বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৩

1
2370

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৩
জাওয়াদ জামী

এভাবে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় অতিবাহিত হয় আরও কিছুদিন। যে যার মত করে চলছে। নিয়মের কোনও পরিবর্তন হয়নি। ভাটা পরেনি ভালোবাসায়।

এইচএসসি’ র রেজাল্ট দিয়েছে। কুহু, সিক্তা দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। কুহু ও সিক্তা বোর্ডের মেধাতালিকায় যৌথভাবে চতুর্থ হয়েছে।
দুই মেয়ের এরূপ অজর্নে সবাই খুশি। নাজমা পারভিন ছুটে এসেছিলেন চিটাগং থেকে। দু’জনকে অনেক কিছু গিফ্ট করেছেন। কায়েসও এসেছিল। মেয়ে আর ভাগ্নীর জন্য দুহাত ভরে জিনিসপত্র এনেছে। বাদ যায়নি শাহনাজ সুলতানা ও তাহমিনা আক্তারও। তারা সবাই ওদের দু’জনকে নিজেদের পছন্দমত শপিং করিয়েছেন।
সবাই ওদেরকে নানানরকম গিফ্ট করলেও, তাহমিদ শুধু সিক্তাকে গিফ্ট করেছে। কুহুকে কিছুই দেয়নি। সিক্তা এই নিয়ে তাহমিদকে খুব খোঁ’চা’চ্ছে, কুহুকে কেন কিছু দিলনা? কিন্তু তাহমিদ মুখে কুলু পেতে রেখেছে।
এতে অবশ্য কুহুর কোন আফসোস নেই। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ নিশ্চয়ই কিছু প্ল্যান করে রেখেছে।

রেজাল্টের পর কুহু এবং সিক্তা পড়াশোনায় আরও মনযোগী হয়। তাহমিদ মাঝেমধ্যে দুজনকেই পড়াচ্ছে। এটা সেটা দেখিয়ে দিচ্ছে। কুহুদের সাথে তাহমিদও যেন কোমড় বেঁধে লেগেছে, যেভাবেই হোক ওদের ভালো কোথাও চান্স পেতেই হবে।

ওরা কয়েক জায়গায় অ্যাডমিশন দেয়৷ তাহমিদ নিজে ওদের নিয়ে গিয়েছে অ্যাডমিশন দিতে।
সবখানেই ওরা বেশ ভালো পরীক্ষা দিয়েছে।
রেজাল্টের পর দেখা গেল কুহু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।
সিক্তাও তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তবে ওর ইচ্ছে ছিল মেডিকেলে পড়ার। কিন্তু মেডিকেলে চান্স পায়না বেচারি। এতে ওর মন ভিষণ খারাপ হয়ে যায়।
সবার সাথে আলোচনা করে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।
কুহু পদার্থ বিজ্ঞানে এবং সিক্তা রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়।

কুহু ফুপুদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় ও এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোন ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানে থাকবে। বিয়ের আগে এভাবে শ্বশুর বাড়িতে থাকা খুব ভালো দেখায়না।
আফরোজা নাজনীন তার পরিবারে এই কথা জানালে, সবাই তার বিরুদ্ধে যায়। তারা কেউই কুহুকে অন্য কোথাও থাকতে দিতে রাজি নয়।
তাহমিদ একদম বেঁকে বসেছে। ও কিছুতেই চায়না কুহু এই বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকুক।
কিন্তু কুহুর জেদের কাছে সবাইকে হার মানতে হয়।
শাহনাজ সুলতানা ও আনান মিলে কুহুর জন্য একটা ফ্ল্যাট পছন্দ করেন। যেটা তার ছোট ননদের। এটা কুহুর জন্য বেশ নিরাপদ হবে। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলা ছাড়া সবগুলো ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া। দ্বিতীয় তলায় শাহনাজ সুলতানার ননদের পরিবার থাকে।
দ্বিতীয় তলার একপাশে দুইটা বেডরুম, একটা কমন বাথরুম, এবং বেডরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দা।
শাহনাজ সুলতানার ননদ এই অংশটা রেখেছিলেন তার শ্বশুর বাড়ি থেকে চিকিৎসার জন্য আসা আত্মীয়দের জন্য। গ্রাম থেকে অনেকেই চিকিৎসার জন্য ঢাকা আসলে এখানেই থাকত। পরে ধীরে ধীরে তারা দোতলা বিল্ডিং পাঁচতলা করেন। এবং নিচে দুইটা রুম, বাথরুম আত্মীয়দের জন্য বরাদ্দ করেন। তাই দোতলার এই অংশটা ফাঁকা হয়ে যায়। তার ছেলে-মেয়েরা দেশের বাইরে থাকায় এতবড় ফ্ল্যাট তাদের দরকার হয়না।
শাহনাজ সুলতানা ননদকে রাজি করান কুহুর থাকার জন্য রুম দুইটা দিতে।
পরে শাহনাজ সুলতানার ননদ দুইটা রুমের মধ্যে ছোট রুমকে রান্নাঘর ও ডাইনিংয়ের জন্য ব্যবস্থা করে দেন।

