বাদামী চোখ, পর্ব:২

0
1344

#বাদামী_চোখ [০২]

লেখাটায় চোখ বুলাতে বুলাতে আমার মধ্যে অনেক ভাবনারা এসে ভীড় করেছে মূহুর্তেই !
আমি ভাবছি লিয়ন যে এখানে লিখেছে, “তখন সে আমার আবেগীয় কথাগুলোকে হেসে অপমানিত করতো”।
কিন্তু আমি তো আমার সামনে তাকে কখনোই অপমানজনিত হাসি হাসতে দেখিনি।
তার মানে সে আসলেই হাসতো তবে আমার সামনে নয়, আড়ালে!। তাহলে তো খুব করুণ অবহেলার ছিল তার সেই হাসি!
তার কাছে আমার অনূভুতিগুলো একসময় শুধুই হাস্যকর হয়ে উঠেছিলো। আর তখন আমার আর্তনাদকে শুধুই তার প্রচলিত আবেগ মনে হয়েছে। তাহলে তো সন্দেহই নেই যে বিচ্ছেদের কারণ তার পরিবার নয়, সে নিজেই ছিলো।
বাহ! মানুষ ভালোবাসার অভিনয়ও এতো নিখুঁত ভাবে করতে পারে? আমি কিনা তার এসবকে পরিবারের বাধ্যতা ভেবে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম!?

এদিকে ভাবী আমাকে একটা টিস্যু পেপারে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা বিচলিত চাহনি নিয়ে তাকাচ্ছে।
আমি এটা বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ ভাবীর নিক্ষিপ্ত দৃষ্টিকে এড়াতে এটা দিয়েই মুখের ঘাম মুছার ভাব করতে লাগলাম।
জানিনা ভাবী কিছু দেখেছিলো কিনা! কিন্তু কেন জানি কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলোনা। পরক্ষণে দৃষ্টি অন্যদিক ফিরিয়ে নিলো।

টিস্যুটা আমার মুঠোয় এখন, ভেতর থেকে চাইছি এটাকে চলন্ত গাড়ী থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেই, যেভাবে লিয়ন সম্পর্ক চলাকালীন এক সময় হুট করেই আমাকে ফেলে নতুন গন্তব্যে অগ্রসর হয়েছিলো!
কিন্তু পারছিনা। আমার হাত কাঁপছে, বুক দুরুদুরু করছে! আমার জানা নেই মানুষ সত্যিই কাউকে ভালোবাসলে তার সামান্য অস্তিত্ব মিশে থাকা কিছুকেও কীভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে!?

অল্পক্ষণের মধ্যেই বাসার সামনে এসে গাড়ী থামলো, আমরা নেমে ধির পায়ে এগুতেই দেখি আমাদের জন্য সবাই বেশ উৎসুকভাবে অপেক্ষারত। আমাদের দেখতেই তারা ছুটে এলো পাত্র পছন্দ হয়েছে কিনা জানতে।
এভাবে বাসার দরজা খোলা রাখতে আর কখনো দেখিনি।
মা তো ভেতরে যাওয়ার আগেই এসেই ভাবীকে বললো,

” বৌমা, ছেলেকে নিবিতা পছন্দ করেছে?

ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি মুচকি হাসছে, তারপর কিছু বলার জন্য উদ্যত হয়েছে। আমি এসবকিছু না শুনেই খুব তাড়া করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলাম। মা এটাও জিজ্ঞেস করতে পারতো নিবিতাকে ছেলে পছন্দ করেছে? কিন্তু এটা না করে মা আমার জায়গাটা জিজ্ঞাসা করেছেন।
আমার আম্মুরও হয়তো ধারণা আমাকে চোখের দিক থেকে বাদ দিলে অপছন্দ করার কারণ নেই। আর চোখের ব্যপারে তো আগেই বলে দিয়েছিলো তাদের।

তবে আমি এখন এটা জানি ভাবী এখন বলবে আমরা একে অপরকে পছন্দ করেছি। কেননা ভাবীকে ইতোমধ্যে এই বিয়েতে রাজী হওয়ার ব্যপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছেন!

রুমে এসে হাতের দিকে নজর করলাম, টিস্যুটা হাতের মুঠোয় থেকে হাতের ঘামে অর্ধেক ভিজে গেছে। সেটার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা অংশ আমার হাতেও লেপ্টে বসেছে।
আমি এটাকে খুলে দেখলাম, লেখাগুলোও প্রায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
রুমের ফ্যানটা অন করে পা দুলিয়ে বসে শেষ পর্যন্ত হাত ছড়িয়ে আধবসাতেই শুয়ে পড়লাম।
হাতের দিকে আরেকবার নজর করতে যাওয়ার সময়ই ফোনের ভাইব্রেশনে ঘাড় ফিরালাম, শোয়া থেকেই পার্সটা টেনে ফোন বের করে দেখি ‘তনয়’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটা নাম্বার ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে!
হ্যাঁ এটা আমিই সেইভ করেছি ঘন্টাখানেক আগে!
মিটমিট করে হেসে আমি কলটা রিসিভ করলাম।
কোনো কথা না বলে চুপ করে কানে ঠেকালাম।
ওইদিকেও নিরবতা।
আড়াই মিনিটের মাথায় গলা কেশে সেই থামা থামা গলায় আওয়াজ বের হলো, বললো..
” তাহলে আপনারা পৌঁছেছেন ঠিকঠাক?

