বেলা_শেষে_শুধু_তুমি পর্ব ১৫

0
1506

বেলা_শেষে_শুধু_তুমি পর্ব ১৫
#আনিশা_সাবিহা

সায়রা বাংলোর ভেতরে ঢুকতেই লোকজনের ভীড়ে হারিয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়। এমনিতেই সারাদিন একটুও না খেয়ে থাকায় মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে ওর। এই ভীড়ে তার নাজেহাল অবস্থা। ভীড় থেকে কোনোমতে বেরিয়ে আসে সে। মোটা লাল কার্পেটের সাথে তার হিল জুতো পড়া পায়ের হোঁচট খেতেই পড়ে যেতে নেয় সে। একটি আগন্তুক মেয়ে ছুটে এসে তার হাত দুটো ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়। সায়রা মেয়েটির আপাদমস্তক খেয়াল করে। কালো রঙের সোনালী পাড়ের পাতলা শাড়ি মেয়েটির পরনে। ঘন কালো চুল ছেড়ে দেওয়া। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক পড়া। আগন্তুক মেয়েটি আর কেউ নয় অনিন্দিতা নিজে। অনিন্দিতা ভালো করে লক্ষ্য করে সায়রাকে। ও প্রথমে চিনতে না পারলেও তার ভাইয়ের ফোনে সায়রার ছবি দেখায় সে চিনেই ফেলে সায়রাকে।

অনিন্দিতা খানিকটা ঘাবড়ে যায় সায়রাকে এই অনুষ্ঠানে দেখে। ও কি করতে এসেছে এখানে? কোনো সিনক্রিয়েট করতে এলে কারোর মানসম্মান থাকবে না। ঝটপট সে বলে ওঠে…..
–“সায়রা রাইট?”
সায়রা অবাক চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। এর আগেও সে অনিন্দিতাকে ছবিতে দেখেছিল। তাই সেও বলল….
–“অনিন্দিতা?”
–“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো। তা এখানে? কোনো কাজ ছিল? নাকি ভাইয়া ইনভাইট করেছে গেস্ট হিসেবে?”

–“আমি নিজে থেকে এসেছি। তুমি তো একটা মেয়ে! আমার মনের অবস্থা নিশ্চয় বুঝতে পারবে। আমি পারছি না এভাবে অন্য কারোর সাথে আমার অভয়কে মেনে নিতে। তাই ওর সাথে বোঝাপড়া করতে এসেছি।”
কথাগুলো বলতে বলতে চোখে পানি ভরে এলো সায়রার। আর একটু হলেই কান্নার বন্যা বইয়ে দিতে তার সময় লাগবে না। অনিন্দিতার বেশ খারাপ লাগলো সায়রাকে দেখে। তবে প্রকাশ করল না। অনিন্দিতা হুট করেই সায়রার হাতটা ধরে সাইডে নিয়ে এলো। সায়রার চোখেমুখে বিরক্তির আঁচ দেখা যায়।

–“কি করছো? আমি অভয়ের সাথে কথা বলতে এসেছি। অভয় কোথায়?”
–“এই দিনে ভাইয়ার কোথায় থাকার কথা জানো না তুমি? হ্যাঁ আমি একটা মেয়ে। একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সংসার ভাঙার সাহস আমার নেই। তোমায়ও এটা বুঝতে হবে তুমি একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সংসার ভাঙতে পারো না। তোমার যতই কষ্ট হক না কেন!”
সায়রার বেশ রাগ হয় অনিন্দিতার কথা শুনে। সে কেন করবে স্যাক্রিফাইজ? এটা তার ভালোবাসা। সে করবে না কোনো স্বার্থত্যাগ।

মৃদুস্বরে সায়রা রাগ বজায় রেখে বলে…..
–“আমার স্বপ্নে বানানো সংসারের কি হবে? যেখানে অভয়কে নিয়ে স্বপ্ন বুনেছি আমি? আমার কোনো ইচ্ছে নেই অন্য কোনো মেয়ের সংসার ভাঙার। কিন্তু এটা আমার জীবন মরণের প্রশ্ন! ভালোবাসা না পেলে আমি বেঁচে থেকেও মরে যাব। নিজেকে মরতে দিতে পারব না আমি। তুমি কি পারতে? আমার জায়গায় নিজেকে একবার বসিয়ে দেখো।”
–“হয়ত কষ্ট হতো একটু। কিন্তু পারতাম আমি। এমনকি আমি অন্যের সংসার না ভেঙে এই সিদ্ধান্তই নিতাম। কারণ কারোর জীবনে তৃতীয় ব্যক্ত হয়ে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। সেল্ফ রেসপেক্ট বলেও তো একটা জিনিস আছে!”

