বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ১৮

0
255

#বাতাসে_তার_সৌরভ–১৮

গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে আজ আটটার মাঝেই গমগমে মানুষের ভিড়, সাথে বাড়ছে কর্মযজ্ঞ। আজ একাধারে দুটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। নোটিশ বোর্ডে উল্লেখ করা আছে, তারপরও নদীকে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিয়ে অতিথিদের জায়গা মতো পাঠাতে হচ্ছে,

সেই সাথে অনুষ্ঠান বহির্ভূত অতিথিদের মিষ্টি হেসে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে নদীর। বুকিং না করে অনেকেই চলে আসেন তাদের নিরাশ মুখ দেখে মন খারাপ হয় কিন্তু কিছু করারও থাকে না। এদিকে রাত বাড়ছে, নদী রিসিপশনের দায়িত্ব আরেকজনের হাতে দিয়ে বুফেট লাউন্সের দিকে চলে যেতে হবে। নদীর বুকে আজ চাপা উত্তেজনা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় টিস্যু দিয়ে সাবধানে ঘাম মুছলো। একটু এদিকওদিক হলে ভয়াবহ ঝামেলা লেগে যাবে।গেট পেরিয়ে আগত কৃষবর্ণের হাতাকাটা ব্লাউজের শাড়ি পরিহিতাকে প্রথম দর্শনে চিনতে পারলো না নদী
” ইয়েস ম্যাম কোন অনুষ্ঠানের গেস্ট আপনি? ”

” যদি বলি আপনারই গেস্ট”
নদী কন্ঠে চমকে উঠলো, ” রাবেয়া আন্টি!”
” মাই মাই লুক এট ইউ… “রাবেয়ার চোখে একভাবে নদীর জন্য মুগ্ধতা অন্যদিকে চাপা বিষাদ। চন্দ্রমল্লিকার রাজকুমারীকে এভাবে দেখার চিন্তা হয়ত তার ছিল না।

” আপনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন সোহরাব স্যার বলেননি “নদী অবাক।

” প্রয়োজন মনে করেননি” রাবেয়ার ঠোঁটে মাপা হাসি।

নদী সহজ হতে চাইলো, হাসি টেনে বলল “যাক ভালো হবে,এখন থেকে রেগুলার দেখা হবে।”

“কীভাবে বুটিক থাকলে তো,সেটা তো আগেই সরিয়ে ফেলেছ তোমার সোহরাব আঙ্কেল!”
নদী একটা থতমত খেয়ে গেল। উপরের একটা ইউনিটের দুই রুম নিয়ে একটা বুটিকের শো-রুম মতো দেখেছিল বটে কিন্তু কিছু দিন আগে তাও এক্যুয়ার করে নিয়েছে গ্যাব্রিয়েলস কিচেন সেখানে রেস্তোরাঁর বর্ধিত অংশের কাজ চলছে। রাবেয়া মূলত তার বুটিকের মালামাল বিষয়ক কাজেই বোঝাপড়া করতে এসেছেন। নদীর সাথে আর কথা এগোলো না তিনি ভেতরে চলে গেলেন।
নিজের চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নদী বুফেট লাউন্সের দিকে এগোলো। যেতে যেতে একঝলক আয়না দেখে নেওয়া লাগলো
জেরিন ম্যামের মতে, ” গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের মতো পশ রেস্টুরেন্টের এটেনডেন্স হবে ব্রেথ অফ ফ্রেস এয়ার, সর্বদা সজীব ;উইথ ড্যাজলিং স্মাইল। ”

স্মাইল তো ঠিক আছে কিন্তু ডেজলিং স্মাইল কী, এটা নদী জানে না। ইংরেজিতে এত দুর্বল হলে আর ভাগ্যের শিকে ছিড়েছে। এমনই আত্মদ্বন্দ্ব নিয়ে নদী কিচেনের দিকে এগোলো।

সালেমভাই ঝড়ের গতিতে উনুন সামলাচ্ছেন, জি এস স্যার কিছু বেকিংয়ের কাজে ব্যাস্ত।
আটটার দিকে সব বুফেট বার্নার ডিশে ফায়ার দেয়া হবে। এপাটাইজার স্ন্যাকস আর মেইনকোর্স আইটেমগুলো লোড কর‍তে হবে।নদী, মবিন, লিজা দ্রুত গতি ডিশ লোডিংয়ের কাজে নেমে গেল। বুফেটের ডিশগুলো বেশ ভারী মেয়েরা সাধারণত নেয় না, লিজা ছাড়া৷
নদী কী মনে করে একাই সামলাতে এগিয়ে গেল। সুদৃশ্য ঢাকনা দেয়া ডিশ, নদী কৌতূহলী হয়ে একটা তুলে দেখলো সুসজ্জিত গোটা আস্ত মাছের কাবাব তার সাথে টুকরো করা ফলের অংশ অদ্ভুত টকটক সসের একটা ঝাঁজ গন্ধ।

” পাইনেপল স্টিমড কোরাল ফিস, ”

নদী চমকে ঘুরে গেল, নাফিজ একেবারে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে মুখে একটা বিটকেল হাসি। অন্য সময় নদীর মুখ শক্ত হয়ে গেলেও আজ মিষ্টি একটা হাসি দিলো।

” নাফিজ ভাই! আপনি যে কী জিনিয়াস বোঝাই যায় না ”

” সুযোগই তো দাও বুঝানোর নাইলে বুজতা আমি সেইই জিনিস ”

” আপনি নাকি থাইল্যান্ডে গিয়ে কুকিং ডিপ্লোমা নিসেন ”

নাফিজের চোখ নেমে যাচ্ছে নদীর গলার থেকে আরও কয়েক ইঞ্চি নিচের দিকে
” শুধু কি আর কুকিং ডিপ্লোমা, আরও কত ডিপ্লোমা নিসি সেটার তো টেস্টই কর নাই হুদাই মরিচিকার পেছনে দৌড়াইতেসো ”

