বেলা_অবেলা- ২য় পর্ব
©শাহরিয়ার
আবির হয়তো তখন তার নতুন বউকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। এটা ভাবতেই আমার হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো। আর এদিকে আম্মা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে মাটির বিছানায়, এতো কিছুর মাঝে আমার চোখে কি করে ঘুম আসে?ক না আমার চোখে আর ঘুম আসেনি, ফজরের আজানের শব্দে ঘর থেকে বের হয়ে ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়লাম, এতিম হলেও এতোদিন শাশুড়ির ভালোবাসায় তা ভুলে ছিলাম কিন্তু এখন সেও নেই। যে মানুষটা প্রথম দেখায় নাকি আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো সেও আজ অনৌ কাউকে ভালোবাসতে ব্যস্ত। আমি কিংবা রাইসা ঠিকমত খেলাম কি না খেলাম সেদিকেও তার কোন খেয়াল নেই। আমরা কেমন আছি তাও তার জানার প্রয়োজন নেই। জীবনটা অসহ্য হয়ে উঠছে প্রতিটা মুহুর্তে। নিজেকে নিজে বলতে থাকি আম্মা হয়তো এই দুনিয়া ছেড়ে যেয়ে ভালোই করেছে নয়তো তার জীবনটাও হয়তো আমার মত নরক হয়ে যেতো। জীবন এমন জায়গা আর এমন মুহুর্তে নিয়ে এসেছে চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও চিৎকার করতে পারছি না। আম্মা মারা যাবার সাত দিন পার হয়ে গেলো। বাড়ির অবস্থা এমন যে আবির তার মাকে ভুলেই গেছে। আমি যেন আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দিন দিন এ বাড়িটা আমার কাছে বড় বেশী অচেনা হয়ে উঠছিলো। এতোদিন ধরে যে ঘর যে বাড়ি আমি সাজিয়েছিলাম আজ সে বাড়িটা আমার অচেনা হয়ে গেছে। বেঁচে থেকেও যেন আমি আর বেঁচে নেই। দম বন্ধ হয়ে আসে এখন এ বাড়িতে, নিঃশ্বাস নিতে খুব বেশী কষ্ট হয়। কোন রকমে বিশটা দিন কাটিয়ে দিলাম। আর পারছি না আমার সামনে ওদের এতো ঢং হাসি খুশি চেহারা আর সহ্য করতে পারছি না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম আর বাড়িতে নয়। সকালে ঘুম থেকে মেয়েকে তুলে সিদ্ধান্ত নিলাম চলে যাবো এ বাড়ি ছেড়ে। ব্যাগ গুছিয়ে আবিরকে ডাক দিয়ে বললাম আমি চলর যাচ্ছি। আর সাথে রাইসাকেও নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের খোঁজার চেষ্টা না করার জন্য। আবির বললো যাওয়াটা কি খুব জরুরি? এ বাড়িতেতো থাকা খাওয়ার কোন অসুবিদা নেই। আমি হেসে বললাম তা নেই, তবুও কেমন জানি লাগে। দূর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নতুন বউ আমি স্পষ্ট তার ঠোঁটের কোনে হাসি দেখতে পাচ্ছি। আমি চলে গেলে রাজার সাথে পুরো রাজ্যই তার। আবির রাইসাকে রেখে যেতে বললো। আমি তাকে বললাম তা হবে না। রাইসাকে রেখে গেলে হয়তো সে বাবার আদর পাবে কিন্তু সৎ মায়ের সংসারে তা খুব বেশী দিন টিকবে না। তাই আমি রাইসাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। দুনিয়াতে আপন বলতে এক মাত্র মামা আর মামীই আছেন। যদি মামী মামার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। তিনি আমাকে আগেও খুব একটা পছন্দ করতেন না। আর এখন যে খুব বেশী ভালো চোখে দেখবেন না এটাও আমি জানি। তবুও আপাতত একটু ঠাঁই পাবার আসায় সেদিকেই রওনা হলাম। সকাল