে,

‘ জানতাম আমি। আচ্ছা যাও এবার। কুসুম হয়ত অপেক্ষা করছে। প্রথমদিন। দেখো নার্ভাস হয়ে কি না কি অবস্থা হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি এবার। ‘

সৃষ্টি চলে যায়। উচ্ছ্বাস মাথা দুলিয়ে অনেককিছুই চিন্তা করে। কিন্তু নিজের ঘরে ঢুকার আগে সব চিন্তা মাথা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করে দরজার লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।

কুসুম উচ্ছ্বাসকে দেখে নড়েচড়ে বসে। এতক্ষণ শুধু ঘেমেছে। এবার মনে হচ্ছে বুকের ধুকপুকানিতে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। কুসুম নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। উচ্ছ্বাস কুসুমকে একপল দেখে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। বাম হাত থেকে ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখল। ড্রয়ার থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছ্বাস বাথরুমে যেতেই কুসুম কিছুটা স্বস্তি পেয়ে হাফ ছাড়ল। এতক্ষণ উচ্ছ্বাসকে দেখে কুসুম যেন শ্বাস আটকে বসে ছিল। এবার যেন বড় করে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল।

বাথরুম থেকে একবারে গোসল করে বের হল উচ্ছ্বাস। বাথরুম থেকে শ্যাম্পুর গন্ধে পুরো ঘর সুঘ্রাণে ভেসে যাচ্ছে। কুসুম নাক টেনে সেই ঘ্রাণ নিজের মধ্যে নিয়ে নেবার চেষ্টা করল। পরপরই লজ্জায় আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে বসে রইল। উচ্ছ্বাস বারান্দায় টাওয়াল মেলে দিয়ে কুসুমের পাশে এসে বসল। আগাগোড়া কুসুমকে একবার দেখে নিয়েই বুঝতে পারল, তার ছোট্ট কুসুম অত্যধিক নার্ভাস হয়ে আছে।
উচ্ছ্বাস লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নেতিয়ে পরা কুসুমকে আজ একটু ছুঁলেই কুসুম ভয়েই জ্ঞান হারাবে। এই হচ্ছে ছোট মেয়েকে বিয়ে করার ঝামেলা। এরা নতুন নতুন অনুভূতি বুঝে না। শুধুশুধু ভয় পায়। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে বলল,

‘ ঠিকাছ তুমি, কুসুম? আনকমফোর্টটেবল লাগছে? লাগলে আমার বলতে পারো। ‘

কুসুম জড়োসড়ো হয়ে বসল। উচ্ছ্বাসের থেকে এমনিতেও অনেক দূরে বসে আছে কুসুম। এই কথা শুনে এবার আরো একটু পিছিয়ে বসল। উচ্ছ্বাস সেটা দেখে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ল। বিয়ের পর কুসুমকে উচ্ছ্বাসের প্রতি স্বাভাবিক করতে অনেকটা সময় লেগে যাবে, সেটা নিমিষেই বুঝতে পারল উচ্ছ্বাস।

উচ্ছাস হালকা কেশে উঠে। এই মুহুর্তে শুধুমাত্র কুসুম নিজে নার্ভাস নয়। বরং উচ্ছ্বাস নিজেও এই মুহুর্তে অনেকটা বিভ্রান্ত। কি করবে, কি বলবে এই মুহুর্তে উচ্ছ্বাস কিছুই ঠাহর করতে পারছে না।পুরুষ হয়ে বাসর রাতে বিভ্রান্ত হওয়া নিশ্চয়ই মানায় না। কিন্তু উচ্ছাসের বেলায় তার যত আত্মবিশ্বাস, চঞ্চলতা সব এই সময় এসে কোথাও হারিয়ে গেছে এটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন হল বুঝতে পারছে না সে।

কুসুম ইতিমধ্যেই ঘেমে একাকার অবস্থা। বিয়ের বেনারসি ঘামে আঁটসাঁট হয়ে মিশে আছে গায়ের সঙ্গে। কুসুম এখন অব্দি কিছুই বলছে না। তাই উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ কুসুমকে দেখে নিয়ে বলল,

