বুধবারের আহ্বান,পর্ব:৭+৮

0
887

#বুধবারের_আহ্বান
তারিখ: ২৯ জুন, ২০১৯
.
সায়রা সিড়ি বেয়ে উঠে নিজের ফ্লাটের সামনে যেতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। ফ্লাটের দরজা পুরোপুরি খোলা অবস্থায় ছিলো। সায়রা ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে অন্ধকারে টর্চ বা চার্জার লাইট কিছু খুঁজে পেলোনা। ড্রয়ারে মোমবাতি আর ম্যাচ পেয়ে মোমবাতি জ্বালালো। আগুনের শিখা ভালোভাবে জ্বলে উঠার আগেই জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিয়ে গেলো। সায়রা ব্যস্তভঙ্গিতে আবার মোমবাতি জ্বালতে গেলো, আর ঠিক সে সময় সে তার পিঠের পিছনে কারো শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, “কে?”
কোনো উত্তর পেলোনা। হাতের ছোঁয়া পিঠ বেয়ে নিচে নেমে কোমরে আসতেই সায়মা ছিটকে সরে গিয়ে পিছন ফিরলো। অন্ধকারের মধ্যে স্পষ্ট কোনো পুরুষের অবয়ব বোঝা গেলো। সায়রা চেহারা না দেখেই পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলো এটা অভ্র হতে পারেনা। সুনীল সাহেব নিশ্চয়ই দরজা খোলা পেয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। সায়রা দৌড়ে খাবার টেবিলের ওপর থেকে ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে সামনের দিকে তাক করে ধরলো, “কে আপনি?”
পুরুষালি ভারী কন্ঠে আওয়াজ এলো, “সায়রা, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবোনা। ভয় পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি আমার কথা না রাখেন, তবে আমি আপনার ক্ষতি করতে বাধ্য হবো।”
সুনীল সাহেবের কন্ঠ তো এমন নয়! তবে কে হতে পারে? সায়রা দ্রুত বোঝার চেষ্টা করলো।
“আমাকে চিনবেন না। আমি এ জগতের কেউ নই। আমার বসবাস অন্য জগতে। আমি শুধু একটা কথা বলে চলে যাবো!”
সায়রা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটাকে নিয়ে আপনি তার বাসায় দিয়ে আসলেন, এই মেয়েটাকে এরপর কখনো মাঝরাতে দেখলে আপনি তার কাছে যাবেন না। আপনার ক্ষতি হবে।”
আঁধারীর মাঝে মৃদু ছায়া-কায়ায় অবয়বটা অস্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে আরো বেশি অস্পষ্ট হয়ে আসলো ছায়াটা। একসময় মৃদু আঁধারের সাথে মিশে কর্পূরের মতো উবে গেলো। অবয়বের প্রস্থানের প্রায় সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে আসলো। সায়রা যেখানে ছিলো সেখানে ঠিক সেভাবেই ছুরি তাক করে দাঁত আছে। কিছুক্ষণ পূর্বে কি হয়েছিলো তা তার কাছে ঘোলাটে, অস্পষ্ট এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি হয়ে হৃদয়ে তোলপাড় তুলছে। সায়রা একটা কড়া মিষ্টি ধরনের গন্ধ পেতে লাগলো। আচমকা মনে হতে লাগলো, যে পুরুষের অবয়ব তার কাছে এসেছিলো তা তার খুব আপন কারো ছিলো। অভ্রর থেকেও আপন কেউ ছিলো।
.
.
রাত তিনটা বারো বাজছে। আজ রাতেও অভ্র বাসায় ফিরেনি। সায়রা তার ঘরের বিছানায় বালিশ খাঁড়া করে হেলান দিয়ে বসে কালচে খয়েরী মলাটের ডায়েরির পাতা ওল্টাচ্ছে। ডায়েরিটার মলাটের মাঝ বরাবর আড়াআড়ি দুইটা লম্বা দাগ। দাগ দুটো নীলচে রঙের। অন্ধকারের মাঝেও নীল রঙটা জ্বলজ্বল করে। এই চিহ্নটাকে ক্রুশিফিক্স চিহ্ন বলে। ডায়েরির পাতাগুলো কালো রঙের। সাদা কালিতে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু শব্দ লেখা প্রতিটা পাতাজুড়ে। কিছু শব্দ অন্য কোনো ভাষার অক্ষরে লিখা। কিছু কিছু সায়রা বুঝতে পারছে। এই ডায়েরিটা সায়রার মা তাদের দুইবোনকে দিয়ে গিয়েছিলো। সায়রার যখন কেবল তিন বছর বয়স তখন তার মা মারা যায়। সায়রা বাবার কাছে দশ বছর বয়স পর্যন্ত থাকে। দশ বছর বয়সে এক্সিডেন্টে বাবা মারা গেলে সে আর তার বোন আশ্রমেই বড় হয়!
.
ডায়েরির প্রথমে দুটো নাম লেখা। তাদের দুবোনের নাম। সায়রা ক্রুশ্চেভ ও নিকিতা ক্রুশ্চেভ।
পরবর্তী পৃষ্ঠার লেখাগুলো সায়রার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। কত হাজারবার এগুলোর অর্থ বের করার চেষ্টা করেছে সে। পারেনি। এগুলোর অর্থ একমাত্র আশ্রমের ফাদার বলতে পারতেন। কিন্তু সায়রা ছোট থাকতে এসব নিয়ে তেমন ভাবেনি আর ফাদারকে প্রশ্ন করলেও তিনি কিছু বলতেন না৷ আজকের অবয়বের ঘটনার পর থেকেই সায়রার বারবার মনে হচ্ছে এ ডায়েরির অর্থ জানলে অনেককিছু জানা যাবে। এ নিয়ে শুধুমাত্র ফাদারই তাকে বলতে পারবেন। কলেজে উঠে সে শহরে হোস্টেলে চলে এসেছিলো। তারপরে আর আশ্রমে যায়নি কখনো সে। এতবছর পর সে হঠাৎই ফাদারের সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো।