” বুঝলাম না” নদী বলতে বলতে একটা ঝনঝন করে শব্দ। লিজা ডিশ সামলাতে গিয়ে হেলিয়ে দিচ্ছিলো। বাকিরা কাজ বাদ দিয়ে ঘুরে গেল সেদিকে নাফিজ ছুটে গেল,

“আরে লিজা বেগম এই পর্বতের শরীর নিয়া সামলাইয়া হাঁটতারো, ডিশ সামলাইতারো না। রাখো ওই জিনিস! ”
লিজা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে।

” ওয়ানথনটা আগে নিয়ে যাও, ওইটা রাখ, ক্যালেঙ্কারি করবা “লিজা কাঁপা হাতে ডিশ রেখে অন্য ডিশ হাতে নিলো। নদী আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে

” আমি ফিসেরটা নেই নাফিজ ভাই ” নদীর মিষ্টি কন্ঠে নাফিজ চমৎকৃত, ” অসাধারণ ফ্লেবার, রেসিপিটা আন্দাজ কর‍তে কর‍তে যাব ”

নদীর কথায় নাফিজের বুকে অন্য তরঙ্গ খেলছে,প্রশংসাবাণীতে বিগলিত,

” শিখতে চাইলে পারসোনালি মিট করতে হবে, আগা থেকে গোড়া শিখায় দিবো ,শিখবা তো?”ঢাকনা সহ ডিশটা নদী হাতে তুলে দিতে দিতে নদীর হাতে আলতো ছোঁয়া।

গালে হাসি টেনে নদী ডিশ হাতে কিচেন থেকে বের হচ্ছে। করিডর থেকে বুফেট লঞ্চের দিকে যেতে যেতে মনে হলো নদীর হাতে যেন গোবর লেগে আছে। নাফিজ শয়তানটা যেখানে ছুঁয়েছে সেটা গোবর লাগারই শামিল। আচ্ছা জিএস হ্যান্ডশেক করলে এমন লাগে না কেন? সম্ভবত তার উদ্দেশ্য ভিন্ন বলে। তবে দুজন পুরুষের উদ্দেশ্য ভিন্ন এটা কীভাবে বোঝা যাবে? জিএস তাকে সেভাবে কখনো দেখেইনি এইজন্য হয়তো..। কী আশ্চর্য জিএসকে নিয়ে তুলনাই বা কেন? কয়েকদিন কি একটু অন্তরঙ্গতা হয়েছে এর মাঝেই অবাস্তব চিন্তা। প্রেম এত সস্তা?

এই রে, জিএস সামনেই আছে শেফ এপ্রোনে গেস্টদের সাথে হেসে কথা বলছে। কথার মাঝেই আড়ে দেখে নিচ্ছে পরিবেশনের অবস্থা। নদীকে ধীরজ দেখে ধমক না দেন। কাজেই চিন্তা ঝেড়ে নদী গতি বাড়ালো।।লিজা তার ডিশ রেখে দ্রুত পায়ে ফিরে আসছে চোখে এখনো উত্তেজনা।

নদী নিজের ডিশের ঢাকনাটার ঠিক
করতে গিয়ে থমকে গেলো। বুক কাঁপছে, মাথা ঘুরছে, উত্তেজনার কারণে ভুল দেখতে পারে।।নদী একটা বিভ্রান্ত হয়ে চারদিকে তাকিয়ে আবার ঢাকনাটা তুলে দেখলো। না এটা কল্পনা নয় এটা সত্যি। নদী অসহায় হয়ে তাকাচ্ছে চারিদিকে। বেশ জটিল পরিস্থিতি, কেউ কি আসবে না সাহায্য করতে?

বিষয়টা গ্যাব্রিয়েলের চোখ এড়ালো না মেহরোজ অনেকক্ষণ ধরেই করিডরে থেমে আছে। কিছু দেখে যেন ভয় পেয়েছে।

“কী অবস্থা মেহরোজ? ”

নদী যেন চমকে তাকালো , গ্যাব্রিয়েল অবাক হয়ে খেয়াল করল মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ” তুমি ঠিক আছো? ”

” আমি ঠিক আছি স্যার তবে… ”

” তবে কী?

” একটা ছোট সমস্যা”
গ্যাব্রিয়েলের মনে পড়ল মেহরোজের বোন নিশির মিসক্যারেজের সময় মেয়েটা এই বাক্যটা ব্যবহার করেছে ” একটা ছোট সমস্যা। “যদিও সমস্যা যথেষ্টই বড় ছিলো।
কী সমস্যা

” স্যার এই ডিশটাতে নাফিজ ভাইয়ের থাই পাইনাপেল স্টিমড ফিশ থাকার কথা ”

“সেটা কি নেই?

গ্যাব্রিয়েল অবাক হয়ে বলল। নদীর গলা শুকিয়ে আসছে,
” সেটা নেই, কিন্তু যেটা আছে সেটা… ”

নদী তার কথা শেষ করতে পারলোনা, গ্যাব্রিয়েল ডিশের ঢাকনা খুলে ফেলেছে। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে প্লেটে সাজানো, একটা কাটা রক্তাক্ত মানুষের হাতের দিকে। ডিস হাতে নদী থরথর করে কাঁপছে।

******-

” তুই ঢাকায় আসতেসিস না এখন? ”

” নো বেইব, এইখান থেকে অনলাইনে ফ্লাইট বুক করে ফেলসে।ঢাকায় নেমেই পরের ফ্লাইটে উই উইল বি অফ টু সিলেট। মম রয়েল সুলতান রিসর্টের ব্যাপারে শুনসে আগে ওইখানে যাবো ওইখানে দুইদিন থাকার পর, জাগলং, শ্রীমঙ্গল চা-বাগান,

নদী বারান্দায় কাপড় মেলতে দিতে দিতে বলল ” বাপরে তাহলে তো লম্বা ট্যুর ”

” হুম আমার ভাল্লাগতাসে না তবে এই মহিলা মাথায় ভ্যাগাবন্ডের ভূত চড়সে ”

নদী হাসলো, নিশি মুখে বিরক্তি দেখালেও এতদিন পর মায়ের সান্নিধ্যে তার মতো খুশি হয়তো আর কেউ নয়।
শানুখালা নিশিকে সাথে নেবার আগে তার মেন্টাল হিলিংয়ের জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন। তার নিজের ইচ্ছে মেয়ে আমেরিকায় ফিরে আবার কোন ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি হোক। তবে নিশির ততটা আগ্রহ নেই। কাজেই তার হৃদয় জয় করতে যা যা পছন্দ তা করে যাচ্ছেন।

-নাও টেলমি এবাউট ইউ বেইব, তোর বাবুর্চির সাথে কিছু হলো?

