বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ২৭

0
354

#বাতাসে_তার_সৌরভ–২৭

” এই ওঠ, ওঠ! আরে! এই মেয়ে.. চোখ মেলো! ”

নদী আধোঘুমে কোনভাবে তাকালো।বুঝলো, তার সামনে ঝুঁকে থাকা অপরিচিত মুখটা তাকে জাগাতে আসেনি, নিজের স্বার্থে এসেছে।

-দয়া করে এলার্মটা বন্ধ কর। পুরো বাড়ি উঠে গেছে এর আওয়াজে।ভোর সকালে একটু আরাম করে ঘুমানোর জো নেই। ”
পাশের ঘরের নাবিলা গজগজ কর‍তে করতে বেরিয়ে গেল।

পিন পিন করে আওয়াজ ছড়িয়ে আছে ঘরময়। মোবাইলের একটা যন্ত্রণা হলো এলার্ম যে সেট করে সে ছাড়া বাকিরা জেগে বসে থাকে। নদী চোখ কচলে এলার্ম বন্ধ করতে করতে ধাতস্থ হলো।
আজ সকাল সাড়ে আটটায় ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশানের টিউটোরিয়াল। তৃষার এসএমএস করেছিল সেই গতরাতে। ম্যাজমেজে ভাব ছুড়ে ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে তৈরি হলো নদী।নিশি তার পাশে ল্যাড়া মেরে এখনো ঘুমাচ্ছে।তার আর চিন্তা কী দেখতে দেখতে যাবার দিন নিকটে আসছে। এদিকে নদীর গোটা এক সপ্তাহের গ্যাপ,সামনেই টার্ম ফাইনাল, আর সামান্য ঢিলেমি দিলে সর্বনাশ।

” ক্যারিয়ারে ফোকাসড হতে গেলে কোর্স কমপ্লিট করা খুব জরুরি। যা শিখবে সবই কাজে লাগবে। ”

রিকশার ঝাঁকুনি খেতে খেতে গ্যাব্রিয়েলের সাদামাটা কথাগুলো হঠাৎ বিশেষ মনে হচ্ছে। সাতক্ষীরা থেকে কাল প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ তারা পৌঁছেছিলো নদীর সাবলেট বাড়ির সামনে।
” আমরা উঠবো কোথায়? ঢাকায় প্রবেশের পর নিশির প্রশ্ন। মবিন রম্য কিছুটা বিভ্রান্ত।
– ” আমার বাসায়।”নদীই যেন বিষয়টা আরও সহজ করে দিলো,” আমার বইখাতা কাপড়চোপড় সব ওইখানে, কাল ক্লাসও আছে। আর তুইও তো আছিস! গিয়ে গোসল করে ঘুম দিবি একটা। ”

বাকিরাও মেনে নিলো কিন্তু নদীর ভেতর কোথাও যেন একটা অন্য আকাঙ্খা, অন্য একটা কৌতুহল ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল, যাকে বড় কষ্টে দমন করেছে ।

” টেক কেয়ার নদী, পরে কল দেব তোমাকে ” এতটাই ছিল রম্যের বিদায় সম্ভাষণ।

শহরের বাতাসে পেট্রোল পোড়ার গন্ধ ম্লান হয়ে টাটকা সৌরভ , রাস্তার মিউনিসিপালিটির ঝাড়ুদার ঝাড়ু দিচ্ছে ধোঁয়া তুলে ; পাড়ার কুকুরগুলো বিভিন্ন বাড়ির গেটে গোল পাকিয়ে এখনো ঘুম, ইউনিফর্ম পড়া ছোট বাচ্চারা স্কুলের উদ্দেশে হেঁটে চলেছে ফুটপাত দিয়ে৷
সকালে শহরটা একটু একটু জাগ্রত হতে দেখে নদীর মনে হচ্ছে, যাহলো তার কিছুরই আসলে অস্তিত্ব নেই। লম্বা ঘুমের স্বপ্ন শুধু। তবে অবিশ্বাসটা ভুল প্রমাণ করছে হাতের চিকন দুটো চুড়ি। সর্বনাশ! রিকশায় বসে চমকে উঠল নদী। এগুলো এখনো হাতে!রাতে খুলতেই মনে নেই কিন্তু রাখবেই বা কোথায়? মামিরা বলেছেন, বিবাহিতাদের হাত খালি রাখতে নেই।আসলে মিথ্যা সংস্কার! তবে মানতে ইচ্ছে হয়। যাহোক চুড়ি না খুলে নদী তার লম্বা হাতার জামার ভেতর ঢুকিয়ে কলেজের গেট পেরোলো।

ক্লাস আজ টানা কয়েকটাই হলো। বেশ লম্বা ছুটি কাটিয়ে তৃষা আর সুবর্ণার জেরার মধ্যে পড়বে ভেবেছিল কিন্তু তেমন কিছু হলো না। এই দুজন অন্য কোন কারণে দারুণ উত্তেজিত।নদী ক্লাস সেরে ক্যানটিনে বসলো পেন্ডিং ক্লাসনোট নিয়ে। ঝড়ের গতিতে হাত চালাচ্ছে, বাকি দুজনের আড্ডায় মেতে সময় নষ্ট করতে চাইছে না। সামনের সপ্তাহ থেকে টার্ম শুরু পরের মাসে সেমিস্টার।এদিকে চোখে ভাসছে অন্য এক রাজপুত্রর মুখ তার মসনদ ! সবকিছু তাল পাকিয়ে বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

সুবর্ণা হঠাৎ কানের কাছে ঝুঁকে এসে বলল -বিয়ে হয়ে গেছে বুঝলি!

-কী!

-আরে ওই ভি আই পি গ্রুপে সিলভিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। দেখিস না ছবি দেখা হচ্ছে আগ্রহ নিয়ে।”

নদী তাকিয়ে দেখলো ওইদিকে বেশ জটলা। সিলভিয়া মেয়েটা কোন এক মন্ত্রী মিনিস্টার পরিবারের শুনেছিলো। এমন মেয়েরা বেশ প্রগতিবাদী, নাকউঁচু টাইপ হয়। তার জোড়া এত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে ভাবা যায় না।আজ ওকে ঘিরে দারুণ জটলা। চেনা অচেনা সব মেয়েরাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আকতের ছবি দেখতে। সুবর্ণা তৃষার আগ্রহ হলেও আত্মসম্মানবোধ বা কনফিডেন্সের অভাবে যেতে পারছে না।

গার্লস ক্যাম্পাসে কোন মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া বিষয়টার ব্যাপক অর্থ। বিবাহিত মানে তার ব্যাক্তিগত জীবন অন্যান্যদের থেকে একস্তর ওপরে উঠে গেছে । তার এখন থাকা, খাওয়া, চলা বসার মধ্যে দশটা কুমারী মেয়ের থেকে কিছু অন্য মাত্রা আসবে, তার বিশেষ একজনকে নিয়ে আলাদা আলাদা রকম বলার মতো গল্প থাকবে৷ যেগুলো আংশিক শুনিয়ে বাকি বন্ধুদের বুক জ্বালিয়ে কয়লা বানিয়ে দেওয়া যাবে। এদের চোখেমুখে কেমন বিজয়ের দীপ্তি থাকে। সিলভিয়া মেয়েটার মধ্যেও কেমন ক্রেস্ট জেতা ভাব। মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে তার ফোন গ্যালারির ছবিগুলো দেখছে সে আহ্লাদী গলায় বলছে,
” আল্লাহ জানিস না দোস্তো একেবারে হুট করেই হয়ে গেল! আব্বুর সে কি কান্না মাত্র দুই সেট গয়নাই রেডি ছিলো ”

বাকি মেয়েরা মুগ্ধ হয়ে শুনছে । প্রত্যেক বাঙালি মেয়েদের জন্য বিয়ের গল্প সাদামাটা হলেও কোন রূপকথার থেকে কম নয়। এই গল্প তারা খুব আয়োজন করে বলতে ভালোবাসে। নদীরও বলতে খুব লোভ হচ্ছে, কিন্তু তার গল্পটা শোনার কেউ নেই।