সায়রা হাসে। হাসিটা বিদ্রুপের। হাসি বজায় রেখে বলে….
–“কাকে তৃতীয় ব্যক্তি বলছো? আমি নই অভয়ের জীবনে তৃতীয় ব্যক্তি। অভয়ও আমাকে ভালোবাসে। ও আমাকে বলেছে।”
–“ভালোবাসে না। ভালোবেসেছিল! সরি একটু বলতে ভুল করলাম। তোমার মোহ বা মায়াতে আঁটকা পড়েছিল। আরে একটা কুকুরবিড়ালের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেও তো মানুষের মায়া হয়। মানুষ এমন একটা জীব যার মাঝে সবথেকে বেশি মায়া বিরাজমান। ও ভুলে যাবে তোমায়। যাবে কেন বলছি অলরেডি গেছে।”

সায়রা এবার বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ও মেনে নিতে পারছে না। অবিশ্বাসের সাথে ও বলে…..
–“আমি মানতে পারছি না তোমার কথা। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না আমার এই কথা।”
–“ঠিক আছে এসো আমার সাথে। নিজেই দেখেও নাও অভয় আর ভাবিকে।”
অনিন্দিতা ভীড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। পেছন পেছন কাঁপা কাঁপা পায়ের ধাপ ফেলে অনুসরণ করে সায়রা অনিন্দিতাকে। ওর সবটা দুঃস্বপ্ন লাগছে। গলায় যেন কাটা বিঁধে আছে। ও শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। এর থেকে অশান্তির বোধহয় আর কিছু হয় না।

–“এই মেয়ে এভাবে হাসছো কেন? একে তো গজদাঁত। তার ওপর পুরো সব পাটি দাঁত বের করে হাসছো। গজদাঁতওয়ালা মেয়েদের দাঁত বের করে না হাসাই ভালো বুঝলে? দেখতে বিশ্রী লাগে।”
একটি অচেনা মহিলার এমন মক্তব্য শুনে মুখ থেকে হাসিটা গায়েব হয়ে যায় ঐশানীর। সরু দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে মহিলাটিকে। তার পাশে আরেক মহিলা। ঐশানী কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না। তার মায়ের কঠোর আদেশ শ্বশুড়বাড়ি কারোর মুখে মুখে জবাব দেওয়া চলবে না। শান্ত হয়ে থাকতেই হবে। ওপর পাশের মহিলা আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে ঐশানীকে দেখে বলে…..

–“তনয়া কাকে পছন্দ করে ঘরে তুলল? অভয় পোলাডা লম্বায় মাশাআল্লাহ। এমন লম্বা ছেলের পাশে এমন খাটো বউ মানায় নাকি? তনয়ার হুঁশজ্ঞান নেই নাকি?”
নিজেকে শান্ত রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে ঐশানীর। আশেপাশের সবাই তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঐশানী লম্বায় একটু খাটো। ৫ ফিট ১ কি ২ হবে। খুব খাটো তাও নয়। হয়ত অভয়ের মতো লম্বা মানুষের সাথে তাকে খাটোই লাগে। রাগে ও অপমানে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকে সে। ইচ্ছে করছে অনেক কিছু বলতে। কিন্তু পারছে না। চোখে পানি টলটল করছে।

অভয় প্রথম মহিলাটির কথা শুনে চুপচাপ ছিল পাশে। কিন্তু তার রাগ হচ্ছে অসম্ভব পরিমাণে। তাদের এতো বড় অধিকার কে দিল ঐশানীকে এসব বলার? আবারও দ্বিতীয় কথাটিও যেন অভয়ের রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজটা অনায়াসেই করে দিল। ঐশানীর দিকে এক পলক তাকায় অভয়। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। অভয় এবার চেয়ারের হ্যান্ডেলে এক হাত রেখে আয়েশ করে বসে বলল…..
–“আপনারা কি দাওয়াত রক্ষা করতে এসেছিলেন না? আমার বউয়ের খুঁত ধরার জন্য আমি আছি তো। আপনাদের আত্নীয় হিসেবে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আমার বউয়ের খুঁত ধরার জন্য নয়।”

