বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ১৯ +২০

0
270

#বাতাসে_তার_সৌরভ–১৯–২০

” এই বুড়ি, এখন হাত ধুয়ে ফেল; মেহেদী ঠান্ডা জিনিস। কাশি বাঁধাবি”

” তুমি যাও তো আম্মু আমার সব বান্ধবীরা লাগাচ্ছে”

” তোর ঠান্ডার ধাঁত তুলে ফেল”

” ধুর!”

আট বছরের নদী রাগ দেখিয়ে মায়ের সামনে থেকে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও রক্ষা ছিলো না। মেহেদীর ভারে নড়াচড়া যাচ্ছে না, ওমনি বাবলুটা পেছন থেকে এসে.. ” ভোওঅঅ, এই নষ্ট হয়ে গেল এই গেল এই গেল…”

” বাবলু মার খাবি, ভাগ ”

” তুমি মার খাবা আমার নাম আছে না? তুমি বাবলু ডাকো কেন? আমার নাম অয়ন ”

“অয়ন পৃথিবীর কাছে আমাদের কাছে বাবলু ”

” তুমিও তাহলে বুড়ি”

” বাবলু হাবলু কাবলু কাবলু”

” বুড়ি, বুড়ি বুড়ি”

” বাবলু হাবলু… ”

বাবলুর আসল নামটা ডাকাই হতো না। বাসার নামটা তার ভালো লাগতো না। ছয় বছরের বাবলুর একসময় ধৈর্য জবাব দিয়ে দিতো রেগেমেগে ছুটে আসতো।নদীর হাত ভরা মেহেদী,পালানোর জন্য একমাত্র পথ বাথরুম। নদী হাত বাচাতে বাথরুমে গিয়ে ছিটকিনি লাগালো। বন্ধ দরজা ধরে ঝাকাচ্ছে বাবলু!

” আপু খোল আমি দরজা ভেঙে ঢুকে যাবো! তোমার মেহেদী লাল হবেন্না ..”

নদী বাথরুম বসে ভাইকে ভ্যাঙালো

” বাথরুমে ভূত আছে ঘাড় মটকাবে আপুউউউ”

দরজার বাইরে শাপ-শাপান্ত করে একসময়৷ বাইরে থেকে লাইট বন্ধ করে দিলো বাবলু…”দেখ ভূত আসবে।

নদীর মনে হলো বাথরুমের স্টোরেজ ক্যাবিনেটে আসলেই ভূত বোধহয়।ওপরের দিকের দেয়ালে লাগানো ছোট্ট দরজা মচমচ করে খুলে গেল।সাথে টপ টপ কলে পানির আওয়াজ, নদীর বুক কেঁপে উঠলো ভয়ে। আঁধারে দরজা হাতড়াচ্ছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। তিলতিল করে ঘামছে আটবছরের নদী। অন্ধকারে মনে হলো ওপরের স্টোরেজ ক্যাবিনেটের দরজা থেকে জমাট কালো আঁধার নামছে। এখনই গ্রাস করবে…
হঠাৎ বাথরুমটা হাস্নাহেনার গন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে,

মস্তিষ্কের স্নায়ুতে সুক্ষ্ম চাপা একটা ধাক্কা, এক মুহূর্তেই চোখ মেলে তাকালো নদী৷ হাল্কা হাল্কা শীত শীত চারদিকে, নাকে এখনো হাস্নাহেনার গন্ধ। নদী সোজা হয়ে বসল। নিজেকে যেখানে আবিষ্কার করলো, শুরুতে ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারল না। লম্বাটে সিরামিকের বিশাল একটা বাটি তার মাঝে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে নদী। চিকন ধারায় টপটপ করে পানি পড়ছে কোথাও।
নদীর সামনাসামনিই বেসিন। ধবধবে সাদা টাইলসে মোড়া দেয়াল। বাথরুমের ছোট জানালা দিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের বিশাল ঝাঁকড়া আমগাছের অংশ দেখা যাচ্ছে।

নদী পুরোপুরি উঠে বসে অদ্ভুত এই পরিস্থিতি সমন্বয়ে করার চেষ্টা করলো।
ধীরে ধীরে মনে পরতে লাগলো একের পর এক দৃশ্যপট। রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ভদ্রমহিলা ভদ্রলোকের সাথে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছেন।

” এই বেশ*** মা** আধাঘন্টার মধ্যে যদি বের না হয় তাহলে আমি পুলিশ ডাকবোই।সে যাবে তোকেও বেঁধে নিয়ে যাবে! ছাড়”

ঝনঝন করে কাচ ভাঙার আওয়াজ।
নদী ঘরের মধ্যে ভয়ে থরথর কাঁপছিল। বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিতে চাইছিলো কিন্তু বারান্দাও পাশাপাশি লাগোয়া।গভীররাতে মহিলার চিৎকার আশেপাশের সব ফ্লাটের মানুষই কান জাগ্রত করে শুনছে।
কম্পিত হাতে একবার নিশিকে ফোন দিতে গিয়ে কেটে দিলো। নিশি ওখানে বসে কী সাহায্য করবে? উড়ে চলে আসবে?কিন্তু আর কে আছে? রাবেয়া আন্টি! এক মুহূর্তে মবে পড়তেই দমে গেল নদী। এমনিতেই তার সাথে কথা বলা হয় না৷ এত রাতে নিজের স্বার্থে হঠাৎ ফোন করলে কি ভাববেন?

” বাইর হইসিস হারামজাদি…! ”

তীব্র চিৎকার শুনে নদীর হাতে আর অপশন ছিল না সাহস করেই রাবেয়ার নাম্বারে কল দিলো।
তিনি দেখা গেল তিনটা রিং এর মাঝেই ফোন তুললেন ;তবে স্বাভাবিকভাবে এত রাতে নদীর কন্ঠে যারপরনাই অবাক হলেন।
নদী সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেছে তিনি কতটুকু বুঝেছেন নদী জানে না। তবে তিনি আতঙ্ক নিয়ে বললেন,

” মাই গড দিস ইজ হরেবল। উফ আমি যে কেন আজ গাজীপুর এলাম! ঢাকায় থাকলে এখুনি রওনা দিতাম ”

নদীর আর কিছু বলার থাকল না। রাবেয়া একেবারে নিরাশ করলেন না,

“তুমি চিন্তা করো না কোনমতে রাতটা পার করো। আমি সকালেই একটা ব্যবস্থা করছি নিজেই আসব তোমাকে নিতে ”

নদী তর্কে গেল না।কখনো কখনো প্রশ্ন গন্তব্যের থাকে না, সাগরের প্রলয়েই নাবিকদের বড় পরীক্ষা। একটা ঘোরে পেয়েই নদী নিজের ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিলো।কোথায় যাবে জানে না৷ করুণাময় আজ যদি তার নিয়তিতে ধ্বংস লেখেন তাহলে তাই সই। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা আর করার কিছুই নেই। এক অর্থে গৃহকর্তা গৃহকর্ত্রীর সামনে দিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল নদী।
বাড়ির লিফট নিচে নামছিলো না নদীর ভেতরের গ্লানির ওজনে নেমে যাচ্ছিল সে বলতে পারবে না। সব কিছু ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো। নিশির সাথে বাসে করে ভাদড়া থেকে পালানোর আগে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো ভুলুটাকে বড় মনে পড়ছিল কেন যেন। ওই অবোধ পশুটার চোখে নদীর জন্য একটা চিন্তার ছায়া ছিল। আজ সেই দৃষ্টি কারো নেই।
লিফট নিচে এসে থামতেই ফোনটা যেন জীবন পেলো।রাবেয়া আন্টি!