” রম্যের বাবার সাথে কথা হয়েছে, উনি আমাদের সাথে মিট করতে চাইছেন। তার আগে আপাতত বন্ধুদের জানাস না শুনলেই বলবে, খাওয়া ” শানুখালার নিষেধাজ্ঞায় নিজেকে সামলে নিলো নদী। বিয়ে, রম্য, একসাথে কাটানো রাত! একটা অদেখা জীবনের হাতছানি ; বেশি ভাবলেও গা ঝিমঝিম করে।

“তোর কী হইসে রে, ফিরে এসে একেবারে থম ধরে আছিস “তৃষার জেরায় নদী চমকে উঠলো।

” মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে কী করলি বললি না তো “সুবর্ণার প্রশ্ন।

“কী আর করব বিয়ে বাড়িতে আটকে ছিলাম, কত কাজ থাকে”

তৃষা মাথা নেড়ে বলল ” আমারও মনে হচ্ছিলো তোকে কামলা খাটাতেই নিয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষ ঢেকি কপাল নিয়ে আসে।স্বর্গে গেলেও ধান ভানবে নরকে গেলেও । বিয়ের ঝামেলা সামলিয়ে এখন রেস্টুরেন্টের ঝামেলা মেটাতে হবে, যাবি তো? চাকরি আছে? ”

নদীর এতক্ষণে জ্ঞান হলো।আসলেই তো দুটার পর থেকে ডিউটি। বান্ধবীদের সাথে লাঞ্চ না করেই বেরিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করে।
চেনা গলি, চেনা কর্মস্থল , অথচ অর্থ বদলে গেছে।আর মাত্র কয়েকদিন সোহরাব সামদানীর সাথে বড়মামা শানুখালার মিটিংয়ের পর পুরা পরিস্থিতি পালটে যাবে।ঘটনা শুনে গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের সব স্টাফদের চেহারা কেমন হবে ?

” হোয়ার দ্যা হেল হ্যাভ ইউ বিন গার্ল? আমি তো ভেবেছি চাকরিই ছেড়ে দিয়েছ ” লিজা তার ছোট চোখজোড়া যতদূর সম্ভব বড় করে বলছে। নদী অল্প হাসলো।

“জিএস নেই, তুমি নেই এত রাশ ছিল রেস্টুরেন্টে, কী আর বলব ”

” সব ঠিক হয়ে যাবে”

নদী নিজের শেফ এপ্রোন গায়ে চড়াতে চড়াতে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল।তুষার কাজের ফাঁকে চোরাচোখে তাকাচ্ছে।নদী গুরুত্ব না দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে কিচেনে ঢুকে গেল।পুরোনো স্টাফদের সাথে নতুন দুজনকে দেখা গেল।একজন অল্প বয়সী তরুণী নদীর থেকে কয়েক বছরের বড়ই হবে সুরাইয়া নাম, আরেকজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। এরা কিচেনে কি করছে? নদীর প্রশ্নের জবাব হলো না।

” কী হে নদ-নদী খালবিল! কোথা থেকে টপকালে ভাই? আমি চিন্তায় চিন্তায় বাঁচি না ” সালেম ভাই আগ্রহী হয়ে বললেন

” টেনশন নেই সালেম ভাই এখনো আস্তই আছি ” নদী মুখে হাসি নিয়ে বলল।

” তোমাকে আস্ত দেখে ভালো লাগলো ” নদীর পেছনে জেরিন থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। ” কিন্তু এখন আমি যা কিছু বলতে চাচ্ছি তা শুনে তোমার ভালো লাগবে না। “জেরিন কথাগুলো বলতে বলতে নিরীক্ষণ করছে নদীর ইউনিফর্ম।
” আমি কিছু বুঝলাম না ম্যাম”

” বুদ্ধিমতী মেয়েদের বোঝা উচিত। দুইদিনের ছুটি নিয়ে এক সপ্তাহ বেড়িয়ে এসেছ” বলতে বলতে জেরিনের কন্ঠ কঠিন হয়ে এলো।নদীকে ইশারায় একটা কোণায় ডেকে নিয়ে গেল জেরিন । নদী দ্রুত চিন্তা করছে কী জবাব দেবে।

জেরিন স্বগতোক্তি করলো,” তুমি কি চাকরি করছ না শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসেছ? ”

নদী কিছু বলতে গেলেও জেরিন তাকে হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো, “তুমি খুবই ট্যালেন্টেড, তোমার সম্ভাবনাও ছিল, কিন্তু এটা কোন ফাজলামোর জায়গা না। আমার হাত নিয়মে বাঁধা। গ্যাব্রিয়েলস কিচেন তোমার আনপ্রফেশনাল বিহেভিয়ার এফোর্ট করতে পারবে না! ভেরি সরি টু সে দ্যাট ইউ আর ফায়ারড ”

নদী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
” জি এস স্যারের আগ্রহে তোমাকে কিচেনে ওন ট্রায়াল চান্স দেয়া হয়েছিল,তুমি ভালোও করছিলে, কিন্তু এটা কন্টিনিউ করা সম্ভব হলো না। নেক্সট মাসের প্রথম সপ্তাহে তুমি চলে এসো আমি তোমার পুরো সেলারিটাই ম্যানেজ করে দেয়ার চেষ্টা করব। ”

নদী আঘাত পাবার থেকে বিস্মিত যেন বেশি হচ্ছে। কিচেনে নতুন শেফের ব্যবস্থা তাহলে এই কারণে?এখানে জয়েন করার পর গত ছয় মাসে নদীর অপমান, অপদস্ত সহ অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। এটাই কি বাকি ছিলো? কিছু না বলে নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করছে চেষ্টা করছে সোহরাব সাহেবের সাথে কথা বলবে না গ্যাব্রিয়েল বা রম্যের সাথে৷ হঠাৎ যেন পরম কাঙ্ক্ষিত মর্মর হাতের স্পর্শে খসখসে অনুভব হচ্ছে।

কিচেনের সবাই নীরবে তাকিয়ে, রাজিয়া পাশে এসে সমবেদনার কন্ঠে বলল, একে তো করেছ গাফিলতি তার ওপর জেরিনেরও হৃদয় ভাঙা। ”

রাজিয়া নদীর দিকে ঝুঁকে গলানিচু করে বললেন ” এই কয়দিনে বড়স্যারকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছিল বলে। মাঝখানে কী নিয়ে বিগড়েছে কে জানে। যাকে দেখছে তার ওপর গজগজ করছে । তুমিও তার শিকার, বুঝলা? কী আর করা। ”

রাজিয়ার কথায় কিছু আর না করার থাকলেও সোহরাব সাহেব কিছু করলেন, রাউন্ডে এসেই। সালেম ভাই কায়দা করে কানে দিল নদীর বিষয়টা। অচিরেই ডাক পড়লো জেরিনের,

” ইউ ফায়ারড হার! কীভাবে একটু এক্সপ্লেইন কর ” সোহরাব বিস্মিত হয়ে বললেন।

” স্যার, বিনা নোটিশ একটা সপ্তাহের গ্যাপ। কোন ধরনের ব্রিফিং নেই, কোন ইনফর্ম করা নেই, এদিকে রেস্টুরেন্টে কি পরিমাণ রাশ! টোটাল ল্যাক ওফ কমিটমেন্ট, আমার শুধু রুলস ফলো করার চেষ্টা করেছি।

” সমস্যা হলো করেছ তুমি! যেটার এখতিয়ার তোমার নেই “সোহরাব সাহেব বললেন।”কেউ কোন কারণে থাকবে কোন কারণে যাবে লেট মি টেক দ্যাট ডিসিশন। তোমার এই ঝামেলা নেবার দরকার নেই তো ”

সোহরাবের ক্যাবিন থেকে যখন দুজন বের হলো নদীর মুখে স্বস্তি। বের হবার মুখে সোহরাবের চোখের পলক ফেলে আস্বস্ত থাকতে বলাটাও তার কাছে অনেক বড় পাওয়া। জেরিনের তার মতো হিল খটখটিয়ে সোজা চলে গেল তার কেবিনে।নদী আবারও দ্রুত হাতে শেফ এপ্রোন পরে নিলো৷

