বাদামী চোখ, পর্ব:৪

0
1025

#বাদামি_চোখ [০৪]

তনয় বেশ ব্যস্ত পায়েই জায়গাটা প্রস্থান করে ভেতরে চলে গেলো।
শুধু আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি! তনয় হয়তো বিয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনা কতদূর এগুলো সেটা জানতে লিয়নের দিকে না তাকিয়েই সবার সমাবেশের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
এদিকে লিয়নও বসা থেকে দাঁড়িয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে তনয়ের পেছন পেছন সেই স্থানের দিকেই চললো!

আর আমি ভাবছি তনয় কি সবকিছু জেনেই আমাকে বিয়ে করতে এসেছে? আর লিয়ন! সে দূরে সরে যাচ্ছেনা কেন? আমাদের আশেপাশে থাকার এখন কি মানে? আর তনয় যদি সবকিছু জেনেই থাকে তাহলে তো এভাবে লিয়নকে তার সাথে রাখছে কেন? সে তো চাইতো তার ভবিষ্যৎ অর্ধাঙ্গিনীকে অতীত আর স্পর্শ না করুক। আসলে কি আছে এদের দুজনের ভেতরে? কিছুই মাথায় যাচ্ছেনা আমার!

অন্যদিকে আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবি আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বললো,
” নিবিতা তুমি এভাবে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কোনো সমস্যা?

আমি ভাবির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,
” মনে হচ্ছে তনয় লিয়নের আর আমার ব্যপারে কিছু জানে ভাবি।

ভাবি দ্রুততার সাথে তার চোখের পলক ফেলতে ফেলতে বললো,
” কি বলো এসব? সে এমন কোনো ইঙ্গিত দিয়েছে নাকি? নিবিতা বলো তনয় কি বলেছে?

আমি হ্যাঁ সম্মতি দিয়ে কিছু বলতে যাবো তখনি আমার আম্মুর ডাক কানে আসলো, তিনি জোরে জোরে ডেকে বলছে,
” বউমা সবার জন্য তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে আসো!

ভাবি আমার আম্মুর ডাকের সাথে সাথে ঝড়ের বেগে হুকুম পালন করতে ছুটলো।
আমি আস্তে আস্তে সেই রুমটাতেই গিয়ে বসলাম।
এখান থেকেই জানালার পর্দাটার ফাঁকে সবাইকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু লিয়নের বউকে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছিনা।
আমি উঠে পর্দাটা পুরো সরিয়েও তাকে দেখতে পেলাম না। লিয়ন তনয়ের সাথেই আছে, আর ভাবি ইতোমধ্যে সবার জন্য মিষ্টি নিয়ে সেখানেই হাসিমুখে হাজির হয়েছে। তাদের একেকজনের দিকে হাসিমুখে মিষ্টির বাটি এগিয়ে দিচ্ছে!
তাদেরকে শুধুমাত্র দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কোনো কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিনা, তবে সবাইকেই দেখতে ভীষণ উৎফুল্ল লাগছে!

আমি আর কিছু খেয়াল না করে ডানদিকের দরজা খুলে আমার রুমে গেলাম।
আর আমার ফোনটা হাতে নিয়ে তনয়কে একটা এসএমএস লিখে জিজ্ঞাসা করলাম,
” সবাইকে এতো বেশি খুশি দেখাচ্ছে কারণ কি? বিয়ের তারিখ এইমাসেই নাকি?

এক মিনিটের মধ্যেই তনয় রিপ্লে দিলো,
” এইমাসে না, এই সপ্তাহেরই শুক্রবার বিয়ের তারিখ পাকা হয়েছে, (সাথে দাঁত বের করা হাসির ইমোজি।)

আমি বেশ বিষ্ময়ের সাথে ফোনটা মুখের উপর তুলে ধরলাম। কি বলছে এসব? এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? কোনো অনুষ্ঠান করবেনা নাকি? করলেও এতো দ্রুত এসবকিছুর আয়োজন কি করে সম্ভব?

আমি এসএমএসের আর কোনো জবাব না দিয়ে আবার সেই রুমে গিয়ে পর্দা সরিয়ে সবার দিকে তাকালাম।
লিয়নের বউকে এবার দেখলাম বাইরে থেকে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেছে। আজকে আমাদের বাড়ির মেইন দরজাসহ যাবতীয় সব দরজা জানালা খোলা অবস্থায় রয়েছে, কেননা মেহমানরা কখন কিসের জন্য বের হয় কে জানে?