” হ্যাঁ নদী, এখন সিনারিও কী মহিলা শান্ত হয়েছে?

নদী উত্তর দেয়নি রাবেয়া বুঝে গেলেন যা বোঝার
” লিসেন তুমি এখন একটু নিচে নামতে পারবে? আমি একজনকে পাঠিয়েছি তোমাকে একটা সেফ জায়গায় নিয়ে যাবে৷ ”

রাবেয়ার কথায় নদীর দ্বিধা কাটে না।
” ভয় পাচ্ছ জানি ট্রাস্ট মি,আমি গ্যাব্রিয়েলকে বলেছি সে তুষারকে পাঠিয়েছে। নিচে যাও আগে কাছাকাছি এসে তোমাকে কল দেবে সে। ”

নদী নিচে এপার্টমেন্ট রিসিপশনে বসে কিছুটা দ্বিধা নিয়ে অপেক্ষা করে যাচ্ছে।তুষার আজকাল সোজা মুখে কথাই বলছে না।বসের অর্ডারে আসবে নিতে? আর গ্যাব্রিয়েল নিজে কি ভাববে৷ এই মেয়েটা সবসময় এমন ভ্যাজালের মধ্যেই থাকে? ঝামেলাদায়ক একটা চরিত্রকে ভালো কোন সুযোগ কি দেবে বিদেশি এই মানুষটা? নদীর হাঁসফাঁস লাগছে, নিরাপত্তা ঝামেলা না থাকলে হয়তো গেট পেরিয়ে বের হয়ে যেতো। হিমুর মতো নিশাচর নগর পরিব্রাজক হওয়া যেত। এই শহর কিন্তু নদীর পানি খোলা ছাদে নষ্ট হয়ে যায়, তাতে ভ্রমণের অবস্থা থাকে না। নদী ওপরে যাবে না বেরিয়ে আসবে এই চিন্তার মাথাতেই আবার ফোন, তবে এইবার রাবেয়ার ছিল না। যার ছিল নাম পড়ে বুককেঁপে উঠলো।

নদী বাইরে এলে গ্যাব্রিয়েল নি:শব্দে গাড়ির দরজা খুলে দিলো।
তার ভাষ্যমতে সে বাইরেই ছিলো তখনই রাবেয়া আন্টির ফোন, নদী নাকি বিপদে।তুষারকে কল দিতে চেয়েছিল কিন্তু ভাবলো ঘুমন্ত মানুষকে বিরক্ত করা ঠিক নয়।
আজও গ্যাব্রিয়েল নদীর বিষয়টির আলাদা কোন ব্যখ্যা চাইলো না।সহজ ভাবে বলল,” এখন মেইন সমস্যা হলো তোমার থাকা তাই তো?
রাবেয়া আন্টির ফ্ল্যাটে তোমাকে দিয়ে আসা যেত কিন্তু তিনি চাবি নিয়ে গেছেন। সকালে জেরিনকে দিয়ে ভালো একটা উইমেন হোস্টেলের ব্যবস্থা হয়ে যাবে এখন একটা হোটেলে তোমার ব্যবস্থা করে দেই। সামনের ব্লকেই আছে খুবই ভালো। আমার ফ্রেন্ডরা এসেছিল ভিজিটে তারা…”

” আমি কোন হোটেলে যাবো না!”

গ্যাব্রিয়েল চমকে তাকালো, নদীর কন্ঠই এত আত্মঙ্কে ভরা ছিলো।

নদী নিজেকে সামলে বলেছিল,” আপনি আমাকে কষ্ট করে একটা বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে যান। যেখানে সাতক্ষীরার বাস যায় আমি বাসে উঠে যাই… ”

গ্যাব্রিয়েল প্রথমে বাসস্ট্যান্ড বিষয়টি বুঝলো না,পরে বুঝে তার বিরক্তি আর বিভ্রান্তি আরও বেড়ে গেল ” সামান্য ব্যপারেএ জন্য তুমি শহর কেন ছাড়বে?আর কাল থেকে ডিউটি করবে কে? আই মিন সিরিয়াসলি! এটা একটা ইনসিডেন্স মাত্র, ইউ ইনসেইন মেহরোজ?”

“আই এম হোমলেস স্যার” নদী বিড়বিড় করে বলল।

গ্যাব্রিয়েল বিরক্তি চেপে গাড়ি টেনে নিয়ে গিয়েছিল কোথায় কোথায় বলতে পারবে না। কী হচ্ছে না সে কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানে না। তবে কেন যেন মনে হলো সাথের চালক ভুল পথে নেবে না। চোখের ওপর ঘুমের লেই একাই এসে গিয়েছিলো। চেনা ছায়ার কাছাকাছি এসে ঘুমের লেইটা কেটে গেল।

” স্যার এখানে… ? ”

“কারণ আমার পক্ষে এর থেকে সিকিউর কোন জায়গা তোমার জন্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি, বাকি তোমার ইচ্ছে”
গ্যাব্রিয়েলের সহজ সাবলীল আমন্ত্রণ।

” একটাই সমস্যা দ্বিতীয় তলায় মেয়েদের যে স্টাফরুমটা ছিলো তা ভেঙে রেস্টুরেন্ট এক্সটেন্ট করা হয়েছে, অসুবিধা নেই আমার ফ্ল্যাট যথেষ্ট বড়, সো বি মাই গেস্ট, টু নাইট ”

এই আন্তরিক আহবানে নদী হঠাৎ জমে পাথর হয়ে গেল,পা দুটো অসাড়; মুখ সেলাই হলো। অনেক কষ্টে নিজেকে গুছিয়ে বলল,” সম্ভব না স্যার বিষয়টি অনেক জটিল ‘

” জটিল কেন? “গ্যাব্রিয়েল বিস্মিত।

নদী কিছু বুঝিয়ে বলতে গিয়ে থেমে গেল, এতো গুলো বাংলা এই লোক বুঝবেও না। শুধু বলল” না আপনার রেস্টুরেন্টের দুজন দারোয়ান এতরাতে আমাকে দেখার সাথে সাথে বিষয়টা জটিল হতে থাকবে”

” কেন হবে? আমি বুঝতে পারছি না”

” আপনার বাবা বুঝবেন ”

” বাবা বাসায় নেই, তিনি এক ফ্রেন্ডের সাথে কুমিল্লা গেছেন ”

” তাহলে আরও জটিল ” নদী হতাশ, এরপর বলল, ” স্যার আপনার রেস্টুরেন্ট স্টাফ কোনভাবে যদি জানতে পারে যে আমি রাতে এইখানে ছিলাম তাহলে সবাই বিষয়টা ভুল ভাবে নেবে ”

” হু আর দিজ “সবাই” হেয়ার? দোজ হু ডিডনট হেল্প ইউ আউট ফ্রম এনি প্রবলেমস রাইট?হোয়াই সুড দে জাজ ইউ ”

নদী তর্কের আশা ছেড়ে দিলো। গ্যাব্রিয়েল কি মনে করে গাড়ির মোড় ঘুরিয়ে দিলো। নদী তর্কে গেল না। ভাবলো জি এস হয়তো মন বদলেছে।এখন কোথায় নেবে জেরিন ম্যাডামের বাড়ি?সেটা তো উত্তরায়। একসময় সামনের গলি ঘুরে একটা চিকন গলিতে গিয়ে গাড়িটা থামালো গ্যাব্রিয়েল।
একটা দেয়াল বরাবর চিকন লোহার গেট।ছায়া দেয়া বড় বড় গাছ বাউন্ডারির ভেতরে । নদীর চিনলো জায়গাটা, এটা চন্দ্রমল্লিকার পেছনের সার্ভেন্টস এন্ট্রি ।