আমিও এবার নিজের মুখ খুলে জবাব দিলাম,
” হুম আসলাম কিন্তু আপনাকে পৌঁছেছি কিনা বললাম নাতো। কি করে জানেন?

খুব চাপা হাসির আওয়াজ আসলো, আর বললো,
” আমি আসলে চুপ করে এইটাই বুঝার চেষ্টা করছিলাম, গাড়ীর শব্দ আছে কিনা! শনশন করে রুমে ফ্যান চলছে তো, তাই বুঝতে পারলাম চলে গেছেন।

আমি এবার হেসে ফেললাম। তনয় আসলেই অন্য রকম! সে ভীষণ সরল আর মার্জিত।
আমি ফোনটা চোখের সামনে একবার এনে হেসে বললাম,
” হ্যাঁ ঠিকমতই পৌঁছেছি। আপনি আছেন কোথায়?

অপরপ্রান্ত থেকে জবাব এলো,
” এইতো বাসায় আসলাম। আম্মু আব্বুর সাথে কথা বলছি।

এইটুকুতেই আমাদের কথা বন্ধ। আমিও জবাব দিচ্ছিনা, সেওও কিছু বলছেনা।
একটা সময় আমি কলটা কেটে বিছানার এক প্রান্তে ছুড়ে ফেললাম। দুদিকেই কথা খুঁজে না পেলে অযথা মিনিট বাড়িয়ে লাভ কি? কিন্তু তনয় ভীষণ লজ্জাপূর্ণ একটা ছেলে, সামনাসামনি ওর এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লেগেছে।
আমি অন্যদিক ফিরে থাকলে সে আমার দিকে তাকায়,কিন্তু আমি সামনে তাকালেই সে মাথা নিচু করে ফেলে কিংবা এদিক ওদিক তাকানোর চেষ্টা করে!

এসব ভাবার এক পর্যায়ে আমি একটু ঘাড় তুলে লিয়নের লিখিত সেই টিস্যুটা জানালার বাইরে দিকে ঢিল মেরে ফেলে দিলাম। আর ভেবেই নিলাম, আমার অতীত এখন শুধুই অতীত! আমাকে আমার নতুন জীবনের উপর সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে হবে! আমার ভালোবাসা এবং আবেগ পাছে কাউকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, আর এখন আমি এর প্রাপ্য মানুষটাকেই সব উজাড় করে দিবো!

রাতে আমাদের দুপক্ষের মতামত জানাজানি হলো। তনয়ের পরিবার এবার আমাদের পরিবারকে পাকা তারিখ দিতে বললেন। কখন তারা মেয়ে দেখতে আসবে এবং বিয়ে নিয়ে চূড়ান্ত অভিব্যক্তি জানাবে, তা নিয়ে তারা শীগ্রই মতামত চান!

মা বাবা এবং ভাইয়া ভাবীর মাধ্যমে আমার থেকে জানতে চাইলেন আমি আরো সময় চাই কিনা!
ভাবী এটা নিয়ে কথা বলতে এলে আমি বললাম,
“ভাবী পছন্দ যেহেতু হয়ে গেছে, সময় চাওয়ার কিছু নেই। ভাইয়া এবং আব্বু আম্মুকে তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত দিতে বলো।

ভাবীও আমার কথাগুলো অবিকল তাদের সামনে বললো। এতে তারা ভীষণ খুশিময় অবাক হলো। কেননা তারা ভাবতেই পারেননি বিয়ের ব্যপারে এতো শীগ্রই আমি আগ্রহ দেখাবো।


সপ্তাহের প্রথমদিন তাদেরকে পাত্রী দেখা এবং পাকা কথা বলার নিমন্ত্রণ করা হলো।
আমরা খুব আয়োজন করেই সাজানো-গোছানো করলাম।
এদিকে আমি তৈরি হওয়ার শেষ সময়ে শুনলাম তারা অনেকেই আজ এসেছে। এতো মানুষ আসার কথা ছিলোনা। মা ফিসফাস করে আমাদেরকে এই কথা শুনিয়ে গেলেন আর খাবার সবার ঠিকঠাক সবার হবে কিনা এই নিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন।
আমি এসবে পাত্তা দিলাম না, যেহেতু তারা সংখ্যার বাইরে মানুষ এসেছে সেহেতু খাবারের ঘাটতি অবশ্যই বুঝে নিবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত তো আর কোনো পরিবার খাবার তৈরি করেনা।