কিন্তু সবার সামনে থেকে লিয়নের বউকে একা বাইরে যেতে দেখাটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকলো।
তবুও সেটার দিকে নিজের ভাবনা এগুতে দিলাম না, আমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
সে মিষ্টি খেয়ে হাতমুখ মুছতেছে!
আর লিয়ন শুকনো মুখেই বসে আছে, সে খেয়েছে কিনা জানিনা, কেননা তার মুখ দেখে এটা এই মূহুর্তে বুঝা যাচ্ছেনা।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম সবাই বেশ নড়েচড়ে বসেছে, আর তনয়ের মা উঠে দাঁড়িয়ে কোথাও যাবেন এমন ভাব করছেন তিনি!
তখনি দেখলাম উনি ভাবির দিকে অগ্রসর হয়ে কিছু বলার সাথে সাথে ভাবি উনাকে এই রুমের দিকেই নিয়ে এগিয়ে আসছে।
উনার আসার কারণ কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম আমি, আর তাই তৎক্ষনাৎ আমিও সাথে সাথে গিয়ে চুপচাপ বিছানার উপর বসলাম।
তিনি রুমে প্রবেশ করেই বললেন,
” নিবিতা মা, আমরা তাহলে যাচ্ছি কেমন? ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো!

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
” জ্বী আপনিও ভালো থাকবেন, ইনশাআল্লাহ খুব শীগ্রই দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ!

তনয়ের মা আমার থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলেন।
আর তিনি সেখানে যাওয়ার পরে বাকিরাও আমার আম্মু আব্বুর থেকে বিদায় নিয়ে একে একে বাসা থেকে বের হতে লাগলো। আমার আব্বু আম্মুও তাদের সাথে সাথে এগিয়ে দিতে বের হলো, ভাইয়াও যাচ্ছে। সবাই বের হওয়ার পরেও তনয় পেছনে বারবার তাকাচ্ছিলো আমাকে বিদায়কালে আরেকবার দেখা যায় কিনা! কিন্তু সে আমাকে দেখতে পেলোনা, শুধু আমিই তাকে দেখলাম।
ওর আড়চোখে খোঁজাখুঁজি দেখে আমি মুখ টিপে আড়ালেই হাসতে লাগলাম।

সবাই বের হওয়ার পরেই আমি জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শরীর থেকে সাজগোজের সামগ্রী সব নামাতে শুরু করে দিলাম।
এতক্ষণ এসব ভীষণ জ্বালাচ্ছিলো, আমার নরমাল থাকতেই বেশি ভালো লাগে। অযথা কেন যে ভাবি আমাকে এসব পরালো কে জানে!?

কিছু সময় অতিবাহিত হতেই আমি ফ্রেশ হয়ে বাসায় যেভাবে থাকি একদম সেরকম রূপ ধারণ করলাম।
ভাবিও উনার সব কাজ গুছিয়ে ইতোমধ্যে আমার কাছে এসে বসেছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে আমাকে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

” নিবিতা তুমি কিছু বলতে চাচ্ছিলে তখন।

আমি ভাবির কথার জবাবটা এড়িয়ে বললাম,
” আচ্ছা লিয়ন তো তোমার সাথে রুমে বসে ছিলো তাইনা?

ভাবি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথা হেলে বললো,
” হ্যাঁ আমরা বসেছিলাম তো।

আমি এবার নিজের কপালে একটা হাত রেখে বললাম,
” আরে আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছোনা ভাবি? ওর সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন তো তোমার সাথে কথা সাক্ষাৎ দুইটাই হয়েছে, তাই সে জানে তুমি যে আমাদের ব্যপারে জানো। তো সে কি আমি আর তনয় কথা বলার সময় তোমাকে কিছু বলেছে? মানে তোমরা কোনো কথাই বলোনি নাকি? আর বললে কি কথা হয়েছে সেটা বলো আমাকে।

ভাবি এবার ভ্রু কোঁচকে বললো,
” নাহহ আমার তো মনেই হলোনা সে আমাকে চিনে বলে! ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর আমিও চুপচাপ বসে ছিলাম। এটা বাদ দিয়ে বলো তনয় কি এমন বলেছিলো যার জন্য তুমি ভাবলে সে লিয়ন এবং তোমার ব্যপারে সে জানে?