.
.
তুহান নাতাশাকে নিয়ে প্রচন্ডরকম হতাশায় ভুগছে। রাতে সে কোথায় যায়, কি করে কোনোকিছুই সকালে আর তার মনে থাকে না। তুহান কখনো আধিভৌতিকে নিশ্বাস করেনি। কিন্তু নিকিতার মৃত্যুর পূর্বের ঘটনাগুলো আর এখন নাতাশার এমন অদ্ভুত সব ঘটনায় তার ধীরে ধীরে আত্মা, ভর করা এসব বিষয়ে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে। তার মনে হয় নাতাশার ওপর খারাপ কোনোকিছু ভর করছে। তাকে দিয়েই রাতের বেলায় মানুষের ক্ষতি করছে। গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত কমিটি আজ সকালের খবরে জানিয়েছে এপর্যন্ত যতগুলো খুন হয়েছে, প্রতিটিই বুধবার মাঝরাতে করা হয়েছে। তারা আগামী বুধবার শহরজুড়ে কারো কাছেই সে এসব কথা বলতে পারছেনা। কারো সাহায্যের খুব প্রয়োজন এসময় তার। নিকিতার অভাব সে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছে।
.
.
সায়রা পরদিন সকালে অভ্র ফিরতেই তার আশ্রমে যাওয়ার কথাটা তাকে জানালো। অভ্র অফিস থেকে ছুটি পাবেনা। সায়রা একাই আশ্রমে গিয়ে ফাদারের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। আচমকাই কাল রাতের ঘটনা তাকে খুব উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অভ্রকে এ বিষয়ে কিছু বললোনা সে। অভ্রও তেমন কিছু প্রশ্ন করলোনা, কেনো হঠাৎ আশ্রমে যেতে চাইছে সে। একা একা প্রতিদিন থাকতে থাকতে হয়তো পুরনো কথা মনে পড়ছে ভেবে বাঁধাও দিলোনা!
.
সায়রা সকাল সকাল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সব অনেক বদলে গিয়েছে। সায়রার ভয় ভয় হতে লাগলো। ফাদার বেঁচে আছেন তো! পুরনো মানুষদের কেউ নেই আশ্রমে। সায়রাকে কেউই চিনতে পারলোনা। চেনার কথাও না। কতবছর পেরিয়ে গিয়েছে। ফাদারের খোঁজ করতেই জানা গেলো তিনি বৃদ্ধপ্রায়৷ আশ্রমের পিছনের দিকের একটা ঘরে থাকেন। নানান রোগ ব্যাধিতে ভুগতে ভুগতে মুমূর্ষুপ্রায় অবস্থা! সায়রা ফাদারের ঘরের দিকে এগোলো। ঘরের দরজাটা হালকা ভিজানো। দরজার কড়া নেড়ে সায়রা বললো, “ফাদার আসবো?”
ভিতর থেকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ফাদার বললো, “সায়রা, আসো!”
সায়রা থমকে দাঁড়ালো। ফাদারের কোনোভাবেই জানার কথা না সায়রা আসবে। আর আসলেও তাকে কন্ঠ চেনার কথা না। সেই কবেই সে আশ্রম ছেড়ে গিয়েছিলো। সায়রা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। কঠোর, শক্ত মানুষটা বয়সের ভারে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। চোখজোড়া কতটা শান্ত; পুরনো সেই কাঠিন্য নেই। বিছানার ওপর জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে। সামনের টেবিলের ওপর নানান রকমের ওষুধের পাতা ছড়ানো ছিটানো। ঘরের দুটো জানালাই বন্ধ। কেমন ভ্যাপসা একটা গরম ঘরজুড়ে। সায়রা ঘরের কোণার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বিছানার পাশে গিয়ে বসলো।
“ভালো আছেন ফাদার?”
মেকি হাসির ঢেউ খেলে দিলে ফাদার বললো, “আছি মা!”
“আপনি জানলেন কিভাবে দরজার ওপাশে আমিই ছিলাম!’
“আমি জানতাম তুমি নয়তো নিকিতা আসবে একদিন আমার কাছে! নিকিতা তো চলে গিয়েছে বছর খানেক হলো। এখন তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম!”
“আপা চলে গিয়েছে মানে?”
“নিকিতার সাথে যোগাযো ছিলোনা তোমার?”
“না। আপা অন্য শহরে থেকে কলেজে ভর্তি হয়; আর আমি আলাদা। অনেকভাবে যোগাযো করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু খোঁজ পাইনি আপার!”
“তোমার আপার মৃত্যুর ছয়বছর হয়ে যাচ্ছে!”
“আপনার কাছে সে পরে আর এসেছিলো?”
“না।”
“তাহলে তার মৃত্যুর খবর পেলেন কিভাবে?”
“পেয়েছি। জানি আমি। সব জানি আমি!”
সায়রা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফাদারের দিকে। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে খুলতে ধরতেই ফাদার বললেন, “অনেকদুর থেকে এসেছো। হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নাও।
” অস্থির মন নিয়ে এসেছিলাম, ফাদার। মন সায় দিচ্ছেনা সব না জানা পর্যন্ত!”
“সময় খুব কম যদিও। খুব কম! বলবো আমি। সব বলবো!”

