বাবার ভালোবাসা পর্ব-১

0
2186

মৌ দু’বার কবুল বলেছে! তৃতীয়বার কবুল বলা সময় ‘ রাইসা ‘ সকলের পাশ কাটিয়ে, সবার সামনে মৌকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে ‘আম্মু তুমি বাবাইকে রেখে এ বিয়ে করো না। বাবাই তোমাকে অনেক ভালোবাসে ! জানো মম বাবাই তোমাকে ছাড়া বাঁচবে না। তোমার ছবি বুকে নিয়ে বাচ্চার মতো কাঁদে! এই যে কাজি সাহেব, আমার মম এটা। আপনি প্লিজ বিয়ে পড়াবেন না। আমার মম বাবাইকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। এই যে আঙ্কেল বর সেজে বসে আছেন কেন? আপনি জানেন না এটা আমার মম! আপনি এতো পঁচা কেন। আর আপনারা সবাই হা করে তাকিয়ে আছেন কেন? আপনারা জানেন না এটা আমার মম।

-এমন সময় মৌ এর বাবা আসাদ সাহেব, রাইসার মুখে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়! ছোটলোকের বাচ্চা তুই ছোটমুখে বড় কথা বলিস কেমনে রে? সাড়ে ছয় বছর বয়সী রাইসা চড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। রাইসা করুণ চোখে মৌ এর দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে তার মম তাকে বুকে জড়িয়ে নিবে। কিন্তু না! আমি ক্র্যাচে ভর করে বিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে! মনে হচ্ছে বক্ষটা আমার অনলে পুড়ে যাচ্ছে। রাইসা মাটিতে পড়ে আছে। চড়টা এতোই জুরে ছিল। রাইসার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে যায়। রাইসার কাছে যেতেই রাইসা রক্তমাখা মুখ নিয়ে বলে ওঠে বাবাই, ‘ মম আমাকে আর তোমাকে রেখে অন্য আরেকটা বিয়ে করছে! এখন আর মম আমাকে আদর করবে না। আচ্ছা বাবাই আমি কি দেখতে খুব পঁচা? দেখ বাবা আমার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। তুমি কষ্ট পেয়ো না বাবা। আমাকে বুকে নাও তো। আমি ক্র্যাচটা ফেলে দিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম ‘ মারে, তোকে না বলেছিলাম এখানে না আসতে। তুই কেন আসলি। রাইসার রক্তমাখা মুখটা আমার হৃদয়ে থাকা ছোট্ট ঘরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে! রাইসার গালে পাঁচ আঙুলের ছাপটা যেন আমার কলিজায় দেখা যায়। রাইসা যে আমার কলিজার টুকরা! দু’চোখ বেয়ে ধরধর করে পানি বের হয়ে যায়। মৌ এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম মৌ মাথাটা নিচু করে বসে আছে। বিয়ের সাজে মৌকে খুব সুন্দর লাগছে। আকাশের চাঁদটা আজ আকাশে নেই। জমিনে নেমে এসেছে। মৌকে এতো সাঁজতে কোনদিন দেখিনি। আমার সাথে মৌ-এর যখন বিয়ে হয়। তখন একপাতা টিপ আর টাউনহল মার্কেট থেকে ৫৬০ টাকার একটা শাড়ি ছাড়া কিছু দিতে পারিনি। আজ মৌ দেবী মূর্তির মতো সেজেছে!

বিয়ে বাড়ির সবাই অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
– এই রহিম, শরিফ তোরা কি করছিস? এই ছোটলোকের বাচ্চাটা কিভাবে ঢুকল! বের করে দে এদের।
– আমি রাইসাকে বললাম চল মা! তোর মায়ের বিয়ে দেখা তো শেষ হলো?
– কি হলো আপনারা যাবেন, নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব? । আপনাদের জন্য আমাদের কথা শুনতে হলো।