” বাপরে সেরের ওপর সোয়া সের দেখছি। নদী, সোহরাব স্যারকে কিভাবে ম্যানেজ করলে বলবা?লিজার প্রশ্ন।

” সবকিছু কি আর ম্যানেজ হয় , বড়স্যার নিজের বুদ্ধিতে চলেন।

” না না আমি আগেও খেয়াল করেছি তোমাকে তিনি একটু বেশি গুরুত্ব দেন। ”

” আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কেউ না ”
.
” অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তোমার মধ্যে কেমন রানী রানী ভাব আছে। ”

নদী হেসে ফেলল লিজার কথায়।
কাচের কেবিন থেকে জেরিন তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। এই মেয়ের কোন পরিবর্তন হয়েছে, অবধারিত ভাবে হয়েছে, সেটা কী? লিজার সাথে কথার মাঝে জি এস নিচে নেমে এসেছে। এখানে আসার প্রায় তিন বছর পর জি এস স্বদেশে ফিরেছিল।দুই সপ্তাহের মাথায় আবার ফিরে আসবে কেউ ভাবেনি। জি এস এর প্রত্যাবর্তনে সবচেয়ে চমকে গেছে জেরিন।

আজ দীর্ঘ যাত্রা শেষে লম্বা ঘুম দিয়ে জেগেছে সে। স্নান সিক্ত ঝকঝকে অবয়ব। ডিউটি বদলের আওয়ারে সব কিচেন স্টাফ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জি এস আগামী পার্টির আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলেন সবার কুশল বিনিময় করলেন।
নদী এক দুই ঝলক দেখেও তার চোখ পড়তে পারলো না। পুরোদস্তুর পোশাকি পুরোনো অবয়বে জিএস, রম্য যেখানে আবৃত।

জিএস নিজেরমতো ব্রিফিং করলো, সিজন চেঞ্জের সাথে সাথে নতুন মেনু রেডি করবেন কিচেনের সবার সাজেশন দরকার। তবে ব্রিফিং শেষে একটা কান্ড ঘটলো, জিএস সোজা হেঁটে এলো নদীর কাছে। জেরিনের ঠোঁটে ধারালো হাসি।।
জিএসএ’র কানে নদীর এপসেন্সের বিষয়টা চলে গেছে। গ্যাব্রিয়েল কোন কথা বলেনি ফোনে। তবে জেরিনের আন্দাজ আছে ছেলে বাবার কথা পাত্তা দেবে না।

” মোহরোজ ”

” ইয়েস স্যার ”

” আজ রাতে চাই তোমাকে,
নদী মাথা তুলে তাকালো।

” আমি কিচেনে থাকবো, এক্সক্লুসিভ কিছু মেনু হবে,আমাকে এসিস্ট করবে রেসিপির সব কিছু এরেঞ্জ করবে, গট ইট? ”

” গট ইট স্যার ”

নদী রক্তিম মুখে জবাব দিলো । জেরিনকে না দেখেই গ্যাব্রিয়েল তার ক্যাবিনে চলে গেল।রাজিয়া তার বিশাল চোয়াল ঝুলিয়ে দীর্ঘ সময় নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

” জেরিন ম্যাডামের মেজাজ আজকাল সপ্তমে চড়ে আছে। আজাইরাই ঝামেলা করে। আমিই জিএসকে বলসি বুঝছ…” তুষার পাশেপাশে হেঁটে নদীর কানে বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে,” আরে এত ট্যালেন্টেড তুমি, জিএসের তোমাকে হারানো মানে কিচেনের বিরাট লস। ইয়ে সাতক্ষীরায় তো তোমার বিয়েটিয়ে হয় নাই তাই না? হলে তো বলতা… “তুষারের ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে নদীর মাথা ধরে যাচ্ছিলো হঠাৎই —

” তোমার হাতের চুড়ি গুলো তো সুন্দর ” রাজিয়ার কাছ থেকে প্রশ্ন উড়ে এলো, ” স্বর্ণের নাকি? মনে হয় তো স্বর্ণের ”

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লিজাও নদী অল্প হাসলো কোন জবাব দিলো না। জেরিন স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,সম্ভবত কিছু বলতো, নদীও রম্যের মতো তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে কিচেনে হেঁটে গেল। কেন যেন আজ মাটিতে পা ফেলতে ইচ্ছে করছে না।

******
নিশিকে বেশি দিন নদীর হোস্টেলে থাকতে হয়নি চার-পাঁচদিন পর শানুখালা এলে সে মায়ের সাথে হোটেলে উঠে গেল।নিশির দীর্ঘ ছয়-সাত বছরের ছড়িয়ে থাকা জীবন গুছিয়ে বাক্সবন্দি করা কিছুটা দুরহ। সারাদিনে মা মেয়ে টুকটুক করে শপিং করে আর লাগেজ গোছায়। আজ ছুটির দিনে নদী এসেছে নিশির প্রিয় একটা আইটেম নিয়ে।

” এই চকলেট পুডিং নদীর হাতের? ”

শানু অবাক। নিশি মাথা দুলিয়ে বলল, ” আই টোল্ড ইউ তুমি পাগল হয়ে যাবা। নদু হলো ফুড ম্যাজিশিয়ান! ওর হাতের চিকেন কোর্মা তুমি যদি খেতে… আগের বাসায় আমাদের নিজের চুলা ছিল উফ মানে মাথা নষ্ট রাঁধে মম ! ”

” তাই তো দেখছি, আর যাইহোক রানু একটা ভালো কাজ করেছে, তোর মাও ভালো রাঁধতো কিন্তু এত ভালো না। তোর দাদি মিনুপাকে রান্না শিখিয়েছিল।”

শানু তৃপ্তি নিয়ে পুডিং খেতে খেতে বললেন, “তোর দাদিও কোরমা ভালো পারতেন। একবার তো তোর এক ফুপু কি যেন নাম রাবেয়া, সে রান্নার অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছিলো। মেহমানের জন্য তোলা ছিল, সে কী রাগ খালাম্মার ”

নদী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ” রাবেয়া ফুপি ওই বাড়িতে থাকতেন?

” থাকতো তো। অনেকেই থাকতো। তোর৷ বাবার তো ভাইবোন কেউ ছিলো না।তবে দূরের আত্মিয়োস্বজনে ভরা জমজমাট বাসা ছিলো। তোর দাদা ভাড়াটে পছন্দ করতেন না। শুধু ছাদে কে জানি সাবলেটে থাকতো, আমার অত মনে নেই। তোর মায়ের বিয়ের দুবছর পর আমি আমেরিকা চলে যাই”

নদী আগ্রহ নিয়ে শুনছে।ওই বাড়ি সম্পৃক্ত সব গল্পই সে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। রাবেয়া ফুপির কথায় মনে পড়লো, তিনি ঢাকায় আসার পর নিয়মিত কল দেন দুই একবার আড়ালে দেখাও করেছেন ।নদীর বিয়েতে তিনি আনন্দিত , ” খুব ভালো হয়েছে। তোমার একটা শক্ত আশ্রয় দরকার ছিলো। কতবার ইচ্ছা হয়েছে তোমাকে আমার কাছে রাখি। কিন্তু তাতে তুমি কলেজ কন্টিনিউ করতে পারতে না। তোমার মামারাও ঝামেলা করতো।বাই দ্যা ওয়ে, তোমাদের ফ্রেন্ডশিপ যে এত দূর গড়াবে বুঝিনি, রম্য এত পছন্দ করে তোমাকে?

– ঠিক জানি না আন্টি।

– আমেরিকান ছেলেরা হুট করে অনেক কিছু করে ফেলে তবে বিয়ে না। বছরের পর বছর একসাথে থাকলেও বিয়ে ওদের জন্য একটা বিশাল ডিসিশন। ইমোশনাল এটাচমেন্ট ছাড়া রম্য এমন কিছু করেনি৷ গুড জব গার্ল!