” তোমার তো মানুষ জানাতে সমস্যা তাই না? এইদিক দিয়ে এন্ট্রি নিলে কেউ জানতে পারবে না বাড়িতে কে ঢুকেছে”

“কিন্তু স্যার এটা ”

” এটাই বেস্ট অপশন মেহরোজ” জি এস হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো নদীকে
” নয়তো সারারাত আমায় তোমাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরতে হবে, কারণ হোটেল তুমি উঠবে না, আর আমি তোমায় একা ছাড়বো না”

গ্যাব্রিয়েল দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ভেতর প্রবেশ করলো ।নদীর তর্ক করার মতো শক্তি, ইচ্ছা কোনটাই শরীরে অবশিষ্ট ছিল না।পরিস্থিতির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নীরবে সিড়ি ভেঙে যেতে লাগলো।

সিড়ি ভেঙে তিন তালা বরাবর এসে গ্যাব্রিয়েল দরজার লক খুলল। গতবার নদী এই ঘরে প্রবেশ করতে পারেনি, সোজা উঠে গিয়েছিল ছাদে।

দরজা খোলা হলে এক ঝলকে ফুটে উঠলো নদীর বাবার স্টাডিরুমটা । বাইরে বড় গাছের ঘন ছায়া, ঘরে চারিদিকে জানালা ঘেরা ঘরটায় বাবা পড়াশোনা করতেন।থরে থরে ছিল বই। অন্যপাশের দেয়ালে লাগোয়া দরজার ওপাশে বাবা-মায়ের বেডরুম । সে দরজা স্লাইডিং ডোর বসে গেছে, গ্যাব্রিয়েল খুলে ভেতরে নিয়ে গেল নদীকে। একটা সুসজ্জিত বেড পেরিয়ে একটা করিডোর, একদিকে চলে গেছে হয় ড্রইং ডাইনিং ,অন্যদিকে সোজা গেস্টবেড।

” দেখলে তুমি এখানে এসেও পড়লে আর কেউ জানলো না। আর যারা জানবেই না তারা কথা বলবে কীভাবে? ”

নদী উত্তর দেয়নি। গ্যাব্রিয়েলের হিসাব এত সহজ হলেও পৃথিবীর নিয়ম এত সহজ না। মুখরোচক সত্যি আর আগুন ধামাচাপা দেয়া যায় না। তবে সত্যিটা কি নদী নিজেও জানে না

” ওকে এখন প্যানিক কমাও, রেস্ট নাও বি কম্ফোর্টেবল। আমি গাড়িটা গ্যারেজে পার্ক করে আসছি ”

গ্যাব্রিয়েল দক্ষ হোস্টের মতো এক গ্লাস পানি ঢেকে রেখে বাথরুমটা দেখিয়ে চলে গেল। গ্লাস হাতে নিয়ে নদীর ভেতর শুরু হলো অন্য রকম ভয়। এতে কিছু কি মেশানো? বাইরে থেকে কেউ জানে না নদী এই বাসায়, তাহলে একা পেয়ে জিএস কিছু যদি করে-টরেও ফেলে তাহলেও কেউই জানবে না। করবে না বলাও যায় না আমেরিকার সাহেব মানুষ, এদের জন্য এইসব কুকুর বেড়ালের মতো ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড ডাল-ভাত ধরনের বিষয়। কিছু হলে নদী যদি কিছু বলতে চায় তাহলে প্রশ্ন আসবে নদী এত রাতে এখানে করছিলো কী?আচ্ছা জি এস এই ঘরে যদি তাকে আটকে রাখে?

একাকীত্বের সাধু পুরুষও ভয়ংকর হয়ে যায়,জিএস যদি সাইকো হয়? আর যদি বেরই হতে না পারে? ভয়ে নদীর হাত-পা পেটে সেধিয়ে যাচ্ছে। নদী দরজা ল্পক করলো, এরপর মনে হলো যদি ইয়েললক হলে তো সব দরজার চাবি গৃহস্বামীর কাছে থাকার কথা।

তাই দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো, এরপরেও নদীর ভয় কাটলো না । আশ্রয় নিল বাথরুমে,কেউ ঘরে আসতে হলে প্রথমে তাকে দরজা খুলতে হবে তারপর বাথরুমের দরজা খুলতে হবে। আচ্ছা বাথরুমের চাবিও নিশ্চয়ই তার কাছে আছে। নদী বাথরুমে ঢুকে সবগুলো ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। একটা বেডরুমের দরজা খুলতে সে কিছুটা ক্লান্ত হয়েছে যাবে, এতরাতে বাথরুমের ছিটকিনি নিয়ে গুতাগুতি করবেন না মনে হয়। গ্যাব্রিয়েল গাড়ি পার্ক করে কখন ঘরে এলো দরজায় টোকা দিলো কি না কিছুই বুঝলো না। নদী ভয় আতঙ্কে সিটিয়ে থেকে একসময় স্থান করে নিলো বাথটাবে।

যেখান থেকে কখন চোখের পাতা ভারী হয়ে আসলো টের পায়নি। সকালে উঠে বসতেই সারা শরীরে ব্যথা ব্যথা করছে। শক্ত তলের ওপরে দীর্ঘক্ষণ শরীর রাখার ফল , নির্বিঘ্নে সকাল যেহেতু হয়েছে গ্যাব্রিয়েল মানুষটাকে নিরাপদ বলা যায়। আর যদি ভাবগতিক উল্টা পালটা দেখে স্বাভাবিক থেকে আড়ালে নিশিকে ম্যাসেজ করতে হবে।

আপাতত নদী সহজ ভাবে মুখ হাত ধুয়ে নিলো।বাস পেলো না আঙুল দিয়ে পেস্ট লাগালো দাঁতে। বিচিত্র অবস্থা, মনে একদিকে ভয়, অন্য দিকে নিজেকে নিয়ে খুঁতখুঁত; এতদিন কেতাদুরস্ত ইউনিফর্ম সামান্য সাজসজ্জা নিয়েই গ্যাব্রিয়েলের সামনে যেত। আজ ক্লান্ত, অবসন্ন, একরাতের অঘুমো ঝড়োকাকের রূপে জিএস তাকে দেখে মনে করবে সে হেমায়েতপুর থেকে পালিয়ে এসেছে।

মুখ ভোঁতা করে ঘর থেকে বেরোতেই আলোতে অনেকটা চোখ ধাঁধিয়ে গেল।দেয়াল ঘড়িতে সকাল পোনে আটটা। মাত্র! বেশ আশ্চর্য লাগল। নদী যখন এই বাসায় এসেছিল তখন রাত দেড়টার কাছাকাছি। সকালের আলোতে গোটা বাড়ির রূপ অন্যরকম লাগছে। মনেই হচ্ছে না এখানে কোন ভুল মানুষ থাকতে পারে। নতুন আল্ট্রা-মর্ডান ফার্নিচারে অসম্ভব ঝকঝকে ফ্ল্যাট বাড়ি, দুই পাশের দেয়ালে সাদা আর নীল রঙের কন্ট্রাস্ট। তাতে সুন্দর ফ্রেমকরা এবট্রাক্ট পেইন্টিং । তবে জানালাগুলো এখনো আগের মতো বড় বড়। দুই লহরের পর্দার ভারী অংশ টেনে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।হাল্কা নেটের পর্দা দিয়ে ঢুকছে সোনালি আলো।

পুরনো মোজাইকের মেঝে ভেঙে ঝকঝকে হাল্কা নীল গ্লাসি ফ্লোর টাইলস বসানো। সাদা লেদারের সোফা, রূপালী মেটালের চেয়ার দেয়া নীলচে কাচের ডাইনিং টেবিল।

