বুধবারের আহ্বান,পর্ব:৬

0
474

বুধবারের_আহ্বান
তারিখ: ২৪ জুন, ২০১৯
.
রাত দুইটা ছাপ্পান্ন… সায়রা বসার ঘরের বড় জানালার গ্রিল ধরে একদৃষ্টে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে বিদ্যুৎ ডাকছে কিছুক্ষণ পরপর। তিনতলার ডানদিকের ফ্লাটটায় সে একা আছে। অভ্র আজরাতে বাড়িতে ফিরেনি। অফিসে কাল নাকি অনেক ক্লায়েন্ট আসবেন। আজ কি সব মিটিং আছে, ফিরতে পারবেনা। অভ্র প্রায় রাতেই অফিস থেকে ফিরেনা। নাইট ডিউটি থাকে। চাকরিটা পার্মানেন্ট হতে আরো কয়েকমাস লাগবে। বাধ্য হয়ে সারারাত ডিউটি দিতে হয়। সায়রার একা একা থাকতে ভালো লাগেনা। ভয় করে। রাতে ঘুমোতে পারেনা। বিছানায় শুয়ে হাসফাস করতে করতে উঠে এসে বসার ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশের ফ্লাটের সুনীল সাহেবের ভাবভঙ্গি তার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। এইতো আজ সন্ধ্যাবেলা যখন সে ছাদ থেকে কাপড়গুলো তুলে নিয়ে লিফটে ঢুকলো, কোথায় থেকে সুনীল সাহেব এসে লিফটে ঢুকে পড়লেন। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই সায়রা বের হয়ে গেলো। লোকটাকে দেখলেই কেমন ভয়ভয় করে তার। সিড়ি বেয়ে একগাদা কাপড় নিয়ে সাত তলা থেকে তিনলায় এসে পৌঁছাইতেই দেখলো সুনীল সাহেব তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ সায়রা তাকে না দেখার ভান করে গিয়ে নিজের দরজার তালা খুললো। আচমকা সুনীল সাহেব পিছন থেকে ডেকে বললেন, “ভাবী ভালো আছেন তো?”
সায়রা চমকে উঠে বললো, “জি ভাই। আপনি ভালো আছেন?”
“একা মানুষ আমি; কিভাবে ভালো থাকি বলুন? তা ভাবি, ভাই কি আজ রাতে ফিরবেন না? নাকি আজ রাতেওওও?”
সায়রার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছেনা। মুখের ওপর ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। সে হাসিমুখে বললো, “ভাই, ঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে৷ ও এসে খাবে। রান্না বসাতে হবে৷ আমি আসি?”
সুনীল সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার আর কি কাজ? একাই তো থাকেন। তা কখনো দরকার টরকার তো পড়ে? আমি তো কাছেই আছি। এইতো আপনার পাশের ফ্লাটেই। রাতে ভয়টয় পেলে শুধু দরজাটা খুলে চলে আসবেন।”
সায়রার গা গুলিয়ে আসে। সে এবার আর থাকতে পারেনা। মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দরজায় ছিটকিনি দেয়। কাপড়গুলো ঘরে রেখে এসে দরজার লক আরেকবার চেক করে, ঠিকমতো লাগলো কি না!
.
জানালায় শিকের ফাঁক দিয়ে বাড়ির সামনের বড় রাস্তাটা দেখা যায়। সুনসান নিরবতা চারদিকে। রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে হলদে আলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। আলোটা ভালোভাবে জ্বলছেনা। কিছুক্ষণ পর কেঁপে কেঁপে নিভছে-জ্বলছে। বাড়ির অদূরেই কোথাও থেকে কুকুরের চাপা আর্তধ্বণি ভেসে আসছে। সায়রা বিয়ের পর প্রথম এবাড়িটাতেই উঠেছে। এই দু’বছরে প্রায় প্রতিরাতেই সে কুকুরের চিৎকার শোনে। তার ভালো লাগেনা আওয়াজগুলো। কুকুরগুলো কেমন করুণ স্বরে কাঁদে। কুকুরের কান্না অশুভ। সায়রা জানে, মাঝরাতে যে বাড়ির সামনে কুকুর কাঁদে, সেই বাড়ি অশুভ; বড় ধরণের বিপদ হয় সেই বাড়ির কারো। সায়রা জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কোনো কুকুর দেখতে পায়না। সুনসান বিরান রাস্তায় কারো হাঁটার আওয়াজ পাওয়া যায়। সায়রা আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আচমকা পাঁচ-ছয় বছরের একটা মেয়েকে দেখতে পায়। রাত তিনটায় বাচ্চা একটা মেয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা লাইটপোস্টের নিচে এসে দাঁড়াতেই সায়রা চমকে উঠে। মেয়েটাকে সে চিনে। মেয়েটা তাদের বাড়ির কয়েকটা বাসা পড়েই তার বাবা, দাদু, দিদার সাথে থাকে। নাতাশা নাম। সায়রা শুনেছিলো মেয়েটা জন্মের কয়েকদিন পরেই মেয়েটার মা গলায় রশি দিয়ে আত্নহত্যা করে। কিন্তু এর কারণ কারো জানা নেই। সায়রার সাথে নাতাশার বাবার পরিচয় আছে। অভ্রদের অফিসেই কাজ করে। সায়রা নাতাশাকে একা এতরাতে বাইরে দেখে আঁতকে উঠলো। দৌঁড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে নিচে নামলো। বাসার সামনে এসে নাতাশাকে রাস্তায় পেলো না। নাতাশা যেদিকে যাচ্ছিলো সেদিক বরাবর কিছুটা ছুটে গিয়ে দেখলো নাতাশা রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সায়রা তাকে কোনোমতে কোলে তুলে নিয়ে তার বাসার দিকে গেলো। মেয়েটা শুকনো পাতলা, বিধায় কোলে তুলতে বেগ পেতে হলোনা।