‘ তুমি ঘেমে গেছো দেখছি। চাইলে একটা শাওয়ার নিয়ে নিতে পারো। ‘

উচ্ছ্বাস বলে কুসুমের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কুসুম এই কথা শোনারই যেমন অপেক্ষা করছিল। তাই উচ্ছ্বাস বলামাত্রই কুসুম দ্রুত লাগেজ থেকে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছাসের বলতে দেরি হয়েছে, পরপরই কুসুমের এত দ্রুত দৌঁড়ে বাথরুমে যাওয়া দেখে উচ্ছ্বাস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মনেমনে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন খেলে গেল, তাহলে কি কুসুম উচ্ছাসের থেকে পালাতে চেয়েছিল এতক্ষণ? শিট!

কুসুম বেশ সময় নিয়ে গোসল করে বের হল। নতুন সাধারণ একটা শাড়ি গায়ে কুসুমকে একদম অন্যরকম লাগছে। কুসুমের দৃষ্টি নত। মুখে কোনো সাজ নেই। চুল বেয়ে টপটপ পানি পরছে। এই দৃষ্টি কোন পুরুষের নজর কাড়বে না? আর যদি সেই পুরুষটা হয় কুসুমের স্বামী? তবে নিশ্চয়ই কুসুমকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে বাধ্য হবে সে। ঠিক তেমনটাই হয়েছে উচ্ছ্বাসের বেলায়। ভালোবেসেছে কি না জানে না। তবে কুসুমকে এইরূপে দেখে উচ্ছ্বাস ভীষনরকম মুগ্ধ হয়েছে। তাই তো বারবার চোখ ঘুরিয়ে কুসুমকে দেখছে। কুসুম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়ালে চুল মুছছে। কুসুমের একবার ইচ্ছে করছিল, উচ্ছ্বাসের ব্যবহার করা টাওয়াল দিয়ে নিজের চুল মুছতে। পরক্ষনেই লজ্জায় সেটা কর করতে পারে নি কুসুম। যদি উচ্ছ্বাসের টাওয়াল কুসুম ব্যবহার করত, তবে নিশ্চয়ই সেই টাওয়ালের উচ্ছ্বাসের স্পর্শ, তার গন্ধ লেগে থাকত। কুসুম সেটা মন ভরে নিজের মধ্যে টেনে নিত। ইশ!

কুসুমের ভাবনার মধ্যেই দেখা গেল, উচ্ছ্বাস একটা টাওয়াল হাতে নিয়ে কুসুমের পেছনে দাঁড়িয়ে চুল মুছে দিতে লাগল। কুসুম চমকে উঠল। টাওয়ালে সেই চিরচেনা ঘ্রাণ! কেমন স্বামী স্বামী ঘ্রাণ। কুসুমের মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের স্বামীর ভালোবেসে চুল মুছে দেওয়া দেখতে লাগল। উচ্ছ্বাস বলল,

‘ কুসুম, তোমার চুল তো বেশ ঘন। আগে লক্ষ্য করিনি। ‘

কুসুম নিভু স্বরে বলল,

‘ ছোট থেকেই এমন। মা ছোটবেলায় বারবার ন্যাড়া করে দিত। তাই বড় হয়ে ঘন হয়েছে চুল। ‘

উচ্ছ্বাস কিছু একটা মনে করে বলল,

‘ হ্যাঁ, ছোটবেলায় তোমাকে প্রায়ই দেখতাম মাথায় চুল নেই। ফাঁকা মাথা। তোমাকে এভাবে দেখে খুব হাসি পেত তখন। ‘

উচ্ছ্বাস এই কথা বলে বলে হেসে উঠল শব্দ করে। কুসুম কিছুটা রাগল। বলল,

‘ মনে হয় আপনি কখনো মাথা ন্যাড়া করেন নি? একমাত্র আমিই করেছি?? ছোটবেলা সবাই মাথা ন্যাড়া করে। ‘

উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়,

‘ বুঝ হবার পর আমি কখনোই আমি ন্যাড়া মাথা করিনি। মা করতে চাইলেও করিনি। ন্যাড়া মাথা নিয়ে বন্ধুদের সামনে গেলে তারা ক্ষেপাত। তাই মা যেদিন জেদ করে মাথা ন্যাড়া করে দিতে চাইত, আমি সেদিন আর বাসায় আসতাম না। বন্ধুর বাসায় সারাদিন থাকতাম। পরেরদিন সকালে বাসায় আসতাম। তাই আমাকে সেভাবে কখনো ন্যাড়া করতে পারেনি। ‘

কুসুম এবার উচ্ছ্বাসের চুলে নজর দিল। বলল,

‘ তবুও আপনার চুল এত ঘন? কিভাবে? ‘

কুসুমের চুল মোছা শেষ। উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে বারান্দায় মেলে দিল। বারান্দা থেকে রুমে এসে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে বলল,

‘ এটা কারো কারো হয়। জন্ম থেকেই চুল ঘন থাকে। আমার আব্বুর চুল দেখো নি? এখনো পাকে নি, তারপর আবার ঘন চুল। আমি বোধহয় আব্বুরটা পেয়েছি। ‘

কুসুম এখনো সেভাবেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস নিজের পাশের জায়গায় দেখিয়ে বলল,

‘ এখানে এসে বসো কুসুম। সারারাত কি দাঁড়িয়েই থাকবে? ‘

কুসুম লজ্জা পেল। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে বসল। উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,

‘ ঠান্ডা লাগছে? ‘

বেশ রাত করে গোসল করায় কুসুমের ঠান্ডা লাগলেও ও মুখে মানা করল। উচ্ছ্বাস কুসুমকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

‘ দেখে তো মনে হচ্ছে ঠান্ডায় কাহিল তুমি। এই, কফি খাবে? দুইজনের জন্যে বানিয়ে আনি? বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে কফি খাওয়া যাবে। আনব? ‘

কুসুম মানা করল না। উচ্ছ্বাস রান্নাঘরে গেল কফি বানিয়ে আনতে। বেশ রাত হয়েছিল। বাসার সব ঘুমে। রান্নাঘর প্রায় ফাঁকা। এতে সুবিধাই হল উচ্ছ্বাসের। নাহলে বাসর রাতে রান্নাঘরে এসে কফি বানানো নিয়ে লজ্জায় পরতে হত উচ্ছ্বাসের।

দুজন কফি নিয়ে বারান্দায় বসল। দুজনের মধ্যে জমে থাকা এত বছরের গল্প, কথা সব লেনাদেনা হল। কুসুম আজকের রাতে নতুন করে জানল উচ্ছ্বাসকে। উচ্ছ্বাসও কুসুমের ব্যাপারে নানা অজানা কথা জানতে পারল। সংসার জীবন হয়ত তাদের অনেককিছু দেখাবে। কিন্তু আজকের রাতটা সারাজীবন দুজন মনে রাখবে। আজকের রাত একটা নতুন দম্পত্তির নিজেদের জানা-বোঝার রাত। একে অপরকে গভীরভাবে চিনতে পারার রাত।

