বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ১৭

0
545

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ?
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

১৭.
টায়রাকে খুঁজতে ঘর থেকে বের হতেই অনাকাঙ্ক্ষিত বশত টিকলির দেখা হয়ে গেলো আদরের সাথে। উল্টো পায়ে চলে যেতে নিলো। আদর পেছন থেকে ডেকে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে টিকলি বলল,

‘বলেছি তো আপনাদের মতো আপনারা থাকবেন আর আমাদের মতো আমরা। আজ থেকে আমরা অপরিচিত। তবে এতো ডাকাডাকি কেনো?’

আদর চেয়েছিলো টিকলিকে সরি বলবে। অনেকবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে সরি প্র‍্যাকটিস করেছে। জীবনে হয়তো এই প্রথম মা ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে সে সরি বলার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু টিকলির এতোসব আগুনের গোলার ন্যায় কথার ছটায় সেসব কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। সরি প্র‍্যাকটিস টা একদম বৃথা গেলো। আবার ভর করলো রাগ। তবুও রাগ গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে আদর এগিয়ে এলো টিকলির দিকে। মুখে গাম্ভীর্য ভাব টেনে বলল,

‘আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি স্বার্থপরের মতো কথা বলছেন?’

টিকলি বিস্মিত হয়েও প্রকাশ করলো না। ভ্রু কুচকে বলল, ‘আমি? স্বার্থপরের মতো কথা বলছি?’

‘অবশ্যই।’

‘ঠিক কি কারণে আপনার এমনটা মনে হলো?’

‘মনে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?’

‘কেনো? কি করেছি আমি?’

‘কি করেন নি? প্রথমত আপনার দরকার ছিলো বলেই আপনি আমাদের সাথে এসেছেন। কারণ আমরা ভালো ভদ্র ছেলে তা তো এক দেখায় বুঝে ফেলেছিলেন। সেই ট্রিকস টাই কাজে লাগিয়েছেন। ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাদের সাথে সেইফ মতো এসেছেন। ঘুরেছেন। যখন দেখলেন আজ বিকালে ঘুরা শেষ। ঠিক তখনি আপনার মনে হলো আপনাদের রাস্তা এবং আমাদের রাস্তা আলাদা। আমরা পরিচিত থেকেও হুট করে অপরিচিত হয়ে উঠলাম!’

আদরের কথায় বিষের ব্যথার মতো যন্ত্রণায় কাতরালো টিকলির মনের মনপাখি। চোখ দুটো উপচে উঠলো নোনা জল দ্বারা।
টিকলির মোটা ফ্রেমের চশমার নিচের জলসিক্ত চোখদুটো কি আদর দেখতে পেলো? তার মুখ হঠাৎ পাষণ্ড থেকে নমনীয় হয়ে উঠলো। আদর বলতে শুনলো। টিকলি নাক টেনে বলছে,

‘ঠিক। আমি খুব স্বার্থপর। আচ্ছা খুব বেশি কি স্বার্থপর? আমি তো আপনার কথাই রাখার চেষ্টা করেছিলাম। আপনার অবহেলা বিরক্তি ভাব তো আমি আগে বুঝতে পারিনি। বুঝতে পেরেছি কমলার দিঘি থেকে। তবুও তেমন কিছু মনে করিনি। কিন্তু আজ সকালেও যখন অযথা বকাবকি করলেন তখনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আচ্ছা? আপনি বলুন তো আপনার দোষ নেই? আমরা না হয় ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। দেরি করেছি। কিন্তু আপনি তো একটাবার ফোন দিতে পারতেন। আপনার কাছে তো আমার নাম্বার ছিলো। বিরক্ত দেখেই তো ফোন দেননি তাইনা?’

