বাদামী চোখ, পর্ব:৩

0
1029

#বাদামী_চোখ [০৩]

হঠাৎ খেয়াল করি পাত্রপক্ষের সবাই একে অপরের সাথে কি নিয়ে যেন কানাকানি করছে।
এখানে শুধু লিয়ন গম্ভীরমুখে দুই হাত পেটে উপর পেঁচিয়ে ধরে, একদম স্থির হয়ে কোনোদিকে তাকিয়ে আছে।
আমি সেটাকে আর লক্ষ্য না করে তনয়ের দিকে তাকালাম, আমি তাকাতেই সে লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো।
ঠিক সেসময় তনয়ের মা তনয়ের হাত ধরে আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” ভাইসাহেব যদি অনুমতি দিতেন আমরা মেয়েকে আংটি পরিয়ে দিতাম।

এটা শুনে বাবা আর মা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গেই বললো,
” নিশ্চয়ই পরিয়ে দিতে পারেন! তাছাড়া আজই তো বিয়ের তারিখ পাকা হচ্ছে।

তৎক্ষনাৎ আমি হেসে তনয়ের দিকে তাকালাম, আর এক্সিডেন্টলি একসাথে দুজনের চোখে চোখ পড়ে গেলো। কিন্তু এখন আর কেউই সাথে সাথে চোখ ফিরালাম না।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তনয়ের ঠোঁটে হাসির রেশ ভীষণ স্বচ্ছ আর প্রানবন্ত।
কে পারবে এই হাসির প্রেমে পড়া থেকে আমাকে আটকাতে? আমার মুগ্ধ চোখ যেন তার থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই চাচ্ছেনা।
সারা মুখমণ্ডল জুড়ে ছেঁয়ে থাকা মায়ার প্রকটতা ভেতরে তীব্র আলোরন জাগাচ্ছে, সেখান থেকে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভালোবাসাময় অনূভুতিগুলো!

এই মূহুর্তে এখানকার সবগুলো মুখেই সজীবতা বিরাজমান, শুধু একটা মুখ ব্যতিত! সেই মুখটায় তাকিয়ে আমার মতো আমার ভাবীও অদ্ভুতভাবে সমবেদনা প্রকাশ করতে চাচ্ছে। সত্যি ভীষণ হাস্যকর লাগছে তাকে এবং তার প্রতিটা চাহনিকেও!

এদিকে তনয়ের মা একটু এগিয়ে বললেন,
” দেখি মিষ্টি মা আমার, তোমার হাতটা দাও দেখি!

আমি হেসে হাত বাড়ালাম! তিনি তনয়ের দিকে ছোট্ট বক্সটা খুলে আমাকে পরিয়ে দিতে ইশারা করলেন।
তনয় সেটাকে তুললো আর এদিক ওদিক তাকালো, দেখলো সবাই ইশারা করছে সে যেন তাড়াতাড়ি পরিয়ে দেয়!

তনয় আমার হাতটা ছুঁতে ধিরে ধিরে বাম হাত এগিয়ে আনলো, আর ডানহাতে রিংটাও সামনে এনে নিলো, আমার পুরো দৃষ্টি ওর হাতের দিকে।
তার হাত প্রায় ছুঁতে যাচ্ছে, তাও সে সাহস করে আমার হাতটা শক্ত করে তার হাতে আবদ্ধ করছেনা।
আমি চোখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই দেখি মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, এতো কম সাহসী মানুষ আর আমি একটাও দেখিনি।
নাকি প্রথম কাউকে এভাবে ছুঁতে চাচ্ছে বলে তার লজ্জা আর খুব বিব্রতবোধ একটু বেশিই সৃষ্টি হচ্ছে?
কি জানি!

কিন্তু তৎক্ষনাৎ তনয়ের মা নিজের হাতটা দিয়ে একটানে তনয়ের বামহাত আমার হাতের রেখে বললো,
” আরে বাবা তোর বউ হবে সে, কেন এতো লজ্জা পাচ্ছিস বলতো? পরিয়ে দে তাড়াতাড়ি।

তনয় তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার অল্প কাঁপা হাতেই পরিয়ে তার নিজের হাতটা এবার তার বসা অবস্থায় কোমরের ভাঁজে গুটিয়ে ফেললো!
পরানোর পরে সবাই হেসে উঠলো, এর মধ্যে কয়েকজন বেশ আওয়াজ করে হেসে তনয়ের কাঁধ চাপড়ালো। শেষ পর্যন্ত যে পারলো!