এগাড়োটার ভিতর মামার বাড়িতে চলে আসলাম। আমাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন মামী। উনি হয়তো কল্পনাও করেননি আমাকে এসময় তার বাড়িতে দেখবেন। বিয়ের পর একবার শুধু এখানে এসেছিলাম। তারপর আবিরকে সব খুলে বলি আবির আমাকে সে সময় বলে আজ থেকে তোমার একটাই বাড়ি। ঐ বাড়িতে তোমাকে আর যেতে হবে না। সে আবির আমি বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে চলে আসার সময় একবার ও বললো না তোমার তো আর কোন বাড়ি নেই কোথায় যেয়ে উঠবে তুমি? মামী কিরে রুকাইয়া এতো বছর পর কি মনে করে আসলি? মামীর কথায় আমি বাস্তবতায় ফিরে এসে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম কেন আমার কি আসা নিষেধ আছে? আমি মুখে ভেংচি কেটে না তুইতো আর বিয়ের পরে আসিছ না তাই জিজ্ঞাসা করলাম। এমন সময় বাহিরের কাজ ছেড়ে মামা বাড়িতে আসলেন। আমাকে দেখে অনেক খুশি হলেন। রাইসাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো এতোদিনে নানা বাড়ির কথা মনে পরলো? আমার দিকে তাকিয়ে বললো যা আগে হাত মুখ ধুয়ে নে খেতে খেতে গল্প করবো। আমারও প্রচণ্ড খুদা লাগার কারণে আর কথা না বলে হাত মুখ ধুতে চলে যাই। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস।হয়ে মামার সাথে খেতে বসি। খেতে খেতে মামাকে সব খুলে বলি, মামা শুনে প্রচণ্ড রেগে যান এবং বলেন যে উনি আমাকে নিয়ে থানায় যেয়ে আবিরের নামে মামলা করে দিবেন। আমি মামাকে ঠাণ্ডা হতে বলি, সেই সাথে বলি তার কোন দরকার নেই। আমি চাইনা কোন রকম ঝামেলা হোক। আমার এখন একটু আশ্রয় দরকার তুমি কি আমাকে থাকতে দিবে?
– মামা অবশ্যই দিবো, আমার ভাগ্নি আমি ফেলে দিবো নাকি? তুই প্রয়োজনে সারা জীবন এ বাড়িতে থাকবি। তোর বাড়ি তুই থাকবি সমস্যার কি এখানে?
– মামার কথায় অনেকটা সাহস পেলেও মামীকে আমার ভীষণ ভয় লাগে। হয়তো আমার জন্য মামা মামী ঝগড়াও লাগতে পারে। যদিও আমার মামা মামীর কোন সন্তান নেই। তবুও কেন জানি মামীর মনে একটু অনুশোচনা নেই। কিংবা কখনোই আমাকে মেয়ের মত দেখতে পারেন না। তবুও সব সহ্য করে রাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে যে আমাকে এ বাড়িতে থাকতেই হবে। খাবার খাওয়া শেষে মামা চলে গেলে বাহিরে কাজের জন্য। আমি আমার ব্যাগ আর রাইসাকে নিয়ে চললাম আমার সেই পুরনো ঘরে। ঘরটা অনেক খালি পরে আছে। ধুলো বালু আর মাকড়সার জালে ভরে রয়েছে। আমি আস্তে আস্তে সব গুছাতে শুরু করলাম। এ ঘরেই প্রথম আমার চোখাচোখি হয় আবিরের সাথে। সে তার মাকে নিয়ে আমাকে দেখতে আসে। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া করে ডাক্তার হবো। কিন্তু ছোট বেলায় মা বাবাকে হারানোর পর এমনিতেই মামার ঘাড়ে বোঝা হয়ে ছিলাম। তারপর মামী আমার লেখাপড়া কোন ভাবেই মেনে নিতে চাইতো না। কোন রকমে এইচ,এস,সি পরীক্ষা দেই। ভালো ভাবে পাস করি। তারপরই এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসতে শুরু করে প্রথমে বেশ কয়েকটা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই। কিন্তু মামীর বাজে ব্যবহারে একটা সময় আবিরকে আর না করতে