টিকলির গলা ভেঙে এলো। হয়তো আর এক মিনিট এখানে দাড়ালে অবাধ্য জল গুলো গড়িয়ে পরবে নির্জীব কপোলের উপর। অভিমানী ঠোঁটের উপর। নিজের উপর নোনতা স্বাদ পেয়ে অভিমানী ঠোঁট দুটো তখন আরো বেশি অভিযোগ করে বলবে,

‘তুই তো সচরাচর কাদিস না টিকলি। তবে এখন হঠাৎ কেদে আমাকে লবণযুক্ত পানি খাওয়াচ্ছিস কেনো রে?’

টিকলি উল্টো ঘুরলো। চশমার নিচ দিয়ে চোখ দুটো মুছে চলে যেতেই পেছন থেকে আদর বলে উঠলো,

‘যাবেন না।’

কেনো কে জানে টিকলির পা দুটো ইট পাথর সিমেন্টের এই স্থাপনার সাথে আটকে গেলো। নিস্পৃহতায় ছেয়ে গেলো শরীর। ক্রমেই অসাড়, নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণ হয়ে উঠছে মন। আদর আবার বলল,

‘আপনার নাম্বার ডিলিট হয়ে গেছে।’

নিদারুণ এক অবাকতা নিয়ে টিকলি প্রশ্ন করলো, ‘হয়ে গেছে?’

কেনো জেনো টিকলিকে মিথ্যা কথা বলতে পারলো না আদর। একটু ইতস্তত অপরাধী কণ্ঠে বলল,

‘না। ডিলিট করে দিয়েছিলাম।’

টিকলি অবাক হলো। নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণায়। সে কিছু বলল না। পা বাড়ালো আবার চলে যাওয়ার জন্য। আদর তড়িঘড়ি করে বলল,

‘কিন্তু সব দোষ আপনার। এসবের জন্য দায়ী আপনি।’

আবারো পেছন ঘুরে টিকলি বলল, ‘আমি দায়ী?’

‘হুম অবশ্যই।’ পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আদর আবারো বলল,

‘আপনি যদি কমলার দিঘিতে গিয়ে আমাকে রিজেক্ট না করে আর্দ্রর সাথে না আসতেন তাহলে এসব কিছুই হতো না। আপনি আমাকে অপমান করেছেন। সারা পথ আমার সাথে এসে মাঝপথে আমাকে কিছু না বলেই আমারি ছোট ভাইয়ের সাথে আপনি চলে এসেছেন। আপনি একবার বলতে পারতেন আমাকে, যে আমার সাথে আপনার যেতে ভালো লাগছে না। কিন্তু এভাবে আমাকে না বলে কয়ে রিজেক্ট করে আপনি কীভাবে যেতে পারলেন?’

বিস্ময়ের সাগরের হাবুডুবু খেতে খেতে টিকলি আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। বড় বড় পল্লব বিশিষ্ট চোখ জোড়া দিয়ে তাকিয়ে থাকলো শুধু। আদর বলল খুব ই করুণ গলায়,

‘আমি কারো কাছ থেকে রিজেক্ট সহ্য করতে পারিনা টিকলি।’

টিকলি অবচেতনে স্বগতোক্তি করলো, ‘ওহ মাই গড। আপনি একটু বেশি বেশি বুঝেন। মানে কেমনে? কীভাবে সম্ভব? একটা মানুষ এতোটা ভুল ধারণা নিয়ে ভুল বুঝে থাকতে পারে কীভাবে?’

আদর কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। টিকলি বলল,

‘আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন আর্দ্র ভাইয়া আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। সেই মুহুর্তে আমি কীভাবে আর্দ্র ভাইয়ার হাত ছাড়িয়ে আপনার সাথে আসবো? আপনাকে বলার সুযোগ টাই তো পাইনি। কিন্তু আমি অনেকবার তাকিয়ে ছিলাম আপনার দিকে।’

আদরের মনে পরলো। হ্যাঁ, টিকলি তাকিয়ে ছিলো। অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলো। ও প্রশ্ন করলো,

‘আর্দ্র কেনো আপনাকে ওভাবে নিয়ে যাচ্ছিলো?’