– আঙ্কেল আমার বাবাইকে বকো না। দেখ না আমার বাবাই হাঁটতে পারছে না। আমার বাবা কান্না করছে। আমরা আর আসব না বড় লোকের বাড়িতে।
– রাইসার কথা শুনে দাড়োয়ানের চোখে পানি চিকচিক করছে।
– আমি ক্র্যাচে ভর করতে করতে নরক পল্লী থেকে বেরিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় আসার পর রুমে মৌ এর ছবিটা দেখে কষ্টটা নতুন করে আবার চাড়া দিয়ে ওঠল! রাতে শুয়ে আছি রাইসা আমার বুকে শুয়ে আছে। আমি রাইসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। রাত ন’টা বাজে, হঠাৎ বুজতে পারলাম রাইসা কাঁদছে।
রাইসার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম’ তুই না আমার মা। তবে কাঁদছিস কেন?

-বাবাই জানো আজ যখন নানু আমার গালে চড় মেরে রক্তাক্ত করল। তখন মম কিছুই বলল না। মম ওই পঁচা আঙ্কেলটাকে বিয়ে করে নিল। বাবা তুমি কষ্ট পেয়ে না। আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না।
– হুম মা! জানি তো। এখন ঘুমুবে কান্না করবে না। রাইসা ঘুমাচ্ছে।
আমি হারিয়ে গেলাম সাত বছর আগে।
-মৌ এর সাথে কলেজে পরিচয়। তারপর বন্ধুত্ব। আর বন্ধুত্বটা একটা সময় ভালবাসার রুপ নেয়। মৌ তখন আমাকে ভীষণ ভালবাসত। আমি একটু ইগনোর করলে পাগলের মতো হয়ে যেত। একদিন মৌ আমার মেসে ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আসে। মৌকে জিজ্ঞেস করলে মৌ আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে ‘ রাজ আমার বাসা থেকে বিয়ে টিক করেছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম’ছেলে কি করে?’
– ছেলে আমেরিকার সিটিজেন!
-আলহামদুলিল্লাহ্! মৌ তুমি বিয়েটা করে নাও।আমাদের সম্পর্কের কোন ফিউচার নেই। তুমি চলে যাও বাসায় প্লিজ।
– মৌ আমার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলে’ রাজ তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তুমি যদি বিয়ে না করো তাহলে আমার সুসাইড করা ছাড়া কোন উপায় নেই। সেদিন মৌ এর জেদের কাছে হার মেনে মৌকে বিয়ে করে নেয়।

– ঢাকা থেকে চট্রগ্রামে চলে যায়। একটা প্রাইভেট কম্পানিতে ভালো একটা জব হয়। আমাদের ঘরটা ভালবাসায় ভরে ওঠে। বছর খানেক পরই আমাদের ঘর আলোকিত করে রাইসা আসে। খুব সুন্দর একটা সংসার। আমার কাছে মনে হচ্ছিল জান্নাতের একটা অংশ! কিন্তু একদিন অফিস থেকে ফেরায় পথে একটা মাইক্রো পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। ভাগ্যিস বেঁচে যায়। কিন্তু জীবন থেকে হারিয়ে যায় অনেক কিছু! হসপিটালে প্রায় ছয়মাস খানেক ছিলাম। চাকরিটাও চলে যায়। এদিকে মৌ আমার দুরবস্থায় একটা প্রাইভেট কম্পানিতে P.A পদে যোগ দেয়। এদিকে একসিডেন্টে আমার ডান পা টাও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। মৌ এর রোজগারের উপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভর হয়ে পড়ি।

-কিছুদিন পর রাইসার পঞ্চম জন্মবার্ষিকীতে মৌ এর বস জনাব সাইফ সাহেব আসেন। লোকটা এসে রাইসাকে কুলে তুলে নেয়। খুব মিশুক একজন মানুষ। মাঝে মাঝেই মৌ এর মুখে তার গুনকীর্তন শুনি।

– দিনগুলো ভালোই কাটতেছিল। হঠাৎ একদিন মৌ ফোন দিয়ে বলল তার আসতে রাত হবে। আমি আর কিছু বললাম না। রাত নয়টায় দিকে মৌ বাসায় আসল। মৌকে বললাম’ এতো রাত পর্যন্ত কি করলে? মৌ সোজা সাপ্টা উওর দিল অফিসে কাজ ছিল।

