#বুধবারের_আহ্বান
.
নিকিতার শাড়ির আঁচলে যুবকটি হাত দিয়ে কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে ফেলে দেয়। ঠিক সে মুহূর্তে নিকিতার ঘোর কেটে যায়। নিকিতা উদ্ভ্রান্তের মতো যুবকটিকে ধাক্কা দেয়। এর পর পরই তার ঘুম ভেঙে যায়। সে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে বসে! এ বাড়িতে আসার পর থেকে একই স্বপ্ন সে প্রতিরাতে দেখছে! প্রথম প্রথম স্বপ্নে শুধু নীল আলোটা দেখতে পেতো! ধীরে ধীরে সে কালো ছায়া, সুদর্শন যুবক, যুবকের প্রস্তাব,.. ইত্যাদি দেখতে থাকে! প্রতিদিন যেনো এক এক ধাপ করে এগোচ্ছে স্বপ্ন… স্বপ্নের যুবক! এর পরের ধাপে কি হতে চলেছে ভাবতে গিয়ে আতঙ্ক, ভয় সব যেনো ঘিরে ধরলো নিকিতাকে……….
.
অভ্যাসবশত তুহানের ঠিক আটটার দিকেই ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে বসে নিকিতার কপালে হাত রাখলো। কপাল ঠান্ডা। নিকিতাকে দেখে বোঝার উপায় নেই গতকাল রাতেও তার ১০৫° জ্বর ছিলো! তুহানের হাতের স্পর্শে নিকিতা চোখ মেলে তাকালো। তুহানের মনে হলো নিকিতা যেনো ঘুমোয়নি সারারাত, কেবল চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো এতক্ষণ। তার হাতের স্পর্শে চোখ মেললো!
“তুমি ঘুমোওনি?”
“কাল রাতের স্বপ্নটা দেখার পর থেকে ঘুম আসলোনা আর!”
“কি এমন স্নপ্ন দেখেছিলে তুমি?”
নিকিতা ঠিক গতরাতের মতোই চুপ করে থাকলো!
“তুমি কি আমায় বলতে দ্বিধাবোধ করছো?”
“না ঠিক তা নয়!”
“আচ্ছা! বলতো হবেনা! তবে স্বপ্ন নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। স্বপ্ন নিছকই কাল্পনিক বৈকি কিছু না!”
“হু”
তুহান আড়চোখে নিকিতার দিকে তাকালো। নিকিতা বেশ ভয়ই পেয়েছে। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট!
“তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি যাও রেডি হয়ে নাও। আমি মিনিকে সকালের নাস্তাটা পাঠাতে বলছি।”
নিকিতা উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। তিন সেকেন্ডের মাথায় আবার ঘরে ঢুকে বললো, “আজ একটু জলদি ফেলার চেষ্টা কোরো অফিস থেকে। সন্ধ্যে হলে একা থাকতে আমার ভয় কর।”
“আজ সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসবো। আর ভয় পেলে মিনিকে ডেকে নিয়ো।”
.
.
তুহান দুপুরের মধ্যেই অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে এলো। আজ সারাদিন নিকিতাকে সময় দিবে ভেবেছিলো৷ কিন্তু নিকিতা বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে তাকে। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে সারাদিন। কথা কম বলছে। হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠছে। বিকালের দিকে তুহান ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলবে ভেবেছিলো। নিকিতা শরীর খারাপ লাগছে বলে গেলোনা। সারাটাদিন বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দিলো। রাতের খাবারটাও ঠিকমতো খেলো না। রাতে খাওয়া শেষে তুহান ঘরে এসে অফিসের কিছু কাগজপত্র দেখছিলো। আর ঘন্টা দুয়েক কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে ঘুমোতে যাবে। নিকিতা নিচতলায় মিনির ঘরে আছে। প্রতিরাতেই খাওয়ার পর দুজন গল্প করে কিছুক্ষণ, তারপর ঘুমোতে যায়। তুহানের প্রচন্ড বিরক্ত লাগে নিকিতার রাতে দেরিতে শুতে যাওয়ায়; কিন্তু কিছু বলতে পারেনা।
আজ তাড়াতাড়িই ঘরে চলে এলো নিকিতা। তুহানের পাশে এসে বসে বললো, “তুমি কি আজ সারারাত কাজ করবে?”
“না। ঘন্টা দুয়েক লাগবে। কেনো বলোতো?”
“এতক্ষণ? আমি যে বাতি না নিভিয়ে ঘুমোতে পারিনা!”
“আচ্ছা, আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি৷ তুমি বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
তুহান বিছানার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলো গুছিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো। নিকিতা বললো, “তোমার আজ কাজ করাটা খুব জরুরী?”