#চলবে

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১৮|

সারারাত ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার পর সবে আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। আকাশের মেঘলা ভাব কেটে রোদ নেমেছে। গতকাল প্রায় ভোর অব্দি গল্প করে ঘুমিয়েছিল উচ্ছ্বাস-কুসুম। কুসুম ঘুমানোর সময় দুজন এক বিছানায় ঘুমানো নিয়ে ভীষন অস্বস্তি বোধ করছিল। তাই
উচ্ছ্বাস কুসুমের থেকে একটু সরে বিছানার এক পাশে ঘুমিয়েছে। কিন্তু উচ্ছ্বাস নিজের জায়গায় ঠিকঠাক ঘুমালেও, ভোরের দিকে বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা লাগায় কুসুম নড়তে নড়তে একদম উচ্ছ্বাসের গায়ের সঙ্গে মিশে গেছিল। উচ্ছ্বাসও ঘুমের ঘোরে উম পাবার জন্যে কুসুমকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। দুজন দুজনের আলিঙ্গনে পুরো একটি রাত কাটিয়ে ফেলল, সেই সম্পর্কে দুজনকেই বেখেয়াল। সকালের দিকে রোদ চোখে মুখে লেপ্টে গেল দুজনের। উচ্ছ্বাস চোখ খিচে বালিশ তুলে মুখে চেপে ঘুমিয়ে গেল। তবে কুসুমের ঘুম ছুটে। চোখ খুলে আশপাশ বোঝার চেষ্টা করে। মনে পরে তখন, আজ কুসুমের বাসর রাত ছিল। কুসুম নিজের বাড়িতে নয়, বরং উচ্ছ্বাস বাড়িতে তার ঘরেই তার সঙ্গে শুয়ে আছে। কুসুম পাশ ফিরে তাকাল। উচ্ছ্বাসের গায়ের সঙ্গে একদম লেপ্টে আছে কুসুম। উচ্ছ্বাসের একটা হাত কুসুমের কোমড় ছুঁয়ে রেখেছে। প্রথমবারের মত উচ্ছ্বাসকে নিজের এতটা কাছে অনুভব করতেই কুসুম কেমন যেন হাসফাঁস করে উঠল। অস্বস্তিতে জমে গেল সর্বাঙ্গ। নিশ্চয়ই রাতে সে নড়তে নড়তে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। ঊষা কুসুমের পাশে ঘুমালে, কুসুম সকালে উঠে ঠিক এই দৃশ্যটাই দেখে। ঊষা বারবার কুসুমকে ঠিক করে দিলেও,সেই কুসুম নড়তে নড়তে ঊষার সঙ্গে লেগে ঘুমায়। উচ্ছ্বাস জেগে যাবার আগেই কুসুম আলগোছে উচ্ছ্বাসের হাত নিজের কোমড় থেকে ছাড়িয়ে নিল। পাতলা শাড়ি ঠিক করে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে চলে গেল। ঝটপট গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নজর গেল উপুড় হয়ে ঘুমন্ত উচ্ছ্বাসের দিকে। সে নির্বিঘ্নে, আরাম করে ঘুমুচ্ছে। কুসুম মৃদু হাসল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে যাবে পা বাড়িয়েও থেমে গেল। পিছিয়ে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে বসল। ঘুমন্ত উচ্ছ্বাসকে দেখতে ভীষন ভালো লাগছে কুসুমের। কুসুম আলগোছে হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বাসের চুল টেনে দিল। আরামে উচ্ছ্বাস গুঙিয়ে উঠলো। কুসুম হাসল। উচ্ছ্বাসের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। গতকাল উচ্ছ্বাসের টাওয়াল দিয়ে চুল ঝাড়তে লাগল। এই টাওয়ালের মধ্যে একটা উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বাস গন্ধ আছে। কুসুমের প্রিয় গন্ধ! কুসুম নাক ভরে টেনে নেবার চেষ্টা করল এই গন্ধ। কুসুমের চুল ঝাড়ার কারণে, চুলের পানি ছিটকে পরল ঘুমন্ত উচ্ছ্বাসের মুখে শরীরে। ঘুমের মধ্যেই উচ্ছ্বাস বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাল। আশপাশ লক্ষ্য করতেই নজর গেল আয়নার সামনে ভেজা অঙ্গে দাঁড়ানো কুসুমের দিকে। তাহলে কুসুমের চুলের পানিতেই উচ্ছ্বাসের ঘুম ভাঙলো? উচ্ছ্বাস হেসে উঠে বসল। মাথার বালিশ কোলের উপর রেখে সেটায় হেলান দিল। গালের উপর এক হাত চেপে ধরে বলল,

‘ চুলটা কবে ভালো করে ঝাড়তে শিখবে, কুসুম? তোমার চুলের পানির ছিটে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। ‘

কুসুম পেছনে ফেরে। নম্র কণ্ঠে জিহ্বা কেটে বলে, ‘ সরি, আর করব না। ঘুমিয়ে পড়ুন আবার। ‘

উচ্ছ্বাস মৃদু হাসে। মাথা তুলে দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে। পরপরই বলে, ‘ শিট! নয়টা বেজে গেছে। আর তুমি বলছ আরো ঘুমাব। বিকেলে রিসেপশন। এত কাজ…ওহ, শিট! ‘