রাবেয়ার প্রশংসায় নদী লজ্জিতর সাথে একটু বিব্রতও হয়৷ যেন রম্যের হৃদয় জয় করা তার একটা মিশন ছিল।
তবে মিশন না থাকলেও এই মোড় তাকে নতুন লক্ষ্যের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আজকাল কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে সময় মনে হয় চন্দ্রমল্লিকা যেন হেসে ফেলে তাকে দেখে। গ্যাব্রিয়েল কিচেনে নদীর অবস্থান যদিও আগের মত আছে। গ্যাব্রিয়েলকে এসিস্ট করছে কয়েকটা ডিশ একহাতে সামলাচ্ছে, সাথে পুরোদমে পড়ার চাপ । গ্যাব্রিয়েল কুশল বিনিময় করে, ক্লাসের খবর নেয়,
– ক্লাস ঠিক মতো করছ?
-জি স্যার ( ব্যক্তিগত কথায় আজকাল নদীর স্যার ডাকতে বাধে)
-বাসায় সমস্যা হচ্ছে?.
– না
– নিজের খেয়াল রেখ, দরকার হলে জানিয়ো । ”

মানুষটা যদি জানতো নদীর আসল দরকারটা কী… ৷ তবে কখনো সখনো হঠাৎই চুলার হাই ফ্লেমের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নদীকে দূর রাখা, ফ্রাইয়ের সময় সাবধানবানীগুলো নিরাপত্তার খাতিরে হলেও এখন নতুন অর্থ দাঁড় করাতে ইচ্ছে করে। নদী ধরে নেয় মানুষটা হয়তো একটু রিজার্ভই। কিন্তু এই মানুষটার জন্য নদীর আগ্রহ চারগুণ বেড়েছে৷ আগ্রহে আগ্রহেই একটা বিষয় জেনেছে রম্য দিনের লম্বা সময় তার ভাইয়ের সাথে কথা বলে কাটায় । তার জীবনে মা-ভাইয়ের অবস্থান কেমন, তার কেমন বন্ধু আছে, এগুলো নদীর জানতে ইচ্ছে করে। এখনো সবকিছু অধরা। সোহরাব সাহেবও কিছুটা গম্ভীর হয়ে থাকেন আগের মতো ততটা সময় নিয়ে গল্প করেন না। নদী স্পষ্ট বুঝতে পারে এই গাম্ভীর্যের জন্য দায়ী সে। আশঙ্কা হয় তাকে নিয়ে পিতা-পুত্রের লড়াই হয়েছে কী?

রাবেয়া নিজের মতো যুক্তি দেখায়,
” ব্যাপারটা ওপেন হয়নি তো এইজন্য সাবধানে থাকতে হচ্ছে। তাছাড়া ওই জেরিনটা প্রচন্ড ধুরন্ধর৷রম্য বা সোহরাবকে তোমার কনফিডেন্সে নেবার আগে যদি আঁচ করতে পারে বিরাট ঝামেলা পাকাবে”

“কী ঝামেলা আন্টি? ”

” এই জেরিন অনেক বড় গ্যাঞ্জাম করে বসে আছে। এইজন্য রম্য যখন চাইছে একটু চুপচাপই থাকো, সাবধানে থেকো ”

রাবেয়া নিয়মিত তাকে ব্রিফিং করে যায়, কিচেনের খবর নেয়। সোহরাবের খবরের সাথে জেরিনের খবরও নেয়। নদীর মনে হয় যেন সে কোন ষড়যন্ত্র কান্ডের সাথে না চাইতেও জড়িয়ে যাচ্ছে।
রাবেয়া আশ্বাস দেন তিনি সব ঠিক করে দেবেন। নদী এই বিষয়েও ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারে না। রাবেয়া ফুপির সাথে সোহরাব সাহেবের একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে, রম্য ফেরার পর তার সাথে যোগাযোগ হলেও তিনি রম্যের সাথে সাতক্ষীরা যাননি। এখন একসাথে বসে মিটিং করবে কি না নদী জানে না।
বড়দের যত জটিল জটিল সমীকরণ।

ভাবতে ভাবতে একটু অবাক লাগে এখন তো সেও বিবাহিত। বড়দের কাতারে সে কি পড়ে না? না আসলে ঠিক এখনো পড়েনি। মূলত এই অস্বচ্ছ, পৃথিবী নিয়ে তার কোন ধারণাও নেই। সেদিন তার ক্লাসের সিলভিয়াকে কোনায় নিয়ে গায়ের ওড়না খুলে বান্ধবীরা কি দেখে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। কলেজের মেয়েদের ভাষায় এটা হলো মেডিকেল করা। বান্ধবীরা হাসিমুখে সিলভিয়ার গলা ঘাড়ে গালে দাগ খুঁজছে। নববধূদের নাকি থাকে। নববধূর এমন কিছু কেন থাকবে নদীর ঠিক মাথা ঢুকছিলো না, তৃষাটা বুঝিয়ে বলতেই নদীর মুখ নীল-বেগুনী হয়ে গেল।

নদীর অবস্থা যেন সিন্দুক আছে চাবিও আছে তবে চাবির ঘরটা কোথায় জানা নেই। উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় তার সাথে কাজে মনোযোগ দেয়া যেমন মুশকিল,এদিকে বিয়ের পর নিশিটার জ্বালাতন সামলানোও আরেক মুশকিল। দেখা হলেই পচানো শুরু করে,

” কিরে নদু, আজ বাবুর্চি তোকে কয়বার কিস করলো টেলমি টেলমি”

“হাবিজাবি কথা রাখ!”নদী খুব সন্তপর্ণে এড়িয়ে যায়।

” বুঝছি তোকে ট্রেইন করতে হবে,এই বিষয়ে এক্সপেরিয়েন্স হইলে আর হাবিজাবি কইতি না। ইটস এ ফ্যান্টাসটিক ফিলিংস বেবি, নট হাবিজাবি এট অল ”

” সারাদিনই তো ব্যস্ত থাকে” নদী যেন সাফাই গায় রম্যের। ”

” তোর কিছু হয় নাই এইটা টেনশন না, বাবুর্চি কিছু করলো না এইটা টেনশন, আমার চিন্তা এই হালায় গে না তো?”

” মানে! ”

” মানে টু মাচ পারফেক্ট পুরুষগুলোর মধ্যে এই ক্যাচাল আছে, আর রম্য থাকে আমেরিকায়। যেইখানে এইগুলো নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নাই কিন্তু এইখানে তো আছে। গে বলেই তুই সহজ টার্গেট ছিলি, নদী তোর যে কী হবে রে”

নদী গা ঝাড়া দেয়, সে এতটা জানে যে রম্যের সমস্যা নেই,” তুই নিজের চিন্তা কর, মবিন ভাইয়ের খবর কী আসার পর দেখা নাই”

” ওই গোল আলুর খবর আমি জাইনা করব কী?মমস এর চামচা”

” তোর প্রতি কেয়ারিং ”

” এই টাইপ ক্যারেক্টর একটা মাছি পেলে তার প্রতিও কেয়ার দেখায়। একটা মিষ্টি গোল আলু। নট মাই টাইপ ”

নিশি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় কথাটা। তবে নদীর তাদের পথে চলতে খুনসুটিগুলো খেয়াল করেছিলো। মবিনের চোখে একটা মমতাই দেখেছিলো নিশির জন্য। কিছু একটা ব্যাপার হয়েছে অবশ্যই, নিশি যেন হুট করে গুটিয়ে ফেলেছে নিজেকে।