এদিকে তারা তাদের বেশি মানুষ আসার বিষয়টা নিজেরাই বুঝতে পারলো। তাই তারা বললো,
” আমাদের খাবারদাবারের দরকার নেই, আমরা শুধু মেয়ে দেখে চলে যাবো।

কিন্তু তা কে শুনে? আম্মু খুব খেয়াল করে সবার জন্য খাবার পরিবেশন করলো। আর সুন্দরমতো খাওয়া শেষ হতে না হতেই তারা মেয়ে দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলো।

আমার আম্মুও ভাবীকে ডেকে চললেন, আমাকে তাড়াতাড়ি সামনে নিয়ে যেতে।
আজকে তনয়ের অফিস ছিল, কিন্তু পাত্রী দেখতে দুদিন আগেই এইদিনের জন্য ছুটি চেয়েছিলো। সেও আজ এসেছে সবার সাথে আবার দেখতে!

এদিকে আমি নিজের রুম থেকে বের হতেই ড্রয়িংরুম থেকে অসংখ্য মানুষের গলার আওয়াজ পেলাম।
আর এসব শুনে মনে মনে ভাবছিলাম বংশের আত্মীয় স্বজন কাউকে আনতে বাদ রাখে নাই হয়তো!
আমার সাথে আম্মু ভাইয়া এবং ভাবী। আব্বু আগে থেকেই তাদের সাথে বসে আছেন। মাথা নিচু করে আমি ধির পায়ে গিয়ে বসে সালাম দিলাম।
তখনি জোর গলায় পরিচিত এক মেয়ে কণ্ঠস্বরে আওয়াজ আসলো,
” আরে আপু আপনি? মানে তুমি! কয়েকদিন আগে তোমাকে না শপিংমলে দেখছিলাম। আরে এই মেয়েটা তনয় ভাইয়ার বউ হচ্ছে? ওর চোখ, মা মা দেখেন ওর চোখ কতো সুন্দর!

আমি আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, কথাগুলো লিয়নের বউ বলছে। তার পাশেই আছে লিয়ন। আর লিয়নের বউ একজন আধ বয়সী মহিলার কাঁধ ধরে আমার চোখে দেখার জন্য ইশারা করছে। আমি চিনতে ভুল করিনি উনি লিয়নের মা।
আমি তাকাতেই উনি আবার তনয়ের মাকে ইশারা করে বললেন,
” আরে ভাবী আপনার পুত্রবধূর বাদামী চোখ! আমার কতো শখ ছিল জানেন? এমনকি খুঁজেছিও! ভাবতাম আমার ছেলের বউ এমন চোখের হবে, নাতিপুতিরাও এমন চোখ পাবে! আমার কাছে কিউট লাগে এই রঙের চোখ। আর মাশাল্লাহ পাত্রী তো সবদিকেই একদম ১০/১০। আজকেই বউ করে নিয়ে যান ভাবী! এমন মেয়ে পেলে আমি চোখের পলকে ঢুঁ মেরে নিয়ে যেতাম।

তনয়ের মা-বাবা বিজয়ের হাসি হাসছে, পাশে তনয়ের বড়বোন, খালাতো ভাই, আর তার চাচা বলে উঠলো,
” মাশাল্লাহ মেয়ে আমাদের সবার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

শুধু একটা মুখ ভারী, সেটা লিয়ন! আমি জানিনা সে জেনেশুনে আবারও কেন এখানে আসছে?
তবে এটা তো স্পষ্ট হয়ে গেলো, সেদিন সে আমার চোখকে নিজে থেকে অপমান করেছিলো।
তার কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজতেছে, সে বলেছিলো,
” নিবিতা আমার আম্মু কখনো তোমাকে মেনে নিবেনা, আমি তোমার ছবি দেখাতেই উনি বললো.. না না এমন বিড়ালচোখা মেয়েকে বিয়ে করালে আমার পরবর্তী প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে। বাচ্চাগুলোও এমন অদ্ভুত চোখ পাবে!

অথচ ওকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি, ওর তো মিথ্যা ধরা পড়ার লজ্জায় সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে যাওয়া উচিত ছিল। আবার সে কিনা খুব ভাব নিয়ে আমার বাড়ি এসেছে, আর এসে ধরাও পড়েছে!
তার কি মনে নেই? সেদিন সে সম্পূর্ণ মিথ্যে অজুহাত দিয়েছিলো, আমাকে দেখানো দূরে থাক, আমার কথা তার মা-বাবার সামনে উচ্চারণও করেনি!
তবুও সে এতটা নির্লজ্জের মতো কি করে এখানে আসতে পারে? কিসের এতো দুঃসাহস তার?

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here