বেড নং ৯ পর্ব ৩

0
1537

#বেড নং ৯
৩য় পর্ব,,,

মেঝেতে রক্ত দেখে আমি ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন বেলা আনুমানিক এগারোটা বাজে। আমি মেঝে থেকে উঠে দেখলাম মেঝেতে পড়া রক্তগুলো অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। কি ভেবে যেন আবার ফ্রিজের দরজাটা খুললাম। দেখলাম না সবকিছু একদম ঠিকই আছে। ফ্রীজে কোন মেয়ের লাশ নেই। আমি জলদি উঠে আমার রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিলাম। দেখি বেলা ১১ টা ২০ বাজে আর ফোনে চল্লিশটা মিসডকল এসে রয়েছে। রবিন স্যার কল করেছিল আর নাইট গার্ড হারুণ চাচা ও। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম নতুন করে আবার কোন বিপদ হলো না তো??

আমি জলদি ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে না খেয়েই বের হলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখি আশফাক স্যারের রুমে পুলিশ কমিশনার জনাব তৌসিফ আর সেদিনের সেই পুলিশ দুজন বসে আছে। বাহিরে হারুন কাকা দাঁড়িয়ে। আমায় দেখা মাত্রই কাকা বলে উঠল,,
– স্যার আপনি কই ছিলেন? কতবার কল করেছি দেহেন নি?? আপনি জানেন এদিকে কি হইছে??
– কি হয়েছে কাকা?? আবার নতুন কোন বিপদ??
– বিপদ বলে কি বিপদ? কমিশনার স্যার বসে আছে সেই সকাল ৯ টা থেকে। ভিতরে মিটিং চলছে। বড় স্যার আপনাকে কল করতে বলল, রবিন স্যারও কল করল আপনি ধরেন নি। সব ঠিক আছে তো??

” কিছু ঠিক নেই” কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম
– সব ঠিক আছে। আচ্ছা কাকা নতুন কি বিপদ একটু বলবেন?
– ওই ৪র্থ নম্বর মাইয়ার লাশটা পাওন গেছে।
– কি বলেন? কোথায় পাওয়া গেলো? কখন??
আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছি এর মধ্যেই। না জানি নতুন কোন বিপদ অপেক্ষা করছে।
– ভোর বেলা ঝাড়ুদার রাজু এসে দেখে বস্তায় মোড়ানো কি যেন একটা হাসপাতালের মূল গেইট এর ভিতরে রাখা। ও বড় স্যাররে ফোন দিলো। লাশটা কখন রাইখা গেছে জানি না। তয় মনে হয় ভোর বেলার দিক। তখন তো সিকিউরিটি গার্ড নামাজে যায়। আপনি জলদি ভিতরে যান।

আমি আর এক মিনিটও দেড়ি না করে আশফাক স্যারের রুমে প্রবেশ করলাম। হাসপাতালে কর্মরত যত
ডাক্তার আছে সবাই সেখানে উপস্থিত শুধু আমি ছিলাম না। আমি জানি এর জন্য আমায় অনেক কথা শুনতে হবে,, মনে মনে তার প্রস্তুতি এই নিচ্ছিলাম। কিন্তু আশফাক স্যার কিছুই বলল না। হয়তো পুলিশের সামনে কোন নতুন ঝামেলা চায় নি। শুনেছি কমিশনার তৌসিফ স্যার বড্ড রাগী আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের। আজ অবধি উনি কোন কেস অমীমাংসিত রাখেন নি। বেশ সুনাম আছে তার।

মিটিং শেষে সীদ্ধান্ত নেয়া হলো আজ থেকে প্রতিটি ডাক্তারের ক্যাবিনেও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হবে। প্রত্যেকের গতিবিধি লক্ষ্য করবেন আশফাক স্যার আর তার সাথে একজন পুলিশ কনস্টেবল ও থাকবে। মিটিং শেষে একে একে আমরা সবাই বের হতে লাগলাম। আমি যখন বের হবো তখন তৌসিফ স্যার বলল,,
– মি.আদ্রিব,, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আপনি একটু আমার সাথে রুম নম্বর ৩০৯ এ আসুন।

আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। তবুও নিজের পেশা আর জীবন বাঁচাতে তৌসিফ স্যারের পিছুপিছু পৌছাতে লাগলাম রুম নম্বর ৩০৯ এ। আমি, তৌসিফ স্যার আর তার একজন পুলিশ কনস্টেবল রুমে ঢুকলাম। আমরা রুমে ঢোকা মাত্রই তৌসিফ স্যার রুমের দরজাটা দিয়ে আমায় তার সামনে রাখা চেয়ারটায় বসতে বললেন। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। যদিও আমি কিছুই করিনি,,তবুও মনে হচ্ছে আমি এই সব করেছি।

আমাকে সামনে বসিয়ে সে আমাকে জেরা করতে লাগল,
– আজকে সকালে যে ৪র্থ লাশটা পাওয়া গেছে সেটা জানেন?
– হুম স্যার, শুনেছি।
– কে বলল?
– হারুন কাকা।
– বিয়ে করেছেন?
– জ্বী স্যার,, কি বললেন?
– বিয়ে বুঝেন?? বিয়ে করেছেন?? মানে বিবাহ?
– নাহ স্যার,, কেন বলুন তো?
– আমি পুলিশ না আপনি? পাল্টা প্রশ্ন করবেন না,যা জিজ্ঞেস করব ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন নতুবা আপনার কপালে দুঃখ আছে।
– সরি স্যার
– এই মেয়েটাকে চেনেন? যার লাশ আজ সকালে পাওয়া গেছে?
– না,স্যার
– তবে তার হাতে আপনার শার্টের বোতাম এলো কোথা থেকে? এমনটা তো নয় আপনি তাকে খুন করেছেন,পরে গুম করেছেন। যখন বুঝতে পেরেছেন যে পুলিশ সবটা বুঝতে পারবে তখনি লাশটা ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন??
– নাহ স্যার তেমন কিছুই না।
– আপনার শার্টের আরেকটা বোতাম কোথায়?

আমি তাকিয়ে দেখি ভুল করে আমি সেই শার্টটাই পড়ে এসেছি যার বোতামটা ছিড়ে গিয়েছিল সেদিন রাতে।
আমি আমতা আমতা করে জবাব দিলাম,
– আসলে স্যার,,,,
– থাক,, আপনি রাতে ঘুমান না?
– কেন স্যার? ঘুমাই তো
– রাতে মনে হয় আপনার ঘুম হয়না। হবে কি করে লাশ নিয়ে এতো ভাবলে। আই মিন হাসপাতালের অবস্থা আর কি।
কথাটা বলেই অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ল তৌসিফ স্যার। আমার মনে হলো লাশের চেয়ে উনি বেশি ভয়ংকর। আমি মনে মনে বিড়বিড় করলাম, ” সাবধানে থাকতে হবে”। কথাটা জানি না কি করে তৌসিফ স্যার শুনে ফেলল,। রুম থেকে বের হতে হতে আমায় বলল, ” একটু সাবধানে থাকবেন।”

আমি রুম থেকে বের হয়ে আশফাক স্যারের রুমে গেলাম। স্যার আমায় কোন কথা না বলেই বের হয়ে গেলো। বলল তার কাজ আছে, আমি যেন পারলে মর্গে একটাবার ঘুরে আসি। উনি নাকি এখন আর কাউকে তেমন ভরসা করেন না। আমি অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মর্গে গেলাম।

এখানে আসতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। সবাই সবার ডিউটিতে আছে তাই বাধ্যতামূলক আমায়,একাই আসতে হলো। রুমে ঢোকা মাত্রই আমার পুরো শরীরের রক্ত হিম হয়ে উঠল। আমি এক পা দু পা করে পুরো মর্গ টা একটাবার চেক করে নিলাম। সব কিছু চেক করা শেষ হলে আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। এমন সময় আমার মনে হলো বেড নম্বর ৯ এর সেই মেয়েটি কি এখনো আছে?? কি ভেবে যেন আমি আবার সেই বেডের কাছে গেলাম। একটানে লাশের উপর রাখা সাদা কাপড়া খুলে দেখলাম মেয়েটা এখনো সেই বেডেই আছে। হয়তো আজ রাতেই ফরেনসিক বিভাগে যাবে। কোন একটা মেডিসিন দিয়ে মেয়েটার লাশটা এখনো সতেজ রাখা হয়েছে।