বলতে বলতে উচ্ছ্বাস দ্রুত কম্বল ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে পরে। ঝড়ের গতিতে ড্রয়ার থেকে টিশার্ট ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই গোসল সেরে বেরিয়ে আসে। কুসুম তখন হাতে পায়ে লোশন লাগাচ্ছে। উচ্ছ্বাস কুসুমের পেছনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে, তৈরি হয়ে নেয়। কুসুম গয়না পড়ছিল। গয়নাগুলো ভারী দেখে উচ্ছ্বাস বলল, ‘ এত ভারী গহনা পড়ার দরকার কি? সিম্পল কিছু পড়ো। সামলাতে পারবে না এসব। ‘

কুসুম হাত থামিয়ে আয়নায় উচ্ছ্বাসের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে বলে,

‘ কেউ কিছু বললে? ‘
‘ কে বলবে? আম্মা? তোমার কি মনে হয়, আম্মা তোমাকে এসব ব্যাপারে কিছু বলবে? ‘

কুসুম মাথা দুলিয়ে মানা করে বলে, ‘ খালামনি না। আপনার ফুপু বা দাদি। ওরা? ‘

উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত থেকে গয়নার বাক্স সরিয়ে আলগোছে ড্রয়ারে লক করে রেখে দেয়। লক করার সময় বলে,

‘ দাদি বা ফুপু বলবে না কিছু। আর বললেও আম্মা বা আমি ম্যানেজ করে নেব। এখন দ্রুত রেডি হও। দুজন একসঙ্গে বের হব। ‘
____________________
নতুন বর বধূ ঘর থেকে বেরিয়ে এলে, সবাই মিলে সকালের নাস্তা সেরে ফেলে। উচ্ছ্বাস নাস্তা করে বেরিয়ে পরে রিসেপশনের প্রস্তুতি নিতে। কুসুম উচ্ছ্বাসের বোনদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। শিউলি কুসুমের পাশে বসে বিয়েতে অস মেহমানদের সঙ্গে কুসুমের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কুসুম খুব নম্র ভাবে কথা বললো তাদের সঙ্গে। বিয়েতে আসা সবার একটাই কথা,

‘ উচ্ছ্বাসের বয়সের তুলনায় বৌ বড্ড কমবয়সী। ছেলে তাদের বাল্যবিবাহ করেছে নাকি? ‘

কুসুম এই কথার জবাবে চুপ থাকলেই, শিউলি তাদের বুঝিয়ে বলল বিষয়টা। কুসুমের কাবিন অল্পবয়সে হলেও, বিয়ে সংসার এখন প্রাপ্তবয়সে হচ্ছে। কুসুমের বয়স এখন উনিশ। সংসার, বিয়ে এসবের জন্যে সে যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক। মেহমানরা কেউ এই কথা শুনে সন্তুষ্টিতে মাথা দুলালেও, কেউ কেউ আড়ালে কথা বাড়ালো। আড়চোখে কুসুমকে শোপিজের ন্যায় পরখ করল। কুসুম এদের এসব বিভ্রান্তকর আলোচনায় অতিষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে তার।

উচ্ছ্বাস বাড়িতে এলো, তখন প্রায় মধ্যদুপুর। সবাই খেতে বসেছে। উচ্ছ্বাস বাইরের শার্ট পাল্টে ঘরের টিশার্ট পরে ফ্রেশ হয়ে নিচে এল। কুসুমের পাশে চেয়ার টেনে বসার সময় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,

‘ ঠিক আছো তুমি? এখানে অসুবিধা হচ্ছে কোনো? ‘

কুসুম মাথা দুলিয়ে মানা করল। উচ্ছ্বাস কুসুমের পাশে বসে প্লেট উল্টো থেকে সোজা করল। একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,