ক্লাস শুরু হওয়ার দশদিন পর কুহু ফ্ল্যাটে চলে আসে। ওর চলে আসাতে সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। কুহু আসার সময় তাহমিদকে দেখতে পায়নি। কুহু যেদিন থেকে জানিয়েছে ও আর ‘কুঞ্জছায়া’ য় থাকবেনা। তারপর থেকে তাহমিদ কুহুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কুহু বুঝতে পারে তাহমিদ ওর ওপর রাগ করেছে। কিন্তু ও নিরুপায়। এভাবে বিয়ের আগে এই বাড়িতে থাকতে ওর খারাপ লাগে।
তাহমিদ কুহুর সাথে কথা বলছেনা, এটাতে কুহু বেশ কষ্ট পাচ্ছে। কয়েকবার তাহমিদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। উপায় না দেখে কুহু তাহমিদকে অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু তাহমিদ একবারও রিসিভ করেনি। উল্টো ওর নম্বর ব্লক করেছে।
বিষন্ন মনে কুহু ‘ কুঞ্জছায়া ‘ র সীমানা ত্যাগ করে।
যাওয়ার আগে একটিবার তাহমিদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন ছিল। তার ভুল ভাঙ্গানোর প্রয়োজন ছিল।

আজ সকালে মেজো ফুপু ফোন করে জানিয়েছেন আগামী সোমবার সকালেই তিনি ঢাকা আসছেন। দুই বোনের সাথে দেখা করে সেদিন দুপুরেই তিনি ফুলতলার পথে রওনা দিবেন। তিনি সাথে করে কুহুকে নিতে চান। আফরোজা নাজনীন ছোট বোনের গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে, নিজেও সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি সানাউল রাশেদিনকে জানালেন। সেই সাথে তাহমিদকে বললেন, কুহুকে নিয়ে তারা ফুলতলা যাবেন। কুহু এ বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর তাহমিদ ওর বিষয়ে কোন কথা বলেনা। তাই বড়মার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া জানায়না।

সোমবার সকালে নাজমা পারভিন কুহুকে নিয়ে প্রথমে বড় বোনের বাসায় আসলেন।
কুহু এখানে এসেই তাহমিদের খোঁজ করে, কিন্তু তার দেখা পায়না। সে নাকি খুব সকালেই কোথাও বেরিয়েছে। কষ্টে কুহু কেঁদে ফেলে। সবার সাথে দেখা করে ঘন্টা দুয়েক পর তারা বেরিয়ে পরেন শাহনাজ সুলতানার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে তিন বোন মিলে কিছুক্ষণ কাটান। শাহনাজ সুলতানার বাবার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আরোশির জন্য যেতে পারছেননা। ওর সামনে পরীক্ষা আছে। তাই মেয়েকে রেখে তিনি যেতে চাইছেননা।
শাহনাজ সুলতানার বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে তারা রওনা দেন ফুলতলার দিকে। রাস্তায় জ্যাম থাকায় তাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। ফুলতলা পৌঁছাতে রাত আটটার বেশি বেজে যায়।

দুই বোনকে হঠাৎ বাড়িতে দেখে কায়েস অবাক হয়ে গেছে। ওরা সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। এরপর কায়েস বাজারে যেতে চায় বোনদের জন্য খাবার আনতে। তারা রাতের খাবার খাওয়ার পরপরই কুহুরা এসেছে। তবে শিউলি রান্না করার জন্য রান্নাঘরে যেতে লাগলে আফরোজা নাজনীন তাকে নিষেধ করেন। কারন তারা হোটেল থেকে খাবার কিনে এনেছেন। তাদের আসতে রাত হবে বুঝতে পেরেই, খাবার নিয়েছেন।

রাতে ফুপুদের কাছে শুয়েছে কুহু। ফুপুরা সেই কখন ঘুমিয়েছে কিন্তু ওর চোখে ঘুম নেই। অনেকদিন যাবৎ তাহমিদের সাথে ওর দেখা নেই। আজ আসার সময়ও তার দেখা পায়নি।
যে মানুষটা ওকে একদিন না দেখলে অস্থির হয়ে যায়, একদিন কথা না বললে ছটফট করে, সেই মানুষটাই আজ দেড়মাস যাবৎ আড়ালে থাকছে। এটা কিছুতেই মানতে পারছেনা কুহু। এত রাগ করেছে সে! কুহু তাহমিদের কথা মনে করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। এখন যে তাকে ফোন করবে সেই উপায়ও নেই।

