বুধবারের আহ্বান,পর্ব:১

0
994

#বুধবারের_আহ্বান
.
প্রতি বুধবার মধ্যরাতে নিকিতা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। বেশিরভাগ দিন ভোররাতের দিকেই ফিরে আসে। এসে ঠিক যেখানে যেভাবে ঘুমিয়েছিলো রাতে, সেভাবেই শুয়ে পড়ে। মাঝের এ দু’-তিনঘণ্টাকে স্কিপ করে দিলে, কারো বোঝার অবকাশ থাকবেনা, কয়েক মুহুর্ত পূর্বেও সে বিছানা ছেড়ে উঠেছিলো। তুহান ঘুমের ঘোরে গত সপ্তাহেও খেয়াল করেছে, নিকিতা পাশে নেই! সারাদিনের ব্যস্ততার অন্তিমে এগারোটা বাজতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে তুহানের। সকাল ছ’টার আগে ভূমিকম্প হোক কিংবা কেউ কানের কাছে গিয়ে অনবরত ড্রাম বাজাক, বিছানা থেকে তাকে তোলা অসম্ভবপ্রায়! তা জানা সত্ত্বেও প্রতিদিন ফজরের আজানের পর নিকিতা তাকে তোলার বৃথা চেষ্টা করে। ছয় বছরের সংসারজীবনের প্রতিদিনের এ ব্যর্থতাও নিকিতার সহ্যের সীমা ছাড়াতে পারেনি। অথচ গতকাল ভোরে তাকে নিকিতা ডাকেনি। গত সপ্তাহে যেদিন নিকিতাকে পাশে অনুভব করেনি তুহান, সেদিনেও ডাকেনি! তুহান গভীরভাবে মনে করার চেষ্টা করলো, সেদিনেও কি বুধবার ছিলো?
তাহলে প্রতি বুধবার নিকিতা কি কোথাও যায়? বাড়ির ভেতরে কোথাও নিশ্চয়ই। নিকিতা কি কারো সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে? রাতে তার সাথে ফোনে কথা বলতে যায়! হতেই তো পারে! নানান প্রশ্ন তুহানের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে!
.
তুহান আর নিকিতা গত দুমাস হলো এবাড়িটায় এসেছে। বাড়িটা তুহানের ছোটমামা, আহসান সাহেব গতবছর নামমাত্র দরে কিনেছিলেন। দেড়শ-দুশ বছর আগেও এটা জমিদারবাড়ি নামেই পরিচিত ছিলো। যিনি বাড়িটা বিক্রি করেছিলেন, তিনি জমিদার বংশীয় ছিলেন, তার পূর্ব পুরুষ পর্যন্ত এবাড়িটায় প্রাণ ছিলো। কিন্তু তার আধিপত্যের সূচনায়ই তিনি স্ত্রী-কন্যাসহ শহরের দিকে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটা মানব শুন্য, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে এ অঞ্চলে! ততদিনে তাদের জমিদারি প্রথার প্রায় সবটুকুই উঠে গেছে। তা প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পুরোনো ঘটনা। যতদুর শোনা যায়, সেসময়ে তিনি এবাড়িটা বিক্রির জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা-তদবিরও করেছিলেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বাড়িটা কেউ কিনতে চায়নি। এতো বছর পরে তুহানের মামার এঅঞ্চলে কিছু কাজ পড়ায় তিনি এখানে এসেছিলেন। সেসময় তিনি এবাড়িটা দেখেন। পুরোনো আমলের অযত্নে পড়ে থাকা এ জমিদারি বাড়িটা তার মনে ধরে। খোঁজ নিতেই একেবারে জলের দামে বাড়িটা পেয়ে যান। বাড়িটায় থাকার সৌভাগ্য তার হয়নি! বাড়িটা কেনার পরপরই দেশের বাইরে কিছু কাজ পড়ে যাওয়ায় তিনি মুম্বাই চলে যান। গত সাতমাস ধরে তিনি ইন্ডিয়াতেই আছেন!
.