আমি জানি না আমার মাথায় কি ভর করল,, আমি মেয়ের শরীরে থাকা বাকি কাপড়টুকুও খুলে ফেললাম। অপলক চোখে মেয়েটার পুরো বডিটা দেখছি। শরীরে একটা সুঁতাও অবশিষ্ট নেই। কি ধবধবে সাদা তার শরীর। মন চাইলো একটাবার একটু ছুঁয়ে দেখি। আমি আমার হাতটা মেয়েটার পেটে রাখলাম। কি মসৃণ আর নরম শরীরটা। আমি মেয়েটির শরীরে হাত বুলাচ্ছি ঠিক তখন মনে হলো মেয়েটা আমার দিকে ভয়ংকর রুপ নিয়ে তাকিয়ে আছে আর বলছে, ” মরার পরও তোরা আমার শরীর ছাড়বি না?”

কথাটা আমি স্পষ্ট শুনলাম। ভয়ে আমি আতকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি মেয়েটি আমার দিকে বিভৎস রুপ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি যেন হুশ ফিরে পেলাম। জলদি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার পুরো মাথাটা ঝিম ধরে আছে। আমি এসব কি করছিলাম? নিজেকে যেন একটা রাক্ষস মনে হচ্ছিল। জলদি বাথরুমে গিয়ে হাত মুখে পানি দিয়ে আমার কেবিনে নিয়ে বসে রইলাম।

পরের দিন সকালে আমাকে ডাকা হলো আশফাক স্যারের রুমে। সেখানে তৌসিফ স্যার বসে আছে। আমি রুমে প্রবেশ করা মাত্রই তিনি বলে উঠলেন,
– আমার প্রথম থেকেই আপনার উপর সন্দেহ হচ্ছিল। লাশগুলো নিয়ে তবে আপনি এই এসব করেন?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি জবাব দিলাম,
– এসব কি বলছেন স্যার?? আমি কিছুই করিনি। আশফাক স্যার উনি এসব কি বলছেন?
আশফাক স্যার কোন কথা না বলে সিসিটিভি ফুটেজটা,দেখালো।

সেখানে স্পষ্ট ভাবে আমার গত দুদিনের মর্গের কর্মকাণ্ডগুলো একদম ক্লিয়ার করে দেখানো হয়েছে। আমার মনেই ছিল না কিছুদিন আগেই মর্গে সিসিটিভি লাগানো হয়েছে। আমি মাথাটা নিচু করে বসে আছি। তৌসিফ স্যার বলল,
– এবার চলুন, জেলের হাওয়া খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বের হতে পারলে বিয়েটা করে নিন। তাহলে আর লাশ নিয়ে এতোসব করতে হবে না।

আমি এদের কি করে বোঝাই আমার কোন হুশ থাকে না মর্গে ঢুকলে। তখন আমায় মনে হয় অন্য কেউ কন্ট্রোল করে। আমি অভাগার দৃষ্টি নিয়ে আশফাক স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। স্যার বলল, ” আপনার থেকে এসব আশা করিনি। ” আমি কিছু বলতে গেলে এখন হীতে বিপরীত হয়ে যাবে তাই চুপ আছি। আশফাক স্যার তৌসিফ স্যারকে বলে আমাকে আপাততো জেলে যাওয়া থেকে বাঁচালো। সেই সাথে পুরো বিষয়টা গোপন রাখল। আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ এসব জানে না। তৌসিফ স্যার বলল এরপর আর কিছু পেলে আমায় জেলে দেবে।

সেদিন রাতে আমি আর আমার বাসায় যাই নি। রবিন স্যারের বাসায় গেলাম। সেখানে সে একা আছে তার স্ত্রী ঋতু ভাবী বাবার বাসায় গিয়েছে। রাতে দুজনে গল্প করতে করতে খেতে বসলাম। খাবারের মেন্যুতে আছে গোশ, মাছ আর ডাল সাথে ভাত। এসব রবিন স্যার নিজেই রান্না করেছে। খাবার খাওয়ার মাঝ পথে রবিন স্যার বলল,
– গোশটা কেমন হয়েছে?
– ভাল, তবে একটু নোনতা।
– মানুষের গোশ খেয়েছেন কখনো?? খুব টেস্ট কিন্তু আর সুস্বাদু ও।
বলেই একটা পৈশাচিক হাসি দিলো।

চলবে,,,,,,,,,
Poly Talukde

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here