সায়রা ব্যাগের চেইন খুলে ডায়েরিটা বের করলো। ফাদারের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, “এই ডায়রির লেখার অর্থ আপনি বলতে পারেন, ফাদার?”
“পারি!” উঠে বসতে বসতে বললেন ফাদার।
“কাল রাতে খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে। আমি কাউকে নললে হয়তো বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু আমার ধারণা আপনি বিশ্বাস করবেন এবং এর ব্যাখাও একমাত্র আপনিই আমাকে দিতে পারবেন।”
সায়রা গতকাল রাতের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললো তাঁকে। ফাদারের চেহারায় স্পষ্ট আতঙ্ক ফুঁটে উঠলো। বিড়বিড় করে শুধু বললো, “বিপদ! সামনে বড় বিপদ। তাঁরা এসে গেছে!”
সায়রা কিছু বললোনা। কিন্তু বুঝতে পারলো, ফাদারই তাকে সাহায্য করতে পারবে।

“কাল রাতে তুমি যে মেয়েটিকে রাস্তায় দেখেছিলে মেয়েটি নিকিতার মেয়ে। তোমার আপার মেয়ে!”
সায়রা এধরনের কিছু শুনবে কল্পনাতেও ভাবেনি। হতভম্ব চেহারায় ফাদারের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
“নাতাশার জন্মের কয়েকদিন পরে নিকিতা আত্নহত্যা করে; করতে বাধ্য হয়! নাতাশা কোনো স্বাভাবিক মানবশিশু নয়! তুহান তার ঔরসজাত পিতা নয়!”
“ফাদার কি বলছেন আপনি?”
.
.
চলবে…..
.
.
#বুধবারের_আহ্বান
#পর্ব_৭