নিশির আশার মতো না হলেও আজ বলার মতো নদীর সাথে একটা ব্যাপার হয়েছে।
নদী জিএসের ক্যাবিনে, রেস্টুরেন্টের জন্য নতুন ইনগ্রেডিয়েন্স আইটেমগুলো নিয়ে কিছু বলার জন্য। এগুলোর কোয়ালিটি আগের মতো নয়। কোম্পানিও নতুন ৷ খাবারের স্বাদে আজকাল তারতম্য হচ্ছে। সালেম ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছিল জিএসের অনুপস্থিতিতে এইগুলো জেরিন ম্যাম অর্ডার করেছেন। নদী সেখানকার ফিস সস দিয়ে বানানো একটা আইটেম জিএসের দিকে এগিয়ে দিল। গ্যাব্রিয়েল মুখে দিয়ে, গম্ভীর হয়ে গেল। মজার ব্যাপার হলো সে কিচেনে থাকতে এই আইটেমগুলো সাবধানে সরিয়ে ফেলা হয়। জিএস শেফ সালেমকে দ্রুত প্রতিটি নতুন আইটেম সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলো। জেরিন ক্লায়েন্ট ডিল করছিলো, বিষয়টা যে জানলো না। জিএস এরপর নদীর দিকে ফিরে বলল

“আমাদের মনে হয় কথা বলা দরকার
ফর সাম পারসোনাল ইস্যুজ!সাতক্ষীরা থেকে ফিরে আমাদের নেক্সট মুভ নিয়ে তোমার মনে প্রশ্ন থাকতে পারে ”

নদী উত্তর দিলো না। বুকে নাকাড়া বাজছিল।
” আমি সময় নিচ্ছিলাম। আফটার অল তোমার সিকিউরিটি দেওয়া আমার ডিউটি, আমি গ্রেটফুল যে তুমি এত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছ”

” আপনার ওপর বিশ্বাস আছে ”

“আমি জানি, কিন্তু কথা বলার জন্য এটা সঠিক জায়গা নয় ।” জিএস ওরফে রম্য গলা নামিয়ে বলল” আলাদা জায়গায় বসে বলতে হবে। তোমাকে নিয়ে আমার যত প্ল্যান আছে সেগুলো ডিস্কাস করব। রেডি থেকো ”

নদী বুঝে উঠতে পারছিলো না কি জবাব দেবে।

” ডোন্ট ওয়ারি,এরপর সব ভালো হবে ”
নদীর হাতে রম্যের হাতের আলতো চাপটা এখনো যেন লেগে আছে।

নিশির কথা মতো এটা তেমন কোন রগরগে অভিজ্ঞতা নয়। তবুও সামান্য স্পর্শেই নদী কাথ। এটা এখন বললে আবার হাসির পাত্রী না হয়।

বিচিত্র আবেগের টানপোড়েন, আজ নিশির লাগেজ প্যাক করবে বলে নাইট ডিউটি মওকুফ করে এসেছে, কিন্তু এখানে মনোযোগ দিতে পারছে না। নিশি নিজের মতো লাগেজ গোছাতে গোছাতে চোখের কোণায় আর্দ্রতা জমছে, যা নদী ঠিক খেয়াল না করে,
রম্য তাকে আলাদা ডেকে কী বলবে এই নিয়ে উত্তেজনা ধামাচাপা দিতে চাইছে। লাগেজ গোছানোর এক পর্যায়ে শানুখালা একসেট থ্রিপিস এগিয়ে দিলেন নদীর দিকে,

“সন্ধ্যায় পরে নিস, রাতে রম্যের বাবা সোহরাব সাহেবের ফ্ল্যাটে আমাদের দাওয়াত। ”

” আমি তো জানি না কিছু”

” রম্য কিছু বলেনি?”

” বলেছিল কিন্তু বাসায় যেতে হবে এটা মনে হয় বলেনি, নাকি বলেছে আমি ভুলে গেছি ”

শানু হাসলেন, “স্বামীর কথাগুলো দয়া গিলে না খেয়ে কান খাড়া করে শুনিস। তোদের বড় মামাও যাবেন ইতোমধ্যে ঢাকায় এসে পড়েছেন এখন গিয়ে মুখের ছিরিছাঁদ একটু ঠিক কর ”

নদী রক্তিম হয়ে গেল। নিশি আগ্রহী হয়ে মেকাপ কেমন করবে এই নিয়ে মেতে গেল৷ মেয়েদের উচ্ছাস দেখেও শানু ঠিক স্বস্তি পাচ্ছেন না৷রম্য ছেলেটাকে বিয়ের বিষয়ে তিনিক ভাইকে রাজি করিয়েছিলেন ৷ এর পেছনে অনেকগুলো যুক্তি ছিলো। এক হলো নদী সিকিউরিটি, শক্ত হাতে গেলে এই নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না। আমেরিকান৷ সিটিজেন যেহেতু নদীর পড়া শেষে সেখানে সেটেল হতে কোন সমস্যা হবে না তারওপর নিশির একাকীত্ব কেটে যাবে। শানু কাছাকাছি থাকলে নজর দিয়ে রাখতে পারবেন। রম্যের পরিবার সম্পর্কে যতটুকু খবর নিয়েছেন সবগুলোই বেশ শক্ত ভিত্তির।ধানমন্ডির কোথায় এদের রেস্টুরেন্ট সেটা নদীর কাছ থেকে জানা হয়নি। তবে রেস্তরার ব্যাবসা এদের আমেরিকাতেও আছে।
কিন্তু সব খবর পোক্ত হবার পরেও ঢাকা ফিরে নদীকে আবিষ্কার করেছেম তার গার্লস হোস্টেলে। তাহলে রম্যের বাবা কি বিয়েটা মেনে নেননি? এই ছেলে মাথা গরম করে বিয়ে করে বসল নাতো? আমেরিকানদের মধ্যে আবেগ যেমন চড়া ভাবে আসে, তেমনি হুট করে আবেগ চলেও যায়।

শানুর মাথায় চিন্তার চাপ,মৃত বোনের বাচ্চাটার নিরাপত্তার ভাবনায় আরও অসহায় করে যাচ্ছেন কি না বুঝতে পারছেন না। রম্য দায়িত্ব বুঝে নিলে তাকে আরও অনেক কিছুই বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন৷ তার আগে জানা প্রয়োজন নদীর চাকরি করে কোথায়, কতটা সুরক্ষিত সেখানে। এই মেয়েটাকে নিয়ে অন্য একটা ভয় আছে যা নদী নিজেও জানে না। যে কারণেই মোজাফফর ভাইজান নদীকে ঢাকায় পাঠাতে চাননি। রম্য কি বিষয়টা বুঝবে।

*******

” এসো এসো রাবু দেরি হলো যে?”

সোহরাব আন্তরিকভাবে দরজা খুলে দিলেন৷ রাবেয়া ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
” হাতে কাজ ছিল সেরে আসতে হয়েছে।”
রেষারেষির পর রাবেয়াকে এমন পারিবারিক মিটিংয়ে সোহরাব ডেকে পাঠাবেন ভাবতে পারেননি।

” সুন্দর ফ্ল্যাট সোহরাব ”

” থ্যাংকস ইন্টেরিয়রটা ইউনিক না?

রাবেয়া উত্তর দিলেন না। সোহরাব আগে গ্যাব্রিয়েলের সাথে রেস্টুরেন্টের তৃতীয় তালার ফ্ল্যাটেই থাকতেন। ছেলের থেকে আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিলেন চার-পাঁচ মাস আগেই। নতুন বাড়িটা রাবেয়া আগে দেখেননি।আজ মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। আধুনিক ডিজাইন, তবে চড়া রঙের ব্যবহার। এটা সোহরাবের পছন্দ অবশ্যই নয়। এই রং এর মধ্যেই সোহরাবের প্রেয়সীর দর্পিত উপস্থিতি চারিদিকে।

” তা একাই এত কিছু আয়োজন করতে গেলে আমাকে জানালেই পারতে, ও আচ্ছা আমার উপস্থিতিতে তোমার গার্লফ্রেন্ড পছন্দ নাও করতে পারে”

“এই মিটিংয়ে তোমার উপস্থিতি তো কম্ফোলসারি ছিল রাবেয়া। আমার ছেলের জীবনে এত বড় মোড় ঘোরানোর হোতাকে এভাবে ইগনর কীভাবে করি? ”

