বৈবাহিক চুক্তি পর্ব ৪

0
1997

#বৈবাহিক_চুক্তি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্বঃ৪

মোবাইলের আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেলো রুশির, এত সকালে কে আবার ফোন তা ভেবেই বিরক্ত লাগছে ওর।উফফফ মোবাইল না থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। ফোন হাতে নিয়ে বুঝতে পারলো বাংলাদেশি নম্বর, কে ফোন দিয়েছে ওকে তাও এত সকালে? তিশান নয়তো কিন্তু ও নাম্বার কোথায় পেলো! হয়তো দাদিমা থেকে নিয়েছে,যা ভেবেছে তাই ফোন ধরতেই বুঝতে পারলো তিশান ফোন করেছে।

তিশান হচ্ছে ওর সৎ মা মানে ছোট মার ছেলে, তানহা আর তিশান হচ্ছে টুইন। তানহা ওকে দেখতে না পারলেও তিশান সম্পূর্ণ তার বিপরীত, রুশির আদরের ভাই। ছোটবেলায় চকলেটটা ও ভাগ করে খেতে ওর সাথে। ক্লাস এইটে যখন পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিল তখন তিশানই তার বন্ধুদের রুশির কাছে পড়তে বলেছিল,

” তিশান কেমন আছিস ভাই? এতদিন পর মনে পড়লো আমার কথা ”

” ভালো না আপি,দাদিমা খুব অসুস্থ, ডাক্তার বলেছে কয়দিন বাচে ঠিক নেই, দাদিমা বারবার তোমার নাম নিচ্ছে। তুমি কি বাংলাদেশে আসতে পারবে? শেষ দেখাই দেখে যাওনা ”

“আমি এখন কি করে…দাদিমা কি অনেক অসুস্থ? কিন্তু আমি আমার কাছে ফ্লাইট বুক করার মতো টাকা নেই, আমি আসবো কি করে?”

“তুমি একটু ট্রাই করোনা আপি, কয়েকদিন থেকে নাহয় চলে যেও”

“আচ্ছা আমি দেখছি, দাদিমার দিকে খেয়াল রাখিস ”

ফোনটা রেখেই কান্নায় ভেংগে পড়লো রুশি, মা মারা যাওয়ার পর থেকে দাদির হাতেই বড় হয়েছে ও। ছোট মা মারলেও দাদিই বাধা দিতো, হাতখরচ দাদিই দিতো প্রায় সময় এমনকি এসএসসি এক্সামের ফর্ম ফিলাপের টাকা দাদিমাই দিয়েছিলো। সবচেয়ে বড় কথা আজ ও বেচে আছে দাদিমা এর জন্যই নাহয় এই অচেনা শহরে ও কি নিজের আবাস গড়ে তুলতো!

ওইদিন সকালে যখন ছেলেটি ওকে ফেলে চলে গিয়েছিলো তখন ও সেখান থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং বাসায় ফিরে। আসতেই ছোট মা যা নয় তাই শোনায় কিন্তু মারতে নিলে তিশান আর দাদি মিলে বাধা দেয়। ওইদিনের মত সব ঠিক হয়ে গেলেও বাধ সাধে একমাস পর যখন ও রান্নাঘরে হঠাত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো আর পরে ছোট মা জানতে পারে ও মা হতে চলেছে, আমাকে বাজে মেয়ে বলে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো, আমি থাকালে নাকি তানহার বিয়ে হবে না। বাবা একটা কথাও বলে নি শুধু তাকিয়ে ছিলো শিথিল চোখে।
আমি চেয়েও কিছু বলতে পারিনি, কি বলবো? আমার বিয়ে হয়েছে কিন্তু আমার একরাতের স্বামী আমায় ফেলে চলে গেছে! আমার এই মনগড়া কথায় কান দিবে কে? সারাদিন দরজার সামনে বসে ছিলাম, যাবো কোথায়, আমার যে যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

বিকালে দাদিমা লুকিয়ে আমাকে বাগানের কোনে নিয়ে হাতে একটি থলি ধরিয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে বললো এগুলো আমার মায়ের গয়না আর কিছু টাকা।তারপর গলির মাথায় নয়ে আসলেন। আসতেই দেখি তিশান একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাদিমা বললেন আমার মামার সাথে কথা হয়েছে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেদিন দাদিমা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলাম আর বলেছি দাদিমা আমি ভুল কিছু করিনি, সত্যি বলছি।
তারপর তিশানের সাথে নানুবাড়ি চলে আসি। বড় মামা পাসপোর্ট তৈরি করে কলকাতায় ছোট মামার কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে প্রায় একমাস ছিলাম। যখন ছোট মামি প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পারে তখন আমাকে নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচুর ঝগড়া হয় তারপর ওইখানে একটা হোস্টেলে উঠি।
সেই হোস্টেলেই সুজির সাথে দেখা ওই আমাকে রেডিও তে আরজে হতে সাহায্য করেছে আর এখন আমি দ্যা পপুলার আরজে আনাম। এখানে কেউ আমাকে রুশি হিসেবে চিনেনা, শহরের সাথে সাথে নামটাও হারিয়ে গিয়েছে। এখানে বর্তমানে একটা ফ্লাটে আমি আর সুজি মিলে তাকি।
কিন্তু দাদিমা এত অসুস্থ, আমাকে তো যেতেই হবে। যে মানুষটা আমার জন্য এতকিছু করেছে। সে না হলে হয়তো আমি বেচে থাকতাম না আর আমার ছোট্ট সোনাটা হয়তো পৃথিবীর মুখ দেখতো না।

