বেলা_অবেলা – ৬ষ্ঠ পর্ব

0
3527

#বেলা_অবেলা – ৬ষ্ঠ পর্ব
©শাহরিয়ার

শুনেছি ঢাকা শহর নাকি মানুষের ভাগ্য বদল করে দেয়। আমার মত অভাগির কপালে কি আছে তাতো শুধু আল্লাহ জানে। ভাবতে ভাবতে একটা সময় বাসের সিটে ঘুমিয়ে গেলাম।

-চোখ মেলে যখন তাকালাম তখন বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আকাশ কিছুটা কালো কিছুটা লাল বর্ণের রঙে সেজেছে। রাইসা বুকের মাঝে ঘুমিয়ে রয়েছে। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। মেয়েটা আর আগের মত চঞ্চল ও নেই। দেখে খুব মায়া লাগছিলো, তাই বুকের সাথে চেপে ধরে কপালে একটা চুমু দিলাম। রাত নয়টার দিকে ঢাকায় এসে নামলাম। লাল হলুদ হরেক রকম আলোতে চোখ জুড়িয়ে যাবে যে কারো। তবে আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছিলো। জীবনে কখনো ঢাকা শহরে আসিনি। কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো এ শহরে যে আমার পরিচিত কেউ নেউ। এতো রাতে কোথাও বাড়ি বাড়াও পাওয়া যাবে না। কে দিবে আমাকে আশ্রয়? নানান রকম প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি হাঁটা শুরু করছি। মেয়েটা ঘুমে টলমল করতে করতে কোন রকমে আমার একটা হাত ধরে হাঁটছে। ফুটপাত ধরে মা মেয়ে হেঁটে চলেছি। কোথাও যাবার কোন উদ্দেশ্য নেই, গন্তব্যহীন পথে হাঁটছি, কিন্তু এভাবে কতক্ষণ যে ভাবেই হোক থাকার একটা জায়গা যোগার করতে হবে মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দেয়া যায় না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দোকানি একজন বয়স্ক মহিলা। তার কাছ থেকে কিছু বিস্কুট আর রুটি কিনে নিয়ে দু’জন খেয়ে একটা ব্রেঞ্চে বসে রইলাম। রাত যত বাড়ছে ভয় ততই বেড়ে চলেছে, এ শহরে জীবনের নিরাপত্তা পাবোতো? দেখতে দেখতে একটা সময় দোকানি মহিলা আস্তে আস্তে সব কিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করলো। একটা সময় সব গুছিয়ে নিয়ে তার ছোট টং এর দোকান বন্ধ করে দিলো। এতো সময় তার আমার দিকে খেয়াল না থাকলেও এখন ব্রেঞ্চ নেয়ার সময় আমাকে প্রশ্ন করলো, তুমি কোথায় যাবে মা? কেন জানি মন থেকেই উনাকে মন থেকে মা বলে ডেকে উঠলাম। বললাম আমার এ শহরে যাবার কোন জায়গা নেই। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন। এভাবেতো বাহিরে থাকতে পারবা না। শকুনের দল যে কোন সময় হামলা করে তোমাকে খাবলে খাবে। তুমি এক কাজ করো আমার সাথে চলো।

– আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এতো রাতে একটা মেয়ে মানুষ বাহিরে রাস্তায় থাকা নিরাপদ নয় এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম। আবার বৃদ্ধা মহিলার সাথে যাবো তার অসুবিদা যদি হয়। এইসব ভাবতে ভাবতে উনি আবার বলে উঠলো,

– ভয় পেওনা আমার সাথে চলো।

– আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তার সাথে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় পনের বিশ মিনিট উনার সাথে হাঁটার পর একটা বস্তির ভিতর প্রবেশ করলাম। আস্তে আস্তে উনার টিনের ঘরে প্রবেশ করলাম। ঘরটা ভালোই বড় তবে মানুষও কমনা। উনার মেয়ে সাথে দুই নাতনি। মেয়েটার বয়স আমার মতই হবে। মেয়েটা আমাকে বললো

– আপা আপনারা দু’জন হাত মুখ ধুয়ে নেন আমি খাবার রেডি করছি। পেটে প্রচণ্ড খুদা কি ভাববে জানি না, তাড়াতাড়ি রাইসাকে নিয়ে কল থেকে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। আলু ভর্ত মশুর ডাল আর ছোট মাছ রান্না হয়েছে, খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলাম।

– খাওয়া শেষে হবার পর আমার জীবনের সব ঘটনা বললাম। শুনে খুব কষ্ট পেলেন উনারা। সে মা ও বলতে শুরু করলেন কি করবে মা বলো ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। দেখোনা আমার মেয়েটার স্বামী দুবছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। মেয়েটা গার্মেন্টসে চাকরি করে আমি দিনের বেলে মানুষের বাড়িতে কাজ করি আর সন্ধ্যার পর থেকে ঐ দোকানটা চালাই তাতে করে আল্লাহর রহমতে ভালোই দিন কেটে যাচ্ছে।