জান্নাতুল মীম (নবনীতা)

#বুধবারের_আহ্বান
.
“তোমার মা ছিলেন বন্ধা। উনিশের কোঠায় পা দিতেই বিয়ে হয়েছিল খ্রিষ্টীয় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বিয়ের বারো বছর পরেও তিনি কোনো সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। ডাক্তার, বদ্যি, ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া থেকে শুরু করে আধুনিক চিকিৎসার সব করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সন্তান জন্মদানে অপারগ ছিলেন। বিয়ের কয়েকবছরের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সবাই নানান কথা বলতে শুরু করলে তোমার বাবা নিজগৃহ ত্যাগ করে তোমার মাকে নিয়ে শহরের সীমান্তে একান্তে বসবাস শুরু করেন। একদিন তোমার বাবার অনুপস্থিতিতে এক তান্ত্রিক তোমার মায়ের বন্ধাত্বের কথা শুনে তাকে নানান কালোজাদু, মন্ত্রের দ্বারা শয়তানকে আহ্বান করে সাহায্য চাওয়ার পরামর্শ দেন। তোমার মা তখন একটা সন্তানের মুখ দেখার জন্য উন্মাদপ্রায়। তিনি সেই তান্ত্রিকের পরামর্শমতো সেখানকার জমিদার বাড়ির পিছনের দিকের কোনো জঙ্গলে খ্রিষ্টীয় কবরস্থানে কালোযাদুর সাহায্যে শয়তানকে আহ্বান করে সন্তান বর হিসেবে চায়।
এর কয়েকমাস পরেই তোমার মায়ের কোলজুড়ে নিকিতা আসে। আর তার ঠিক দু’বছর পরে তুমি হও। তোমার যখন তিনবছর বয়স, তখন তোমার মা স্বপ্নযোগে জানতে পারে, শয়তান কোনোকিছুর বিনিময়ে তোমাদের দুবোনকে পৃথিবীতে এনেছে তোমার মায়ের মেয়ে করে। আর তা হলো তোমরা দুবোন পুরোপুরি সুস্থভাবে আর পাঁচজন মানুষের মতোই বেড়ে উঠবে। কিন্তু তোমরাই শয়তানের বংশধর কিংবা খারাপ আত্মাদের পৃথিবীতে আগমনের পথ তৈরি করে দিবে। নিকিতা কিংবা তুমি কোনো মানবশিশুর জন্ম দিতে পারবেনা। বিয়ের পরে কোনো না কোনোরূপে কোনো শয়তান তোমাদের তাদের সংস্পর্শে নিয়ে গিয়ে সন্তানের আশায় প্রলুব্ধ করে তুলবে। তার চেহারা হবে অতি সুদর্শন, তার কন্ঠ তোমাদের মাঝে মাদকতা ছড়িয়ে দেবে। ক্রমশ এ প্রলোভনে একসময় তোমরা স্বেচ্ছায় সঙ্গমে সম্মত হবে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে যে শিশুর জন্ম দেবে তোমরা, সে অর্ধমানব ও অর্ধরক্তখেঁকো প্রেতাত্মায় পরিণত হবে। হঠাত কোনো কোনো রাতে তাদের প্রেতাত্মারূপ প্রকট হয়ে উঠবে। আবার সেই শিশু বড় হয়ে যখন কোনো অন্য জগতের কারো সাথে স্বেচ্ছায় সঙ্গমে লিপ্ত হবে তখন যে শিশুর জন্ম হবে, তা হবে আরো বেশি ভয়ঙ্কর, আরো বেশি শক্তিশালী! তোমার মা এ ডায়েরিতে সাংকেতিক ভাষায় তোমাদের জন্য সব লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তোমার বাবার মৃত্যুর পর যখন এ ডায়েরিটা নিকিতা আমাকে দিয়েছিলো তখনই আমি এর অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখন তোমরা দুবোন এতটাই ছোট যে এসব কথা তখন তোমাদের আমি বলতে পারিনি। নিকিতার মৃত্যুর কথা আমি স্বপ্নযোগে পেয়েছিলাম। আর তুমি যে আসবে এটা ছিলো আমার বিশ্বাস।”
.
সায়রা দম বন্ধ করে এতক্ষণ ফাদারের বলা কথাগুলো শুনছিলো। তার অতীতের এতো বড় সত্যিটা এতকাল চাপা পড়ে ছিলো। তাহলে নাতাশা! নাতাশার কথা মনে পড়তেই সায়রার বুক কেঁপে উঠলো।
“ফাদার, তবে কাল রাতে আমার কাছে যে এসেছিলো সে কি তবে…”