পারিনি। প্রথম দেখাতে আমারও কেন জানি আবিরকে ভীষণ ভালো লেগে যায়। ফর্সা গাল দু’টো রোদ্রে লাল টকটকে হয়ে ছিলো। যখন আমাদের বাড়িতে সে আসলো। চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদ্রের এক বিকেলে সে মায়ের সাথে আমাকে দেখতে আসে। আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হই। সব চেয়ে বেশী ভালো লাগে আম্মা যখন মামাকে বললো মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমাদের কোন কিছু দরকার নেই। শুধু মেয়েটাকেই আমার চাই। আম্মার এমন কথায় মনে মনে আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলি আলহামদুলিল্লাহ।
– মামী নানান রকম আয়োজন করে সেদিন হয়তো আমি চলে যাবো তাতে সে ভীষণ খুশি হয়। আমি দূরে বসে দেখছিলাম আবির লাজুক ভাবে অল্প অল্প করে খাবার খাচ্ছিলো। আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো, আবিরকে এভাবে খেতে দেখে। হঠাৎ করেই আবিরের চোখে চোখ পরতে আমি লজ্জায় সেখান থেকে দৌঁড়ে পালাই। তখন আমার বয়সই বা কত সতের কি আঠারো। যাবার সময় আম্মা আমার হাতে তার হাত থেকে খুলে বালা জোড়া আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেন। এটা প্রথম দিন আমার শাশুড়ি আমাকে পরিয়ে দিয়ে দোয়া করেছিলো। আজ আমি তোমাকে পরালাম। জীবনে অনেক সুখি হবে আর অল্প দিনেই তোমাকে আমি আমার ঘরে নিয়ে যাবো। সেদিনই মাকে আমার ভীষণ ভালো লেগে যায়। আমি সেদিনই ঠিক করি উনাকে কখনো কষ্ট দিবো না।সেদিন সারা রাত ঘুমাতে পারি নি বার বার শুধু আবিরের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। একটা মানুষ এতোটা সুন্দর হয় কি করে। তার কথা বলার ধরণ আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছে। সে যখন মামা মামীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলো। তখন মনে হচ্ছিলো এ মানুষটা আমার কতদিনের পরিচিত। অথচ সেই মানুষটাই কিনা এমন করে বদলে গেলো। যে মানুষটা আমাকে পাগলের মত ভালোবাসতো, সেই মানুষটা কি করে বদলে গেলো তা আমি একটুও বুঝতে পারলাম না। যে মানুষটাকে ঘিরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছিলাম, যে মানুষটাকে সাথে নিয়ে সারা জীবন এক সাথে থাকার ইচ্ছে ছিলো আজ সে মানুষটা আমার জীবন থেকে বহুদূর হারিয়ে গিয়েছে। আজ সে মানুষটার বুকে অন্য কেউ মাথা রেখে স্বপ্ন দেখে। কথা গুলো ভাবতেই টপটপ করে ঘুমন্ত রাইসার মুখের উপর চোখের পানি পরতেই।
– রাইসা চোখ মেলে তাকিয়ে বলে উঠলো আম্মু তুমি কাঁদছে কেন?
– মেয়ের কাছে চোখের পানি লুকাতে তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে কই মামুনি কাঁদছি না, চোখে ময়লা পরেছে তাই চোখ দিয়ে পানি পরছে তুমি ঘুমাও। রাইসা আর কিছু বললো না আমার হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে আবারও ঘুমিয়ে পরলো। আমি ভাবছি কতদিন আমার এভাবে কাটবে মেয়ে বড় হবে মানুষজন হাজার রকম কথা বলবে। আমি কি পারবো সমাজের এ মানুষদের সব কথা সহ্য করে আমার মেয়েটাকে মানুষের মত মানুষ করতে?
#চলবে…
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3138228759739188/