তাহমিদ ওর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গতরাতে যখন শুনেছিল আজ কুহু আসবে, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার। ও কুহুর সামনে কিছুতেই পরতে চায়না। মেয়েটাকে অনেক বুঝিয়েছে এই বাসায় থেকে ক্লাস করতে। একা একা কুহু অন্য জায়গায় থাকবে, এটা চায়নি তাহমিদ। বাইরের জগৎ খুব খারাপ। তারউপর কুহু খুব একটা চালাকও নয়। ওর বাইরে একা টিকে থাকতে খুব কষ্ট হবে। এই বাসায় ও থাকলে তাহমিদ নিশ্চিন্তে থাকত। কিন্তু জেদি মেয়েটা সেই কথা মানলে তো।
এতদিন কুহুকে না দেখে তাহমিদের ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। একবার মন চাচ্ছে কুহু ঢাকায় আসলেই, ওর কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন কুহুর ত্যাড়ামোর কথা মনে হয় তখন সব ভালোবাসা উবে যায়। একরাশ রা’গ এসে জমা হয় বুকের মাজারে। এখানে রা’গ জিতে যায়, হারিয়ে দেয় ভালোবাসাকে।

ফুপুদের আসার কথা শুনে পরদিন দুপুরে দৃষ্টি স্বামীসহ বাপের বাড়ি আসে।
দৃষ্টিকে দেখে তারা দুই বোন একে অপরের দিকে তাকায়। ফর্সা টুকটুকে মেয়েটার এ কি হাল হয়েছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। চেহারার সেই লাবন্য কোথায় হারিয়েছে! এতদিন দৃষ্টির ওপর যে রাগ ছিল ওকে দেখামাত্রই তা মিলিয়ে যায়। দৃষ্টি দৌড়ে এসে বড় ফুপুকে জড়িয়ে ধরে। আফরোজা নাজনীন অবাক হয়ে যান দৃষ্টির এমন কাজে। যে মেয়ে তারা আসলে তেমন একটা ভিড়তনা আজ সেই মেয়ে তাকে এভাবে জাপ্টে ধরেছে! ভাতিজীর মুখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়েই তিনি বুঝে নেন, তার ভাতিজী ভালো নেই।

শিউলি ননদদের সাথে সবুজকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারাও সবুজের সাথে যতটুকু কথা বলা প্রয়োজন ততটুকুই বলেন। সবুজকে দেখেই তাদের অপছন্দ হয়।

দুপুরে খাবার সময় নাজমা পারভিন দৃষ্টির সাথে এটাসেটা নিয়ে কথা বলছেন।

” দৃষ্টি বিয়ের পর তোর শ্বশুর তোকে গহনাগাঁটি কিছু দিয়েছে? তোর ভরনপোষণ কে করছে? ” নাজমা পারভিন চেয়ারম্যান সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। তাই তিনি ইচ্ছে করেই সবুজের সামনে এই প্রসঙ্গ তুলেছেন।
ফুপুর কথা শুনে দৃষ্টি মাথা নিচু করে থাকে। সে কি করে বলবে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত ও শ্বশুর বাড়ি থেকে একটা সুতাও পায়নি।
দৃষ্টির মৌনতা দেখে তারা সব বুঝে যান।

” এই যে ছেলে, লেখাপড়া কিছু জানো? চাকরি করতে চাইলে আমাকে বল। আমার ভাসুরের কোম্পানি আছে। তুমি চাইলে সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। বিয়ে করেছ অনেকদিন হয়েছে, এবার কিছু কর। আর কতদিন আমার ভাই মেয়ে-জামাইকে টানবে? এদিকে তোমার বাপও বোধহয় কিছুই দেয়নি। এবার নিজের রাস্তা নিজে দেখ। এতদিন শুনেছি চেয়ারম্যান মানুষের জিনিস খেয়েই বিল্ডিং উঠায়, এবার নিজের সামনে সব দেখছি। সে কি পারেনা তার একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে ব্যবসায় নামাতে! সে তা করলনা৷, টাকা দিল আমার ভাই। আবার তার ভরনপোষণও করছে! ” দৃষ্টিকে চুপ থাকতে দেখে নাজমা পারভিন সবুজের সাথে কথা বলতে চান।

এদিকে সবুজ নাজমা পারভিনের কথা শুনে খাওয়া ভুলে গেছে। এভাবে কেউ ওকে অপমান করতে পারে, তা ও ভাবতেই পারেনি। তবে সবুজ এটা বুঝে নেয় এই মহিলার সাথে উচ্চবাচ্য করা যাবেনা। ভদ্রমহিলা ঠোঁ’ট’কা’টা স্বভাবের। তাই ও ভেতরে ভেতরে রা’গ’লেও বাহিরে থেকে হাসিমুখে নাজমার কথা হজম করে৷

চলবে…

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here