“তুমি বললে, তুমি কাল কড়া মিষ্টি একটা গন্ধ পেয়েছিলে। তুমি নাতাশার সত্যিটা জেনে ফেললে তোমাকে বশ করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়তো। তাই শয়তান তোমাকে ভয় দেখাতে এসেছিলো। সেই অবয়ব চলে যাওয়ার পর তোমার মনে হয়েছিলো, সে তোমার খুব আপন কেউ ছিলো। আবার, তোমার বর অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকায় তোমাকে আকৃষ্ট করাটা শয়তানের পক্ষে সহজ ছিলো। সেই অবয়বের কন্ঠ তোমার মাঝে ঘোর সৃষ্টি করে দিয়ে গিয়েছে। খুব শীঘ্রই সে তোমার ওপর পুরোপুরি প্রভাব ফেলতো!”

সায়রার মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হতে শুরু করলো। কথাগুলো বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার এখন ভেঙে পড়লে চলবেনা। নাতাশাকে বাঁচাতে হবে তাকে; নিজেকে বাঁচাতে হবে! সায়রা ফাদারের কাছে এ বিপদ থেকে বাঁচার উপায় জানতে চাইলো।
“তোমার মাকে যে তান্ত্রিক শয়তানকে আহ্বানের উপায় বলে দিয়েছিলো, একমাত্র তিনিই এ প্রেতাত্মাকে বিনাশ করার উপায় বলতে পারবেন!”

“সেই তান্ত্রিককে এখন কোথায় পাবো? তিনি কি বেঁচে আছেন?”

“আছেন। তাকে সেই জঙ্গলেই খুঁজে পাবে. যে জঙ্গলে তোমার মা শয়তানকে আহ্বান করেছিলো; যেখানে নিকিতা শয়তানের সাথে দেখা করেছিলো। তোমাকেও নিয়ে যাবে শয়তান সেখানে। তার আগেই তোমাকে এর বিনাশ করতে হবে। তোমাকে….”

ফাদার আর কোনো কথা বলতে পারলেন না৷ লুটিয়ে পড়ে গেলেন বিছানার ওপর। সায়রা চিৎকার করে তাকে ধরতে গেলো। তার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিথর দেহটা বিছানার ওপর পড়ে রইলো। ফাদার তার কথা শেষ করতে পারলোনা। সায়রা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো ফাদারের দিকে। ফাদার চলে গেলেন….

পরদিন সকালে সায়রা ঢাকায় ফিরে গেলো। সেদিনেই সে তুহানের সাথে দেখা করে নিকিতা আর তার সম্পর্কের কথা জানালো৷ ফাদারের বলা কথাগুলোও তাকে জানালো। তুহানও এমন কিছু শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলোনা। সায়রার কথাগুলো শুনে সে পুরোপুরি ভেঙে পড়লো। তুহান সায়রাকে নিকিতার গর্ভধারণের পূর্বের সবটা খুলে বললো। সবশুনে সায়রা সেই জঙ্গলে তান্ত্রিকের সাথে দেখা করবে বলে ঠিক করলো। তুহানও সায়রার সাথেই যাবে বললো।

