#বিপরীতে_তুমি_আমি
(দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ)
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
|৬|
বর্ষার মৌসুম চললেও গ্রীষ্মের প্রভাব বিলুপ্ত হয় নি। যতটুকু সময় সূর্যের দর্শন পাওয়া যায় ততটুকুতেই গরমে নাজেহাল হওয়ার মতো অবস্থা হয়। কিন্তু এসিযুক্ত গাড়িতে বসে এ গরম তো সংস্পর্শে আসার কথা না। তবুও জান্নাতের অস্থির অস্থির ভাবের কারণটা বোধগম্য হলো না মেহরাবের। বাহিরের অবস্থা ভালো না। জান্নাতকে নিজেই কলেজে ছেড়ে দিয়ে আসবে। কিরণের ব্যপারটা জানার সাথে সাথেই মেহরাব ছুটে এসেছে জান্নাতদের বাড়িতে। ঋতু-রোহানদের আসার পথেই সতর্ক করেছে। জিহাদ হসপিটালে চলে যাওয়ায় নিজেই সেই দায়িত্ব নিয়েছে। দ্বিতীয় একটা কারণ অবশ্য আছেই। রফিকউল্লাহর গ্রেপ্তা*রের দিন সকলে উপস্থিত থাকলেও জান্নাত যেতে পারে নি। দুদিনের জন্য গিয়েছিল বড় খালার বাসায়। এতদিন পর সুযোগ হয়েছে দেখার। সে সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? কিন্তু এমন দর্শণ পাবে সে আশা মেহরাবের সর্বোৎকৃষ্ট কল্পনাতেও ছিল না। বর্ষার সদ্য ফুটিত কাঠগোলাপ যে! সিকিউরিটির সাথে কথা বলে মাত্রই ঢুকবে তখনই চোখে পড়ে জান্নাতকে। এ প্রথম জান্নাতের চাহনী অন্যরকম দেখেছে। পলকহীন চাহনী। চোখে চোখ পড়ার পর থেকেই জান্নাতের এ অস্থির অবস্থা চলমান রয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে মেহরাব আড়চোখে জান্নাতের হাবভাব পর্যবেক্ষণ করছে। কখনো নখ দিয়ে নখ খুটছে তো কখনো হাত ঘষছে। মোবাইল অবিরত ঘুড়াচ্ছে নয়তো শাড়ির আঁচলের সাথে ছোট খাটো যুদ্ধ লাগাচ্ছে। ব্যপারগুলো মেহরাবের মনোযোগ টেনে হিঁচড়ে জান্নাতের দিক নিয়ে যাচ্ছে। আর যতবারই জান্নাতের দিকে মনোযোগ যাচ্ছে যেন মনোযোগ না মনটাও পুরোপুরি লুট হচ্ছে। শীতল রূপেও মেয়েটা আগুনের মতো উত্তাপ ছড়াচ্ছে কারো বুকে সে কি জানে? জানে না তো! অস্থির হওয়ার কথা তার তবে জান্নাত কেন? মেহরাব গাড়ি চালাতে চালাতেই জান্নাতকে জিজ্ঞেসা করলো,
এনি প্রবলেম জান্নাত?
হঠাৎ মেহরাবের কন্ঠে চমকে ওঠে জান্নাত। বুকের ভেতর উদ্দাম ঝড়ের মাঝে মেহরাব কন্ঠ বিপদ সংকেতের মতো শোনালো। ভেতর থেকে কেমন যেন কেঁপে ওঠলো। মনে হচ্ছে যেন ঘেমে নেয়ে গিয়েছে একদম। শাড়ির আচঁল দিয়ে ঠোঁটের ওপরিভাগ মুছে উত্তর দিতে গিয়েও তোতলে গেল,
হ হ্যা! না না কোনো সমস্যা নেই!