ঐশানী অভয়ের এমন কথাগুলো এক্সপেক্টই করেনি। পাহাড়ের সমান হতভম্বতা নিয়ে চোখ ছলকে পাশে তাকায় সে। অভয় তার হয়ে প্রতিবাদ করছে ভাবতেই মনে অন্যরকম দোলা লাগছে। দুইবার ‘আমার বউ’ শব্দটা শুনে বুকটা দুরুদুরু করছে। ইশশ….কতই না সুন্দর মোহনীয় লাগছিল সেই শব্দটি। ঐশানীর ইচ্ছে করে আবারও ‘আমার বউ’ শব্দটি শুনতে।

কথা শোনানো মহিলা দুটো এক গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। যারা ঐশানীকে কথা শোনাচ্ছিল তারা হলেন মিসেস. তনয়ার চাচাতো বোন। তনয়ার নিজের কোনো ভাই-বোন নেই বলে বড়ই সাধ করে উনাদের দাওয়াত দিয়েছেন।
–“মা গো মা! ছেলের কথা শুনো। একদিন যেতে না যেতে বউয়ের আঁচলের তলায় ঢুকে পড়ে কিভাবে বউয়ের গুনগান গাইছে আর আমাদের অপমান করছে? এই অনুষ্ঠানে আর থাকা যাবে না।”

অভয় হেসে ঐশানীর হাতটা খপ করে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে নেয়। হাসিটা প্রসারিত করে বলে…..
–“আর কি যেন বলছিলেন? ঐশানীর গজদাঁতের হাসি ভালো লাগে না। হাসতে নেই আরো অনেক কথা। আপনাদের ওর হাসি বাজে লাগলে চোখ বন্ধ করে থাকবেন দয়া করে। আমি ওকে সবসময় হাসতে বলব। ওর গজদাঁতের হাসি এতোটাই সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ যে ওর হাসিটা দেখেই আমি ওকে পছন্দ করেছিলাম। আর আন্টি, গতবছর যে শুনলাম আপনার ছেলে ভালোবেসে একটা উঁচু দাঁতওয়ালা মেয়েকে ঘরে বউ করে তুলেছে! কথাটা কি সত্যি?”

প্রথম মহিলাটি আর কোনো উত্তর দেওয়ার মুখই পেলেন না। চোখ গরম করে গটগট করে চলে গেলেন অন্যদিকে। দ্বিতীয় মহিলাটি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকায় অভয় প্রশ্ন করে…..
–“আপনিও কি এখানে উচিত জবাব শোনার অপেক্ষা করছেন?”
সেই মহিলাটিও মুখ ভেঙিয়ে বিদায় নেন সেখান থেকে। ঐশানী তো নিজের বিস্ময় কাটাতেও পারছে না। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে তার সেই হাতের দিকে যেই হাতটি আবদ্ধ অভয়ের হাতে।

অভয় সেটা খেয়াল করে দ্রুতই ছেড়ে দেয় তার হাত। ঐশানীও নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে পড়ে। অভয় হালকা কেশে গম্ভীর ভাবভঙ্গি নিয়ে বলে….
–“উচিত জবাব দিতে অনেক কিছুই বলেছি। তুমি আবার সিরিয়াসলি নিও না যেন।”
–“সিরিয়াসলি নিতে আমার বয়েই গেছে। আপনার মতো লোক আমাকে পছন্দ করবে? এটা অসম্ভবের চেয়েও অসম্ভব ব্যাপার। আমার মতো শান্ত মেয়েকে আপনার মতো লোক পছন্দ করতেই পারে না।”