নদী বারান্দা থেকে আনা শুকনো কাপড় ভাজ করতে করতে বলল,” কী আর হবে, আমি মনে হয় উনার জন্য মরিয়া”

” মরিয়া কি বাচিয়া, তুমি উনার দিওয়ানা। তবে তোর মতো ভেবদি দিয়ে কিছু হবেও না।তুই ওখানকার থালাবাসনই তুলতে থাক। আমার থিওরি এপ্লাই করসিলি? বলেছিলাম না, ব্ল্যাঙ্ক স্পেস তৈরি কর”

” করসিলাম তো ”

” তার কী হলো? ”

নদী কথাটা বলতে বলতে চেপে গেল। এইসব অতিলোভে তাতি নষ্ট টাইপ কর্মকাণ্ড বলতেও ইচ্ছে করে না। ফোন রাখার আগে শানুখালা কথা বললেন, ” শোন রানুর ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে তো জানিসই। আর দুই সপ্তাহ পরেই, আমি যাবো না। ঢাকার বাইরেই থাকব, তবে আমার এক ফ্রেন্ড একটা কাজে সাতক্ষীরা যাবে। তার সাথে তুই চলে যাস মা। লায়লাকে রানুর ছেলের বউয়ের জন্য একটা নেকলেস কিনতে দিয়েছি। সেটা গিয়ে রানুকে দিয়ে দিবি। ”

নদী বুঝলো বোনে বোনে শীতলতা এখনো কমেনি।তিনি শুধু দায় সারছেন যদিও সাতক্ষীরা তার যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না, তবে শানুখালাকে না বলার মতো ক্ষমতা নদীর নেই। শানু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো নিশি বাধ সাধলো। ” হইসে হইসে বেচারির দিল টুটা আর বেশি বুলি করো না। উসে আকেলা ছোড় দো… ”

নদী ফোন ছেড়ে ঘর গোছাচ্ছে। কয়েকদিন পর সাবলেটের বাড়িতে সে ফিরলো।বাড়ির এই মাসের ভাড়া শানুখালা দিয়ে গেছে কাজেই বাড়িওয়ালার কিছু বলার নাই। ঘরের কোণায় কোণায় ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে নিশির কথা মনে পড়ছে।

তার মনটা আসলে ঠিক খারাপ নয় একটু বিষণ্ণ। মূলত ছলচাতুরী সবার ধাতে মনে হয় সয় না। অথচ সব প্ল্যান মতোই হচ্ছিল, সেই সন্ধ্যায় নদীর শুকনো মুখ দেখে গ্যাব্রিয়েল এগিয়ে এসেছিলো বাফেট ডিশ প্ল্যাটারের সিলভার লিড ওঠানোর পর একঝলকের চমকে ওঠার পর পরই কী দ্রুততার সাথে নিজেকে সামলে নিয়েলো। দৃশ্যটা নদী বারবার চিন্তা করে,

প্ল্যাটারের মধ্যে সুসজ্জিত মানুষের কাটা হাতটা বানানো প্রায় নিখুঁত,সে পরিস্থিতিতে যেকেউ প্রচন্ডভাবে ভয় পেয়ে যাবে। গ্যাব্রিয়েল এক দুই সেকেন্ডের জন্য চমকে গেলেও ভয় পেলেন না। সাবধানে নদীকে একপাশে কোণায় নিয়ে গেলেন, নদীকে বলতে হলো যে এটা নাফিজই তার হাতে তুলে দিয়েছে। গ্যাব্রিয়েল বেশি একটা জেরায় গেল না, প্ল্যাটারটা পরীক্ষা করলো । অভিজ্ঞ চোখ আশ্বস্ত হলো দ্রুতই যে এটা একটা কেক। নি:সন্দেহে সুন্দর তবে এর পেছনে বানানোর উদ্দেশ্য মোটেও সুন্দর নয় বরং এটা গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের জন্য ভয়াবহ।

যাহোক ভরা পার্টিতে গ্যাব্রিয়েল বিষয়টি টানলো না। নদীর ভয় কাটালেন,”ইজি হও এটা একটা প্র‍্যাঙ্ক, নাও পানি খাও একটু ফ্রেশ হও “নদী সহজ হবার ভাব করলো কতটা পারলো বুঝতে পারলো না।
জি এস খুব পেশাদারী কেতায় সার্ভের আগে আবার কিচেনে গিয়ে প্রতিটি প্ল্যাটার নিজে চেক করে বুফে লাউন্সে পাঠালেন । এর মাঝে ব্লুটুথে এই কর্ণারের সিসিটিভি ক্লিপিং আলাদা করে রাখতে বলল সিকিউরিটিকে।

গ্যাব্রিয়েলের কড়া চোখে অনুষ্ঠান দুটো বেশ নির্বিঘ্নেই শেষ হয়েছিল। সুন্দর পরিপাটি ম্যানেজমেন্ট, রান্নার তারিফ শুনে শেফরাও বেশ খুশি।বিশেষ সুনাম কুড়ালো থাই পাইনেপল স্টিমড কোরাল। কিন্তু সেই খুশি উবে গেল কিচেন ক্লোজিংয়ের আগে আগে।