– আমি মাকে বললাম আমাকে একটা ঘর জোগার করে দিতে সাথে যে কোন একটা কাজ জোগার করে দিতে।

– উনি বললেন কালকেই ঘর জোগার করে দিবে। আর সকালে কাজে বের হয়ে দেখবেন কোন বাড়িতে লোক লাগে কিনা। বাড়িতে কাজ করলেও অনেক টাকা পাওন যাইবো তাতে করে আমাদের দু’জনের বেশ ভালো করেই দিন কেটে যাবে। উনাদের ব্যবহারে আমি অনেক খুশি হলাম।

– এই পৃথিবীতে আমার চেয়েও অনেক অসহায় মানুষ আছে, এই যে যাকে মা ডাকলাম তার মেয়েটার জীবনে কি কম কষ্ট? এতো অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। দুই দু’টো মেয়ে, তাদের নিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে দিব্বি দিন চালিয়ে দিচ্ছে। সে তুলনায় আমি অনেক ভালোই আছি, হয়তো স্বামী পাশে নেই তবুও সে আছেতো। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

– রাতে বেশ ভালো ঘুম হয়েছে, আজ এক ঘুমে সকাল হয়ে গেছে ফজরের আজানে উঠে নামাজ পড়লাম। মা আর তার মেয়ের সাথে ঘরের কাজে হাত লাগাতে চাইলে মেয়েটা বললো আপা আপনি আমাদের বাসায় যে কয়দিন আছেন মেহমান আপনি কোন কাজ করবেন না।

– নিজের অযান্তেই চোখে পানি চলে আসলো। যেখানে নিজের বাড়িতে, নিজের মামী বলেছে কাজ না করলে খাবার দিবে না, সেখানে অপরিচিত এক বোন, এক মা নিজের মেয়ের মত বলছে তুমিতো মেহমান তোমাকে কোন কাজ করতে হবে না এ বাড়িতে যত দিন থাকবে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আল্লাহর দুনিয়াতে আর কি হতে পারে। নিজের মনে অনেক সাহস হচ্ছে, নিজেকে নিজেই বলতে শুরু করলাম আমি এ শহরে আর একা নই। একটা কথা প্রচলিত আছে আপনের চেয়ে পর অনেক ভালো আজ তার বাস্তবিক প্রমাণ পেলাম।

– সবার সাথে সকালের নাস্তা করে নিলাম। পারুল আপা আর মা বের হয়ে গেলেন তাদের কাজে, তাদের বাচ্চা দু’টোকে আমাদের সাথে বাসায় রেখে গেলেন। মা বললেন আসার সময় ম্যানেজারের সাথে কথা বলবেন পাশেই একটা ঘর খালি আছে সে ঘরটা আমাকে ভাড়া দেবার জন্য। আমি ওদের তিনজনকে সাথে নিয়ে ঘরের বসে বসে গল্প করছি। তিনজনই প্রায় সমবয়সী, রাইসারও অল্পতেই ওদের সাথে বেশ জমে গেছে।

– দুপুরে মা খুশি খুশি মনে এসে বললেন, ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছেন, সে ঘরের চাবি দিয়ে দিছে আজ রাত থেকেই আমি ঐ ঘরে থাকতে পারবো। সেই সাথে একটা বাড়িতে কাজের ও ব্যসস্থা করেছেন। এতো খুশিতে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম আলহামদুলিল্লাহ।

– মা বললেন পরদিন সকালেই আমাকে সে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। এ খান থেকে দশ মিনিটের মত লাগবে হেঁটে যেতে। সকালে যেয়ে নাস্তা বানিয়ে দিয়ে দুপুরে রান্না করে জামা কাপড় ধুয়ে দিয়ে এসে আবার শেষ বিকেলের দিকে যেয়ে রাতের খাবার রান্না করে দিয়ে চলে আসতে হবে।

– আমি বললাম আমার কোন সমস্যা হবে না।

– মা বললেন লোকটার স্ত্রী মারা গেছে, দু’টো ছেলে মেয়ে দু’জনই বিদেশে থাকে তবে এখন বাংলাদেশে দুই তিন মাস থেকে আবার চলে যাবেন। মাসে সাত হাজার টাকা দিবে কয়েক মাস পর বাড়িয়ে দিবে।