“না৷ তেমন জরুরী না৷ পরে করলেও হবে! আজ সময় পেলাম, তাই ভাবলাম করে রাখি”
“আজ রাতে আর কিছু করতে হবে না।”
তুহান নিকিতার দিকে তাকালো। নিকিতা তীক্ষ্ণ চোখে তুহানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আচমকা উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলো। ড্রয়ার থেকে দুটো মোমবাতি আর ম্যাচ বের করে জ্বালালো। ঘরের এক কোণার টেবিলের ওপর মোমদুটো রেখে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আসলো। আবছা আলোর মাঝে আঁধারীর মায়াজ্বালেও তুহান নিকিতার চোখের ভাবের খেলা স্পষ্ট দেখতে পেলো। এই মেয়েটার এমন দৃষ্টি তুহানকে বরাবর এলোমেলো করে দেয়। সব ওলটপালট হয়ে যায়। তুহান ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো নিকিতার দিকে তাকালো। তাকিয়েই থাকলো। চোখ একমুহূর্তের জন্যেও সরালো না। নিকিতার চোখভর্তি আকুলতার অব্যক্ত কথার অর্থ তুহান জানে। তুহান দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে নিকিতাকে কাছে টানলো। নিকিতার চিকন কোমল কোমর চেপে ধরলো। নিকিতাও যেনো এমুহূর্তেরই অপেক্ষায় ছিলো। সে তুহানের শরীরের ভেতর ডুবে গেলো। নিকিতা মাথানিচু করে তুহানের বুকে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। তুহান একহাতে নিকিতার থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরলো। নিকিতার দুচোখ বন্ধ। সেখানে একরাশ নামহীন অনুভূতি নিয়ে থরথর করে কাঁপছে তার পাতলা লালচে ঠোঁট। নিকিতা চোখ মেলে তুহানের দুচোখে চোখ রাখলো। আচমকা তার চেহারার ভঙ্গি বদলে গেলো। লাজুক হাসিটুকু উধাও হয়ে গেলো। দুহাতে তুহানকে ধাক্কা দিয়ে পেছনে কয়েক পা সরে গেলো নিকিতা। তুহান নিজেকে সামলাতে না পেরে বিছানার ওপর গিয়ে পড়লো। অকস্মাৎ নিকিতার এমন অদ্ভুত আচরণ বুঝে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো তুহানের। নিকিতা দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পড়লো। সে কেনো এমন করলো তা সে নিজেও জানেনা। কয়েক সেকেন্ড দুজন এভাবেই বসে থাকলো। নিকিতা কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে তুহানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আজ না। আজ তুমি ঘুমিয়ে পড়ো! আজ না।”
তারপর কাঁথা দিয়ে সমস্ত শরীর মুড়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো।
নিকিতার হঠাৎ কি হলো তুহান বুঝতে পারছেনা৷ আজ বেশ অনেকদিন পর নিকিতা তার কাছে এসেছিলো। নিজে থেকেই এসেছিলো৷ তবে আচমকা এমন আচরণই বা কেনো করলো। নিকিতার মাঝরাতে ঘর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা গত কয়দিন তাকে খুব ভাবিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই তার জ্বর আসা, আজকের হঠাৎ কাছে আসার কামনা প্রকাশ করা এসব কিছুতে সেই ভাবনাটা চলে গিয়েছিলো। কিন্তু নিকিতার তাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ঘটনায় সেই ভাবনা আবার তার উপর জেঁকে বসলো। নিকিতার তার ওপর আগের সেই আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। এর পেছনের কারণটা তুহানকে জানতেই হবে। আগামী বুধবার তাকে যে করেই হোক জেগে থাকতে হবে। নিকিতা কোথায় যায়, কার সাথে কথা বলে তা সেদিনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
.
আজ বুধবার। সকাল থেকেই তুহান অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। এ কয়দিন সে শুধু আজকের রাতের প্রতীক্ষার প্রহর গুনে গিয়েছে। গত কয়েকদিনের প্রতিরাতেই একবার নিকিতা চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠেছে। ভয়ে, আতঙ্কে প্রচন্ড শীতের মাঝেও দরদর করে ঘামে ভিজে একাকার হয়েছে। নিকিতা কোনোভাবেই তার আতঙ্কের কারণ তুহিনকে বলেনি। তুহিনের আজ সকাল থেকেই বারবার মনে হচ্ছে আজকে রাতে সে ভয়ঙ্কর কিছুর মুখোমুখি হতে চলেছে। উত্তেজনায় সকালের চা খেতে গিয়ে হাত ফসকে চায়ের কাপ ফেলে সাদা শার্টে দাগ ভরিয়ে ফেললো। অফিসে গিয়েও ফাইল ওলটপালট করে ফেললো। জোহরের আজানের আগেই ছুটি নিয়ে বাসায় চলে এলো। আজ সময় কাটছেনা। রাত দশটার দিকে তুহান রাতের আহার তাড়াতাড়ি শেষ করেই ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লো। সাড়ে এগারোটা নাগাদ নিকিতা মিনির ঘর থেকে দোতলায় এসে তার পাশে শুয়ে পড়লো। তুহানের প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। রাত জাগার অভ্যাস তার নেই। কাজকর্ম না করে চোখ বন্ধ করে জেগে থাকা