সিসিটিভি ফুটেজ সবার সামনেই পরীক্ষা হয়েছে।নদীর পাশে দাঁড়ানো লিজা তখন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, সিসিটিভি তার পর্যন্ত কভার করেছে কি না বুঝতে পারছিলো না। তবে দেখা গেল তার বিশাল শরীর সুচারু ভাবেই ব্যাপারটা কভার করে ফেলেছে।তার প্ল্যাটার বদলানোর দৃশ্যটা সেভাবে ধরা পড়লো না। ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়লো নাফিজই নদীর হাতের প্ল্যাটার বদলে কাটা হাতের প্ল্যাটার তুলে দিয়েছে।

নাফিজ ব্যাপারটার ব্যাখ্যায় তালগোল পাকিয়ে ফেলল,
” স্যার আমি কিছু জানি না,এইটা ষড়যন্ত্র

“তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কার লাভটা হবে একটু বলো” সালেম প্রশ্ন করলো।

” বুঝতেসি না স্যার এইটা তো যাবার কথা না,এই হাতের কেকটা তো এখন আসারই কথা না,আমি তো এইটারে কয়েকদিন ধরে খুঁজতেসিলাম।..

” তুমি এটাকে খুঁজতেসিলে মানে কী তার মানে এটার ব্যাপারে তুমি জানো? জিএসের স্পষ্ট প্রশ্ন।

” না স্যার আমি জানি না ”

“তাহলে তুমি বললে কেন যে তুমি এটা খুঁজছিলে? ‘

” আসলে এটা হারায় গেছিল ”

“কোথা থেকে হারিয়েছিল বুঝিয়ে বলো”

গ্যাব্রিয়েলের প্রশ্নে নাফিজ চোখ মুখ দিয়ে কিছু বলার চেষ্টার মাঝেই হঠাৎ করে দমে গেল। জিএস কিচেন ছাড়া রেস্তোরাঁর অন্যান্য স্টাফদের ছুটি দিয়ে দিলেন। পরবর্তী দিন সকালবেলা নদী লিজার ফোনে জানতে পারল দায়িত্বে অবহেলা, রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়ানোর অভিযোগে নাফিজের চাকরিতে থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছে৷

” হালায় কাজে এত ভাল, মিচকা শয়তানিটা যদি না করতো এমনে ফাসতে হইতো না। ”

সালেমভাইয়ের কথায় নদী তখন আশায় বুক বেঁধেছিল। এত বড় ব্যস্ত রেস্তোরাঁয় এখন নিশ্চয় কাজে পটু একজন কাউকে প্রয়োজন। নাফিজের ডিউটি হয়তো পারবে না, তবে সালেম ভাইকে এসিস্ট নদী করতেই পারে। নাফিজ চলে যাওয়ায় ওনার কাজের চাপ নিশ্চয়ই বাড়বে। গ্যাব্রিয়েল স্যার এখানেও নিশ্চয়ই অনিয়ম হতে দেবেন না। তিনি সব জিনিসই খুব গুছিয়ে করেন। তবে বাস্তবে জি এস দেখা গেলো নদীর চিন্তার থেকেও দুই ধাপ বেশী গোছানো। রাতেই তিনি নাফিসের অল্টারনেটিভ শেফ রেডি করে দেখেছেন। একটা জনপ্রিয় থাই রেস্তোরাঁর প্রাক্তন শেফ, সকালবেলা এসেই জয়েন হয়ে গেলেন।

স্মৃতি কাটিয়ে নদী ঘর গোছনো শেষ করে ছোট একটা নি:শ্বাস ফেলল। জীবনের অংক গল্প কবিতার মতো সহজ ভাবাটাই মানুষের সবচেয়ে বড় বোকামি। জীবনকে যখনই সহজ ভেবে ধরে নেয়া হয় তখন সেটা পেজগি লাগিয়ে ফিচেল হাসি দেয়৷ এমন সব চিন্তার জালে ছেদ পড়লো।নদী ঘর গোছাতে গিয়ে কয়েকটা কাপড় খুঁজে
পাচ্ছে না। যতদূর মনে পড়ে সেগুলো সেদিন বারান্দায় সুতি ওড়নার নিচে রোদে মেলে দেয়া ছিল। এই কয়দিন সেসবের খেয়াল নেই। ঝড়ে কি উড়ে গেল? শুক্রবার দিন এত সময় নিয়ে ঘর গুছিয়েও ঘরে পাওয়া গেল না। কোথায় না কোথায় গেছে! নদী অস্বস্তি নিয়েই রেডি হয়ে গেল। একেকটা ঘটনা প্রাত্যহিক জীবনে একটা ধাক্কা তো দেবেই।

” এই অবেলায় কোথাও যাচ্ছো ?”

নদী দরজার মুখে তার সাবলেট বাড়িওয়ার সাথে দেখা। অল্পবয়সে চুল ঝরে গেছে,ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়স নাম জসিমউদদীন। কোন ব্যাংকে চাকরি করে।আদলে, স্বভাবে স্ত্রীর একেবারে বিপরীত। কিছু দম্পতি জোড়া আছে একজনের ব্যক্তিত্ব আরেকজনের সম্পূর্ণ কভারেজ খেয়ে ফেলে। এই দম্পতির ক্ষেত্রে তাই বলা যায়, ভদ্রলোক যত খাটো, মহিলা ততো বেশি লম্বা, ভদ্রলোক যত শুকনো, মহিলা ততই স্বাস্থ্যবতী। ভদ্রলোক যত শান্ত, মহিলা ততটাই লাউড। ঘরের ভেতরের যত কথপোকথন শোনা যায়, সেটায় মনে হয় মহিলা একা একাই বলে যাচ্ছেন। মহিলা গোটা অস্তিত্ব দিয়ে ভদ্রলোককে দমিয়ে রাখেন আর এই কারণেই ভদ্রলোকের সাথে ভালো মতো কথা হয় না নদী অথবা নিশির। আজ জসিম নিজে এসে যেচে কথা বলছে দেখে নদীর কিছুটা অবাক লাগলো , সম্ভবত ভদ্রমহিলা বাড়ি নেই ।