রাবেয়া চমকে গেলেও দ্রুত সামলে নিলেন৷ সোহরাব স্বগতোক্তি করে বললেন, ” পুরো বিষয়টি তুমি ফাঁকে থেকে ভালো ভাবে এক্সিকিউট করেছ। রম্যকে কায়দা করে সাতক্ষীরা পাঠিয়েছ এখানে বসে তাকে বিয়ের জন্যেও কনভিন্স করেছ। ”

” তাতে কি কোন ক্ষতি হয়েছে সোহরাব? ”

” লাভ-ক্ষতির হিসাব আলাদা, আমি আমার এই ছেলেটার সাথে গেইম খেলতে চাইনি । রম্য আর অর্ণবের মধ্যে পার্থক্য আছে ”

” যাক তাও ভালো যে বুঝতে পারলে। তবে ভেবো না যা হয়েছে একসময় তুমি আমাকে থ্যাংকস দেবে,”

সোহরাব সাহেব রাবেয়াকে কড়া গলায় কিছু বলতে চাইছিলেন কিচেন থেকে রম্যের আওয়াজে সামলে গেলেন। আজকের ডিনার আয়োজনের কিছু আইটেম তারই রান্না করা। সোহরাব এই বিয়ে নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলেননি। রাবেয়ার ব্রেইন ওয়াশে যদি ভালো কিছু হয় তাহলে তাই সই। লক্ষ্মী বাঙালি মেয়ের সাথে সান্নিধ্যে ছেলের জীবনে মন বসে গেলে তো ভালোই।
অতিথিদের জন্য রম্যও দেখা গেল পরম যত্নেই ডিনার টেবিল সাজিয়েছে৷ তবে ভেতরে ভেতরে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে। আজ অর্ণবের সাথে তার ভালো তর্কাতর্কি হয়েছে। অর্ণবের যুক্তি অকাট্য কিন্তু রম্যের জন্য সেটা মানা কষ্টকর।

” আমাদের আর চয়েস নেই রমি, ঝামেলা কমাতে রুথলেস হওয়া লাগে,হিসেব করে দেখ এতেই সবার ভালো, বি প্রেকটিক্যাল ”

হয়তো এটাই সত্যি কিন্তু অর্ণবের কথা মাথার মাঝে সুঁচের খোঁচার আঘাত দিচ্ছে।ব্যাপারটা বেশ ঝুঁকির, রম্য কি পারবে?

কলিংবেল বেজে উঠলে রম্য নিজেই দরজা খুলে দিলো।।

” আস সালামু আলাইকুম আন্টি, আঙ্কেল কেমন আছেন আপনারা? ”
স্পষ্ট বাংলায় অতিথিদের স্বাগত জানালো রম্য৷ শানু মোজাফফর সাহেব খুবই খুশি।রাবেয়া আর সোহরাব সাহেব সাদরে বসালেন তাদের। নিশি নদী সরে এলো রম্যের সাথে। দুই কন্যা আজ মিল করে গোলাপি জামা পরে এসেছে৷ তবে নদীর সাজ অনেক বেশি যত্নে করা। নিশি মায়ের মুক্তোর মালা পরিয়েছে নদীর গলায়।
রম্যকে স্বীকার করতে হলো,

” নদী তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে ”

” এবং তোমার কথাগুলো বোরিং শোনাচ্ছে “নিশির অকপট প্রত্যুত্তর,”
ডিয়ারেস্ট বাবুর্চি মোর সেন্সুয়াস ওয়ার্ড ওয়াজ নিডেড ”

” নিশিটা আসলে এমনই মানে…” নদী একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল।

” আই এম গেটিং ইউজড টু ইট ” রম্যে হাসলো।

” হ্যাঁ কিন্তু আমার কাবাবে হাড্ডি হবার জন্য ইউজড টু নই, তোমাদের আশেপাশে থাকলে কিন্তু আমি বিরক্ত করতেই থাকব ”
নিশির কথার জবাব এলো আরেকটি কলিংবেলে। দেখা গেল মবিন ছোট একটা উপহারের বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রম্যই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল । সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার দীর্ঘ যাত্রা, একসাথে ভাগ ভাগ করে ড্রাইভিংয়ের চমৎকার অভিজ্ঞতার জন্য একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য ছিল মবিনের।

” কি অবস্থা মেয়েরা? ”

” ভালোই ছিল, রিসেন্টলি মাথা ধরেছে”
নতুন অতিথির আগমনে নিশির মুখ অন্ধকার মবিন হেসে ফেলল।
” বিয়ের ডেট ফিক্স হয়েছে দাওয়াত দিতে এসছো?. ”

নিশির প্রশ্ন শুনে নদী অবাক । কথায় কথায় জানলো মবিনের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে।নিশি এই বিষয়টা জানেও। একটা কাল্পনিক নদীর উপর গড়া সেতু মুহুর্তে ভেঙে গেল যেন।

” আরে নাহ এমন মেয়ে আম্মা প্রতি মাসে তিনটা করে দেখে,আমি বাতিল করি। আম্মার এখন মেয়ে দেখা হবি হয়ে গেছে৷ “মবিন নিশিকে প্রতুত্তর করলো।

ডিনারে এখনো দেরি আছে, বড়রা ড্রইংরুমে বসেছেন টুকটাক কথা বলছেন । নিশি মবিনের খুনসুটির মাঝে রম্য হঠাৎ নদীকে বলল, তুমি ড্যাডের ক্যাকটাসের কালেকশন দেখতে চাও?
” ক্যাকটাসের কালেকশন দেখার কি আছে ” নিশি ঠোঁট উল্টে বলল।

” সেটা তুমি বুঝবে না ” মবিন বলল” তোমরা যাও না হয়, আমরা ভেতর বসি”
মবিন পরিস্থিতি গুরুত্ব বুঝে নিশিকে সামলে নিলো।

রম্য নদীকে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলো মনের মধ্যে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে।
*******

” লিসেন টু মি গার্ল ভেরি কেয়ারফুলি! তুই কিন্তু .. ” নিশি বলতে বলতে থেমে গেল।
ব্যাপারটা বিরক্তিকর। দীর্ঘদিন পর নিজ দেশে ফেরত যাবে সামান্য ক্যাজুয়াল কিছু কথা বলতে এত সিলিনেস আসার কথা না৷ তবুও চলে আসছে।গলা ভারী হয়ে আসছে। নদী হাঁদাটা হা করে তাকিয়ে। কিচেনের কাজ সেরে রাতে নিশিদের সি অফ করতে চলে এসেছে৷ একটা একটা করে দিন এভাবে গড়িয়ে যাবে নদী নিজেও বোঝেনি৷ থেকে থেকে নিশির দিকে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে বুকটা কেউ হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো করে দিচ্ছে৷ শানুকে জড়িয়ে এক দফা কেঁদে ফেললেও নিশির কাছ থেকে বিদায় নেওয়া কঠিন। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে গেলে নিশি বিরক্ত হয়ে দেবে একটা ঝাপড়। বিষাদভরা সময়ে পাওয়া সঙ্গীর থেকে সুখের সময় আলাদা হওয়াও একটা পরীক্ষার মতো। যদিও নিশির মতো নিলিপ্ত গলায় বলার চেষ্টা করছে নদী–

“ফিরে গিয়ে একটু পাগলামি কমিয়ে দিদ, পড়াশোনায় মনোযোগী হ। খালামনিকে কিন্তু আর কষ্ট দিস না”

” তুই এত রাতে ডিউটি শেষ করে আমাকে লেকচার দিতে এসেছিস “নিশির কন্ঠে বিরক্তি।

” পাহারা দিতে এসেছি যেতে যেতে হয়তো মূড বিগড়ে যাবে হুট করে বললি যাবি না ”

” ভয় নাই তোর এই ফাও কথায় কিছু আসবে যাবে না। আমার দেশের প্রতি ভক্তি উঠে গেছে কোন আগ্রহ নাই ফেরার। ফালতু ইডিয়ট লোকে ভরা একটা দেশ। এইখানে থেকে তুই বিগড়ে না গেলেই হলো।”