তার জন্য বড্ড বেশি কষ্টের। ঘুমে দুচোখ বারবার জড়িয়ে আসছে; বাঁধা মানছেনা। কিন্তু আজ তার না জাগলে হবেনা। আজকের রাতের ওপর তার বিশ্বাস-অবিশ্বাস জড়িয়ে আছে। নিজের দুচোখের ওপর একরকম জোর খাটিয়ে কয়েক ঘন্টা পড়ে রইলো তুহান। ঘড়িতে টিকটিক শব্দটা থেমে গিয়ে দু’বার ডংডং আওয়াজ হলো অর্থাৎ দুটো বাজছে। বিছানা হালকা নড়ে উঠলো। তুহান চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারলো নিকিতা উঠে বসেছে। তুহানের বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। সে চোখ খুলছে না; নিকিতাকে কোনোভাবেই বুঝতে দেয়া যাবেনা যে, সে জেগে আছে। তুহান মন থেকে পজিটিভলি ভাবার চেষ্টা করছে। নিকিতা তো বাথরুমেও যেতে পারে। তুহানের ভাবনা মিথ্যে হলো। সে দরজার ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেলো। বাথরুম তো ঘরের ভিতরে। কিন্তু নিকিতা ঘরের বাইরে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে তুহান লাফ দিয়ে উঠে বসলো। পাশে নিকিতা নেই; থাকার কথাও না। তুহান খুব সাবধানে কোনো আওয়াজ না করে ঘর থেকে বের হলো। নিকিতা সিড়ির একদম নিচের ধাপে নামছে। তুহান ধীরু পায়ে এক এক পা করে এগোচ্ছে! নিজেকে আড়াল করার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে সে। সিড়ি অতিক্রম করে নিকিতা সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। তুহিনের মনে হচ্ছে নিকিতা টলছে। যেনো ঘুমের ঘোরে টলতে টলতে হাঁটছে। নিকিতা কাঠের সদর দরজাটা খুললো। খুলে বাইরে বেড়িয়ে বাগানের মাঝামাঝি ছোট রাস্তাটা বরাবর হাঁটা ধরলো। সদর দরজা খোলাই পড়ে রইলো। তুহানের সমস্ত শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে এলো। নিকিতা গেটের কাছে গিয়ে টুলে বসে থাকা দারোয়ানের কোমরে রাখা চাবির গোছা তুলে নিয়ে গেটে ঝুলানো বড় তালাটা খুলে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। দারোয়ান বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সে কিছু টেরও পেলোনা। তুহান কিছু ভাবতে পারছেনা এখন তার কি করা উচিত। দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তাকে টেনে তুলে কষে দুটো চড় বসিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু এখন কিছু করা যাবেনা। সে নিকিতাকে অনুসরণ করে গেটের বাইরে বেড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। নিকিতা জমিদার বাড়ির পেছনের দিকের রাস্তা ধরে হাঁটছে। কয়েক ক্রোশ পড়েই জঙ্গলের রাস্তা। নিকিতা জঙ্গলের দিকেই যাচ্ছে। তুহান থরথর করে ঠান্ডায় কাঁপছে। কালো একঝাঁক পাখি তার মাথার ওপর দিকে উড়ে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশে কনকনে শীতল হাওয়ার মাঝে বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর শব্দে শরীরের শিরা উপশিরার দিয়ে আতঙ্কঘন শিহরণ বয়ে গেলো। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। প্রথমে একটা দুটো কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে আওয়াজটা বেড়ে চলেছে। একসাথে যেনো অনেকগুলো কুকুরের আর্তচিৎকার কানে বাজছে। কুকুরগুলোর একত্রে গগনবিদারী করুণ চিৎকার অশুভ ভয়ংকর কোনোকিছুর অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে যেনো। জঙ্গলের গাছগুলো দু’পাশে হেলে পড়ছে। ডালপালার আন্দোলনে শা শা আওয়াজ বলে দিচ্ছে আজকের রাত বড় ভয়ঙ্কর রাত!
নিকিতা এক মুহুর্তের জন্য থামছেনা। যেনো কেউ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। তাকে দ্রুত পৌঁছাতে হবে তার গন্তব্যে।
.
তুহান নিকিতাকে অনুসরণ করতে করতে জঙ্গলের কাছাকাছি চলে এসেছে। জঙ্গলের ভেতরে পা দিতেই মাথার পেছনে প্রচন্ড আঘাতে যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তুহান। মাথার পেছনে উষ্ণ, আঠালো তরল কোনো পদার্থ অনুভব করলো সে। নিকিতা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে পিছন ফিরে তাকালো। তুহান নিকিতার দিকে তাকিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে বন্ধ হয়ে আসার ঠিক আগমুহূর্তে সে স্পষ্ট দেখতে পেলো নিকিতার চোখ বন্ধ অথচ ঠোঁট দুপাশে প্রশস্ত হয়ে আছে। তার ঠোঁটজুড়ে অস্বাভাবিক একটা হাসি। আচমকা চোখ খুলে তাকালো নিকিতা। তার চোখের মণিদুটোতে নীলচে আলো জ্বলছে!
তুহান আর তাকিয়ে থাকতে পারলোনা। সব ঝাপসা হয়ে চোখে আঁধার নেমে এলো………..
.
চলবে………..
.
.
#বুধবারের_আহ্বান
#পর্ব_৩
জান্নাতুল মীম (নবনীতা)