বুধবারের আহ্বান,পর্ব:২

0
511

#বুধবারের_আহ্বান
.
“বাড়িটা ভালা না, আপা! খারাপ নজর আছে এই বাড়ির ওপর!”
“কিসের নজর?”
“ওঁদের নজর!”
“ওরা মানে? কারা?”
“আপা, ওঁরা! বদ আত্মা, খারাপ জীন! এই বাড়ির পেছন দিকে সোজা হাঁটতে থাকলে, কিছুদূর গিয়ে জঙ্গলের মতোন পাওয়া যায়! ওদিক কেউ যায়না। সন্ধার পর দরকার না থাকলে এ জায়গার কেউ বাড়িত থেইক্কা বাড়ায়না! এদিক থেকি মাঝে মাঝে একটা নীল আলো দেখা যায় শুধু. আমি দেখছি. ওঁরা ওই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়! জঙ্গলের একদম ভেতরের দিকে নাকি একখান কবরস্থান ছিলো মেলা আগত! আমাগো ধর্মের মানুষদের না, ওই যে খিরিষ্টানরা আছে না? ওদের কবর ওখানে! কেউ ওই কবরস্থান পর্যন্ত গিয়ে আর ফিরে আসেনা….”
“তুমি কখনো গিয়েছিলে? দেখেছো ওই জঙ্গল?”
নিকিতার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মিনি বললো, “কি কন আপা? আমি ক্যান যাবো ওইখানে? দূর থেকি ম্যালা বার দেখছিলাম জঙ্গলটা; ভয়ে পালায় আসছি! কাছে গেলেই খালি মনে হয়, আমাক ডাকতিছে কেউ জঙ্গলের ভেতর থেকি!”
“ওখানে না গেলে জানলে কিভাবে এতকিছু? ওখানে কি আছে এসব?”
“আমার বাপে কইছে! বাপজান নাকি ছোডকালে খেলা করতে যাইতো অই জঙ্গলে! ওই কবরস্থান দূর থেকে দেখছে! সেখানে নাকি ওঁনাদেরও দেখছিলো উনি। পরে দাদি নিষেধ করলে আর যায় নাই।”
“ওহ আচ্ছা!”
নিকিতা কি একটা ভাবলো। একটু থেমে হঠাৎ বলল, “মিনি, ওই জঙ্গলের ভেতরে কি কোনো ভাঙা কুঠির আছে?”
মিনি একথা শুনে চমকে নিকিতার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ হাঁ করে থাকলো। তারপর একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো, “এইডা তো আমি শুনিনি কখনো! ওই জঙ্গলে তো কেউ যায়না! ওখানে কুঠির ক্যান থাকবো? তেঁনারা কি আর বাসা বাড়ি বানায়? তেঁনারা তো বড় বড় গাছেই থাকে।”
মুখে হাত দিয়ে হেসে উঠলো মিনি।
নিকিতা আর কোনো কথা বললো না! সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো।
.
তুহানের আজ অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। অফিসের কোনো গাড়িই গ্যারেজে পাওয়া গেল না। কোনো মাইক্রোবাসও সন্ধ্যার পর শহরের বাইরে এদিকটায় আসতে চায় না। অনেক ঝামেলা করে কয়েকবার গাড়ি বদলে অবশেষে রাত নয়টায় এসে পৌঁছালো। ঢাকা শহরে রাত বারোটায়ও রাস্তায় রিক্সা-গাড়ি চলে। এ অঞ্চলে সন্ধ্যার পরপর চারদিক খাঁ খাঁ করে। জনমানবশূন্য পরিবেশ তৈরি হয়। তুহান মাইক্রো থেকে নামার পরের কিছুটা পথ পায়ে হাঁটা! হাঁটতে শুরু করতেই বুঝলো এবছর শীতটা বেশ জাঁকিয়েই বসেছে। কিংবা এখানে প্রতিবছরেই এমন শীত পড়ে! শরীরের হাড়গুলোও যেন জমে যাচ্ছে। দশ মিনিটের পথ তুহানের কাছে শত সহস্র প্রহর মনে হচ্ছে। এ কয়দিনে ঘরের ভেতরে এতটা ঠান্ডা বোঝা যায়নি। তুহান ধোঁয়াটে ঘন কুয়াশার মাঝেও দোতলা বিশাল জমিদার বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। বাড়ির পূর্বদিকে বহুদূর থেকে নীল রঙের আলো দেখা যাচ্ছে! আলোটা অনেকটা দূর, হাঁটতে শুরু করলে পথ ফুরোবেনা যেনো এতদূর! অথচ তুহানের মনে হচ্ছে কয়েক পা এগোলেই নীল আলোটা ছুঁতে পারবে সে। তুহানের মধ্যে কেমন একটা ঘোর তৈরি হতে থাকলো। যেনো চুম্বকের মতো তাকে আলোটা টানছে। মোহজালে আবদ্ধ হয়ে চার কদম এগিয়ে তার মনে হলো, এসব তার ভ্রান্তি, দৃষ্টিভ্রম, হ্যালুসিনেশন! নিজের কৌতুহলকে সংবরন করে জমিদার বাড়ির দিকে এগুলো। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে দারোয়ান বিশাল লোহার গেট খুলে দিলো। বাড়ির ভেতর ঢুকে তুহান খেয়াল করলো, দোতলাটা পুরো অন্ধকার! কোথাও বিন্দুমাত্র আলো নেই। বিদ্যুৎ বেশিরভাগ সময়েই থাকেনা এখানে যদিও! নিচতলার মাঝের ঘরটায় যখন আলো জ্বালানো রয়েছে অর্থাৎ বিদ্যুৎ আছে! নিকিতার ঘরে ঢুকেই তুহানের মনে হলো ঘরে কেউ নেই! তুহানের মনের আতঙ্ক তখনোও পুরোপুরি দূর হয়নি! ঘরের আলো জ্বালতেই দেখলো নিকিতা হাত পা হাঁটু সব পেটের কাছে গুঁজে ধরে শুয়ে থরথর করে কাঁপছে! তুহান নিকিতার গায়ে হাত দিয়েই বুঝলো প্রচন্ড জ্বর এসেছে! অফিসের ব্যাগটা রেখেই তাড়াতাড়ি থার্মোমিটার এনে জ্বর মাপলো। অস্বাভাবিক জ্বর; ১০৬°! মিনি কে নিচতলা থেকে ডেকে আনলো! মিনি বালতিতে করে পানি এনে নিকিতাকে সুবিধামত শুইয়ে মাথায় পানি ঢাললো! জলপট্টি দিয়ে দিলো। বালতির পানি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে! তিন বার বালতির পানি বদলাতে হলো; কিন্তু জ্বর কমলোনা!
তুহান বাধ্য হয়ে নিকিতাকে তুলে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে মেঝেতে শুইয়ে ঝরণা ছেড়ে দিলো! টানা একঘন্টা পর নিকিতার জ্বর একশোর কোঠায় এসে নামলো!
কাপড় বদলে তুহান বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো তাকে! নিকিতার জ্বরের ঘোর তখনোও লেগে আছে! মিনি খাবার গরম করে আনলো। কিছুই খেতে পারলোনা নিকিতা। মুখে কয়েক লোকমা নিয়ে আবার উগলে ফেলে দিলো! সব তিতা লাগছে তার! তুহান জোর করলো না বেশি! প্যারাসিটামল খাইয়ে ঘুমোতে বলে নিজেও ঘুমোতে গেলো! সকালে অফিস যেতে হবে তাকে…
.
রাত তিনটার মতো বাজছে। কারো ফিসফিসানির আওয়াজে তুহানের ঘুম ভেঙে গেলো। কেউ বিড়বিড় করে কিছু বলছে। তুহান ঘুমঘুম চোখে নিকিতার গায়ে হাত দিলো। নিকিতা থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। তুহান উঠে বসলো। এতক্ষণ যে বিড়বিড় আওয়াজটা পাচ্ছিলো, তার উৎস স্পষ্ট হয়ে গেলো। নিকিতা ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কথা বলছে! কি বলছে তা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছেনা। হয়তো কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছে! ঘুমের মধ্যেই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। তুহান বোঝার চেষ্টা করলো নিকিতা কি বলছে। চার-পাঁচ টা অদ্ভুত কিছু শব্দ অস্পষ্টভাবে বোঝা গেলো! কিন্তু এগুলোর কোনোটার অর্থই তুহান বুঝতে পারলোনা! শব্দগুলো অজানা! কয়েকটা শব্দ ছিলো “ওরডগ”, ” “পোকোল”, ” ক্রুশিফিক্স”, “স্ট্রেগোইকা”, “ভ্রোলোক”, “ভ্লকোশ্লাক” এধরণের কঠোর! এসব কি বলছে নিকিতা! স্বপ্নে কি মানুষ তার অজানা ভাষায় কথা বলতে পারে? স্বপ্ন কি বাস্তবিক জানাশোনার বাইরের কিছু মানুষকে প্রদর্শন করে? তুহান বুঝে উঠতে পারলোনা তার কি করা উচিত! কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার!
.
আচমকা নিকিতা ঘুম ভেঙে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো! তুহিন বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে গ্লাসভর্তি পানি এগিয়ে দিলো নিকিতার দিকে। নিকিতা একনিশ্বাসে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে ভীত সন্ত্রস্থ চোখে তুহিনের দিকে তাকালো!
“খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছো?”
“হু!”
“কি স্বপ্ন!”