মেহরাব একফাঁকে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করলো,
তো মুরগির বাচ্চার মতো ছটফট করছিস কেন? এসি চলছে তবুও নাকের ঢগায় ঘাম জমছে কেন? তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
কথাটা বলতে বলতেই মেহরাবের চোখে দুশ্চিন্তা ভর করে এলো। এ কথা তো ওর মাথায় আগে এলে না। কিন্তু সেই চিন্তা মিথ্যা করে জান্নাতের উত্তর এলো,
না আমি ঠিক আছি। ওইতো শাড়ি পড়েছি তো। অভ্যাস নেই বলেই ভেতর থেকে কেমন গরম গরম লাগছে।
তো পড়েছিস কেন? কলেজে যাবি পড়াশুনা করতে, এমন সং সাজতে কে বলেছে তোকে?
জান্নাতের এতো সময়ের সকল অস্থিরতা মেহরাবের এ কথায় কর্পূরের মতো ওড়ে গেলো। তখন নিজের অজান্তেই মেহরাবকে দেখে থমকে গিয়েছিল জান্নাত। অপ্রত্যাশিতভাবে মিল গিয়েছে তাদের পোষাক। মেহরাব গায়ে আকাশী রঙ্গের শার্ট। হালকা ধূসর রঙ্গের প্যান্টের সাথে শার্টা গুজে ফিটফাট সাহেব। শার্টের হাতাটা গুঁজতে গুঁজতে যখন কথা বলছিল সে দৃশ্য হঠাৎ মোখার মতো জান্নাতের বুকে আ*ঘাত হানে। একদম আকষ্মিক আঘা*ত। মেহরাবের এমন রূপ তো তার নতুন দেখা নয়। তবে আজ কেন? সেদিনের নেশার ব্যপারটার পর থেকে জান্নাতের মাঝে একটু একটু পরিবর্তন আশা শুরু করেছে। অবচেতন মনে বার বার আবছা হয়ে দেখা দিচ্ছে মেহরাবের মতো এক কায়ার আদুরে সংস্পর্শ। প্রতিধ্বনির মতো বাজে এ মোহনীয় কন্ঠস্বর ‘ কি হয়েছে জান!’ জান্নাতের বার বার মনে হয় এ হয়তো তার ভ্রম। কিন্তু ভ্রম কি এতোটা বাস্তবিক হয়! মনের ছোট্ট এক কোণা থেকে প্রবাহিত হয় মেহরাবের প্রতি অদ্ভুত এলোমেলো অনুভূতি। সে অনুভুতির তাগিদেই তো আজও তার এই বিরূপ আচরণ। কিন্তু মেহরাবের কটুক্তিতে সে অনুভূতিতে বন্যার পানি এসে ভরে গেল। তবে কি তার ব্যপারে মেহরাবের অনুভূতি সম্পর্কে সে ধারণা করেছে তা ভুল? ভুল! জান্নাতের মস্তিষ্ক এই ভুল শব্দটা নিতেই পারলো না। তেতে ওঠলো। দৃষ্টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেহরাবের দিকে ঘুরে বললো,
সং! এতো সুন্দর সাজকে তোমার সং মনে হয়? সাজের কি বুঝ তুমি? আর কলেজে আজ অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে কলেজ ড্রেস পড়ে গেলেই সং সাজা হতো। সং মানে বোঝো?