অভয় ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। নিজের কানটা ঠিকঠাক পরিষ্কার করে নেয় ও। তারপর ফিক করে হেসে বলে…..
–“তুমিও আবার শান্ত? তোমার সাথে শান্ত শব্দটা ঠিকঠাক যায় না! তোমার নাম শুনলেই তো শান্ত শব্দটা দৌড়ে পালাবে। তুমি নাকি আবার শান্ত! হাউ ফানি।”
অভয় ঐশানীর কথায় মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে থাকে। অভয় আবারও তার উদ্দেশ্যে বলে…..
–“আমার সাথে তো খুব তর্কাতর্কি করতে দক্ষ। তাহলে ওরা যখন অপমান করল তখন এই মুখটা ছোট্ট হয়েছিল কেন? ওহ হো! সবার বেলায় ষোলো আনা ছাড় দাও আর আমার বেলায় চার আনাও না!”

–“আমি কি করতাম? আমার মা তর্কাতর্কি করতে মানা করেছে বড়দের সাথে।”
–“এতোই মায়ের কথা মানো জানতাম না তো! যাই হোক ওদের কথায় আবার হাসিটা বন্ধ করো না। আগের মতোই সবসময় হাসতে থাকবে। ওকে?”
ঐশানী এবার হাসে। গজদাঁত বেরিয়ে আসে হাসিতে। ওই হাসিতে যেন সত্যিই আলাদা সৌন্দর্য। হাসি বজায় রেখে সে বলে……
–“আপনার কি মনে হয়? উনাদের জন্য আমি হাসি ছেড়ে দেব? কোনো প্রশ্নই আসে না। আপনার মতো আমি হাসি ছাড়া থাকতে পারব না।”

–“এই এই মানে কি হ্যাঁ? আমি হাসতে জানি না?”
–“জানেনই না তো। গোমড়ামুখো শ্যামলা ঘোড়া, রামগরুড়ের ছানা হাসতে তার মানা।”
বলেই নিজের জিহ্বা কাটে ঐশানী। একচোখ বন্ধ রেখে অন্যচোখ দিয়ে অভয়ের দিকে তাকায়। অভয় রাগে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে। সবার সামনে আর কিছু বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তাই আর কথা বাড়ায় না অভয়। চোয়াল শক্ত করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। তবুও চোখজোড়া ঘুরেফিরে যায় সেই ফাজিল মেয়েটার দিকেই। কারণ মেয়েটা হাসছে। অভয়কে রাগিয়ে যেন সে অন্য মজায় মেতেছে। সেই মজা থেকেই মন খুলে হালকা হালকা শব্দ করে হাসছে।

এই প্রথম ঐশানীর হাসি গভীরভাবে লক্ষ্য করে অভয়। তার হাসি সত্যিই মোহনীয় এবং লোভনীয়। এই লোভনীয় হাসিতে সবসময় তাকিয়ে থাকতে যে কেউই চাইবে। কে বলেছে গজদাঁতের হাসিতে তাকে অসুন্দর লাগে? বরং তার সৌন্দর্য মান যে দ্বিগুন বেড়েছে। এই প্রথম বারের মতো ঐশানীকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখেও নেয় সে। সোনালী রঙের লেহেঙ্গা পরনে তার। খুব বেশি ফর্সা নয়। চেহারায় গোলাপি আভার মতো একটা ভাব রয়েছে। হাসিতে তার ঘন পাপড়িতে আবৃত চোখজোড়া ছোট হয়ে এসেছে। একগোছা চুল বাঁকা করে খোঁপা করা। কপালের প্রায় পুরো অংশ ঢেকে গেছে তার টিকলিতে। হঠাৎই অভয়ের খেয়াল হতেই চোখ সরিয়ে ফেলে সে। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে। তার মন বলে ওঠে…..

–“বার বার তুই কি করছিস অভয়? ওর এই সৌন্দর্য, হাসি, বাচ্চামোতে ভুলছিস তুই। কিন্তু এটা তো অনুচিত! তুই না অন্যকাউকে ভালোবাসিস? তাহলে ওকে এভাবে দেখিস না। বের কর যতদ্রুত পারিস ওকে মন থেকে।”
ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে অভয়। বিড়বিড়িয়ে বলে….
–“আমি কি ভয় পাচ্ছি এই মেয়ের প্রেমে পড়ার? অভয় নাম আমার! তবুও ভয় পাচ্ছি আজ। এতো ভয় পাচ্ছি কেন??”

চলবে…….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here