তিনমাস আগে হঠাত নিকিতা ঢাকার বাইরে কোথাও ঘুরে আসার কথা তুললো! নিকিতার শরীরটাও খারাপ তখন কিছুটা! তুহানের বান্দরবান যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো! কিন্তু নিকিতা হঠাৎ মামার এ বাড়ির কথা বললো! তুহান মামাকে জানাতেই তিনিই নিজেই এখানে কয়েকমাস থাকার মতো ব্যবস্থা করে দিলেন। চট্টগ্রাম শহরের সীমান্তে ছোট্ট জায়গা। কেউ এ অঞ্চলে বেশিদিন স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতেই পারবেনা! যদিও তুহানরা আসার পর খাওয়া-দাওয়ার কোনো সমস্যা হয়নি। আহসান সাহেব একজন কেয়ারটেকার, দুজন দাড়োয়ান আর একটা মেয়েকে রেখেছেন রান্নার জন্য। দোতলার দক্ষিণ দিকের বড় ঘরটায় তুহান আর নিকিতা থাকছে। ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দা। বিশাল বারান্দা; লম্বায়-চওড়ায় প্রায় সমান! তিনবেলা কেয়ারটেকার দোতলায় খাবার পৌঁছে দেয়। খাবারের মান ভালো; যথেষ্ট ভালো! যদিও খুব স্বল্প আয়োজন। কিন্তু রাঁধুনীর রান্নার হাত প্রশংসাতুল্য।
.
তুহানের সাথে নিকিতার সম্পর্কটা নয় বছরের। একই ভার্সিটি থেকে পাশ করে বেড়িয়ে পরিবারের সম্মতিতেই দুজনে বিয়ে করে। যদিও পরিবার বলতে শুধু তুহানের বাবা-মা আছেন। নিকিতা এতিম; আশ্রমে বড় হয়েছে। ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তানের মুখ দেখেনি দুজনে। ডাক্তারের চিকিৎসা থেকে কবিরাজের পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক সব করা হয়েছে। সমস্যাটা তুহানের নিজের। তুহান বেশ কয়েকবার নিকিতাকে ডিভোর্সের কথাও বলেছে। নিকিতা কোনোভাবেই রাজি হয়নি। প্রতিরাতে থেমে থেমে বালিশচাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় তুহান! অসহায় লাগে নিজের কাছে। এতিম একটা মেয়েকে মা হওয়ার আনন্দ দিতে না পারায় নিজের কাছে নিজেকে অক্ষম মনে হয়! নিকিতার কান্নার প্রতিটা বিন্দুকে অনুভব করে তুহান। নিকিতা কষ্ট পায়, কিন্তু তুহানকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।
.
কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে নিকিতার প্রতিরাতের ঘটনায় তুহিনের যতটা না সন্দেহ হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি হতাশা হচ্ছে! হয়তো নিকিতার মায়া কাটতে শুরু করেছে। আবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলবেনা! নিকিতার কি কাউকে ভালো লাগে? লাগাটাই স্বাভাবিক। সে নিকিতার জায়গায় হলে কি করতো? পারতো, আবেগের বশে সন্তানের মায়া কাটাতে? পারতোনা! এসব ভাবতে ভাবতে তুহানের প্রচন্ড অসহায় লাগতে শুরু করলো!
.
সকাল ৮ টা বাজছে। এসময়ে তুহানের অফিস থাকে! অভ্যাসবশত এসময়েই ঘুম ভেঙে যায় প্রতিদিন। আকও তার ব্যতিক্রম হলোনা! ঘুম ভেঙেই পাশে তাকিয়ে দেখলো নিকিতা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। কত নিষ্পাপ লাগছে তার চেহারাটা। ফর্সা টকটকে গায়ের রং, শরীরের প্রতিটা শিরা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সাদা চামড়ার ওপর দিয়ে। শরীরে একটু টোকা পড়লেই যেনো গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে পড়বে। নিকিতার চেহারাটা পুতুলের মতো। লালচে ছোট্ট ঠোঁট। চুলগুলো খয়েরী, লালচে আভা চুলে। চুলে রোদ পড়লে লালচে রঙ যেন আরো ভালোলাবে বোঝা যায়! লম্বা, শুকনো ছিমছিমে শারীরিক গড়নের বিড়ালচোখী একটা মেয়ে। নিকিতা কখনো এত বেলা করে ঘুমোয়না। ফজরের নামাজ পড়ে হাতে চায়ের মগ নিয়ে ছাদে চলে যায়! ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা কিছুক্ষনের হাঁটে! এবাড়ির ছাদটা তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে! তিনদিকের বড় বড় গাছ বেঁকে গিয়ে ছাদের রেলিংয়ের ওপর ডালপালা মেলেছে! কিন্তু আজকাল কেনো যেনো দেরীতে ঘুম ভাঙ্গে নিকিতার। চোখের নিচেও কালচে স্তর পড়েছে। সারারাত কি করে সে? কোথায় যায়!