মনে পড়ে নদীর মাও খুব পরিপাট্যতা পছন্দ করতেন। তবে নদী আর বাবলু কতো এলোমেলো করতো সারাদিন। ছুটির দিন সকালে উঠে ভাই-বোনের কোন না কোন কারণে মারামারি শুরু হয়ে যেতো । সেই ছোটাছুটির মধ্যেই নাকে হানা দিতো রসুই থেকে ভাজি বাগাড়ের গন্ধ , ভাজা ডিম, ঘিয়ের পরোটার সুবাস…।

ঘিয়ের পরোটা নয়, তবে সত্যি তপ্ত মাখনের সৌরভ এখনো নাকে হানা দিচ্ছে। রসুইঘরের ঝঙ্কার বলছে গৃহকর্তা উঠে গেছেন।
ড্রইং ডাইনিংয়ের মাঝে এখন আর দেয়াল নেই নকশাদার কাচের ফোল্ডিং ডোর আছে।সেটা ভাঁজ করে রেখে আপাতত লম্বাটে স্পেস তৈরি করা। একেবারে শেষ কোণায় কিচেন। একদিকে কোন দেয়াল দরজা নেই, একেবারে খোলা; তাই মায়ের রসুইয়ের মতো দরজার আড়াল থেকে উঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।

শুরুর দিকে একটা মদ খাবার বারের লম্বাটে কাউন্টার টেবিল সেখানে ডাইনিংমুখী দিকে গোল গোল রিভলভিং চেয়ার পাতা, মানে অল্প মানুষের জন্য কিচেনেই খাবার ব্যবস্থা । ভেতরের কিচেনে গ্যাব্রিয়েল ঝড়ের গতিতে একাগ্র হয়ে উনুন সামলাচ্ছে। ছোট ওভেনে কি বেক করতে দিয়েছিলো সেটা বের করলো। মানুষটা রাঁধতে সময় যেন আর কারো খেয়ালই রাখেন না। একমনে শিল্প গড়ে একসময় দয়া হলো সুপারশেফের,

” গুড মর্নিং মেহরোজ, নতুন জায়গায় রাতে গুম হইলো” নদীকে দেখে সরল ভাবে হাসলো।

” গুম.. জি স্যার”

” ভেরিগুড, এখন ব্রেকফাস্টটা সেরে ফেলো।তোমাকে তো ক্লাসের জন্যও বের হতে হবে”

গ্যাব্রিয়েল কথাগুলো বলতে বলতে খুব সাবলীলভাবে নদীকে তার ব্রেকফাস্ট প্ল্যাটার গুছিয়ে এগিয়ে দিলো, সাথে ম্যাঙ্গো জুস।
নদী তাকিয়ে আছে জিনিসগুলোর দিকে। না, এখন আর রাতের ভয় তাড়া করছে না। খাবারের পরিমাণ দেখে অবাক। সকালে উঠে এটা একান্ত হাতির খাবারই হতে পারে। জিনিসগুলো কি তাও বুঝতে পারছে না।

” বেকড বিনস, টোস্ট, মাশরুম, বাটার ম্যাশড পটেটো, বেকন এগস, এন্ড ব্ল্যাক পুডিং” নদীর দ্বিধা দেখে রম্য নিজেই হাসিমুখে বলল ” গ্যাব্রিয়েলস কিচেন ছাড়া বাড়িতেও একটা মেনুবুক আছে আজকের মেনু হলো অথেনটিক ইংলিশ ব্রেকফাস্ট। যদিও গেস্টের মতামত নেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দেখলাম তুমি ঘর লক করে ঘুমাচ্ছ তাই নিজের দায়িত্বেই রেডি করে ফেললাম। আশা করি তোমার পছন্দ হবে”

গ্যাব্রিয়েল নিজের মতো করেই বলে চলেছে। নদী ইংরেজি শব্দগুলো কানে ভেঙে অনুবাদ করতে করতে দেরি করছে।

গ্যাব্রিয়েলের অভয়ে বিনগুলোর চামচে করে মুখে দিলো। সস আর অল্প মশলায় রান্না করা জিনিসটা সিমের বিচির মতো, মন্দ নয় । তবে সকালে এই জিনিস খেয়ে সে অভ্যস্থ নয়। ডিম পোচ আধাকাঁচা নদীর ভালো লাগে না ; কিন্তু স্বয়ং বসের তৈরি বলে সোনামুখে খাওয়া বাঞ্ছনীয়। নদীর ভূত মার্কা চেহারা দেখে সকালে হয়তো মানুষটা এমনিতেই বিরক্ত। নদী কাটাচামচ দিয়ে পোচ ডিম ভাঙছে, কুসুম ছড়িয়ে যাচ্ছে প্লেটময়, ভালো যন্ত্রণা!

রম্য মনোযোগ দিয়ে দেখছে নদীকে। ঘুম থেকে উঠে মেয়েটার এখনো দ্বিধা কাটেনি। মজার ব্যাপার হলো সকালে তাকে ঠিক চেনা যায় না। ইন্ডিয়ান অলিভ কালার রঙ স্বাভাবিক সময়ের থেকে উজ্জ্বল লাগে, চোখ মুখ ফুলে আছে তবে সুন্দর লাগছে। সতেরো আঠেরোর মেয়েগুলোর মধ্যে একটা প্রাকৃতিক সজীবতা থাকে । দেখতে ভালো লাগে।

” ব্ল্যাক পুডিংটা ট্রাই করো ”

“ব্ল্যাক পুডিং? ” নদী প্রশ্ন নিয়ে প্লেটের দিকে তাকালো।

” এই যে এইটা গোলমতন কালচে স্লাইস মাংসের কিমা দিয়ে বানানো ”

নদী আগ্রহ নিয়ে ভাঙলো একটা অংশ, দূর থেকে দেখে কেকের মতো লাগছিল। কিমা দিয়ে পুডিং হয় এটাই জানা ছিল না। পুডিং বলতে ডিম আর দুধের কিছুই জানতো।
রম্য মাথা নেড়ে বলল” ইংলিশ রেসিপির মধ্যে এটাতেই সবচেয়ে বেশি মসলা দেওয়া হয়, মাংসের কিমা, ওটস, মেজ, ফ্লেবারড স্পাইস, এন্ড ব্লাড ”

” এন্ড কী? ” নদী টুকরো মুখে নিতে নিতে থেমে গেল।

” ব্লাড.. পর্ক ব্লাড!” রম্য নির্বিকার।
নদী আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে হাত থেকে চামচ পড়ে গেছে। পেটের থেকে মনে হচ্ছে নাড়িভুঁড়ি সব উল্টে আসছে।এই জিনিস পাশে রেখে সে এতক্ষণ খেয়েছে! গলা দিয়ে চি চি করে প্রশ্ন,

” এইটাতে কী দেয়া? ”

রম্য হা হা করে হাসছে, “গট ইউ! কিচ্ছুই দেয়া নয়, এটা কেক ”

” হ্যাঁ? ”

” সিরিয়াসলি এটা কেক, স্মেল করে দেখ।সিম্পল চকলেট কেক স্লাইস। ব্ল্যাক পুডিংয়ের আদলে বানানো সাদা অংশ গুলো আমণ্ড নাট। ”

নদী সন্দেহ নিয়ে নাকে শুকে দেখলো আসলেও কেকের গন্ধ।

” সেদিন হাতের কেক দেখিয়ে আমাকে ভড়কে দিয়েছিলে, আজ ভাবলাম শোধ নেই।”