.
.
মাঝরাতে হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে তুহান ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো। পাশে নাতাশাকে না দেখে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার শিরদাঁড়া দিয়ে। এরকরম ছুটে দিয়ে সদর দরজা খুলতেই দেখলো একটা মাঝবয়সী মেয়ে নাতাশাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুহান এতটাই ভয় পেয়েছে যে কি বলবে বুঝতে পারলোনা। মেয়েটার কোল থেকে নাতাশাকে নিয়ে আদর করতে লাগলো।
“ভাইয়া, এতো রাতে ও বাইরে কিভাবে গেলো? আমি তো জানালা থেকে বড় রাস্তায় ওকে একা হাঁটতে দেখে বের হয়ে ছুটে গেলাম৷ গিয়ে দেখি রাস্তার ওপর সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে!”
“আপনি অভ্রর ওয়াইফ না?”
“জি ভাইয়া!”
“অসংখ্য ধন্যবাদ ভাবী! আসলে ওর স্লিপ ওয়াকিং প্রবলেম আছে। কখন যে বেড়িয়ে গিয়েছে বুঝতে পারিনি!”
“আমিও তেমনটাই ভেবেছিলাম। সাবধানে রাখিয়েন ওকে। দরজায় ভালোভাবে খিল দিয়েন। ডাক্তার দেখিয়েছেন তো?”
“জি। স্যরি আপনাকে দরজায় দাঁড়িয়ে রেখেছি। আসুন ভিতরে আসুন!”
“না না ভাই। অনেক রাত হয়েছে। বাসার দরজাও খুলে চলে এসেছি। আমি যাই বরং!”
“আপনাকে কষ্ট করতে হলো। অনেক ধন্যবাদ। আপনি ওকে না দেখলে যে আজ কি হতো!”
.
সায়রা চলে গেলে তুহান দরজা লাগিয়ে ঘরে এসে নাতাশাকে শুইয়ে দিলো। কপালের দুপাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। নাকের ওপরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভয়ে এখনো বুক ঢিপঢিপ করছে তার। সায়রাকে সে মিথ্যে বললো। নাতাশার স্লিপ ওয়াকিং নেই। আজ বুধবার। নিকিতার মতোই নাতাশাও বুধবার রাতে বাইরে বেড়িয়ে যায়। নাতাশার যখন পাঁচ বছর পূর্ণ হলো এই সমস্যাটা তখন থেকেই শুরু হলো। তুহান প্রতি বুধবার রাত জেগে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু রাত যত গভীর হয়, সে তত বেশি ঘুমে তলিয়ে পড়ে। নাতাশা গতমাসেই ছয় বছরে পা দিয়েছে৷ যত সময় যাচ্ছে তার সমস্যাগুলো তত প্রকট আকার ধারণ করছে।
তুহান আলো জ্বালিয়েই মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লো। মেয়েটা একদম মায়ের রূপ পেয়েছে। নিকিতার বিড়ালচোখী ছিলো, নাতাশার চোখের মণি হয়েছে নীল। চিকন ফিনফিনে গড়নের বাচ্চা মেয়েটা বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তুহান নাতাশার কপালে একটা চুমো এঁকে দিলো। আনমনে বিড়বিড় করে বললো, “প্রভু, তুমি রক্ষা করো; আমার মেয়েটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করো!”
.
সকালে নাস্তা খেতে বসে আজকের পত্রিকাটা মেলে ধরতেই প্রথম পাতায় বড়বড় করে লেখা শিরোনামে চোখ পড়লো তুহানের- “শহরে রক্তখেঁকোর আক্রমণে খুন আরো তিনজনের, তদন্ত কমিটি নিশ্চুপ।”
গত চারমাসে ঢাকা শহরে মোট সতেরজন খুন হয়েছে। রহস্যজনকভাবে এদের প্রত্যেককে খুন করা হয়েছে শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়ে এবং দুটো চোখ উপড়ে নিয়ে। মৃতদেহগুলো থেকে কিভাবে রক্ত শুষে নেয়া হয়েছে তা বোঝা যায়নি। দেহগুলো রক্তশূণ্যতায় ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। তদন্ত কমিটি জোরদার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে রাজধানীজুড়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোনো সমাধান তারা করতে পারেনি। লাশের অবস্থা বিবেচনায় খুনীকে কোনো সাধারণ মানুষ বলে মনে হয়না। দেশজুড়ে প্রবল আতঙ্ক বিরাজ করছে।
তুহান আড়চোখে খাবার টেবিলের অপরপ্রান্তে বসে থাকা নাতাশার নিষ্পাপ, নির্মল চেহারাটার দিকে তাকিয়ে খুব সন্তর্পণে একটা ছোট্টো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তুহান জানে খুনগুলো কিভাবে হচ্ছে, কিন্তু তার কিছুই করার নেই। লোক জানাজানি হলে তার বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে৷ এসব থেকে মুক্তি পেতে কে সাহায্য করবে তাকে?
.
.
চলবে……….
.
.
এতটা গুরুত্ব দিয়ে অপেক্ষা করায় ভালোবাসা রইলো ♥

গল্পের রিভিউ দেবেন আশা করি Nobonîta-নবণীতা গ্রুপে…☺ আপনাদের রিভিউ আমার ভুল শোধরাতে সাহায্য করবে… আর পরবর্তী পর্ব লেখার অনুপ্রেরণাও দেবে… পাঠকের মতামতের ওপর পরবর্তী পর্ব দিবো!?

পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করবেন… ^_^
.
#বুধবারের_আহ্বান
#পর্ব_৬

জান্নাতুল মীম (নবনীতা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here