‘টায়রা আর ভাইয়ার মধ্যে ঝগড়া বেধেছিল তাই তারা দুজন আর দুজনের সাথে যাবে না। তার জন্য বাধ্য হয়ে আমার আর্দ্র ভাইয়ার সাথে যেতে হয়েছে।’

আদর তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। নিজের এতো বোকামির জন্য নিজের গালেই চর লাগাতে ইচ্ছে করলো। আদর হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘আসলেই?’

টিকলি আদরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে চলে যেতে ধরলো।
মনে পরলো, আদর সরি বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বলা হয়ে উঠলো না। সে পেছন থেকে ডাক দিলো,

‘টিকলি?’

ঘাড় ঘুরিয়ে টিকলি বিরক্ত নিয়ে বলল, ‘বারবার পিছু ডাকছেন কেনো? যেতে দিবেন না আমাকে নাকি?’

‘নাহ..মানে বলছিলাম যে আপনি আমার উপর রেগে নেই তো?’

ইশশ…সরি বলা হলো না! আদরের নিজের উপরেই রাগ হলো। টিকলি ভ্রু কুচকে বলল, ‘আমার রাগ হলেই আপনার তাতে কি?’

আদর থতমত খেয়ে বলল, ‘কিছুই না।’

টিকলি আবার চলে যেতে ধরলে আদর আবার পেছন ডাকলো। বিরক্তের উচ্চ সীমায় পৌঁছে দাঁত কটমটিয়ে টিকলি বলল, ‘সমস্যা কি আপনার?’

‘আমরা যেমন একসাথে এসেছি একসাথেই যাবো। কাল ই রৌনা হবো।’

টিকলি এক পলক তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।
উফফ আপসোস… এই বেলায়ও আদরের সরি বলা হয়ে উঠলো না। আদেও বলা হবে কি না কে জানে?

________________________________

ঘরে ঢুকেই টিকলিকে থমথমে মুখে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো টায়রা,

‘কি হয়েছে রে তোর?’

‘কি হবে?’

ভ্রু কুচকে চিন্তিত কণ্ঠে টায়রা বলল, ‘নাহ। আজকাল একটু বেশি মন খারাপ থাকছে তোর। তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে টিকলি বলল, ‘হয়তো। যাই হোক, ব্যাগ গুছিয়ে রাখিস কাল চলে যাবো।’

টায়রা অবাক হয়ে টিকলির কাছে এসে বসে বলল, ‘কাল ই?’

‘হুম। কাল ই।’

‘কেনো? কাল কেনো? দুটো দিন ও হয়নি এসেছি। মাত্র কাল দুপুরে আসলাম। মাত্র তিনদিন হলো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবো?’

হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে টিকলি বলল,

‘আদর সাহেবের নাকি জরুরি কল আসছে বারবার। এদিকে নিঝুম দ্বীপও তো মোটামুটি সব ই দেখা হয়েছে। কাল সকালে মেবি উনারা নামা বাজার সি বীচ আর উপর বাজার সি বীচ দেখিয়ে আনবেন।’

টায়রা মন খারাপ করে কাপড় গুছাতে লাগলো।

‘তুই চাইলে আমরা আরো কিছুদিন থেকে যেতে পারি। ওরা চলে যাক। আমরা না হয় পরে যাবো।’ টিকলি অন্যমনস্ক গলায় বলল।

টায়রা একটু ছন্নছাড়া হয়ে বলে,

‘কি দরকার? কোনো দরকার নেই। এখানে থেকে আর কি করবো? ভালো লাগছে না। একসাথে এসেছে একসাথেই চলে যাই। ঢাকার আশেপাশে বান্ধবীদের বাসায় ঘুরেফিরে আর দুটো দিন নাহয় কাটিয়ে পরে বাড়ি ফিরবো।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ টিকলি খুব গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘আচ্ছা, টায়রা? তোর কি মনে হয় না আমরা ওদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরেছি?’