নদীর তখনও বাকরুদ্ধ। রম্য স্বগতোক্তি করলো,

” মেহরোজ আমি হালাল খাই, আমার নাম গ্যাব্রিয়েল সামদানী রিমেম্বর?আমার তৈরি খাবার কেউ চোখমুখ শক্ত করে মুখে দিলে আমার বিরক্ত লাগে। তার সাথে একটু মজা করি তা ছাড়াও আজ দিনটা সেলিব্রেশনের ”

” সেলিব্রশন ”

রম্য এর সরাসরি উত্তর দিলো না।সেও ব্রেকফাস্টে বসে গেল নদীর সাথে। এরপর খাবার পর্বে ততটা কঠিনও ছিল না। যদিও রান্না ভালো কি মন্দ বিচার করার অবস্থা নেই, কারণ নদীর কাছে সবকিছুই নতুন। তবে নি:সন্দেহে বাবুর্চির আন্তরিকতা অসাধারণ।

” তোমাকে আজকেই কাছের একটা লেডিস হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দেবে জেরিন, সো বি ইজি, সব ঠিক হয়ে যাবে”

নদী সহজভাবে হাসলো । তার এমন যাযাবরের জীবন দেখে কোন বাঙালি ছেলে কি এভাবেই কথা বলতো? টুকটাক কথায় খাবার সারলো দুজন। নয়টায় টিউটোরিয়াল, এবার নদীর কলেজে যাবার পালা। তার হাতের ব্যাগে কাপড় ভরা।কলেজে মতো নেবার তেমন কিছুই নেই। বইখাতা নোট সবই ওই বাড়িতে।
রম্য একটা ব্যাগ এনে দিলো সাথে দুটো নোটবুক আর কলম।

“আমি তোমার অস্বস্তি বুঝি তবে তোমাকে বুঝতে হবে যে মানুষ মাত্রই সমস্যায় পড়ে। আর সমস্যায় একজন মানুষই আরেক মানুষের পাশে দাঁড়াবে।আজ তুমি সাহায্য নেবে কাল অন্য কাউকে তুমি সাহায্য করবে,তাই সাহায্য নেওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই, সাহায্য করার মধ্যেও কোন বাহাদুরি নেই ”

পেছনের সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিদায় বেলায় রম্যের ঘাড়ে হাত রেখে বলা কথাগুলো যেন বোঝা নামিয়ে দিলো। প্রাতঃরাশ সেরে নিয়মমাফিক গৃহকর্তারই স্বয়ং বিদায় জানানোর কথা।তবে অতিথির লোকজ মঙ্গল বুঝে তিনি এলেন না, বাইরের গেটের দারোয়ানদের কথায় ব্যস্ত রাখতে সেদিকে নেমে গেলেন । নদীকে পেছনের গেটের চাবি দিয়ে দিলেন। গাছের আড়ালে ঢেকে থাকা সিড়িঘর দিয়ে নদী নেমে গেল নিচে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু কথা,

” সোহরাব স্যার রাতে কুমিল্লা কেন গেলেন?

“বন্ধুদের সাথে হ্যাঙাউটে আছেন ”

নদী এই ইংরেজির তর্জমা করতে পারলেও অর্থ বুঝলো না।বুড়ো বাবাকে নিয়ে ছেলে ততবেশি বিচলিত নয়। হয়তো নদীর প্রশ্ন করাটাই ভুল। গ্যাব্রিয়েল নিজে তাকে তেমন প্রশ্ন করে না। বিলিতিরা প্রাইভেসি খুব মেনটেন করে,তাই সব প্রশ্ন তাদেরও করা যায় না। তবে প্রশ্ন এসে যায়। ঘটনাক্রমে বসের ব্যাক্তিগত জীবনের একটা ঝলকের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে এই যোগাযোগটা কি সুদূরপ্রসারী নাকি ক্ষণিকের স্থিরতা নদী জানে না তবে কৌতূহল একাই জন্ম নেয়। কেন ঘুরেফিরে এই পুরাতন আশ্রয় তাকে টেনে নিচ্ছে?

চন্দ্রমল্লিকার পেছনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর খেয়াল হলো সে ক্রমে বাড়ির ছায়া থেকে সরে সরে যাচ্ছে। ভেতরে কেমন অসহায় অনুভব হচ্ছে। গ্যাব্রিয়েল বলেছিলো আজকের মধ্যে জেরিন ম্যাম ব্যাবস্থা করে দেবেন। যদি না দেন?আজ কোন ঠিকানায় ফিরবে?

” এই তোমার ইনহেলার! ”

চিন্তার জাল ছিড়ে নদী থেমে গেছে। সামনের একটা লাল ছোট গাড়িটা জেরিন ম্যামের। জানালা থেকে মাথা বের করে ডাকছে যাকে, সে অনেক আগে চলে গিয়েছিল। ফিরে তাকাতে তাকাতে নদী চিনলো সোহরাব সামদানী।জেরিন গাড়ি থেকে বেরিয়েছে। নদী দ্রুত কারেন্টের টাওয়ারের আড়ালে চলে গেল । এত সকালে এরা দুইজন তাকে বাড়ির আশেপাশে দেখলে প্রশ্ন অবশ্যই করবেন।

” এই নিয়ে তিনটা ফেলে এসেছ আমার বাসায়”

“আমার কি যে হবে তোমাকে ছাড়া “সোহরাব সাহেবের গাঢ় কন্ঠ।

” হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুল ধরা পড়লেই ডায়লগ শুরু”

জেরিন হাসছে। আড়ালে দেখা যাচ্ছে সোহরাব জেরিনের গালে হাত রেখে মাথা নামিয়ে কানের কাছে কিছু বললেন। জেরিন খিলখিল করে হেসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো । কারেন্টের টাওয়ারের পেছনে নদীর চোয়াল ঝুলে আছে। সোহরাব সাহেব নাকি কুমিল্লায়? অন্তত জিএস তো তাই জানে! তাহলে জেরিনের বাসায় ইনহেলার কেন? কে এই জেরিন, সোহরাব সামদানীর ছেলের বয়সী প্রেমিকা?আচ্ছা, কোন আজিব দুনিয়ার মানুষ এরা?
*******
পর্ব –২০

” থাই চিলি চিকেন ইজ রেডি স্যার”

সুসজ্জিত ডিশটার ফ্লেবার দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে। সব দেখে সালেম সরু চোখে, শুকনো মুখে বলল,” একমিনিট লেট, যাক উন্নতি হইসে ”

নদীর মুখ কালো” এইবারে তো মনে হয় অনটাইম হইসিলো”

” অনটাইম পারফেক্ট ডিশ আসতে দেরি আছে। আরো সুইফট হইতে সময় লাগবে৷ গতির থেকে বড় হইলো টেস্ট কন্ট্রোল৷ টেস্ট ঠিকাছে। লেবুর খোসা সরায় ফেল৷ ওইটা থাকা যাবে না। খানেওয়ালারা ফ্লেবার পাবে কিন্তু ফ্লেবারের উৎস যেন ধরতে না পারে সব রান্নায় কিছু রহস্য রাখতে পারে যে, সেই সেরা বাবুর্চি৷ ”

সালেমের কথায় মাথা নাড়লো নদী। আজ তিন সপ্তাহ হতে চলল সে গ্যাব্রিয়েল কিচেনে এসেছে। ঘরোয়া রসুই সামলানো থেকে এমন অভিজাত রেস্তোরাঁর দায়িত্বের বিশাল তফাৎ। তবে একাগ্র ছাত্রী পেয়ে সালেমভাই দ্রুতই তৈরি করছেন তাকে৷ সেইসাথে কাজের গতির সাথে নদীর বদলেছে জীবনের গতিও। সেইদিনই তার নতুন বাড়ির একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিন্তু হোস্টেল নয় এটাও সাবলেটে।

