বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ পর্ব_৩

0
640

#বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
#পর্ব_৩

আমাদের পরিবারের সবাই একে অন্যের সাথে খুব এটাচড অন্যরকম শুধু বুবু, এমন না বুবু স্বেচ্ছাচারী কিন্তু বুবু সবসময় নিজের মত থাকতে পছন্দ করত ন্যায় কে ন্যায় অন্যায় কে অন্যায় বলতে বুবু কখনো পিছুপা হতো না তবে বুবু বরাবর খুব কেয়ারিং শুধু কাউকে বুঝতে দিতে চায় না সে চায় না কেউ বুঝে যাক যে তার মধ্যে সমুদ্র সমান ভালোবাসা রয়েছে, তবে একজন বুঝতো খুব করে বুঝতো বুবুর ওই নাকের ডগায় রাগের মাঝে ভালোবাসাটা প্রান্ত ভাই খুব করে বুঝতো, আমাদের বাড়ির পূর্ব পাশের বাড়িটা প্রান্ত ভাইদের, বুবুর ইন্টারের যখন মাস আটেক বাকি, টাইফয়েড থেকে উঠে পড়ালেখা নিয়ে দিশেহারা অবস্থা, বুবু বরাবরই লেখাপড়ায় বেশ ভালো যদিও প্রিপারেশন ভালো কিন্তু কিছুতেই সে শান্ত হতে পারছিলো না, মা তাই তখন পাশের বাড়ির মেডিকেলের শেষ বর্ষে পড়ুয়া ভীষণ মেধাবী প্রান্ত ভাইকে অনুরোধ করলেন বুবুকে একটু পড়া দেখিয়ে দিতে, বুবু সবসময় ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকতো সবচেয়ে বড় কথা ছোট থেকে বুবু আব্বাকে সবচেয়ে অপছন্দ করত অথচ আমি দেখেছি আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে আব্বা সবচেয়ে অস্থির ছিল বুবুর জন্য সারাদিনে বুবুর সাথে একটা কথা বলার জন্য আব্বা উৎকন্ঠা থাকতো,সারাদিন তার ইচ্ছে কখন একটু পুষ্প আসবে একবার আব্বা বলে ডাকবে, আমি আমার এত বছর বয়সে কখনো বুবুকে শুনিনি আব্বাকে আব্বা বলে ডাকতে।অথচ বৃতি কিন্তু বাবা বলতে অজ্ঞান! যাই হোক বুবু প্রান্ত ভাইয়ের সাথে পড়ালেখার বাইরে কোনো আলাপ করত না।কিন্তু প্রান্তভাই ছিলো সম্পূর্ণ অন্যরকম সে ছিল ঝড়ের মতো সব্বাইকে মাতিয়ে রাখা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না, তাছাড়া প্রান্ত ভাইয়ের কিছু মানবিক গুণ ছিলো সে এলাকায় ছিলো সবার কাছে প্রিয় যে কারোর যে কোনী বিপদে সে সবার আগে এগিয়ে যেতো, তার কিছু সংস্থা ছিলো কিশোরদের নিয়ে সে সমাজের সকল অসহায়দের সহায়তা করতো, লেখাপড়ার মতো তার মধ্যে সেবার মনোভাব ছিলো প্রবল, তার ব্যাক্তিত্ব ছিলো অসাধারণ। ধীরে ধীরে বুবুর প্রান্ত ভাই এর প্রতি একটা আসক্তি হয়ে গেলো প্রান্ত ভাইয়ের উপস্থিতিতে বুবুও চঞ্চল হয়ে পড়তো, ভালোবাসলে আমার বুবু পাগল হয়ে যায় আমার শান্ত সভ্য বুবু প্রান্ত ভাইয়ের জন্য সব রকম পাগলামি করতে থাকলো রাত নেই দুপুর নেই ছাদে গিয়ে বসে থাকতো একবার প্রান্ত ভাইকে দেখার জন্যে কিন্তু প্রান্ত ভাইয়ের তখন পড়ার খুব চাপ বুবুকে কোনো সময়ই দিতে পারত না, ক্যারিয়ার নিয়ে সে চরম ব্যস্ত আর বুবু? তার পড়ালেখা সব গোল্লায় তার চিন্তা চেতনা জুড়ে সবটাই কেবল প্রান্ত ভাই….।
প্রান্ত ভাইয়ের মনে যে কি ছিলো তা আজও আমার কাছে পরিষ্কার না, ছেলেমানুষি করতে গিয়ে বুবু চরম অসুস্থ হয়ে পড়লো তখন দেখতাম প্রান্ত ভাই এলোমেলো হয়ে যেতো তার অস্থিরতা বেড়ে যেতে রাত দিন এক করে সে বুবুর পাশে বসে থাকতো, আমাদের বাড়ির লোকেদেরও প্রান্ত ভাই মনে ধরেছিলো কিন্তু বুবুর বয়প্স কম হওয়ায় সেভাবে কেউ বিয়ের কথা তুলতো না আর প্রান্ত ভাইও কেবল ডাক্তারি পড়া শেষ করেছে, কিন্তু তাও কিভাবে কি হলো বুবুর সাথে প্রান্ত ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো দুই পরিবারের সম্মতিতেই প্রান্ত ভাইয়ের মায়ের আমার বুবুর প্রতি আলাদা একটা মমতা কাজ করতো আমার বুবুর দিনগুলো স্বপ্নের মতো সুন্দর কাটতে লাগতো সারাদিন বুবুর মুখে অদ্ভুত হাসি লেগেই থাকতো, ধীরে ধীরে