ঠিক তখনি তনয়ের চাচা বললেন,
” কিরে তনয় নিবিতার সাথে আলাদা কথা বলবি? বলতে চাইলে বল, আমরা এবার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা পাকাপোক্ত করি!

তনয় তার মায়ের দিকে তাকালো, তিনিও হেসে বললেন,
” আচ্ছা কথা বলতে চাইলে বল, বিয়ের আগে তো তোদের আর দেখা হবেনা!

এরপর তিনি আমার ভাবীকে লক্ষ্য করে বললো,
” তুমি ওদেরকে নিয়ে যাও মা, আর আমার ছেলেটা বড় লাজুক, এতো লজ্জা নিবিতাও পাবেনা, যতটা ও ছেলে হয়ে পায়!

উনার কথা শেষ হতেই আবার হাহাহা করে বিরাট হাসির শোরগোল উঠলো।
আর ভাবী এসে আমাকে তুলে নিলেন।
আমি পেছন ঘুরতেই শুনি লিয়নের মা বলছে,
” লিয়ন যা তনয়ের সাথে। সে যেতে সাহস পাচ্ছেনা দেখ!

এই কথাটা আমার কাছে বেশ বিরক্তির ঠেকলো, তনয়ের সাথে লিয়ন কেন আসতে হবে?

ভাবী আমাকে পেছনের বারান্দায় নিয়ে ঘুরে তনয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
” উনাকে পাশের রুমে রেখে শুধু আপনারা কথা বলুন। আমিও আছি আপনার পাশেই!

এখানে রাবারের ফিতায় বানানো বিরাট দুইটা চেয়ার, আর ছোট একটা টি টেবিল থাকে! পুরো গ্রিল বেয়ে উঠেছে অপরাজিতা ফুলের লতাপাতা এবং ফুল। জায়গাটা আমাদের সবার ভীষণ প্রিয়! এখানে কফি এবং চা বানানোর পুরো আয়োজন সবসময় রাখা থাকে।
আমি আগে আগে গিয়ে বসলাম, আর বললাম,
” বসুন, আর বলুন চা না কফি খাবেন?

দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই তনয় বললো,
” না না কিছু খাবোনা।

বলেই সে ভেতরের দিকে লক্ষ্য করছে শুধু। আমি বসে গিয়েও ওর এমন ভীতিকর অবস্থা দেখে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
বসা থেকে উঠে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম দরজা দিয়ে ভেতরে লিয়নকে দেখা যাচ্ছে, তনয় অদ্ভুত লজ্জায় লিয়নকে আড়াল করে এসে বসতে চাচ্ছেনা।
ভাবীও এখানেই আছে কিন্তু ভাবীকে বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছেনা , আমি এবার লিয়নকে দেখিয়ে তনয়ের দিকে অনেক এগিয়ে তনয়ের কাঁধে হাত ডানহাতে জড়িয়ে বললাম,
” আরে পাছে না তাকিয়ে এসে বসুন তো!

আমি এভাবে এলোপাতাড়ি হয়ে ছোঁয়াতে তনয় যতটা অবাক হলো তার চেয়ে বেশি হলো লিয়ন। মাত্র একটু দেখেছিলাম, সে এটা দেখে হা হয়ে গেছে।
আমি তনয়কে নিয়ে বসলাম আর ধমকে বললাম,
” ফোনেও কথা বলতে পারেন না আবার সামনাসামনিও এতো ভয়? বিয়ের পরে বউয়ের সাথে একাকিত্বে থাকাকালীন এভাবে কাউকে গার্ড হিসেবে বসিয়ে রাখবেন নাকি?

তনয় এবার আমার কথা শুনে লজ্জায় নিজের মুখ চেপে ধরলো। আমি হাসতে হাসতে হিটারটায় দুই কাফ কফির মতো পানি দিয়ে সুইচ অন করলাম। আর নিজেই হাত বাড়িয়ে তনয়ের মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললাম,
” মেয়েদেরকে সাথে কথা বলতে লজ্জা লাগে?