ভাবির কথা আমার বিশ্বাস হলোনা। কারণ লিয়নের সাথে ভাবি আমার চেয়ে ভালো বন্ধুত্ব করে ফেলেছিলো, ভাবিকে আলাদা করেও লিয়ন ফোন দিতো। আমি মানলাম আমাদের বিচ্ছেদের পরে উনার সাথে যোগাযোগও ছিন্ন হয়েছে তাই বলে এক জায়গায় বসেও কথা বলবেনা এটা কি করে হয়?

তবুও আমার ভেতরের কুটকুটানিকে চাপিয়ে বললাম,
” না মানে তনয় বলছিলো লিয়ন নাকি চোখের সৌন্দর্য বুঝায় অজ্ঞ! তাতে আসলে আমার সন্দেহ হচ্ছে।

আমি আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে চলে গেলো। কোনো জবাবই দিলোনা আমার এই কথার!
ভাবি কি আমার এই সন্দেহকে তাচ্ছিল্য করলো? মানে এইটার উপর তনয় সবকিছু জানে বিষয়টা ভাবা কি আসলেই হাস্যকর? না আমি এই মূহুর্তে ভাবির হাসিটা ঠিক ধরতে পারলাম না!


দুইদিন পরের কথা।
আজকে তনয় বিয়ের বাজার করতে যাবে!
ওর সাথে আমার রোজ কথা হয়,কিন্তু লিয়নের ব্যপারে আর কোনো প্রসঙ্গই উঠেনি।
এদিকে তনয় বিয়ের বাজার নিয়ে আমার সাথে যাবতীয় বিষয়েই আলোচনা করে করে জিনিসপত্র কিনতে চাইলো। বিয়ের সময় শাড়ী নাকি লেহেঙ্গা পরবো, আর সেটা কোন রঙের হতে হবে, সাথে আর কি কি চাই এসব নিয়ে জানতে চাইলো, কিন্তু আমি উনার পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে বললাম,
” আপনি আপনার বউকে কীভাবে সাজতে এবং দেখতে পছন্দ করবেন সেভাবেই সব কিনে নেন।

তবুও তনয় আমার পছন্দ নিয়ে জানতে বেশ জোরজবরদস্তি করলো, আমি একদম আমার কথাতেই থেমে রইলাম। আমারও কেন জানি ইচ্ছে করছে তনয়ের কল্পনা অনুযায়ীই সাজি! দেখি তার পছন্দ কেমন?

রাতে সব কেনাকাটা করে তনয় আমাকে টেক্সট করলো ,
” ভিডিও কল দেই নিবিতা?

আমি ভাবলাম তার বুঝি আমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে। আমি ওড়না টেনে ঠিকঠাক হয়ে বসে বললাম,
” আচ্ছা দেন!

তনয় সাথে সাথে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল দিলো।
আমি কলটা রিসিভ করে প্রথমে ক্যামেরা অফ করে নিলাম। সে চাইলে সামনে আসবো!
কিন্তু তনয় আমাকে পেছন ক্যামেরা দিয়ে সামনে দেখালো বিশাল জিনিসপত্রের বাহার! সে সেখান থেকে হাত দিয়ে টেনে সবুজ রঙের শাড়ী বের করে বললো,
” এইটা বিয়ের জন্য! দারুন না?

আমার চোখ এইটার দিকে পড়তেই গা জ্বলে ওঠলো,আমি রাগ নিয়েই বললাম,
” সবুজ? আমি জানি এটা আপনার পছন্দ নয়!

তনয় তৎক্ষনাৎ ফ্রন্ট ক্যামেরার সামনে এসে বললো,
” হ্যাঁ কিন্তু সেটা তুমি কি করে জানো? এটা কিনতে লিয়ন ভাই সাজেস্ট করেছে! বললো এমন একটা রঙ নাকি তোমার মতো সুন্দরীদের জন্যই বাজারে তৈরি হয়েছে!

আমি এবার চুপসে গেলাম। এখন কি করে বলবো লিয়নের পছন্দ সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো ধারণা আর কারোর নেই?

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here