‘ কোনো অসুবিধা হলে বলবে, ঠিকাছে? ‘

কুসুম মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল। আজকের সকালের ঘটনা চেপে গেল উচ্ছ্বাসের সামনে। উচ্ছ্বাস নিজে নাস্তা কুসুমের প্লেটে তুলে দিল। একটু বেশি করে পোলাও প্লেটে তুলে দিতে চাইলে, কুসুম উচ্ছ্বাসের হাত চেপে ধরে। বলল,

‘ এর বেশি খেলে আমি মরে যাব। ‘

উচ্ছ্বাস ভ্রু কুচকে কুসুমের দিকে তাকায়। পোলাও আর দেয়না। কিন্তু কুসুমকে বলে, ‘ এরকম চড়ুই পাখির মত খাবার খাওয়া এই ঘরে চলবে না। আমরা সবাই পেটুক। সো, তোমাকেও পেটুক হতে হবে। খালামনির বাড়িতে প্রেশার লো হয়ে পরে থাকা এই বাড়িতে চলবে না। আজকের মত কম খাও। কালকে থেকে খাবারে যেন অনীহা না থাকে। ঠিকাছে? ‘

কুসুম কি বলবে আর। উচ্ছ্বাসের গরম চোখ দেখে কিছু কথা বলার সাহস নিভে এলো। চুপ করে প্লেটের খাবার খেয়ে নিল। তবুও ফাঁকফোকরে উচ্ছ্বাস গরুর কলিজার টুকরো, বোরহানি এসব খাওয়ালো কুসুমকে। এই প্রথমবার কুসুমের মনে হল, তার পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি সব খাবারে হয়ত পেঁচিয়ে গেছে। এত এত খাবার খেয়ে সে নড়তে অব্দি পারছে না। আজকে কম খাবে বলে ঠিকই খাইয়ে খাইয়ে তার পেট ফাঁপিয়ে দিয়েছে। নিষ্ঠুর লোক!

বসার ঘরে মেহমানরা সবাই গল্প করছে। কুসুম একপাশের সোফায় বসে। সামনে বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। মানহা কিছু ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে। খেলার ফাঁকে ফাঁকে বারবার চোখ ঘুরিয়ে কুসুমকে দেখছে। কুসুম অনেকক্ষন ধরে ওকে লক্ষ্য করে একসময় হাত বাড়িয়ে ডাক দিল ওকে। মানহা উঠে এলো। কুসুমের সামনে দাঁড়িয়ে আবারও চোখ বড়বড় করে ওকে দেখছে। কী এত দেখছে কুসুম সেটা জানে না। কুসুম হেসে বলল,

‘ কোলে বসবে আমার, বাবু? ‘

মানহা কিছুই বললো না। শুধু চেয়ে রইল। আগের চেয়ে কিছুটা বড় হয়েছে মানহা। বয়স চারবছর। কুসুমকে যেদিন দেখতে গেছিল তখন ওর বয়স ছিল মাত্র একবছর। বড় হওয়ায় মানহার চেহারাতেও পরিবর্তন এসেছে। আরো সুন্দর হয়েছে। হাত বাড়িয়ে মানহার ফুলো গাল টেনে দিল কুসুম। মানহা এখনো চেয়ে আছে। একদমই মানহা বলল,

‘ আমাকে কোলে নিবে? ‘

কুসুম হেসে উঠল। মানহাকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিল। মানহার কপালে চুমু খেয়ে বলল,

‘ কেন নিব না, মেয়ে? এত কিউট একটা মেয়েকে কোলে না নিয়ে পারা যায়? আজকে তোমাকে কোল থেকেই আর নামাব না। ঠিকাছে? ‘

মানহা কি বুঝল কে জানে? ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেললো। এত বড় একটা মেয়ে কোলে উঠে এমন হাউমাউ করে কাদতে দেখে কুসুম বোকা বনে গেল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে মানহাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। মানহা শান্ত তো হলোই না, উল্টো কুসুমকে খামচে, কামড়ে দিতে লাগল। কুসুম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কোল থেকে নামাবে, তার আগেই দূরে থেকে উচ্ছ্বাস ছুটে এসে মানহাকে কোলে নিয়ে নিল। মানহার গলা বসে গেছে কাদতে কাদতে। মানহা উচ্ছ্বাসের ঘাড়ে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠল। উচ্ছ্বাস মানহার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ কাদে না, কাদে না। বড় হয়েছ না তুমি। বড় মেয়েরা কাদে? ছিঃ, মানহা। এটা ব্যাড হ্যাবিট। কান্না থামাও। ‘