পরদিন নাতাশাকে নিয়ে তুহান আর সায়রা সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লো। বিকালের মধ্যে পৌঁছে সেই জমিদারবাড়িতেই উঠলো তারা। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই নাতাশাকে মিনির কাছে রেখে দুজন জঙ্গলের দিকে হাঁটা শুরু করলো। তুহান জঙ্গলের কাছাকাছি এসে একবার থমকে দাঁড়ালো। গতবার এখানেই তাকে কেউ মাথায় আঘাত করেছিলো, কিন্তু তার কোনো ক্ষত পরে আর ছিলোনা। সে ধীর পায়ে কয়েক পা এগিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলো। জঙ্গলের ভিতরে নানান গাছপালার কারছে দিনের বেলায়ই বেশি আলো যায়না। বিকালের দিকে প্রায় অন্ধকার নেমে আসে। তুহান সায়রা হাঁটতে হাঁটতে কবরস্থানটা দেখতে পেলো। আরো কিছুটা এগিয়ে ভাঙ্গা ছোট্ট একটা কুঠিরে চোখ পড়তেই তুহান আর সায়রা ছুটে গেলো সেই কুঠিরের দিকে। কুঠিরের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভেতরে কেউ থাকতে পারে বলে মনে হয়না। তুহানের পিছনে পিছনে মোবাইলের ফ্লাশলাইটের আলোতে সায়রা কুঠিরে ঢুকলো। পুরোনো আমলে কোনো সাধু সন্ন্যাসীর আবাসস্থল ছিলো হয়তো এটা। আচমকা ঘরের কোণার দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলো দুজনে। সায়রা চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে তুহানের ডানহাত চেপে ধরলো। ঘরটার কোণায় কালোমতো একটা অবয়ব পড়ে আছে। সায়রার চিৎকারে বস্তুটা নড়ে উঠলো।

কালো চাদরের আড়াল থেকে থুরথুরে এক বুড়োলোক কাঁপতে কাঁপতে বেড়িয়ে আসলো। ধীরে ধীরে উঠে বসে সায়রার দিকে তাকিয়ে হাতের তর্জনী তার দিকে নির্দেশ করে কাঁপতে কাঁপতে থেমে থেমে বললো, “এই মেয়েকে আমি চিনি। এ কোনো স্বাভাবিক মানুষ নয়! এ কে আ আমি জানি!”

সায়রা তুহানের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে মুখ বাড়িয়ে তাকালো। এই বুড়োমতোন লোকটাই কি সেই তান্ত্রিক?

তুহান একটু এগিয়ে গিয়ে বললো, “আমরা আপনার কাছে খুব বিপদে পড়ে এসেছি। আপনার সাহায্যের আমাদের প্রয়োজন!”

“জা আনি আমি। তোমাদের বিপদ। শয়তান এসে গিয়েছে। সে কাউকে ছাড়বেনা। কাউকে না!”

তুহান আর সায়রা নাতাশার কথা, এছাড়া ফাদারের মৃত্যুর আগে বলা কথাগুলো সব তান্ত্রিককে জানালো।

“নাতাশার বিনাশ অনিবার্য! নাতাশা এ পৃথিবীর শিশু নয়! তাকে সুস্থ মানবশিশুতে পরিণত করা অসম্ভব!”
তান্ত্রিকের কথা শুনে সায়রা অস্থির হয়ে পড়লো।
“কোনো উপায়ই কি নেই?”
“আছে একটা উপায় আছে!”

“কি সেটা?” তুহান আর সায়রা একসাথে জানতে চাইলো।

“সেন্ট জজ দিবসের আগের রাত্রি মধ্যপ্রহরে এ জঙ্গলের ওই কবরস্থানের সকল প্রেতাত্মারা জেগে উঠবে। তাদের জাগরণে কবরস্থানের একদম মাঝবরাবর এক নীল আগুনের গোলা তৈরি হবে। এই গোলার সংস্পর্ষে আত্মারা থাকলে তাদের বিনাশ অনিবার্য। তাই সে সব আত্মারা দূরে সরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু এরা মানুষের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা, যতক্ষণ না কোনো শরীরে ভর করতে পারবে। এই নীল আলো বহুদূর থেকে দেখা যায় এ রাতে৷ রাত যত গভীর হবে আলোর তীব্রতা তত কমতে থাকবে। একসময় আলো নিঃশেষ হয়ে যাবে আর প্রতাত্মারা ফিরে আসবে। নাতাশাকে এ রাতে এখানে একা আসতে হবে। সাথে তার মা কিংবা মায়ের ঔরসজাত পিতার কোনো সন্তান ছাড়া কেউ থাকতে পারবেনা। নাতাশা এই আগুনের কাছে গিয়ে আগুনে প্রবেশ করলেই তার মধ্যকার প্রেতাত্মার বিনাশ হবে। এই আত্মার বিনাশ হলে সায়রার আর কোনো ক্ষতি শয়তান করতে পারবেনা। কারণ নিকিতা আর সায়রার মেয়ের ওপর একই আত্মা তার প্রভাব ফেলবে!”
.
“সেন্ট জজ দিবস কবে?” তুহান প্রশ্ন করলো!
“আগামী বুধবার”