” আরে বিগড়াবে কেন? আর কয়েকদিন পর নদীও আমেরিকা চলে আসবে! “শানু খালা হৃষ্ট কন্ঠে বললেন। সোহরাব সাহেব সেরকমই আশ্বাস দিয়েছেন। মূলত তিনি যা বলেছেন সেটা বেশ যুক্তিসঙ্গত, নদীর সামনে সেমিস্টার পরীক্ষা ।সেটায় কোন হ্যাম্পার যেন না হয় এইজন্য রম্যের আগ্রহেই নদী হোস্টেলে আছে।
রম্যের ফ্ল্যাটের ইন্টেরিয়রও ঠিক করতে হবে। নতুন বউয়ের থাকা নিয়ে কথা, কিছু সময়ের ব্যাপার। এটা ঠিকঠাক করিয়ে অচিরেই ছোট একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করে নদীকে বাড়ি তুলে নেয়া হবে।
সহজ যুক্তি অথচ শানু কেমন আকাশকুসুম ভেবে বসেছিলেন । দাওয়াতে রম্যের আন্তরিকতাও ছিল দেখার মতো৷ নিজ হাতে কি চমৎকার বিরিয়ানি রেঁধেছিল ছেলেটা। মোজাফফর সাহেব তবুও সন্দেহ কমাতে পারেননি। তার মতে দুজন একসাথে থাকুক, মেয়েটার প্রতি ভালো আচরণ করুক তারপরই এদের ভালো পরিবারের সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে।

শানু নদীকে সান্ত্বনা দিলেন —

” তুই ভালো মতো সেমিস্টার পরীক্ষা গুলো দে এরপর তো রম্যের সাথে আসবিই”

” চাইলে এখনই আসতে পারে, এক কাজ কর নেক্সট ফল সিজনেই চলে আয় সোজা ক্যালিফোর্নিয়া এসে যাবি “নিশির কথায় নদী হাসলো কোন উত্তর দিলো না মবিন পরম নিষ্ঠার সাথে লাগেজ ট্রলিতে উঠিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটাকে দেখে শানুর ছোট একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। মবিনের একটা দুঃখজনক অতীত আছে তার সাথে একটা খুবই সংস্কারাচ্ছন্ন গোড়া পরিবার। নিশির মতো কারো জন্য এমন কাউকে আশা করা কিছুটা দুরাশা ।
সব ভালো সবার জন্য মানানসই নয় এই সান্তনা বুকে নিয়েই চলে যেতে হচ্ছে। মবিনকে বলে গেলেন যোগাযোগ রাখতে। নদী এতদূর মূলত তার ভরসাতেই এসেছে।ফিরতি পথে মবিন তাকে নামিয়ে দেবে।

“মবিন কেন এই ডিউটি তো বাবুর্চির, সে কোথায়? ”

নদী ব্যস্ততার বাহানা দিয়ে এড়িয়েছে।তবে বুকের কাঁপুনি বেড়েছে কয়েকগুণ। কখনো কখনো কিছু পরিস্থিতি মানুষকে নুতন করে নিজেকে চেনায়। সেইদিন সোহরাব সাহেবের ফ্ল্যাটে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রম্যের কথাগুলো নদীর ভেতরে কতটা এলোমেলো করে দিয়েছে সেটা আর কাউকেই তার বলতে ইচ্ছে করেনি। পরিস্থিতি যেন তার মুখটাকে সেলাই করে দিয়েছিল।

” তুমি ওই ঝামেলায় আমার জন্যই ফেসেছিলে” কথাগুলো রম্য শান্ত গলায় ধীরেধীরে বলছিল, ” আমি তোমাকে কোন সমস্যার মধ্যে দেখতে চাচ্ছিলাম না। আমি জানি তুমি এম্বিশাস এবং ট্যালেন্টেড। একটা আনওয়ান্টেড সম্পর্ক এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, তোমার ফ্যামিলি অন্য কোন লজিক বুঝতেই চাইছিল না।তাই সে মুহূর্তে তোমাকে ওখান থেকে মুক্ত করতে আমার যা সঠিক মনে হয়েছে তাই করেছি। কিন্তু তুমি আমি দুজনেই জানি এই ঘটনার পেছনে ভালোবাসা প্রেম বা আবেগ কিছুই ছিল না। ইন এভরি মিন উই আর পোলস আ পার্ট ”

নদী স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে। রম্য কিছুটা বিব্রত হয়ে বলল

” আই মিন আই রিয়েলি লাইক ইউ এজ এ পারসন। তুমি খুব চমৎকার, আমার তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে,, তোমার কাজ ভালো লাগে, তোমার গাটস, জীবনের স্ট্রাগলও খুব ফেসিনেটিং, কিন্তু এই ফিলিংসটা তেমন নয় যেমনটা প্রেমের জন্য যথেষ্ট হয়। আর প্রেমে পড়লেও কী, আমি তো কারো প্রেমে থেকেও বিয়ে করতে চাই না! আমার লং টাইম গার্লফ্রেন্ডের বিয়ের খুব শখ ছিল, সেটা পূরণ করতে একবার রাজি হয়েছিলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে
শখ মেটেনি তবে আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। এই ভুল দ্বিতীয়বার আমি করতে চাই না। বিয়েটা আমার কাছে একটা পোশাকি কমিটমেন্ট । সম্পর্কের উপর কোন বিশ্বাস না থাকলে এটা স্থায়ী হয় না,তা যতগুলো কাগজেই তুমি সাইন করো। তুমি যতই শপথ কর…যা ভাঙার তা ভাঙবেই। আর মানুষের মাইন্ড চেঞ্জ হয়, হৃদয়ও ভাঙে। কাজেই কেন শুধু শুধু কেন অযথা সম্পর্কের সার্টিফিকেটের পেছনে ছোটা? ”

” তা হলে… আমি এখন কী করব? ”

” এনজয় ইউর ফ্রিডম ।”রম্য জোর দিয়ে বলল,” ইমাজিন এখন তোমার ওপর খবরদারি করার কেউ নেই! যে কাগুজে বিয়ের যা কিছু আছে আমি সেই সমস্যার সলভ করে দেব । আমি একজন লইয়ারের সাথে কথা বলেছি, এই রেজিস্ট্রিটা তো মুসলিম ম্যারেজ ল তে হয়েছে। সেই হিসেবে তোমার এলিম্যানি হলো কাগজে উল্লেখিত টাকাটাই তাই না? সেখানে উল্লেখ আছে দশ লাখ টাকা অর্থাৎ আমেরিকান ডলারে প্রায় এগারো হাজার। (২০১৮ সাল)! আমি তোমাকে বারো হাজার পে করে দেবো। তোমার কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে? থাকলে আমাকে অ্যাকাউন্ট নাম্বার দাও। আমি ট্রান্সফার করে দেবো। এর পর লিগ্যাল প্রসিজার করে ঝামেলা মিটিয়ে নিলেই হবে। ”

নদী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো রম্যের দিকে। কত সহজ-সাবলীল গলায় বলে চলেছিল,” এই অ্যামাউন্টটা তোমার জন্য খুব জরুরী।তোমার ভবিষ্যৎ গড়তে কাজে আসবে। আর গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে তোমার চাকরি তো বহাল থাকবেই। তুমি যত শিখবে তত দক্ষ হবে।আর আমি তো গাইড করবই, ট্রাস্ট মি যা করছি তা তোমার ভালোর জন্যই ”

নদী বাকরুদ্ধ ছিল বেশ কিছুক্ষণ স্বাভাবিক হবার জন্য উঠে দাঁড়াল। ওয়াশরুমে গিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে স্বাভাবিক ভাবে সবার সাথে ডিনার করতে বসলো।রম্য হাসিমুখে সবাইকে আপ্যায়ন করছিল। ডাইনিং টেবিলে বসে নদীর তখনও পুরো বিষয়টি বিশ্বাস হচ্ছিল না।বুকটার ভেতর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া হৃদয়টা চিৎকার করে কাঁদতে ভুলে গেছে অনেক আগেই।এত সহজে সুখ ধরা দেবে এটা ভাবলেই বা কিভাবে? নদীর কেন যেন নিজের বোকামিতেই কেমন রাগ হচ্ছিলো। সেই রাগ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে, বড় মামার ওপর, নিজের ভাঙা ভাগ্যের ওপর,মৃত বাবা-মায়ের ওপর, থেকে থেকে রাগ উঠেছে রম্যকে দেখেও। কিন্তু এই রাগের সাথে লড়তে গিয়ে ক্লান্ত লাগে। গনগনে রাগটা শান্ত করে কাজ করে যায় নদী।