আমার বুবুর সেই কাঙ্খিত দিন চলে এলো সকল স্বপ্ন সত্যি হবার দিন বুবুর পরীক্ষার মাত্র দিন পনেরো বাকি কথা হলো শুধু পরিবারের মানুষের উপস্থিতিতে কাবিন হবে পরীক্ষা শেষ হলে অনুষ্ঠান। আমার বুবুকে পুতুলের মতো করে লাল টুকুটুকে বউ সাজানো হলো ওইদিন দেখলাম বুবু আব্বার কাছে গিয়ে বাবাকে কদমবুসি করলো আব্বা খুশিতে কেদে ফেললেন,কাবিন হবার কথা ছিলো বাদ জোহর আমাদের বাড়ি কাজী ডাকা হলো, বুবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো কিন্তু প্রান্ত ভাই এলেন না, দুপুর গড়িয়ে বিকেল বিকেলের পর সন্ধ্যা হলো প্রান্ত ভাইয়ের বাবা মাও আমাদের বাড়িতে কিন্তু প্রান্ত ভাইকে পাওয়া গেলো না রাত দশটায় একটা চিঠি এলো প্রান্ত ভাইয়ের লেখা, তিনি বিয়ে টা করতে চান না, তিনি নাকি কনফিউজড! তার স্কলারশিপ এসেছে তিনি আগেই বিয়ে করতে চান না তিনি বিদেশ গিয়ে বড় ডিগ্রী অর্জন করতে চান।বুবু সেদিন একটুও কাদলো না, তবে আমি খুব কাদলাম দাদাই আর আমি সারা রাত বুবুর পাশে বসে রইলাম বুবু আস্তে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো আমিও সারারাত পেছন থেকে বুবুকে জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদলাম আর দাদাভাই সারারাত জেগে বুবুর পায়ের কাছে বসে রইলো। প্রান্ত ভাইয়ের বাবা মা খুব লজ্জিত হলেন তারা বারবার ক্ষমা চাইলেন।বুবু কিছুই বলল না।
বুবু পরদিন সকাল থেকে খুব স্বাভাবিক আচারণ করতে লাগলো,পরের পনের দিন পাগলের মত লেখা পড়া করল।
প্রান্ত ভাই এর পরও মাস চারেক বাড়িতে ছিলেন,বুবুর সাথে দেখা হতো,তিনি অনেকবার বুবুর সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু বুবু এমন ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে প্রান্ত ভাই আর কিছুই বলতে পারি নি, লজ্জায় সে বাড়িতেও আসতে পারতো না। প্রান্ত ভাই বাইরে চলে গেলেন।বুবুর রেজাল্ট তার মনের মতো হলো না, অনেকটা সময় অপচয় করে ফেলেছিলো তবুও বুবু জেদ করে মেডিকেলের জন্য কোচিং করতে লাগলো আমরা বাড়ির লোক তার পড়ার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম,সে হলো না। বুবু যেদিন ডাক্তারি পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো সেদিন বুবু প্রান্ত ভাইয়ের বাড়ি থেকে তার নম্বর নিয়ে তাকে ফোন করলেন। সেইদিন বুবুর কথা শুনে আমি বুঝলাম বুবু নিজেকে কতটা গুছিয়্র নিয়েছে,বুবু প্রান্ত ভাইকে ফোন দিয়ে সালাম জানিয়ে বলল,
—প্রান্ত ভাই, আমি পুষ্প আমি জানি মনে করিয়ে দিতে হবে না কোন পুষ্প আমার কন্ঠ আপনার কাছে অপরিচিত নয়।আপনার সাথে অনেকদিন যোগাযোগ হয় না প্রান্ত ভাই তাই ফোন করলাম এতদিন আপনার সাথে কথা বলার মতো আমার কোনো যোগ্যতা ছিলো না,আজও আমি আপনার যোগ্যতার কাছে নিতান্ত তুচ্ছ একজন মেয়ে, প্রান্ত ভাই মনে আছে আপনি এক সময় আমার শিক্ষক ছিলেন আমি আপনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ। আপনার ছাত্রী নিজের ক্যারিয়ারের দিকে প্রথম সিড়িতে আজ পা রাখলো আপনি আমার জন্যে দোয়া করবেন প্রান্ত ভাই আমি যেন লেখাপড়ায় আপনার মতো সফলতা অর্জন করতে পারি আমি যেন আপনার মতো খুব ভালো মানুষ হতে পারি আমি যেন সেবায় নিয়োজিত হতে পারি, আপনার দোয়া আমার খুব প্রয়োজন প্রান্ত ভাই খুব বেশি।

ওই দিনের পর অনেকদিন প্রান্ত ভাই বুবুর সাথে আবার যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো কিন্তু তারপর বুবু প্রান্ত ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে চিরকালের জন্যে।আজ তিন বছর প্রান্ত ভাইয়ের সাথে বুবুর কোনো যোগাযোগ নেই।

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here