“জবে যাচ্ছি জসিম ভাইয়া”

” জব এই ছুটির দিনে অবেলায়? কিসের জব কর? ”

” এই তো কাছেই একটা রেস্তোরাঁয় ” নদী বেশি কথা না বাড়িয়ে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল । জসীম লম্বা গড়নের মেয়েটাকে আড় চোখে দেখে ঘরে এগোলো। কয়েকদিন ধরে তার সংগ্রহে যে নারী অন্তর্বাস আছে সেটা সাবলেটের কোন মেয়েটার সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে, একান্ত গোপনে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নেয়। পাশাপাশি বারান্দায় জিনিসটা চোখে পড়েছিল, ডুবলিকেট চাবিটা কাজে লাগিয়ে এটা কুক্ষিগত করা গেছে। জসিমের বিচিত্র ফ্যান্টাসির এটাও একটা, এতে যে বিচিত্র উন্মাদনা জাগে তার তুলনা হয় না।
******

হোটেলের কর্মযজ্ঞের মধ্যেই নদীর ফোন এলো বড়মামার কাছ থেকে। কাজের মধ্যে রিসিভ করা আরেক ঝামেলা, নদী ফাঁকে গিয়ে কথা বলল। বড়মামা জানতে চাইলে নিচের শানু তার সাথেই আসছে কিনা।
নদী বিষয়টা এড়িয়ে গেল বলল, ঠিক জানি না। মূলত বড়দের ঝামেলার মধ্যে ঘোট পাকাতে তার ভালো লাগেনি। বড়মামার ঘাটালেন না বারবার বললেন শানুর সাথে নদীও যেন চলে আসে, অনেক দিন বাড়ি ফেরে না সে।
নদী দ্রুত ফোন রাখলো, বন্ধনের জাল ম্লান হলেও সেটা জালই বটে, টান পড়লে বুকে লাগে। আবেগ রেখে নদী কাজে ঝাঁপালো,

” সালেমভাই, টেবিল সেভেনটিন,
একটা পাস্তা এরাবিয়াটা, চিকেন লাজানিয়া, আর ডেজার্টে ..

নদী অর্ডার বলতে বলতে থেমে গেল। সালেম ভাই নিজের মনেই গজগজ করছেন। সমস্যা কি জানতে চাওয়াও যেন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠারই সামিল।

” আরে সব জায়গায় নিজের সিস্টেম থাকে। যত অভিজ্ঞতাই তোমার থাকুক সিস্টেমগুলো বোঝার জন্য সময় লাগে।বড় বড় ব্যাটিং করার আগেই উইকেট বুঝে করতে হয় আর এইটা তো রসুই, ঢুইকাই মাতব্বরির দরকার আছে? জি এসের হাউশের শেফ, উউল্টাপাল্টা করতে লাগবো, ভুল হইলে গালি তো খামু এই আমি। ”

” ব্যাপার কি সালেম ভাই? ”

” দেখ ব্যাপার কী “সালেম বড় একটা গামলা সেদ্ধ আলুর ভর্তা দেখালেন।

” আজ ব্রেকফাস্টের মেনু না পইড়া ইচ্ছা মতো আলু সিদ্ধ করে বসে আছে। ইংলিশ মেশড পটেটো কর‍্তে গেসিল অথচ আজ ব্রেকফাস্ট বুফেতে মেনু ছিল মোগলাই আর থাই। তারে জিগাইলেই কয় আমি তো মানুষ ফেরেশতা না ভুল তো হইতেই পারে, এত উত্তেজিত হবার কি আছে? শালা দুই কেজি আলু সেদ্ধ করে বল উত্তেজিত হবার কী আছে? উত্তেজনা আমি তোর পা**র মধ্যে ডুকামু। নতুন মানুষ সব করতেসে ব্যারাছ্যারা, একা হাতে এত্তগুলা কাম আলুগুলোর যে কায়দা করব তার সময়ও বের করতে পারতেছি না।”

” আমি মনে হয় সুযোগ দিলে কায়দা করতে পারব সালেম ভাই। ”

সালেম বেশ অবাক হলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কারণেই হয়তো, গ্যাব্রিয়েল কিচেনে অতিথি কিছু কম ছিল। লিজা তুষার সুন্দরভাবে সামলে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ ক্লায়েন্ট কমিশন চিন্তা বাদ দিয়ে নদী সময় করে ঢুকে গেল কিচেনে, পরে নিলো এপ্রোন। সালেম অর্ডারের কাজ সামলাতে সামলাতে অবাক হলেন। নদী ঝড়ের গতিতে সব আইটেম জোগাড় করে এক করছে।

– করস কী! এত্তকম সময়ের মধ্যে এত্তোগুলো চপ!
নদীর মুখে তৃপ্তির হাসি। সালেমভাই একটা মুখে দিয়ে হতভম্ব।মুচমুচে ব্রেড ক্র‍্যাম্বের অসাধারণ ফিনিশিং সাথে ভেতরের ডিমের পুরের মাঝে মশলার সঠিক পরিমিত ব্লেন্ড। আর এই তেতুলের টক,মিষ্টি ঝাল চাটনি। স্বাদ মুখে লেগে থাকে,আরেকবার মুখে পুরে দিতে মনে চায়।

নদী হাসিমুখে বলল, আলু কেমন কায়দা করে ফেললাম দেখেন , চারটা করে কমপ্লিমেন্টারি চপ সার্ভ করা হলে কেমন হয়?