বুধবার পর্যন্ত তুহানরা জমিদারবাড়িতেই থেকে গেলো। বুধবার রাতের জন্য প্রবল আতঙ্ক নিয়ে কাটলো দুজনার। নাতাশাকে কেউ কিছু জানালো না। ওকে জানালেও কিছু হতোনা। কারণ ও কিছু বুঝতোনা। রাত বাড়তেই তিনজন বেড়িয়ে পড়লো। তুহান জঙ্গল পর্যন্ত নাতাশা আর সায়রাকে এগিয়ে দিয়ে সেখানেই থেকে তাদের ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলো।

সায়রা নাতাশাকে নিয়ে এগিয়ে চললো। দূর থেকে নীল আলো দেখতে পাচ্ছে সে। কবরস্থানের কাছাকাছি চলে আসতেই নাতাশা কেমন মোচড়াতে লাগলো। সায়রার হাত ছেড়ে সরে যেতে চাইলো। ক্রমশ যেনো সে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সায়রা শক্ত করে হাত টেনে ধরে এগোনোর চেষ্টা করছে। কিন্তু নাতাশার শক্তির সাথে খুব বেশি পেরে উঠছেনা। সায়রা নীল আলোটার দিকে এগোচ্ছে যত নাতাশার চাঞ্চল্যতা তত বেড়ে যাচ্ছে। সায়রা আর পারছেনা। আর কয়েকপা এগোলেই আলোটা! কিন্তু কোনো উত্তাপ পাচ্ছেনা সায়রা! নাতাশার শক্তির সাথে পারছেনা সে৷ হাতটা ছেড়ে দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নীল আগুনের দিকে নাতাশাকে ধাক্কা দিলো সায়রা। নাতাশা চিৎকার করে পড়ে গেলো আগুনের গোলার মাঝে। নাতাশার গোঙ্গানি শোনা যাচ্ছে। সায়রা চোখ বন্ধ করে বসে পড়লো। এতোকিছু হয়ে গিয়েছে গত কয়েকদিনে। মাত্র কয়টা দিন তার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। অথচ সে একবারও কাঁদেনি। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে সে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
এভাবে কতক্ষণ সে সেখানে বসেছিলো সে জানেনা।

নাতাশার গোঙ্গানি থেমে গিয়েছে। আলোটা ক্রমশ কমতে কমতে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। নাতাশা পরে আছে কবরস্থানের মাঝে। সায়রা তাকে কোলে তুলে নিয়ে জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে এলো।

অমানিশা কেটে গিয়েছে। নতুন একটা সকাল এসেছে তুহান, নাতাশা, সায়রা, অভ্রের জীবনে। একবছর পরেই সায়রা অভ্রের জীবন আলো করে একটা ছেলে হয়েছে। শয়তানের প্রভাব মুছে গিয়েছে….
তুহান মাঝেমাঝে ভাবে, “আসলেই কি গিয়েছে মুছে? নাকি অন্য কোথাও, অন্য কারো জীবনে, অন্য কোনোভাবে অমানিশার কালোছায়া নেমে এসেছে?”
….
….

..
ধানমন্ডির নতুন বিল্ডিংটার তিনতলার ডানদিকের ফ্লাটে শাম্মী আর দীপ্ত থাকে। দীপ্ত প্রায়ই রাতে বাসায় ফিরেনা। শাম্মী একা থাকে সারাদিন। তার প্রতি আটবছর আগের সেই আকর্ষণ আর নেই দীপ্তর। শাম্মীর কোনোকিছুতেই কমতি নেই। কমতি শুধুই তার মা হতে না পারাতে। আজকাল রাতে সে প্রায়ই অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখছে। একটা জঙ্গলের মাঝে ভাঙ্গা কুঠুরীতে সে দাঁড়িয়ে আছে। কুঠুরীর মাঝে নীলচে আলো জ্বলছে। একটা অতি সুদর্শন যুবক তার হাত ধরে বলছে, “তুমি যা চাও আমি দেবো তোমায়!”
.
.
সমাপ্ত……
.
.
#বুধবারের_আহ্বান
#সর্বশেষ_ও_অষ্টম_পর্ব

জান্নাতুল মীম (নবনীতা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here