মানহা উচ্ছ্বাসকে ভীষন মানে। ছোটবেলা থেকেই ও উচ্ছ্বাসের জন্যে একপ্রকার উন্মাদ। তাই উচ্ছ্বাস দুইবার বলার পরই মানহা কান্না থামাল। কুসুম ওকে আবার কোলে নিতে চাইলে, মানহা আবার ঠোঁট ভেঙে কাদতে চাইল। চট করে কুসুম হাত সরিয়ে নিল। উচ্ছ্বাসের দিকে অসহায় চোখে চাইলে উচ্ছ্বাস চোখের ইশারা করে বললো,

‘ ছোট মানুষ। তোমাকে চিনতে সময় লাগবে। ‘

কুসুম কথা বাড়ালো না। মানহার কান্না থামলে উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,

‘ কেঁদেছিল কেন, মানহা? নতুন বউ তোমাকে আদর করেছে না? কেউ আদর করলে কাদতে হয়? ‘

মানহা আড়চোখে কুসুমের দিকে চেয়ে বলল,

‘ উনি আমাকে বেচে দেবে ঝালমুড়িওয়ালার কাছে। তাই আমি ভয় পেয়েছি। ভয় পেলে আমার কান্না আসে, জানো না তুমি? ‘

উচ্ছ্বাস ভ্রু কুচকে তাকাল কুসুমের দিকে। তারপর হেসে মানহাকে বলল, ‘ নতুন বউ তোমাকে কেন বেচে দেবে, মানহা? ও তোমাকে কত আদর করে। আমি তোমাকে আদর করি না, আমি কি তোমার বেচে দেব, হু? ‘

‘ তুমি দিবে না জানি। কিন্তু নতুন বউ দেবে। আমাকে বলেছে। ‘
‘ কী বলেছে নতুন বউ? ‘
‘ কোল থেকে নামাবে না আমাকে। কোলে তুলে বেচে দেবে ঝালমুড়িওয়ালার কাছে। ‘

কুসুম ভ্রু কুঁচকে চেয়ে হঠাৎ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো তার। উচ্ছ্বাস নিজেও হাসলো। কুসুমকে বলল, ‘ ও শুধু ঝালমুড়ি খায় দেখে ফুপু ওকে ঝালমুড়িওয়ালার ভয় দেখিয়েছে। ওর উইক পয়েন্ট এটা। কথা অমান্য করলেই, ঝালমুড়িওয়ালার ভয় দেখালেই শান্ত হয়ে যায়। তাই ও ভেবেছে তুমিও ওকে ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছে দিয়ে দেবে। ‘

কুসুম হাসলো। মানহার কাছে গিয়ে ওকে মানানোর চেষ্টা করল। উচ্ছ্বাসও কিছুটা সাহায্য করল এতে। মানহা একটু পরই কুসুমের সঙ্গে মিশে গেল। উচ্ছ্বাস মানহাকে কুসুমের কোলে দিল। কুসুম কোলে নিয়ে গল্প শুনাতে লাগল মানহাকে। উচ্ছ্বাস কুসুমের পাশে বসে মোবাইলে কিছু করছে। একপর্যায়ে কুসুম জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনার বাচ্চা খুব পছন্দের, তাইনা? ‘

উচ্ছ্বাস মোবাইলে অন্যমনস্ক হয়ে বলল,

‘ বাচ্চাদের কার ভালো লাগে না? তবে আমার একটু বেশিই ভালো লাগে। বাচ্চা ঘরে থাকলে, ঘর ভরা ভরা লাগে। নাহলে তো ভূতের ঘরের মত হয়ে থাকে ঘর। ‘

কুসুম শুনে। ভাবে কতকিছু। পরপরই উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে রয় নির্নিমেষ। একটা বাচ্চা…. বাচ্চা এলে কি আসলেই ঘর ভরে উঠে খুশিতে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here