সালেম ভাই মাথা নেড়ে বললেন – আর সাথে ক্লায়েন্ট নোট কালেকশন। যদি তাদের পছন্দ হয় তাহলে জেরিন ম্যাডামকে বলে স্ন্যাকস মেনুতেও জুড়ে দেওয়া যায়। একটা আইটেম তোমার হাতের”

নদীর সাথে পরিকল্পনার সিড়িতে বেশি দূর যেতে পারলেন না সালেম। এক অনাহুত চরিত্রের উপস্থিতি টের পেয়েই সামলে গেলেন। নদী দ্রুত টেবিল অর্ডার নিয়ে বেরিয়ে গেল। গেস্ট সার্ভ করে ফিরতি পথে করিডোরে রাজিয়ার কালো ছায়া এড়ানো গেলো না।

” তোমাকেই খুঁজছিলাম, গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের এত পপুলার ফেইস কোথাও গেল, মনেই ছিলো না যে কোথাও না পাওয়া গেলে কিচেনে অবশ্যই তিনি থাকবে, কোণায় বসে আড্ডাবাজী তো অবশ্যই করবে ”

” টেবিল সেভেনটিনের অর্ডার ছিল ম্যাম.. ”

“আর সেদিনের হাতের কেকটা কার অর্ডার ছিল যেন? ‘

” জি? ”

” আমার সাথে স্মার্ট হবার চেষ্টা করবে না মেহরোজ, তোমার স্মার্টনেসে আমি মু**”
রাজিয়ার রোগা পটকা চেহারাটা হঠাৎ কেমন তক্ষক সাপের মতো হয়ে যাচ্ছে মুখ, নিচু গলায় বললেন ” আমি খুব ভালো মতো জানি এই কেক সেইদিন বার্নার প্ল্যাটারে কীভাবে গেল”

” জানারই তো কথা, খোদ এই অসামান্য শিল্পের স্রষ্টা বলে কথা”

কম্পিত বুক সামলে নদী পেছনে তাকালো , রাবেয়া মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে রাজিয়ার দিকে।

” নাফিজ কেকটা নদীর হাতে দিয়েছিল সত্যি কিন্তু এটা তৈরি কে করেছিলো সেই সত্যিটা কিন্তু জিএস জানতে চায়নি। তুমি চাইলে জানিয়ে দেই? ”
বাবেয়ার কথায় রাজিয়ার তক্ষক সাপের মতো মুখটা টিকটিকির মতো হতে সময় লাগলো না।

“ম্যাম আমি কিছুই জানি না।আপনি এমন ভুল এলিগেশন দিতে পারেন না৷ এইটা খুব আপত্তিকর … ” রাজিয়া দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
নদী যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।রাবেয়া আন্টির চোখাচোখি হতেই তিনি সহজ করার জন্য হাসলেন,
“আমি তোমাকে বলেছিলাম পদে পদে বাঁধা আসবে৷ তবু্ও কী জটিল জীবন বেছে নিলে ; বুঝতে পারছ কাদের কাদের সাথে লড়তে হবে? ”

“আমি পারব আন্টি, আপনি সাথে থাকলে…”

” আমিই তো থাকছি না মেয়ে,দেখ না সোহরাব আমায় সব ভাবে বেদখল করে দিয়েছে; স্টাফ কোয়াটার উঠিয়ে দিয়েছে, আমার বুটিক ভেঙেছে, আমায় জানায়নি। ”

নদী মুখ অন্ধকার করে থাকলো এই সমবেদনা দেবার মতো কোন কথা খুঁজে পেল না। সম্ভবত আজকে রাজিয়াকে এড়াতেই সকালবেলাতেই সোহরাব সাহেব কাজের ছুতো ধরে বেরিয়ে গেছেন।এখনো ফেরেননি।

” আজ তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছি তবে তোমার চিন্তা মাথা থেকে নামছে না। তোমাকে দেখতে হলেও আমায় আসতে হবে মাঝেমধ্যেই। ”

রাজিয়া নিজের বুটিকের যাবতীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে বের হবার প্রস্তুতি নিলেন।কয়েকদিনের মাঝেই সব সরিয়ে ফেলবেন।
নদীর এই সমীকরণটা মাথায় এলো না, সোহরাব সামদানী নিজেও মানুষটা খারাপ না, রাজিয়া আন্টির ভালো বন্ধু। তবে দুজনের মধ্যে হঠাৎ দূরত্ব তৈরি হবার কারণ কী?

জেরিনের কথায়, ” এসব বড়োদের ব্যাপার মেহরোজ এগুলো নিয়ে ভেবো না। এইখানে ভাবনাচিন্তার জন্য যত কম পরিশ্রম করবে তত ভালো করবে, রাজিয়া ম্যাম থাকলেই তোমার সমস্যা বেশি হতো ”

” মানে? ”

“প্রতিটি কাজে ওনার কথা বলার অভ্যাস। ভাব এমন যে বাড়িটাই তার। এই ক্যাফে শুরুতে ভালোই চলছিল হুট করে বলে বসলেন গোটা ইমারত ভেঙে নতুন করে বানাই। হোটেল ব্যবসাও লাঠে উঠতো যদি জি এস এসে সামলে না নিতো ”

নদী বেশ অবাক হলো, রাজিয়া এই বাড়ি ভাঙার চিন্তা করছিলেন? কিন্তু কেন?আর তিনি এটা বলেন কি করে, বাড়ি তো সোহরাব সাহেব লিজ নিয়েছিলেন।

” ওনার অপসারণ সময়ের ব্যাপার ছিলো, সোহরাব তো বিরক্তই ছিলো ওর ওপর।”

