বৃষ্টি_থামার_পরে পর্ব ১

0
5895

“অইযে আকাশী শার্ট পরা ছেলেটা দেখছিস! ওকে এই চিঠিটা দিবি। যা।” শয়তানি হাসি দিয়ে বলল ভার্সিটির এক সিনিয়র আপু।
মিহি একটু ভরকে গেল৷ কারণ ভার্সিটির প্রথম বর্ষের শেষ পর্যায়ে এসে র‍্যাগ খেতে হচ্ছে আজ। শুধু মাত্র সামান্য একটা ধাক্কা লেগেছিল এই ডাইনির সাথে।
“কিহলো?” চোখ রাঙিয়ে বলল সেই সিনিয়র।
মিহি না চাইলেও কিছু করার নেই। পরে নাহলে আরো ঝড় যাবে। কয়েকদিন আগেই এক জুনিয়রকে ফল ভুগতে দেখেছে।
“জলদি নে। নাটক করিস না। আর শোন, খবরদার বলবি না আমি দিতে বলেছি তাহলে তোর খবর আছে।”
মিহি শুকনো মুখে ইতস্তত করে চিঠিটা নিলো। তারপর সেই সিনিয়র যেদিকে ইশারা করেছিলো সেদিকে অনেক দ্বিধার সাথে এগিয়ে যেতে লাগল।
ছেলেটা মিহির দিকে পিঠ ফিরিয়ে থাকলেও মিহি বুঝলো যে সে হাতের ফোনের ক্রিন স্ক্রোল করতে করতে আড্ডাতে মেতে আছে। কারণ ওখানে আকাশি রঙের শার্ট পড়া ছেলের সাথে আরো সাতটা ছেলে মেয়েও আছে। সবাই হাসাহাসি করে গল্প করছে। সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাজ মনে হচ্ছে। আজ ঘোর অপমান হবে। চিন্তা করেই মিহির গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি করবে ও এখন! এরাও যদি রাম ধোলাই দিয়ে দেয়?
আজকের দিনটা সবচেয়ে কুফাময় দিন।
উপরওয়ালাকে ডাকতে ডাকতে ওদের কাছে হাজির হলো মিহি।
একটা মেয়ে হেসে হেসে কথা বলছিলো কিন্তু মিহিকে দেখে হাসির পাল্লাটা একটু কমিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। তার চাহনির অর্থ হলো, কে তুমি! কি চাই?
আকাশী রঙের শার্ট পড়া ছেলেটা ওই মেয়েটার দিকে ঘুরে ছিল। সে তার মত ফোনে ব্যস্ত যদিও মুখে এখনো লম্বা হাসি।
একে একে সব ছেলে মেয়েগুলো মিহির দিকে তাকালো। সবাইকে হঠাৎ চুপ করে যেতে দেখে ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই ছেলেটা বলল, “কি হলো? চুপ করে গেলি কেনো? তারপর?”
মেয়েটা মিহির দিকে ভ্রু উঁচু করে ইশারা করল যে মিহি কি চায় এখানে?
মিহি হাতের সাদা কাগজটা মুঠোয় আরো শক্ত করে ধরল। হাতটা কাঁপছে। সাহস হচ্ছেনা কিছু বলার।
মেয়েটা মিহির কম্পিত হাতের দিকে তাকাতেই সাদা কাগজটা দেখলো।
মিহি ছেলেটার দিকে কাগজটা কোনো মতে বাড়িয়ে দিয়ে কাপা গলায় বলল, “ভ..ভ…ভাইয়া, এটা…আপনার।”
ছেলেটা হালকা ঘাড় ঘুড়ালো। আর ঘাড় ঘুরাতেই চোখে পরলো একটা মেয়ের হাত যা সাদা কাগজ ধরে আছে।
সেই কাগজটার দিকে লক্ষ্য করেই মিহির দিকে তাকালো সে। সাথে সাথে চোখ আটকে গেল তার।
মিহি আপাতত মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। অপেক্ষায় আছে অপমানের। ঘোর অপমানের।
ছেলেটার ফ্রেন্ডরা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। যে মেয়েটা বকবক করছিল সে মিহির হাত থেকে ছোঁ মেরে চিঠিটা নিয়ে নিলো।
মিহি সাথে সাথে দুই হাত একসাথে গুটিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। এখনো ছেলেটার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছেনা। এদিকে ভয়ে বুক ধুকপুক করছে।
মেয়েটা চিঠি খুলে পড়তে শুরু করে দিলো, “আপনাকে আমি খুব করে চাই। অনেক কাছে।
অনেক ভালোবাসতে চাই। তাই প্লিজ বিয়ে করবেন?”
এটুকু পরেই ওই মেয়ে সহ সবাই অট্টোহাসিতে ফেটে পড়লো।