” চাইলে পশ দেখে একটা হোস্টেলে তোমার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম, কিন্তু তুমি সেগুলোর খরচ কুলাতে পারতে না। কাজেই এইখানেই ভালো।একা সারাদিন তো বাইরেই থাকবে। রাতে এসে শুধু ঘুমানো তোমার জন্য পারফেক্ট। ”

জেরিনের কথায় নদী উত্তর দিলো না। মূলত কিছু সত্যি থেকে পর্দা সরে গেলে হয়তো যুক্তি সম্মত কথাও বাঁকা শুনতে লাগে।জেরিনিকেও তার মুখোশধারী লাগে।আর এই নতুন ঠিকানাটাও নদীর সুবিধার মনে হয়নি৷ ডিউটি করে রাতে এসে তার ক্লাসের পড়াও পড়তে হয়। সেটার জন্য নিরিবিলি নীরবতা দরকার। নতুন সাবলেটের মেয়েগুলোকে বেশ উগ্র
।পাশের ঘরে সব সময় উচ্চস্বরে চিৎকার হতে থাকে, আর তার রুমমেট সারাক্ষণ ফোনের ভিডিওতে নাচ রেকর্ড করতেই থাকে, সাথে অদ্ভুত সাজসজ্জায় ঘুরে বেড়ায়। এর পাশে কতক্ষণ ভালো থাকবে নদী জানে না।

” সব জেরিনের মাতব্বরি, আমার সামনেই রম্য স্পষ্ট বলে দিয়েছিল যে সবচেয়ে ভালো এবং এক্সপেনসিভ হোস্টেলে যেন তোমার ব্যবস্থা করা হয়। সেটা খরচ নিয়ে ওর এতো মাথা ব্যথা কেন?”

সব জেনে রাবেয়ার আস্ফালনে নদী প্রত্যুত্তর করতে পারেনি। তবে ভেতর ভেতর বেশ কিছু জটপাকানো ঝামেলা টের পেয়েছে। তাই নদীরও ইচ্ছে হয়নি সেই রাতে সে কোথায় ছিল রাবেয়াকে এটা জানাতে অথবা সোহরাব সাহেবের বিষয়েও কিছু বলতে৷ তার এই মুহূর্তে শান্তি মতো পড়াশোনা আর চাকরি দরকার। কাজেই কিছু বিষয়ে আপাতত মুখে কুলুপ এঁটে থাকা ভালো।

নদীর বাড়ি স্থানান্তরে শানুখালা ফিরে এসে বেশ চটলেন, একঝাঁক ঝগড়া করতেও উদ্যতও ছিলেন কিন্তু নদীই বাধা দিলো।ওইদিকে গেলে আবার গ্যাব্রিয়েলের সাহায্যের কিছু যদি জানে,কী দরকার? এখন নিশির পাসপোর্টের সমস্যা কেটেছে। যাবার আগ পর্যন্ত দেশে থেকেও মায়ের সাথে জায়গায় জায়গায় বেড়াচ্ছে।একা নদীর একটা কোন রকম বাড়ি হলেই হয়।

যদিও ক্লাসের চাপ আর সাবলেট বাড়ির চেচামেচির মাঝামাঝি স্নিগ্ধ বাতাসের মতো গ্যাব্রিয়েল কিচেনের পরিবেশ তাকে সতেজ করে। তবে সুক্ষ্ম পাকা জোহরীর নজর এড়ায় না।

” তুই কিছু লুকাচ্ছিস নাকিরে নদু? আই গেস সামথিং হেপেনিং টু ইউ বেইব, তোর মধ্যে কেমন চোর চোর ভাব লাগে কেন? “নিশির ফিচলে হাসি দেখে বিরক্ত হয়েছে নদী।

” চোর চোর ভাব মানে? ”

“না মানে মনে হয় তুই চুরি করে কিছু খেয়েছিস ধরা পড়ার ভয়ে ফাঁকে ফাঁকে আছি, ওই, বাবুর্চির সাথে মেক আউট করে ফেলেছিস নাকি রে? ”

” নিশি একটা লাগাবো ”

” আমাকে লাগাবি কেন, ছি কী নোংরা কথা বড়োবোনকে”

নদী আশা ছেড়ে দিলো। তবে নিশিকে দেখে ভালো লাগলো সে আগের থেকে অনেক শক্ত। যেন এক নতুন নিশি যার কারিগর শানুখালা।

তবে নতুন পরিচয় নদীরও আছে যার কারিগর গ্যাব্রিয়েল কিচেন।নিয়মিত চর্চায় থাই অনেকগুলো আইটেম নদী এখন ভালো পারে।কিচেনে সালেমভাইয়ের সাথে একরকম অভিজ্ঞতা হয়,আর বৃহস্পতি শুক্রবারে জি এস যখন থাকে তখন অন্যরকম একটা অনুভব৷

যদিও জিএস কিচেনে থাকলে সাধারণত তার সাথে সালেমভাইই এসিস্ট্যান্ট থাকেন। এই সময় সালেমভাইকেও যেন হিংসা হয় নদীর। কিন্তু অতদূর যেতে গেলে হয়তো আরও ধৈর্য প্রয়োজন৷

গ্যাব্রিয়েল যেদিন কিচেনে দায়িত্বে থাকেন না সেদিনও নিয়মিত টহল দেন পুলিশের মতোন৷ হুটহাট কোন শেফের প্ল্যাটার তার নজরদারিতে পড়ে যায়৷ কখনো পরিমাণ মতো তুলে মুখে দেন চোখ বন্ধ করেন, ” সব ঠিক ছিল কিন্তু চিকেনটা ওভারকুকড, হাইফ্লেমে বসিয়েই ঝামেলা করে ফেলেছ চিকেনের মধ্যে ময়শ্চার নেই। ”
সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য যে এতদিনেও নদীর কোন আইটেম চেক করেননি। হয়তো নদী সেই পর্যায়ে এখনো যায়নি। তবে কাজের মাঝে নজরদারির আওতায় সেও আছে এটা বুঝতে পারে দূর থেকে। কখনো স্থির দৃষ্টিতে নদীর ঝড়ের গতিতে সবজি চপিং দেখে আবার কখনো তার আইকনের শেফের নকলে সসপ্যানের খাবারগুলো হাওয়ায় খেলানোর চেষ্টা দেখে চাপা হাসেন।অনেকটা ছোট্ট বাচ্চাদের কর্মকাণ্ড দেখে বড়োরা যেমন হাসে।

সত্যি বলতে এই কিচেনে জিএস মানুষটাকে সবাই বেশ ভয়ই পায়, তবে স্বস্তি লাগে যে একই মানুষ অন্যরূপটাকে একটু হলেও নদী চিনছে । রন্ধন ক্রিয়ায় নদীকে আরও নিখুঁত করতে এই মানুষটার আলাদা পদ্ধতি আছে, সেখান থেকে নদী কতটা শিখছে বলতে পারবে না তবে সবার অজান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে রেশম সুতার প্রায় অদৃশ্য জাল।

কিন্তু কিছু বাধাও আছে, রেস্তোরাঁয় রাজিয়া, জেরিন.. তবে আপাতত প্রধান বাধা সাতক্ষীরা। গ্যাব্রিয়েল কিচেনে চাকরির পুরো বিষয়টি তাকে গোপন রাখতে হচ্ছে। তার ওপর সামনে আসছে বিয়ের একটা অনুষ্ঠান। বড়োমামা ঘন ঘন ফোন দিচ্ছেন, কিন্তু নদী করে তো করে কি?