কাপড় ভাঁজ করা থামিয়ে ভ্রু কুটি করে টায়রা বলল,

‘হঠাৎ এখন এই প্রশ্ন? আমি বিকালে শুনেছিলাম আদর ভাইয়াকেও এসব বলছিলি তুই। কি হয়েছে তোর?’

‘কিছু হয়নি। তোকে যেটা জিজ্ঞেস করলাম সেটা বল না।’

হাতের কাপড় গুলো ভাঁজ করায় আবার ব্যস্ত হয়ে পরলো টায়রা। অমনোযোগী গলায় বলল,

‘জানি না।’

টিকলি নিষ্প্রাণ শ্বাস ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের কোল ঘেঁষে জেগে উঠলো শত না বুঝা গল্পকথা।

_____________________________

ফোনে মগ্ন ভাইকে আদর প্রশ্ন করলো,

‘আচ্ছা আর্দ্র? মানুষ অর্ধপরিচিত কাউকে সরি কীভাবে বলে?’

ফোন থেকে চট করে চোখ উঠালো আর্দ্র। বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো পুরোদস্তুর চার মিনিট। আদরের কুচকানো কালো দুই ভ্রু। কপালে সুক্ষ্ম তিন-চারটি চিন্তার ভাঁজ। মুখে পরাজয়ের চিহ্ন। যেনো কোনো কিছু না পেরে সে বড্ড হতাশ। পরীক্ষার খাতায় দুটো রসগোল্লা পেয়ে সে ভবিষ্যতের চিন্তায় মশগুল।

ভাইকে পর্যবেক্ষণ শেষে আর্দ্র গলা খাকারি দিয়ে বলল,

‘সরি? মানে তুমি কাউকে সরি বলবা?’

আদর চট করে তাকালো আর্দ্রর দিকে। ধাতস্থ হয়েও রাগী কণ্ঠে বলল,

‘তোকে এতো প্রশ্ন করতে বলেছি?’

‘আচ্ছা? অর্ধপরিচিত সেই ব্যক্তিটি কে?’

‘আমি তোকে প্রশ্ন করতে মানা করেছি?’ গরম চোখে তাকিয়ে আদর বলল।

মুখ গোল করে ‘ওহ’ বলে আর্দ্র নিজেও খানিকটা চিন্তিত হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ ভাবা-ভাবির পর বলল,

‘একটা সরি নিয়ে এতো ভাবা-ভাবির কি আছে ভাইয়া? স্রেফ সামনে যাবা যাকে সরি বলার বলে দিয়ে চলে আসবা।’

কথাটা বলেই আর্দ্র আবারো ফোনে ধ্যানমগ্ন হলো। আদর এক ঝলক ভাইয়ের পানে তাকিয়ে ভাবলো, ‘এতো সোজা বুঝি? যদি এতো সহজ ই হতো তবে টিকলি যখন সামনে ছিলো আদর কেনো সরি বলতে পারলো না। বারবার সরি বলতে গিয়েও কেনো অন্য কথা বলল। সরি কি এতো সস্তা? গিয়ে দাড়ালাম আর বলে চলে আসলাম?’ আদর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো ভাবলো,

‘হয়তো কারো কারো ক্ষেত্রে এতোটাই সোজা। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই সরি বলাটা ভীষণ কঠিন।’

ভাবতে ভাবতেই আদর এলোমেলো হয়ে পরলো। উদাস চোখে খুঁজে বেড়ালো আকাঁবাকাঁ নদীর পাড়। নদীর কিনারা খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গন্তব্যবিহীন মাঝির ন্যায় ঘুরে বেড়ালো সারা তটিনী জুড়ে। তবুও প্রশ্ন থেকেই গেলো। উত্তর পাওয়া হলো না ওই নদীর বুক থেকে।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here