তনয় মাথা ঝাকিয়ে বললো,
” হুউউম!

আমি তাজ্জবতার সাথে হাসতে হাসতে বললাম,
” কি বলেন? কেন? জীবনে প্রেমে পড়া হয়নি বুঝি?

তনয় লালচে মুখে জবাব দিলো,
” হয়েছে!

আমি ভ্রু কোঁচকে বললাম,
” তাও সাহস হয়নি? তা কখন প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন?

তনয় আমার টেবিলে রাখা হাতের উপর আস্তে করে হাত রেখে থামা গলায় বললো,
” যেদিন আপনার সাথে আমার দেখা হলো, সেদিন!

আমি এতক্ষণ ব্যস্ত দৃষ্টি নিয়ে কফি এবং তনয় দুদিকেই লক্ষ্য করছিলাম। এবার ওর কথায় স্থির হয়ে গেলাম। বুকের মধ্যে খুব চেনা একটা অনূভুতি আবার উদয় হলো, বহুদিন এইটা অনূভব হয়নি।
খুব গভীর থেকে কম্পিত হয়েছে এই প্রেমময় বোধ!
আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম! সত্যিই কতো নিষ্পাপ তনয়ের চোখজোড়া, এখানে শুধু দেখা যাচ্ছে নিখাঁদ ভালোবাসার গর্জন!

আমি ওর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে দুইটা কাপ কফি বানিয়ে একটা ওর দিকে ঠেলে বললাম,
” এই যে এটা শুরু! কয়েকদিন পরে রোজ আমার এই স্বাদের কফি খেতে খেতে বোর হতে থাকবেন! হাহাহা আমি কিন্তু খারাপ বানাইনা, দেখুন দেখুন খেয়ে দেখুন!

তনয় কাপ হাতে নিয়ে মৃদু হেসে চুমুক দিয়েই বললো,
” কি যে বলেন, আগামী ১০০ বছর সবকিছুর বদলে এই হাতের শুধু কফি খেলেও অরুচি হবেনা।

আমি ওর কথায় আরো হাসতে লাগলাম। বেচারার লজ্জা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে! এখন আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারছে। সাথে আমার ভালোলাগাও তার উপর ক্রমশ বিদ্যুৎ গতিতে বাড়ছে!
পাগল করা চাহনি তার, আর প্রতি ক্ষনে ক্ষনে বুকে তীর ছুড়ে যেন তার বোকা বোকা হাসিগুলো!

তারপর কফি শেষ হতেই আমি কাফটা রেখে বললাম,
” তারপর আর কিছু বলার আছে? আমরা যাই তাহলে, উনাদের আলোচনা শেষ বোধহয়!

তনয় মুখটা গম্ভীর করে বললো,
” আরেকটু থাকি, কে জানে কতো দেরিতে বিয়ের তারিখ? এর মধ্যে তো আর দেখা হবেনা।

আমি দুইহাত সামনে রেখে সেখানে থুতনি ভর করে বললাম,
” আমার চোখ! এই যে বাদামী চোখগুলো আপনার এত ভালো লাগে, আপনি কি জানেন একটা সময় এর জন্য আমাকে ভীষণ যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে! এমনকি এর জন্য…

বলার সময়ই দরজার উপর থেকে লিয়ন বললো,
” তনয় তোদের কথা শেষ হলো?

আমি মুখ উঁচু করে তাকালাম,ভাবীও সাথে আছে।
তনয় ঘাড় ফিরিয়ে বললো,
” এইতো শেষ, তুমি যাও আমি আসছি।

লিয়ন মুখে অন্ধকার টানিয়ে চলে গেলো।

আমিও উঠে দাঁড়িয়ে ওপাশ থেকে এপাশে আসলাম। আর তনয়কে বললাম,
” চলুন যাই তাহলে।

তনয় আস্তে আস্তে বললো,
” চোখ নিয়ে কি যেন বলছিলেন? শুনেন আমার মনে হয় না দুনিয়ায় লিয়নভাই ছাড়া চোখের সৌন্দর্য্য বুঝজ্ঞানে কেউ এতটাও অজ্ঞ!?

তনয়ের কথায় আমি চমকে গেলাম। তবে কি সে লিয়ন আর আমার ব্যপারে কিছু জানে?

চলবে…….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here