“শুনলাম নতুন বাসা খুব কাছে?”
তুষারের আন্তরিক কথায় নদীর অবাক লাগলো।

” কয়েকটা দিন টেনশন চলতেসিল বুঝলা, বাড়ি মা অসুস্থ ছিল তো, সময় দিতে পারিনি, এখন প্রতি দিন সাথে নামাতে পারব ”

” হাঁটার দুরত্ব তুষার ভাই কাউকে লাগবে না”

” আমার তো লাগবে, ” তুষারের গাঢ় কন্ঠ পাত্তা না দিয়ে কাজ গোছালো। কয়েকদিন ফাঁকে থেকে আবার মাথায় কী ঢুকেছে কে জানে,আজকাল যেচেই আসছে কথা বলতে। মাথায় কোন মতলব আছে নাকি কে বলতে পারে? ওই বাচ্চাদের সাথে সেদিন দেখা হবার কথাটা এখনো সোহরাব বা গ্যাব্রিয়েলকে বলা হয়নি। সাবধানে বলতে হবে যেন বিশ্বাস করে। নদী তুষারের এই চিন্তা পাত্তা না দিয়ে কাজ গোছালো। আজ বৃহস্পতিবার কাল
আরেকটা ভ্যাজাল যা তাকে সামাল দিতে হবে। সব সঠিক প্ল্যান মতো হলেও হয়।

প্ল্যান গোছানোর আগেই পরেরদিন সময়মতো রানুখালা আর বড়োমামা উপস্থিত। তারা এসেছেন দুইদিন আগেই, রানুখালা ছেলের বিয়ে উপলক্ষে শপিং করেছেন। রানুর স্বভাব চরিত্র জেনে বাকি ভাইবোন তার কোনঅনুষ্ঠান আয়োজনে দূরে থাকেন । শানুখালাও খুব সাবধানে কন্যা নিয়ে চিটাগং চলে গেছেন ; বিয়েতেও আসবেন না। একমাত্র আশ্রয়দাতা ধৈর্যশীল বড়োমামা। রানু একা সব যোগাড়যন্ত্র করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বোনঝিকে নিতে এসেছেন,

” তো নদী কাপড় গুছানো হইয়েসে? সব দেইখে নে,আমাদের রাতের গাড়ি কিন্তু ”

” খালা আরেকটা যে সমস্যা হয়েছে, সামনে আমার কয়েকটা আইটেম পড়ে গেছে ”

“তা পড়ুক ,তোর সমস্যা কী?

” খালা বোঝনি আমার পরীক্ষা সামনের সপ্তাহ থেকে ”

” যখনই আসি তখনই পরীক্ষা? তোর শামীম ভাইয়ের যে বিয়ে সেটা কিছু না? হ্যাঁ এত্তগুলোন লোকের সামাল দিতি হবে, রান্নাবান্না, তার সাথে ওই বুড়ির বেইড়েসে পাগলামি তুমি এইখানে বসে বসে পরীক্ষা মারাচ্ছো ”
নদী হতাশ হয়ে তর্ক ছেড়ে দিলো, কিছু মানুষের নিজের স্বার্থ আর সুবিধা বাদে অন্য কিছু ভাবার ক্ষমতা আল্লাহ দেন না।

বড়োমামাও বোনের সাথে গলা মেলালেন ” তাই তো তুই তো আমাদের আগে বলিস নি তোর পরীক্ষা ”

” তোমরা কি আগে জিজ্ঞেস করছিলে মামা? শামিম ভাই এলো আর তার বিয়ে ঠিক করে দিলে। এইদিকে আমার অনেকগুলো টাকা প্র্যাকটিক্যালে খরচ হয়ে গেছে পরীক্ষা না দিলে সেমিস্টারে মার্ক কমে যাবে, ফেল করলে আবার পরীক্ষা দেয়া লাগবে সেই খরচ আলাদা। দেখ এরাও এখন এসেছে গ্রুপ স্টাডি করতে ”
তৃষা আর সুবর্ণা চলে এলো তখনই । বক্তব্যে তারাও নদীর সাথে তাল মেলালো,

মোজাফফর হোসেন সাহেব এবার দমে গেলেন, পড়াশোনার দোহাই দিলে জোর করা সমীচীন নয়। নদী বুঝলো আরেকটু লড়ে গেলে প্রতিপক্ষ পরাস্ত।গ্যাব্রিয়েল কিচেনে সবে নিজের অবস্থান পোক্ত করছে, এখন নদী কিছুতেই যাবে না সাতক্ষীরা।তার গোয়ার্তমি দেখে রানুখালাও দুর্বল পড়ে গেল, অসহায় হয়ে বললেন,

“তাহলি কী হবে ভাইজান?

“কী আর হবে যাতি পারবে নানে, “তুই ভয় পাচ্ছিস কেন, আমরা সবাই তো আছিই মঞ্জুরের বউ আছে, তোর ভাবি আছে”

নদীর মনে হলো পরিস্থিতি কায়দামতো হয়েই এসেছে, সে সান্ত্বনা দিয়ে বলল “আমিও আসব ইনশাআল্লাহ পরীক্ষা শেষ করে বিয়ের পরদিন বৌভাতের আগে আগে। ”

” হ্যাঁ এইসো মহারানী, দাওয়াত খাতিই তো আসবে। আমি কি কোন উপকার কইরেসি নাকি যে আমারি সাহায্য করবে?” রানুখালার মাথায় তখনো তেলে-বেগুনে বাগাড় কমেনি৷

নদী উত্তর দিলো না এর মাঝেই মুঠোফোনে একটা উড়োচিঠি,

” মেহরোজ তুমি ঘরে ?”

” জি স্যার ”

” আমি তোমার এপার্টমেন্টসের নিচে ”

নদীর আত্মা উড়ে গেল,” কেন? “মোবাইলে কথাটা লিখে মুছে ফেলল ।মাথা তুলে বড়োদের বলল “নিচে একটা ডেলিভারি ম্যান এসেছে আমি দেখে আসি। ”

তীব্র ভয় আর চাপা উত্তেজনা নিয়েই নদী নামলো নিচে। অলিখিত এই জালের নাম কি দেবে জানে না। কিছু দুর্বোধ্য কিন্তু আকর্ষণীয়। কিচেনে কর্তব্য পালনে কড়া হলেও কিচেনের বাইরে জিএসের অন্য একটা রূপ যাতে নদী অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। যে তার খেয়াল খবর রাখে,নিয়মিত টুকটাক ম্যাসেজ দেয়। আগে যেটা সোহরাব সাহেব করতেন বাসায় পৌঁছেছে কি না, শরীর ভালো কি না। সমস্যা হলো সোহরাব সাহেব যখন এই দায়িত্ব পালন করতেন একটা স্নেহই ছলকে উঠতো, কিন্তু পুত্রধনের ভূমিকাটা একই কাতারে ফেলা যায় না।বা নদীর ফেলতে ইচ্ছে করে না।এভাবে সে সব স্টাফের খেয়াল রাখে না বলেই নদী বিশ্বাস করে। রাতে ঘুমানোর আগে সারাদিনে তিনি কী কী কাকে বললেন, কীভাবে বললেন,আজ নতুন কী শেখালেন, কীভাবে হাসলেন কীভাবে চুপ ছিলেন, তার ইংরেজি উচ্চারণ, না না ভঙ্গিমা কল্পনা করতে করতে চোখ বোজে নদী।