🌸🌸🌸

সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রেডিও স্টেশন থেকে ১সপ্তাহের ছুটি নিলো। সুজির সাহায্যে জরুরি ভিত্তিতে ভিসা তৈরি করে নিয়েছে। রুহানতো সেই সকাল থেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে যদি আমি আমাদের নিজের দেশে যাচ্ছি তাহলে এই দেশ কার? আর যদি আমাদের নিজের দেশ অন্যটা তাহলে আমরা এখানে কেন থাকি, নিজের দেশে কেন থাকিনা?
ওকে যতপ্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি তত নতুন প্রশ্ন জুড়ে দিচ্ছে। কে বলেছিল এত ছোট বয়সে এইরকম ম্যাচিউরড হতে? কই আমিতো এমন ছিলাম না! নির্ঘাত বাবার মতো হয়েছে গম্ভীর আর ওভার ম্যাচিউরড। আচ্ছা ওই লোকটি কেমন দেখতে? রুহানতো দেখতে পুরো ইংরেজ বাচ্চাদের মতো, হেয়ার কালারও বাদামি আবার সুজির সাথে থেকে থেকে ইংরেজিও শিখে গেছে। ওকে দেখলে মনেই হয়না ও আমার ছেলে।

প্লেনে বসে ভাবছি আজ প্রায় চারবছর পর দেশের মাটিতে পা রাখবো, আসলে যে যেখানেই থাকুক না কেন নিজের দেশে যেমন বুক ফুলিয়ে হাটা পরদেশে তো ভিন্দেশী হয়েই থাকতে হয়, আসলে কবি ঠিকি বলেছিলেন

“এমন দেশটি কোথাও খুজে
পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণি সে
যে আমার জন্মভূমি ”

আমি বাঙালি এই শব্দটিতেই যেন পরম সুখ খুজে পাওয়া যায়। আমি গর্বিত কারণ আমি বাঙালি…

***এয়ারপোর্টে নামার সময় রুহানকে জাগিয়ে তুললাম, সারা সময় ও ঘুমিয়েই এসেছে। ওকে কোলে নিয়ে হাটতে হচ্ছে আবার একহাতে ট্রলি। যদি রুহানের বাবা থাকতো তাহলে হয়তো এই কষ্ট হতো না। উফফ কেন যে বারবার ওই লোকটির কথা মাথায় আসে? যে আমাদের ছেড়ে সুখে আছে তাকে ভেবে কি লাভ? সে তো হয়তো বউ বাচ্চা নিয়ে সুখেই আছে।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে টেক্সি নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি তখনি দেখলাম সবাই হঠাত ছুটাছুটি করছে। কি হলো বুঝলাম না কিন্তু মনে হচ্ছে গোলাগুলি হচ্ছে। আমার আত্মা কেপে উঠলো, আমার সাথে রুহান আছে যদি ওর কিছু হয়ে যায়? না আমাকেও পালাতে হবে। যেই ছুটবো তখন বুঝলাম ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, একটা লোক গান হাতে আমাদের দিকেই ছুটে আসছে, সময়টা যেন থমকে গিয়েছে, প্রতিটা সেকেন্ড ঘন্টার মতো মনে হচ্ছে, অনেক চেষ্টা করে পা দুটোকে নাড়াতে পারলাম না। এই পরিস্থিতি খুব পরিচিত, মনে হচ্ছে চার বছর আগের সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। চারবছর আগের মতো সে কি আসবে আমাকে বাঁচাতে? না চাইতেও সেই বলিষ্ঠ হাতের মালিককে খুজছি আমি,

তখনি কেউ হাত টেনে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো, রুহান খুব জোরে চিৎকার করে উঠলো আর আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপছি।একজোড়া হাত খুব শক্ত করে আমাদের জড়িয়ে ধরলো, জানিনা সে কে তবে এই মুহুর্তে এই স্থানটি সবচেয়ে নিরাপদ মনে হচ্ছে, একদমি ভয় করছেনা আমার, একদমি না…

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here