জান্নাতের আকষ্মিক আচরণের পরিবর্তনে মেহরাব খানিকটা ভড়কে গেল। এই সামান্য কথায় জান্নাত এমন তেতে ওঠবে তার ধারণা মোটেও ছিল না। তাই গাড়িটাও হুট করে থামিয়ে জান্নাতের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। জান্নাত ব্যপারটা বুঝতে পেরে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নেয়। মেহরাবও পুনরায় গাড়ি চালানো শুরু করলো। হাত ঘড়িতে সময় দেখে হঠাৎই রাস্তা পরিবর্তন করে ইউ টার্ন নিল। জান্নাত প্রথমে খেয়াল না করলেও পরবর্তীতে খেয়াল হলো রাস্তাটা ভিন্ন। এদিক সেদিক তাকিয়ে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
এইটা তো আমার কলেজের রাস্তা না। এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
মেহরাবের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো। যেন এরই অপেক্ষাই ছিল সে। তবে সে হাসি জান্নাতের চোখে পড়ার আগেই সামনে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
ম্যপে দেখ কি জ্যাম পড়েছে! এদিক দিয়ে একটু ঘুড়ে গেলেও জ্যামটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে।
জান্নাত কথামতো ম্যপের দিকে তাকালো। খানিকটা লাল চিহ্ন দেখলো বটে কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখা হলো না সেই জ্যামের চিহ্নটা আদৌও কলেজের রাস্তায় কিনা। বোকার মতো মেহরাবের কথাতেই বিশ্বাস করে বসে রইলো। মিনিট তিনেক পর অলস বসে থেকে জান্নাত হাত বাড়িয়ে মিউজিক সিস্টেম অন করতেই এক হিন্দি গান বেজে ওঠলো। জান্নাতের বেশ পছন্দ হলো। কিন্তু মেহরাব বাঁধ সাধলো সেথায়। গাড়ি চালাতে চালাতেই বাম হাত দিয়ে গান পরিবর্তন করে দিল। মুহুর্তেই মৃদু স্বরে পরিবর্তন হয়ে এলো পরিবেশ।
তোমার জন্য নীলচে তারার একটু খানি আলো!
ভোরের রং রাতে মিশে কালো।
কাঠ গোলাপের সাদার মায়ায় মিশিয়ে দিয়ে ভাবি
আবছা নীল তোমার লাগে ভালো!
গানের স্বরে বসন্তের আমেজ পেলো জান্নাতের মন। নিষিদ্ধ চাওয়ার আশঙ্কায় মেতে ওঠতে চাইছে। মন থেকে আওয়াজ আসছে এ গান বোধ হয় মেহরাবের অব্যক্ত অনুভূতি। ঠান্ডা শীতল রক্ত বয়ে গেল জান্নাতের মস্তিষ্কে। নিঃশ্বাসও কেমন অস্বাভাবিক হলো। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। শুধু ভেবেই যদি এমন হয় তবে কি হবে যদি অন্ধকারে এ ঢিল ছুঁড়াটা সঠিক নিশানায় পড়ে? প্রাণ বুঝি ওষ্ঠাগত হবে! নিচের ঠোঁট দাঁত ধরে কামড়ে ওঠতেই হঠাৎ সামনের দিকে ঝুকে পড়লো জান্নাত। গাড়ি আকষ্মিক থামানোর ফল। আতঙ্কিত হয়ে মেহরাবের দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো মেহরাব নজর ঘুরিয়ে সামনের দিকে নিয়ে বললো,
সামনে কুকুর এসে পড়েছিল।
অথচ জান্নাতের চোখে কোনো কুকুর বিড়াল কিছুই পড়লো না। আড়চোখে মেহরাবকে দেখে অন্যরকম লাগলো। হঠাৎ মুখোভাব পরিবর্তন হলো কেন? জান্নাত কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভাবতে ভাবতেই ফোনটা হাতে নিল। ফোনের চার্জ নেই! সর্বনাশ! সকালে তৈরী হওয়ার চক্করে ফোনের চার্জের কথা মনেই নেই। দ্রুত সোজা হয়ে বসে গাড়ির সামনের বক্সে হাত হাতড়ে চার্জার খুঁজতে লাগলো। হঠাৎই একটা ছোট প্যকেট চোখে পড়লো। মেহরাবের দিক তাকালো। ব্লুটুথে কার সাথে যেন কথা বলতে ব্যস্ত। হয়তো অফিস থেকে ফোন। প্যকেটটা বের করে হাতে নিয়ে বসলো। স্বচ্ছ প্যকেটটার ভেতরে ছোট একজোড়া ঝুমকা স্পষ্ট দেখতে পেল জান্নাত। ভারি সুন্দর! সাধারণ খুবই। জান্নাতের কপালে দুটো ভাজ পড়ে গেল। অজানা আশঙ্কায় ভাটা পড়লো মনে। মেহরাবের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। শেষ হতে হতেই মৃদুস্বর বেড়িয়ে এলো জান্নাতের কন্ঠ হতে,
তোমার প্রমিকা আছে মেহরাব ভাই?