তবে আজ নদীর ঝামেলা আজই তাকে কেন আসতে হলো? তাও আকাশী টিশার্ট আর কালো জিন্স পরা গ্রিকগড এপোলো সেজে!
আজ দুপুরের সব আলো এই শরীর দিয়েই বের হচ্ছে যেন। হঠাৎ হঠাৎ হীনমন্যতা হয় নদীর, আকাশপাতাল কল্পনা করে নিজের অবস্থান ভুলে বসে থাকে । বাস্তবে এই মানুষটার সামনে সে একজন বিশিষ্ট পেত্নি ছাড়া আর কিছু না ।

” সরি মেহরোজ, তুমি মনে হয় বিজি ছিলে ”

“কিছু না,ঘরে পড়ছিলাম স্যার ” নদী দ্রুত বলল।

” এত চমৎকার দিনে পড়ছিলে? তোমার ক্যাম্পাসের বন্ধুরা কেউ নেই? তাদের সাথে ঘুরতে যাও না? ”

নদী অল্প হাসলো প্রতুত্তর করলো না।

” তোমার একটা জিনিস আমার কাছে ছিল ” গ্যাব্রিয়েল একটা লম্বাটে বাক্স এগিয়ে দিলো,নদী চিনলো গাড়িতে ফেলে আসা চেইন লকেটের বক্স। গ্যাব্রিয়েল বলল,

” দেব দিচ্ছি করে সময় হয়নি, আর কিচেনের ব্যস্ততা তুমি বোঝই। আমি এই উইকেন্ডে ডালাস যাচ্ছি, তাই আজ মনে পড়তেই নিয়ে চলে এলাম ”

“ডালাস ” নদী হতভম্ব।

গ্যব্রিয়াল আনন্দে মাথা নাড়লো ” ইয়াপ, দুইবছর কোন ভ্যাকেশনেই যাওয়া হয়নি,সম্পূর্ণ সময় দিয়েছি গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে, ওখানে বন্ধু ফ্যামিলি রেগুলার রিকল করছে, ভাবলাম এই সামারটা কাটিয়ে আসি। এদিকে ড্যাড থাকবে ম্যানেজমেন্টে, আর জেরিন তো আছেই৷ সালেম ভাইয়ের আন্ডারে তুমি ভালো কাজ করছ কিপ আপ দ্যা গুড ওয়ার্কস। আমার মতে খুবই মেধাবী তুমি, দ্রুত কাজ শেখার দারুণ ক্ষমতা রাখো। আমি শিওর ফিরে আসতে আসতে তুমি একজন ফেসিনেটিং শেফে পরিণত হয়ে যাবে ”

নদী জোর করে ঠোঁট টেনে সৌজন্য হাসি দিল। মাতৃভূমি যাবার জন্য মানুষটা উচ্ছাসিত।এদিকে তার সাতক্ষীরা যাওয়ার জন্য এতটা বিতৃষ্ণা কেন হচ্ছিল এখন যেন স্পষ্ট হলো, কিন্তু এখন বিষয়টি সম্পূর্ণই অর্থহীন।

“হ্যাভ এ নাইস টাইম স্যার”

” ইউ টেককেয়ার ওফ ইউর সেল্ফ ওকে? উই উইল বি ইন টাচ। এনি ওয়ে তোমার কিছু চাই ওখান থেকে আমি কিছু নিয়ে আসব? ” সরল সহজ প্রশ্ন জিএসের।

” নাথিং অনলি ইউ….হ্যাভ এ সেফ জার্নি স্যার ”

ক্ষণিকের জন্য ঘাড়ে রাখা ভরসার হাত আজ কেমন বোঝার মতো লাগলো।গ্যাব্রিয়েল গাড়ির দিকে যাচ্ছে। তখনই৷ নদীর মনে পড়লো জি এসেরও একটা আমানত আছে তার কাছে৷ একটা হলুদ চামড়ার ব্যাগ সেদিন কলেজে নিয়ে যাবার জন্য দিয়েছিল। ব্যাগই নয় সেখানে কটা কাগজ আর একটা পেনড্রাইভও ছিল৷ এসব হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে নদী গুরুত্ব নিয়েই আগলে রাখবে৷ পাওয়া না পাওয়ার হিসাব ছাড়াই কিছু মানুষের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি জিনিসই আগলে রাখতে ভালো লাগে। রেখে দিলে ফেরত দেবার একটা বাহানা তো থাকবে।

রম্য গাড়িতে উঠতেই অর্ণবের ফোন
” অলসেট? ”

” হুম বলা যায়”

” ওকে, মমও খুব এক্সাইটেড তোর জন্য। আমি মনে হয় বলিনি সামনের সপ্তাহে ভেগাসের একটা প্যাকেজ বুক করেছি ”

” অনি এই আইডিয়া ড্রপ দে”

“মোটেই না আরে তুমি দীর্ঘদিন সন্ন্যাস ভেঙে আসছিস, তোকে দ্রুত পুরুষ বানাতে হবে না?”

রম্য বিরক্ত ঝেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো, ” রমি বাই দ্যা ওয়ে তুই ওই ডকুমেন্টস গুলো কি সলিসিটরকে পাঠিয়েছিস?”

” ওহ ভালো কথা ওগুলোর সাথে পেনড্রাইভটাও আছে, আজই পাঠিয়ে দেব ”

“হ্যাঁ প্লিজ, এটা ইমার্জেন্সি, বাবাকে আর হ্যাম্পার করার দরকার নেই এটা এখন আমরাই হ্যান্ডেল করি। এখানের রুলস এখানকার লইয়ারইই বুঝুক। এনি ওয়ে তুই ঘরের বাইরে কোথায় আছিস? ”

” ছিল একটা দরকার ”

” কার সাথে, এনি ডেট? ”

“স্যাট আপ অনি ”

ভাইয়ের সাথে খুনসুটি তর্ক করতে করতে রম্য গাড়ি টান দিলো।যেতে সময় হাত নাড়লো নদীর দিকে।
ওপর থেকে এই একই দৃশ্য দৃষ্টি ভেদে অর্থ বদলে গেল মোজাফফর সাহেব জানালায় দাড়িয়ে পাথর হয়ে আছেন৷তিনি যা ভেবেছিলেন তাই, হ্যাঁ সেই একই বিলিতি ছেলেটা। সমস্যা দ্রুত ছড়ানোর আগে সমাধান জরুরি, নয়তো নিশির জায়গায় নদীকে আবিষ্কার করতে দেরি হবে না।

তবে সব গুছানোর জন্য
রানুকে বলে বুঝিয়েও লাভ নেই। যা করতে হবে তাকেই সাবধানে করতে হবে। মোজাফফর সাহেব ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। নদী যেহেতু বৌভাতের আগে আসবে সেহেতু তেমন ভাবেই গোছাতে হবে।

এইদিকে, ঘরে নদীর বান্ধবীরা নোট গোছাতে ব্যস্ত। রানু নিজের কাজ গোছাতে ব্যস্ত । আজও গাউসিয়ায় টুকটাক শপিং করতে করতে অনেক হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে আরও একটা ব্যাগ নিয়ে নিলে মন্দ হতো না।নদীর ঘরে একটা হলুদব্যাগ বেশ খাসা লাগলো।আসল চামড়ার বেশ দামী ব্যাগ, সম্ভবত ওই শানুর কাছ থেকে বাগিয়েছে। বদ মেয়ে! রানু বেশ সাবধানে ব্যাগটা সরিয়ে নিজের লাগেজের মাঝে ভরে নিলেন।নদী তো সাথে যাচ্ছে না, জরিমানা হিসেবে নিয়ে নিলেন, পরে একসময় জানালেই হবে।

(চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম

ডিসক্লেইমার
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here