মিহি কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। অনেক বড়সড় ধাক্কা খেল সে। কত বড় বোকামি করেছে ভেবেই চোখ ভিজে এলো ওর। চিঠিটা আগে নিজের পড়া উচিত ছিল। র‍্যাগ মানেই ত বাজে কিছুই হবে। ভুলে গেল কিভাবে ও? প্রথম কথাটাতেই ত ওর মান সম্মান শেষ হয়ে গেছে।
মেয়েটা হাসতে হাসতে আরো পড়তে লাগল, “বিয়ের পর আমরা চাঁদে হানিমুনে যাব। আর তোমার…
আকাশী রঙের শার্ট পরিহিত ছেলেটা এক থাবা দিয়ে চিঠিটা নিয়ে নিলো।
“চাঁদে?” সবার অট্টোহাসি আরো বেড়ে গেল।
“কি করলি তুই? দে না পড়ি।” হাসিসমেত ভ্রুকুচকে চিঠিটা নেওয়ার চেষ্টা করে বলল মেয়েটা।
কিন্তু ছেলেটা নিতে দিলোনা। বরং ঠান্ডা গলায় বলল, “নিজের বয়ফ্রেন্ডকে বল লিখতে। তারপর তার টা পড়িস।”
মেয়েটা হা হয়ে গেল।
মিহি এখনো মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে। এত বাজেভাবে এসব না হলেও পারতো। ইতিমধ্যে আশেপাশের কতগুলো ছেলেমেয়েও কানাকানি করছে।
“এখান থেকে যা সবাই। আমার ওর সাথে কথা আছে।” বলেই সবাইকে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো ছেলেটা।
“ব্রো র‍্যাগ দিবি নাকি?” ফিসফিস করে বলল ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা ছেলে।
“যেতে বলেছি।” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতেই সবাই ভরকে গিয়ে একে একে কেটে পরতে লাগল। ওই মেয়েটা সবার শেষে গেল। আর যাওয়ার আগে মিহির দিকে কড়া নজরে কয়েকবার তাকালো।
সবাই চলে গেছে টের পেতেই মিহি নিজেও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু বলবে টা কি ছেলেটাকে! ওই সিনিয়র ত সত্যি বলতে মানা করে দিয়েছে।
আপাতত দৌড়ে পালানোই ভালো।
চিন্তা করেই মিহি উলটো দিকে ঘুরতেই ছেলেটা বলে উঠল, “তুমি অনেকগুলো বাচ্চা চাও?”
শোনার সাথে সাথে মিহির পা আটকে গেল। এটাই বাকি ছিলো হয়তো।
“উম, যদিও আমার বাচ্চা একদমই পছন্দ না। কিন্তু..।”
“স..সরি। প্লিজ ওটা ছিড়ে ফেলুন।” কোনোমতে কান্না আটকে কথাগুলো বলল মিহি। তারপর চলে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা বাড়ালো।
কিন্তু দুই কদম যেতে না যেতেই পিছন থেকে ছেলেটা বলে উঠল, “হেই, কাপ কেক!”
ডাকটা শুনেই মিহি ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর হালকা শীতল শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। তবে ঘুরে তাকানোর সাহস হলো না।
এইটাই ত সেই ছেলেটা। যার সামনে ও একদমই পরতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত কিনা এর কাছেই চিঠিটা গেল?
ভেবেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে মিহির।
কোনমতে ঘুরে তাকাল মিহি। সাথে সাথে চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল।
হ্যা এটা সেই ছেলেটাই। কিন্তু এখানে কি করছে!
ছেলেটা মিহির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
এতেই মিহির মধ্যে এখন প্রচন্ড ভয় কাজ করতে শুরু করল। তাই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিহি।
“তো, তুমি এখানে পড়ো!” মুচকি হেসে বলল সে।
মিহি হ্যা না কিছুই বলল না। বরং নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলাতে শুরু করল।