মাথায় বাজ পড়ার মতো চমকে ওঠলো মেহরাব। হুটহাট জান্নাতের উদ্ভট প্রশ্নে জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় মেহরাব। গাড়ি চলমান রেখেই জান্নাতের দিকে তাকায়। জান্নাতের প্রশ্নবিদ্ধ দু চোখে অসীম আশঙ্কা দেখতে পেলো। প্রশ্নের কারণ জানতে চাওয়ার আগেই নজরে এলো জান্নাতের হাতে থাকা ঝুমকা। প্রশ্নের আগেই উত্তর পেয়ে গেল। ধাতস্থ হলো থমকে যাওয়া প্রাণ। স্বাভাবিক হয়ে গাড়ির চালানোতে মনোযোগ দিলো। অথচ জান্নাত তখনও সেভাবেই তাকিয়ে। কিছুক্ষণ পরেই মেহরাব উত্তর দিলো,
হ্যা! আমার প্রেমিকা নয়, সে আমার ব্যক্তিগত কাঠগোলাপ।
—–
সময়ের প্রতিযোগি হয়ে অনুমানকৃত সময়ের পূর্বেই অর্ণব গন্তব্যে পৌঁছালো। কিরণের লোকেশন দেখে কোথাও বিলম্ব না করে হাওয়ার গতিতে রিসেপশনে আইডি কার্ড দেখিয়ে বাগান পেড়িয়ে ছুটে আসে রেস্টুরেন্টের দরজায়। কাচের দরজার বাহিরে আসতেই আঁটকে যায় পায়ের কদম। অপেক্ষমান রমণীকে দেখে মিস হয়ে যায় যেন হার্ডবিটও। অর্ণবের মনে হলো আজ সে যে করেই হোক, যে কোনো উপায়েই হোক হার্ড অ্যটাক তো করবেই। কিরণ যেনো কোমর বেঁধে নেমেছে। ধীরে ধীরে হাতটা দরজায় দেয়ার আগেই ফোন কেঁপে ওঠে বাম পাশে পায়ের কাছে। অর্ণবের ধ্যান ফিরে। ফোনের স্ক্রিনে নাম দেখে মস্তিষ্কের নিউরনসমূহ জেগে ওঠে। সেখানে দাঁড়ি থেকেই ফোন রিসিভ করে। কথার রেশ ধরে দৃষ্টি যায় কিরণের থেকে ষাট ডিগ্রি কোণায় বসে থাকা সাদা রং ক্যাপ পরিহিত এক যুবকের দিকে। অর্ণব ফোন রেখে পুনরায় ফোন দেয় অন্যত্র। মিনিট পাঁচেক আলোচনা করে ফোন পূর্বের স্থানে রেখে দেয়। ঠায় দাঁড়িয়ে রয় দরজার বাহিরেই। প্রেয়সীর অপেক্ষারত দৃশ্য দেখা তো মন্দ নয়। দু পকেটে হাত রেখে একদম কোণায় বসে থাকা লাল শাড়ি পরিহিত কিরণকে অপলক দেখে যাচ্ছে। দৃষ্টি যেন টেনে হিঁচড়েও সরানো দায় হয়েছে। প্রায় দশ মিনিট অতিবাহিত হতেই অর্ণবের ফোন মৃদু কেঁপে ওঠলো। অর্ণব পকেটে ঢুকানো হাত দিয়েই ফোনটা বের করে সামনে আনতেই দেখলো সেখানে গোটা গোটা করে লেখা,
এভ্রিথিং ইজ রেডি.
চলবে ~~~~