জেরিনের কন্ঠের চাপা ক্ষোভের সাথে অন্যকোনো দ্যোতনা ছিল কী? নদী ঠিক বুঝলো না তবে এটা বুঝলো যে রাবেয়া আন্টির অন্তর্ধানে জেরিন বেশ খুশি। জেরিনের সাথে কথা বলে রেস্তোরাঁর ব্যাকইয়ার্ড থেকে ফিরতি পথে নদী একঝলকে স্থির হয়ে গেল। ব্যাকইয়ার্ডের গাছের আড়াল থেকে বের হচ্ছে দুই মলিন পোশাকের ছেলেমেয়ে। ছেলেটার পাঁচ ছয় মেয়েটার আট থেকে দশ।
মেয়েটাকে নদী নি:সন্দেহে চেনে।সেইদিনের ফ্রিজার রুমে দাবিকরা নদীর ভূত।নদী কী করবে হেঁটে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, না পাত্তা না দিয়ে ডিউটি সামলাবে।

” আজ লাগবে না, না ডাকলে আসবি না বলেছি না”

” খিদা লাগসে স্যার ”

” পরে পরে এখন না ”

” কিছু দেন না”

“বেশি ফাল পাড়লে পুলিশে দিয়া দিমু ভাগ এখন”

তীব্র বিস্ময়বোধেও মানুষ নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারায় না এটা টের পেল নদী। বাচ্চাদের বিদায় করে তুষার হেঁটে এদিকে আসতে আসতে নদী ঝড়ের গতিতে হোটেল রিসিপশনের সামনে স্বাভাবিকভাবে এসো দাঁড়ালো।তুষারের সাথে চোখাচোখি হলে নদী হাসলো স্বাভাবিকভাবেই, তবে বুকের কাঁপুনি তখনও স্বাভাবিক হয়নি।

সহজ মুখভঙ্গিতে কাজে ফিরেও মাথায় খেলা করছে হাজারো প্রশ্ন। একে একে মনে পড়ছে এই চন্দ্রমল্লিকাকে নিয়ে করা তুষারের মন্তব্যগুলো। শুরু থেকেই সে খুব সচেতন ভাবে যেন ভয় দেখাতে চাইছিল নদীকে। সোহরাব সামদানী সাহেবের এত বিশ্বস্ত মানুষের এই রূপ? সেও তাহলে গ্যাব্রিয়েল কিচেনের বিরুদ্ধে? ভূতের গোটা ব্যাপারটাই তাহলে বানোয়াট। কিন্তু কেন ? নদীর ভাবতে ভাবতে একটু ভয়ও লাগছে তুষারের পেছনে কে আছে?

তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা মানে নিজের জন্য কোন ঝুঁকি বয়ে আনা নয়তো? বেশি শার্লক হোমস হতে গিয়ে কপালে দূর্গতি না আসে।
তবে যেদিন কপালে দূর্গতি লেখা থাকে সেদিন আসলে কিছুতেই এড়ানো যায় না। নতুন ক্লায়েন্ট
অর্ডার কিচেনে কিচেনে রিপোর্ট করতে গিয়েই জিএসের তলব। তার রুমে যেতে যেতে চোখ পড়লো রাজিয়ার দিকে। তার বন্ধ ঠোঁটে ক্রুর হাসিটা বয়ান করলো অনেক কিছুই।

এই দিকে জিএসের মুখ দেখা গেল থমথম করছে। তার টেবিলে একটা আলুর চপের প্ল্যাটার আর সাথে চাটনি। দাঁড়িয়ে থাকতে নদীর হাটু কাঁপছে, জি এস টেনে টেনে বাংলায় প্রশ্ন করলেন,

” এই পটেটো কাটলেটের আইডিয়া তোমার ছিল? ”

নদী ঢোক গিলল, ” স্যার একচুলি,অনেক গুলো ম্যাশ পটেটো ছিলো, সালেম ভাই খুব বিজি ছিলো ”

” গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের আইন কী ছিলো? ”

” আমি আসলে শুধু.. ”

“আইনটা কী ছিল মেহরোজ ? ”

গ্যাব্রিয়েল ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছেন নদী ক্ষীণগলায় বলল, “আই এম স্যরি স্যার ”

” ডোন্ট বি মেহরোজ, এই স্যরি শুনতে শুনতে, গত কয়েকডিনে আমার খান পসিয়া গেসে ”

” খান পসিয়া গেসে ” বিষয়টি কী, তার তর্জমা নদী করতে পারলো না।এইসময় সালেম ভাই মিনমিন করে এগিয়ে এলো, ” স্যার একটু ট্রাই দিন, আজ আমরা এটা কমপ্লিমেন্টারি ডিশ হিসেবে সার্ভ করেছি ক্লায়েন্টের রিভিউও ভালো।স্যার প্লিজ ”

সালেমের কথার সম্মান রাখতেই গ্যাব্রিয়েল বিরক্ত মুখে কাঁটাচামচ দিয়ে চপের কিছু অংশ ভেঙে মুখে দিলেন।

নদী খেয়াল করলো জিএসের ভ্রুকুটি করা চোখ একটু একটু সহজ হচ্ছে।খেতে খেতে তেতুলের চাটনিটা টেনে নিয়ে আগে গন্ধ নিলেন, তারপর এক টুকরো চপ ডিপ করে মুখে দিলেন।রম্য চোখ বন্ধ করে এর তৈরি প্রণালী ভাবছে, সরল ভাবে প্রস্তুত করাই এর বিশেষত্ব। ক্রিসপি, ঝাল, টক, মশলাদার চেনা অদ্ভুত একটা স্বাদ! খুবই অথেনটিক সেই সাথে দারুণ ব্যালেন্সড।

জিএস একটা ঝলক নদীর মাথা নিচু করা চেহারা দেখে গম্ভীর গলায় বলল, “মেহরোজ, কাল থেকে তোমার ওয়েট্রেসের ডিউটি অফ ”

রাজিয়া শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অপেক্ষায়। বেশি পাকামো করছিলো, একে বলে ইট মেরে পাটকেল খাওয়ার মতো।

” কাল দুপুরের শিডিউল থেকে তুমি কিচেনে জয়েন করবে সালেম ভাইয়ের এসিস্ট্যান্ট শেফ হিসেবে!আমার মনে হয় গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে একজন নিউট্রিশনিস্টও দরকার ”