নিকিতা তাকিয়েই রইলো। কিছু বললোনা! কিছুক্ষণ পর আবার শুয়ে পড়লো। নিজের দুহাতের মুঠোয় তুহানের ডানহাত নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো! তুহান আর কিছু প্রশ্ন করলোনা৷ নিকিতার দিকে মুখ করে নিজেও শুয়ে পড়লো।
.
নিকিতা আজ রাতেও একই স্বপ্ন দেখেছে। একটা জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট একটা ভাঙ্গা কুটির। কুটিরের ঠিক মাঝ বরাবর একটা নীল আলো। নীল আলোকে ঘিরে একটা কালো ছায়া ঘুরছে। ঘুরতেই আছে। ঘুরতে ঘুরতে আচমকা থেমে গেলো। কালো ছায়াটা যেনো একটা ছায়ামানবে পরিণত হলো। ছায়ামানবটা তাকে লক্ষ্য করে এগোচ্ছে! খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে! যত এগিয়ে আসছে আরো যেনো স্পষ্ট হয়ে উঠছে ছায়াটা! একদম কাছাকাছি চলে এলে নিকিতা এক যুবককে দেখতে পেলো! কালো ছায়াটা এক ফর্সা ধবধবে সুদর্শন যুবকে পরিণত হলো! যুবকের চোখের মণিটা নীল। ঠিক সেই নীল আলোটার মতো মণি দুটো! চোখজুড়ানো অদ্ভুত একটা মায়া! ঠোঁটটা লালচে; খয়েরি-লাল চুল! যুবকটি এগিয়ে এসে নিকিতার হাত ছুঁয়ে দিলো! নিকিতার চোখে চোখ রেখে বললো, “নিকিতা!”
তার কন্ঠে দুবার প্রতিধ্বনিত হলো শব্দটা। নিকিতার মনে হলো, থেমে গেলো কেনো! সেই কন্ঠ শুনার প্রবল তৃষ্ণা অনুভব করলো সে! সেই কন্ঠে গাম্ভীর্য নেই, আনন্দ নেই, বিষাদ নেই, সরলতাও নেই! কিন্তু অদ্ভুত কিছু রয়েছে।
নিকিতা নিজের অজান্তেই তার অপর হাত দিয়েও যুবকের হাত ধরলো! যুবক মৃদু হেসে বললো, “নিকিতা, তুমি ভালো আছো?”
নিকিতা আচ্ছন্ন হয়ে বললো, “হ্যাঁ আমি ভাল আছি!” খুব ভালো আছি!”
“না নিকিতা! তুমি ভালো নেই। তোমার অনেক কষ্ট।”
নিকিতা বিড়বিড় করে বললো, “হ্যাঁ। আমার অনেক কষ্ট!”
“কিসের কষ্ট নিকিতা?”
“কষ্ট? কিসের? আমি তো জানিনা!”
“তুমি জানো! তোমার কষ্ট তুমি মা হতে পারবেনা জন্যে! তুমি চাওনা মা হতে?”
“হ্যাঁ চাই। আমি চাই মা হতে।”
“আমি তোমাকে সাহায্য করবো নিকিতা! তুমি মা হবে। তোমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে ঠিক তোমার মতোই!”
“মেয়ে!…… আমার মেয়ে! আপনি কিভাবে সাহায্য করবেন?”
“আমি করবো তোমায় সাহায্য! কিন্তু তোমাকেও যে আমার কথা রাখতে হবে! তুমি শুধু আমায় বাঁধা দেবেনা। ঠিক আছে, নিকিতা?”
নিকিতা বাচ্চা মেয়ের মতো মাথা নারে, “আচ্ছা!”
নিকিতার শাড়ির আঁচলে যুবকটি হাত দেয়.. কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে ফেলতেই নিকিতার ঘোর কেটে যায়। নিকিতা উদ্ভ্রান্তের মতো যুবকটিকে ধাক্কা দেয়। আর ঠিক তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়। সে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে বসে! এ বাড়িতে আসার পর থেকে একই স্বপ্ন সে প্রতিরাতে দেখছে! প্রথম প্রথম স্বপ্নে শুধু নীল আলোটা দেখতে পেতো! ধীরে ধীরে সে কালো ছায়া, সুদর্শন যুবক, যুবকের প্রস্তাব,.. ইত্যাদি দেখতে থাকে! প্রতিদিন যেনো এক এক ধাপ করে এগোচ্ছে স্বপ্ন… স্বপ্নের যুবক! এর পরের ধাপে কি হতে চলেছে ভাবতে গিয়ে আতঙ্ক, ভয় সব যেনো ঘিরে ধরলো নিকিতাকে……….
.
চলবে…..
.
.
#বুধবারের_আহ্বান
#পর্ব_২

জান্নাতুল মীম (নবনীতা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here