– আমি বললাম সমস্যা নেই তাতেই আমাদের চলে যাবে।

– মা আর সমস্যা হলেতো আমরা আছি।

– রাতের খাবার মা আর পারুল আপার সাথে করে আমি নতুন ঘরে গেলাম। মা আর পারুল আপা আমাকে সাহায্য করলেন নতুন ঘর গুছাতে, সেই সাথে কিছু প্রয়োজনিও জিনিস ও দিলেন যদিও আমি নিতে চাইনি তবুও জোড় করেই দিলেন। এই মানুষ গুলোর ঋণ সত্যিই শোধ করার মত নয়। পৃথিবীতে অসংখ্য ভালো মানুষ এখনো আছেন। এরাই তার বাস্তবিক প্রমাণ। চেনা নেই জানা নেই একলা একটা মেয়ে মানুষের জন্য মানুষ এতো কিছু করে ভাবতেই মনটা প্রশান্তিতে জুড়িয়ে গেলো। আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন।

– পরদিন সকালে মা আমাকে সে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। আমাকে সব কিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে সে তার কাজে চলে গেলেন। আমিও আমার মত কাজ করতে শুরু করলাম।

– খুব অল্প সময়ের ভিতর আমার জীবনের সব কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেলোও আমি হতাশ হলাম না, সেই সাথে আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস আর আস্থা রাখলাম।

– নাস্তার টেবিলে সে বাড়ির সকলের সাথে পরিচিত হলাম। লোকটার বয়স বেশ ভালোই হবে আমার মামার বয়সী, ছেলে মেয়ে দু’টোও প্রায় সম বয়সী হবে দু এক বছরের ছোট বড় হবে। তাদের ব্যবহার ও খুব ভালো। প্রথম দিন নাস্তা করে আমার বেশ প্রশংসা করলেন।

– আমি সকালের নাস্তা বানিয়ে দিয়ে বাসায় এসে রাইসা আর পারুল আপার মেয়ে টিনা আর টুম্পাকে এক সাথে নিয়ে নাস্তা করে ওদের গোসল করিয়ে রেডি করে রেখে আবার চলে আসলাম দুপুরের খাবার রান্না করার জন্য।

– এভাবেই দিন চলে যেতে থাকলো, এ বাড়িতে সকলে আমার বেশ প্রশংসা করতে লাগলো কাজের আর রান্নার। সারা দিনের কাজ শেষ করে এসে রাতে আমরা সকলে এক সাথে রাতের খাবার খেয়ে গল্প গুজব করতে থাকি।

– পারুল আপা মাঝে মাঝেই বলে তার গার্মেন্টসে কাজ করতে ভালো লাগে না। কিন্তু অন্য কাজ করবে তাতে টাকা কম সেই টাকা দিয়ে মেয়ে দু’টোকে সাথে নিয়ে থাকতে খুবই কষ্ট হবে। আমি পারুল আপাকে বলি কষ্ট হলেও করতে হবে ওদের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে হলেও।

– পারুল আপা বলে মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে, আমি নারী বলেই কি আমার কোন সম্মান নেই? গার্মেন্টসে কাজ করি বলেই কি শরীরটা যাকে তাকে দিয়ে দিতে হবে। তুমি জানো না সহকর্মী থেকে ম্যানেজার কারো চোখ থেকেই যেন দেহটা রেহায় পায় না। সকলে চোখ দিয়ে খুবলে খুবলে খায়। সুযোগ পেলে হয়তো আর বড় কিছু করে ফেলবে।

– আমি বললাম যতটুকু পারো নিজেকে সামলিয়ে রেখো আপু, আমাদের গরীবদের থাকার ভিতর আছে এই সম্মান টুকু এটুকু হারালে হয়তো আর বেঁচেই থাকতে ইচ্ছে করবে না।

– এভাবেই দিন গুলো মোটামুটি বেশ ভালোই কেটো যাচ্ছিলো। শহরে এসে মা পেয়েছি, একটা বোন পেয়েছি পেয়েছি আরও দু’টো সন্তান এর চেয়ে শান্তির আর কি হতে পারে?

– এতো কিছুর পরেও রাতের আঁধারে ঠিকই বুকের মাঝে চিনচিনিয়ে ব্যথা অনুভুত হয় সেই মানুষটাকে ভেবে যাকে বড্ড বেশী ভালোবেসে ছিলাম। যত বেশী সেই মানুষটাকে ভুলে থাকতে চাই ততবেশী করে তার কথা মনে পরে। আসলে চাইলেই আমরা সব কিছু ভুলে যেতে পারি না। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে রাইসাকে বুকে জড়িয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম।

– পরের দিন কাজে আসার পর জানতে পারি, ছেলে মেয়ে দু’জন আজ রাতেই চলে যাবে বাংলাদেশ ছেড়ে। আমি মনে মনে খুশিই হলাম, কিন্তু সে খুশি যে খুব বেশী সময়ের জন্য হবে না তা বুঝতেই পারিনি। আমি নিজেকেই নিজে বলতে থাকি সব সময় আমার সাথেই কেন এমন হবে?

#চলবে…

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3141462082749189/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here