– এতো রাত পর্যন্ত কিসের কাজ তোমার ?
-তুমি কিন্তু আমাকে সন্দেহ করছ।
– এটা সন্দেহ না। আমি শুধু জানতে চেয়েছি।
– আমি তোমাকে কৈফিয়ত দিতে পারব না। আমার টায়ার্ড লাগছে।
– রাতে ঘুমিয়ে গেছি হঠাৎ ফিস ফিস আওয়াজে ঘুম ভাঙল। পাশ ফিরে দেখি মৌ এতোরাতে কার সাথে যেন কথা বলছে। হঠাৎ মৌ বলল ‘ স্যার আপনি এতো দুষ্ট তা তো আগে জানতাম না। আজ যা করলেন।
– আমি আর কিছু শুনতে চাইলাম না। কারণ এসব সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

দু’হাতে কান ধরে আছি। আর মনে মনে বলছি, হারয়ে ভালোবাসা! নিমিষেই চোখের কোণে জল এসে গেল! নদিতে বর্ষায় যেমন বান আসে।তেমনি আমার চোখে বান এসেছে!

-পরের দিন মৌ, আমার দেয়া নীল শাড়িটা পড়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বলল ‘ রাজ অফিসের জরুরী কাজে কক্সবাজার যাবো। তুমি রাইসাকে দেখো। পরশু এসে পড়ব। আমি কিছু বললাম না। শুধু অভিশপ্ত পা টার দিকে তাকালাম! মুচকি হেসে বললাম ‘ বিধাতা কোন খেলা খেলছ এই অর্ধমের সাথে। ‘

– এদিকে দু’দিন পর মৌ এসেই রাইসাকে কুলে তুলে নিল।
মম আমার জন্য কি নিয়ে আসছো?
– তোমার জন্য অনেকগুলো চকলেট নিয়ে আসছি। আমি মা-মেয়ের কথোপকথন শুনে হাসলাম। মনে মনে বললাম চিরদিন যেন এ মমতায় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। মৌ আমাকে দেখে কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেল।

– পরের দিন হঠাৎ করেই দিনের বেলা কাপুনী দিয়ে জ্বর এসে গেল। জ্বরে সহ্য করতে পারছি না। রাইসা পাশের রুমে টিভি দেখতে ছিল। রাইসাকে ডাক দিলাম। রাইসা কাছে এসে বলল’ বাবাই ডেকেছ আমায়? হ্যাঁ মা। তোমার মমকে ফোন দিয়ে বলো তো ‘ বাবাই খুব অসুস্থ! রাইসা মৌকে কয়েকবার ফোন দিতেই মৌ ফোন রিসিভ করেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল’
কেন ফোন দিয়েছ? ‘
-মম বাবাই খুব অসুস্থ, তুমি আসো! বাবাই জ্বরে কেমন করছে!

– মামনি তোমার বাবাইকে বলো ডক্টর দেখাতে। আমার আজ একটা পার্টি আছে। রাইসা ফোনটা কেটে দিল।

– বাবাই চলো তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো। রাইসার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। মেয়ের আকুতি শুনে, না করতে পারলাম না। বিকেল বেলা হসপিটালে ব্লাড টেস্ট করে ধরা পড়ল ‘ আমার টাইফয়েড জ্বর হয়েছে! ডাক্তার পেসক্রিপশন লিখে দিল। ওষুধ নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে রিক্সা করে যখন বাসায় আসছিলাম। রিক্সাটা যখন পার্কের সাইড দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় রাইসা বলে উঠল ‘ বাবাই দেখ তো, মম না ওইটা। আচ্ছা বাবাই মম ওই আঙ্কেলটাকে জড়িয়ে ধরে আছে কেন?
– আমি পার্কের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম।

চলবে”””

গল্পঃ #বাবার_ভালোবাসা।

প্রথম পর্ব

লেখাঃরাইসার_আব্বু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here