নদী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।জি এস এগিয়ে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করছে তার সাথে, বিষয়টা ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।গোটা বিষয়টিই যেন ঘোরে পাওয়া মনে হলো। ঘোরের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ডিউটি করলো, ঘোর নিয়েই যেন সেদিন বাসায় ফিরলো।একা রিক্সায় সাড়ে এগারোটার রাতের রাস্তার ভয়ডরও যেন হারিয়ে গেল। কানের মধ্যে বাজছে হ্যান্ডশেক করার সময় নিচুগলার উচ্ছাস,

” হোয়ার হ্যাভ ইউ বিন সো লঙ লিটল গার্ল? কত জায়গায় খুঁজেছি তোমায় ”

কেউ যদি এভাবে বলে তাহলে মনে হয় হাসতে হাসতে বিল্ডিং থেকে ঝাপ দিলেও ব্যথা লাগবে না। এই লোক এমন করে কেন বলল? মেরে ফেলতে চায় নাকি? কাল থেকে কিচেনে ডিউটি, মরে গেলে ডিউটি করবে কীভাবে?

আজকে রাতে তো মনে হয় ঘুমই হবে না। আচ্ছা ঘুম যদি না হয় সকালে উঠে তো পচা দেখতে লাগবে। হুহ, এমনিতেই যেন কত না ভালো দেখতে। মা তো নদীকে কালোই বলতো, জি এসের গায়ের রঙের কিয়দংশ যদি তার হতো…।কী মানাতো।
আকাশকুসুম কল্পনায় ছেদ পড়লো হঠাৎ করাঘাতে, নদী সতর্ক হয়ে উঠে বসলো। ভেতর বাড়ির সাথের দরজায় কেউ করাঘাত করছে। রাত প্রায় পৌনে একটা বাজে, এখন তাকে গৃহকর্তার কি প্রয়োজন পড়ল বুঝতে পারছে না।

” এই যে একটু খোলো, দরকার আছে ”

ভদ্রমহিলার কন্ঠে কিছুটা আশ্বস্ত হলো নদী। ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলে অবাক হলো, মধ্য রাত্রে নাইটি পরিহিতার কেমন রুদ্র কঠিন মূর্তি। পেছনে জসিম স্ত্রীকে ধরে টানছে,” নার্গিস প্লিজ ”
কিন্তু তিনি শুনছেন না।
নদী বলল,”জি আপু ”

“একটা দরকারে এসেছি দেখো তো এইটা কি তোমার? “ভদ্রমহিলা হাতে একটা সাদা অন্তর্বাস দেখালো। নদীর মুখের বদলে যাওয়া রঙ তার উত্তর দিয়ে দিলো।

” নির্লজ্জ, বেহায়া, আমার বাড়িতে বসেই ব্যবসা শুরু করসিস না? ”

মহিলার মুখ মুহুর্তে হিংস্র হয়ে গেছে
নদী মুখ থেকে সব শব্দ খসে পড়লো কি বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না।

” নার্গিস তুমি কি শুরু করলে আসো না প্লিজ…” জসিম স্ত্রীকে ধরে টানছেন, নার্গিস ঘুরে ফনা তুলল যেন, ” শুরু তো তোরা করসিস আজ আমি আগেই নিষেধ করসিলাম এই ছি**ল মা**ইদের ভাড়া দিয়ো না ; কিন্তু তোর তো জোয়ান মাইয়া দেইখাই লোল পড়তেসিলো… ওই মা**ই এই বাড়ি থেকে বের হ।এখনই বের হ!”

নদী স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে, তার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।গোটা পরিস্থিতি ঠিক বাস্তব মনে হচ্ছে, না মনে হচ্ছে কোন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।

“বের হবে মানে? রাত একটা বাজে মাথা ঠিক আছে? ” জসিম মিন মিন করে বলল।

” মাথা এখনো ঠিক আছে বলেই ও আস্ত আছে, নয়তো এতক্ষণে খুন হয়ে যেত। এই মেয়ে বের হবে এবং এখনই বের হবে। নয়ত এই মেয়েকে আমি জেলে পাঠাবো।”

” জেলে পাঠাবেন মানে কেন জেলে পাঠাবেন আমি কি করেছি? “নদী সাহস নিয়ে বলল।

নার্গিস হিশহিশ করে বলল,” কী করসিস? শোন আমার সোনার চেইন চুরি করছিস আমি নিজে পাইসি তোর রুম থেকে তুই দেখতে চাস? এখনই ডাকতেসি পুলিশ… ”

মহিলা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো, জসিম তাকে থামাতে রীতিমত হাতাহাতি করছে; কিন্তু বিশাল বপুরর সাথে পেরে উঠছে না।সেখান থেকে যুদ্ধ করতে করতেই বলল,

” নদী শোন ওর একটু সমস্যা আছে থাইরয়েডের, খুব প্যারোনয়েড হয়ে যায়। তোমার কোন আত্মিয়ো কেউ কাছে কাছেপিঠে?তোমাকে আজ রাতটা একটু রাখতে পারবে না, আমি সামলে নিবো কিন্তু এখন ও….। এর আগেও একটু ওয়াইল্ড হয়ে গেছে, এইজন্যই কোন কাজের লোক থাকতে চায় না…”

নদীর মনে হলো পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে সে যেন আরও নিচে ধ্বসে যাচ্ছে। মন যেন নিজেই প্রশ্ন করছে একাকীত্বের এত ভয়াবহ রূপ আগে কখনো দেখেছে কী?এইদিকে ঘরের মধ্যে তান্ডব শুরু হয়ে গেছে,
” বাইর কর ওরে, নাইলে খুনাখুনি হয়ে যাবে আল্লাহর কসম…!”
তীব্র ভয় গ্রাস করছে , একা এতরাতে কোথায় যাবে নদী?

( চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম

ডিসক্লেইমার
(কিছু টক্সিক কথা)

*

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here