.
এতসব ভাবতে ভাবতেই নিকিতার ঘুম ভাঙলো। আচমকা হুড়োমুড়িয়ে উঠে বসে বললো, “ক’টা বাজে? আমি আজও দেরী করে ফেললাম উঠতে! তুমি ডাকোনি কেনো?”
“তোমার শরীরটা খারাপ মনে হলো। চোখগুলো ফুলে আছে। রাতে বুঝি ভালো ঘুম হয়নি?”
“নাতো! আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। সারারাতে একবারও ঘুম ভাঙেনি!” হাসিহাসি মুখে বললো নিকিতা।
তুহানের মন কিছুটা খারাপই হলো। নিকিতা কত সহজেই না তাকে মিথ্যে বলছে। তুহান আর কিছু বললোনা৷ বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো।
.
তুহান ঢাকার একটা প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি কোম্পানিতে ভালো পোস্টেই জব করে! শীতের ছুটিসহ একমাসের ছুটি নিয়ে এখানে এসেছিলো! নিকিতার আবদারে অগত্যা কোম্পানির চিটাগাং ব্রাঞ্চে বদলি নিয়েছে তিনমাসের জন্য। উপর মহলে ভালো যোগাযোগ থাকায় তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিদিন অনেকটা পথ পেরিয়ে অফিস করতে হয় তাকে! এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালোনা! অফিসে তেমন কাজ নেই তার; কিন্তু প্রতিদিন উপস্থিত থাকাটা বাধ্যতামূলক! তুহান অফিসে চলে গেলে নিকিতার সারাদিন একাই কাটে৷ মাঝেমধ্যে রাঁধুনি মেয়েটাকে ডেকে গল্পও করে। মেয়েটা সাদাসিধা ধরনের। খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকে। এ অঞ্চলেই ছোট থেকে বড় হয়েছে। নিকিতা ওকে এবাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করাতে কেমন চুপ হয়ে গেলো! চেহারায় হালকা ভয়ের ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেল।
“তুমি আমাকে নির্ভয়ে বলতে পারো! আমি কাউকে বলবোনা এ ব্যাপারে!”
“আপা, আপনের কেনো মনে হলো, বাড়িটা ভালা না?”
“আমি তো ভালোনা বলিনি, মিনি! আমি জানতে চাইলাম, এবাড়িটা কেউ কিনতে চাইতোনা কেনো? এর পেছনের কারণটা কি?”
“বাড়িটা ভালা না, আপা! খারাপ নজর আছে এই বাড়ির ওপর!”
“কার নজর?”
“আপা, তাইলে কই! আপনে কাউকে কইয়েন না, আমি আপনেরে কয়া দিসি!”
মেয়েটা কথাবার্তা গোছালো! বেশি একটা পড়ালেখার সুযোগ পায়নি হয়তো! আঞ্চলিক টান আছে কথায়। কিন্তু স্পষ্ট কথাগুলো! মিনি যা বললো তা অবিশ্বাস্য কিন্তু নিকিতার মনে যেন গেঁথে গেলো কথাগুলো! একটা অদ্ভুত কারণে মিনির প্রতিটা কথাই বিশ্বাস করলো নিকিতা!
.
.
চলবে………
.
#বুধবারের_আহ্বান
#পর্ব_১

জান্নাতুল মীম (নবনীতা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here