“সমস্যা নেই। আমি তোমাকেই বিয়ে করব।” মুচকি হেসে বলল সে।
মিহি এবার চমকে ছেলেটার চোখের দিকে তাকালো।
ছেলেটার মুখজুড়ে সুন্দর হাসি৷ তাও মিহি ভয়ে শেষ।
মিহি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে দুইপা পিছিয়ে গেল। তারপর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে ঘুরে সেদিনের মত আবার পালিয়ে গেল।

আসলে কিছুদিন আগে স্টেডিয়ামে ঘুরতে গিয়েছিল তমা আর মিহি। সেখানেই এই ছেলের সাথে দেখা। স্টেডিয়ামের এক পাশের ক্যান্টিনের খাবার অর্ডার নিয়ে নিজের বসার সিটে যাচ্ছিলো মিহি।
তখনি ভুলবসত প্লাজুতে পা আটকে ধরাম করে পরলো।
পরলো ত পরলো একটা টেবিলের উপর হুমরি খেয়ে পরলো।
হাতের ট্রে থেকে সব খাবার ছিটকে এদিক ওদিক চলে গেল তন্মধ্যে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হলো টেবিলে কতগুলো ছেলে বসে ছিলো। তাদের সামনে মান সম্মান পানি পানি হয়ে গেল।
মিহি আতংকিত চোখে প্রথমে ডান দিকে তাকালো। ছেলেগুলো ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে আছে। কিন্তু তাদের সবার দৃষ্টি বাম দিকে।
ওদের মধ্যকার একটা ছেলে বাঁকা হাসির সাথে বাম দিকে বসা কারো দিকে তাকিয়ে সুর টেনে বলে উঠল, “ড্যাম~ ইট~!”
মিহি হন্তদন্ত করে উঠে দাঁড়াতেই বাম দিকে চোখ পরল ওর। আর চোখ পরতেই থমকে গেল মিহি।
কারণ একটা ছেলের সাদা টি-শার্টটার বুকের কাছে পুরো ব্লাক কফি ছড়িয়ে গেছে। আর মুখে কাপ কেক পরে মুখ সাদা হয়ে গেছে। ছেলেটা হালকা মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে আছে। তবে তার মেজাজ যে বিগড়ে আছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছে। কারণ টেবিলের উপর রাখা তার হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে।
ভয়ে মিহি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
ছেলেটা আস্তে আস্তে চোখ খুলল তবে মাথা নিচু করেই রইল।
আশেপাশে ফিসফিসানি চলছে। কেউ কেউ মুখ চেপে হাসছে। এমনকি টেবিলে বসা ছেলেগুলোর কয়েকজনও হাসছে।
“আ…আপনি…মানে আমি…।” এটুকু বলেই মিহি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেল।
ছেলেটা মিহির দিকে না তাকিয়েই ওর এক পাশের ওড়না হাত দিয়ে ধরে নিজের মুখে লেগে থাকা কেকের ক্রিমগুলো মুছতে লাগলো।
মিহি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
পুরো মুখ মুছে তারপর চোখ পাকিয়ে মিহির দিকে তাকালো সে।
ব্যস, এতেই মিহির অবস্থা টাইট হয়ে গেল।
কিন্তু ছেলেটা কিছুই বলল না। বরং সেই চোখের চাহনি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
মিহি একশ্বাসে বলে উঠল, সরি, আমি বুঝিনি।
তারপর দ্রুত উল্টো দিকে ঘুরে সেখান থেকে কেটে পরলো।
“কিছু বললি না?!” টেবিলে বসা সব ছেলেগুলো অবাক হয়ে একসাথে বলে উঠল।
তাদের মধ্যে কয়েকজন হা হয়ে গেল।
ছেলেটা একটু কপাল কুচকে নিজের টি শার্টের দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটের কোনে একটু হাসি টেনে আনলো।
বসে থাকা ছেলেগুলো ভ্রুকুটি করে বুঝতে চেষ্টা করলো।

মিহি হন্তদন্ত করে স্টেডিয়ামের পাশের হাঁটার জায়গা দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। আর বার বার পিছনে তাকাতে লাগল।
শান্তির বিষয় এটাই যে ছেলেগুলো পিছু নেয় নি। তাহলে ত আজ ওকে বাঁচানোর কেউ থাকত না।
তবে এতদূর এসে এখন তমার কথা মনে পড়লো।
ওকে ত ফেলে এসেছে। কিন্তু আবার ফিরে যাওয়ার সাহসও হচ্ছেনা। কয়েক মিনিট জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগল কি করবে।
পরে মিহির চিন্তা করে মনে হলো, আগে পালিয়ে বাঁচা ভালো।
সেটাই করার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে একটা কন্ঠস্বর কানে এলো, “হেই কাপ কেক!”
থমকে দাঁড়িয়ে গেল মিহি। অনেক ভয় নিয়ে আস্তে আস্তে পিছনে ঘুরে তাকালো।
যা সন্দেহ করেছিলো তাই-ই। সেই ছেলেটা।
দেখেই মিহি থতমত খেয়ে গেল। এখন যদি এই ছেলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কিছু করে!
ছেলেটা এক ফালি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ওর দিকে হেঁটে এগিয়ে আসলো।
মিহি এলোপাতাড়ি দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেও পারলো না। কারণ ভয়ে পা নড়ছে না।
মিহি ওড়নার প্রান্তভাগ দুইহাতে ধরে মোড়ামুড়ি করতে লাগল।
“ক্ষতিপূরণ কে দেবে?” নিজের টি-শার্টের দিকে ইশারা করে বলল ছেলেটা।
মিহি ছেলেটার পরনের টি-শার্টে টার দিকে তাকালো। কফি পরে সাদার উপর কাদা কাদা অবস্থা। তাও ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টা মিটলেই ভাল।
“ক..কত টাকা? বলুন আমি দিয়ে দেব।”
“টাকা চাইনা।”
“তাহলে?” অবাক হয়ে গেল মিহি।
“তোমাকে চাই।” মৃদুহেসে বলেই ছেলেটা নিজের বুকের কাছে দুই হাত গুজলো।
মিহি চমকে গেল।
“ফাজলামো করছেন?”
“তুমি কি আমার বউ লাগো যে ফাজলামো করব!” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ছেলেটা।
মিহির মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এ কেমন বিপদ রে বাবা! এই সাদা একটা ফালতু টি-শার্ট এর ক্ষতিপূরণে নাকি ‘তোমাকে চাই’।

(চলবে…?)

গল্পের নাম: #বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ১: #কাপকেক
লেখিকা: #Lucky_Nova

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here