অন্যদিকে মনের লোভাতুর অংশ বলছে একসাথে দশলাখ টাকা! খারাপ কী? ভবিষ্যতে তার তো টাকার দরকারই। অন্য অংশ গ্লানিতে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। পরিবার-পরিজন হীন একটা মেয়ে কি এতই সস্তা ? না সে সস্তা না তাহলে কেন কাঁদবে? নিশিও তেমন কাঁদছে না নির্লিপ্ত গলায় মবিনকে বলছে,

” এনিওয়েজ কয়েকটি দিন তোমাকে বেশ দৌড়ের ওপর রেখেছিলাম তুমি বেশ পেইসেন্সের সাথে আমায় হ্যান্ডেল করেছ। এইজন্য আই এম নট সরি এট অল।আমার কথা তুমি শুনেছ নিজের রিস্কে, ওয়াট ক্যান আই ডু? ”

” তোমাকে কিছু করা মানায় না। তবে আমি বোধহয় তোমার অর্ডারক্যারি করা মিস করব ” মবিন সরল গলায় বলল।

” ওহ রিয়েলি? তুমি যেন মিস না করো সেই ব্যবস্থা করছি, “নিশির ষড়যন্ত্রী কন্ঠে মবিন হেসে ফেলল।
নিশি ঘুরে তাকাল নদীর দিকে, যে এখনো শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে, চোখে অশ্রু নেই,

” ওকে মিস হার্ড নাট, আসি রে। হ্যাভ ফান উইথ ইউর বাবুর্চি! আমায় আপডেট জানাতে থাকিস কত দূর গেলি আই উইল বি ওয়াচিং ইউ গার্ল… ”
নিশি খুব ক্যাজুয়াল ভাবে একটু জড়িয়ে ধরে গটগট করে সামনে এগোলো। শানু একটু অবাক হলো। এত সহজে দুইজন বিদায় নেবে আশা করেননি তিনি।

মায়ের পাশে নিশি দ্রুত হেঁটে ভেতরে যাচ্ছে। তার লাগেজ স্ক্যান হচ্ছে সে মায়ের সাথে কী নিয়ে তর্ক করছে।দূরে নদী দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। তার এই প্রথম কেমন একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাঁর নিজের বলে আর কিছুই নেই। এমন কেউ নেই যাকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে পারে। ক্লান্ত অবসন্ন অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে মবিনের সাথে।নদীর চোখ ঝাপসা হলেও সেথা হতে পানি গড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছে।

” নদুউউউ! ”

হঠাৎ চিৎকারে সবাই তাকিয়ে আছে। শানু থেমে গেছেন নিশি জোরে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে নদীকে

” নদুরে! তোকে ছাড়া কীভাবে থাকব রে! তুই তো একা গাধামির উপর গাধামি করেই যাবি, তোকে কে সামলাবে?বাবুর্চি পারবে তো? নদু! নদুরে ”

নিশি নদীকে জড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে যাচ্ছে । আশেপাশের মানুষ ঘুরে তাকিয়ে দেখছে এই দুই বোনের বিচিত্র কান্না। বিদায় বেলার অশ্রুর মাঝে বিচিত্র মায়া জড়ানো থাকে। সবার চোখেই সংক্রমণ হয়। এই জগতে মায়া বড়ো মন্দ জিনিস।
******

পরদিন সকাল সাড়ে বারোটা। নিশিকে সি-অফ করে দিয়ে রাতে ভালো মতো ঘুম হয়নি। বিচিত্র গা ম্যাজম্যাজে ভাবের কারণে আজকে কলেজে ও যায়নি। কেন যেনো আজকে কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না । কর্মক্ষেত্রেও নয়৷
গনগনে রাগ মাথায় নিয়ে কতদিন স্বাভাবিক থাকতে পারবে তাও জানে না নদী। রাগটা নিজের ওপরও কম নয়, টাকাগুলোর মায়া কাটাতে না পারার রাগ। এদিকে মনের কোন একটা অংশ তাকে প্রবোধ দিচ্ছে এগিয়ে যেতে হলে টাকা দরকার এতগুলো টাকা তাকে কে দেবে? গ্যাব্রিয়েল যা করেছে তার ক্ষমতার মধ্যে সেটাই হয়ত সেরা। হয়তো নদীর জন্য তার তেমন আবেগ ছিল না।কিন্তু এই কয়দিনে দেখা অস্পৃশ্য স্বপ্নগুলোর জন্য রাগ উঠে যাচ্ছে। যে রাগেরও কোন অর্থ নেই।

সকালবেলা লম্বা সময় বিছানায় পড়ে থেকে যখন উঠলো তখন মোবাইলে বেশকিছু মিস কল৷ কয়েকটা রম্যের, কয়েকটা অচেনা। মেসেজও এসেছে কয়েকটা রম্যের প্রশ্ন ব্যাংক একাউন্ট খুলেছে কিনা টাকাটা দ্রুত ট্রান্সফার করতে চায়। নদী ফোনটা সুইচড অফ করে নিজের মতো থাকল। ঘর গোছানো কাপড় ধুলো । নিশির কাপড়-চোপড় এখনো ঘরের মধ্যে ছড়ানো। মনোয়ার কাটাতে অল্প কিছু বাজার করবে ভাবল। নিচে দারোয়ান থেকে ফোন নদী আপার একটা পার্সেল হাজার তিনেক টাকার”
” আমার কোন অর্ডার নেই ”
” ওহ তাইলে শ্যামা নন্দী আপার হইব”
নদীর পাশের ঘরেই মেয়েটা থাকে মাঝেমাঝেই তার নামের পার্সেল নদীর কাছে চলে আসে। নদী তাকে জানিয়ে রেডি হয়ে নিচে গেল। মনে মনে বাজারের লিস্ট ঠিক করতে করতে সিদ্ধান্ত নিলো আজ কাজে যাবে না। তবে চিন্তাটা হোঁচট খেলো অচিরেই। প্রমো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। মুখ অন্ধকার
” হেই নদী, কল দিয়েছি কয়েকটা এরপর দেখি ফোন সুইচড অফ ”

” আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে কেন আমার সুইচড অফ?” নদীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল কিন্তু কিছুই বলল না। নিজের অক্ষমতায় রাগ যেন আরো বেশি বেড়ে গেল।

” তোমার সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলাপ ছিল ”

” স্যার আমার একটু বাইরে যাওয়া প্রয়োজন ছিল ”

” আমি ড্রপ করে দিচ্ছি, কিন্তু আমার কথাগুলো শোনা বেশি ইম্পর্টেন্ট। তোমাকে একটু আমার বাবার সাথে কথা বলতে হবে। আমার ডিসিশনের কথা কাল বাবাকে বললাম, জানি না কেন সে খুব উইয়ার্ডলি এক্ট করছেন।আমার সাথে রীতিমতো চিৎকার।আমি যেন পাগলের প্রলাপ বকছি, বাংলাদেশে কেউ এভাবে মেয়েদের কি ডিভোর্স দেয় না? আশ্চর্য ”

নদী হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল। রম্য বলল,” হোয়াট এভার, তোমাকে তার সাথে কথা বলে বোঝাতে হবে যে ডিসিশনটা আমাদের দুজনের ঠান্ডা মাথায় নেওয়া৷ এতে তোমার কোন আপত্তি নেই। ওভার-অল এটা তোমার ভালোর জন্যই ”

” আমার ভালোর জন্য ডিভোর্স! ”

” অভিয়াসলি, যেখানে ভালোবাসাই নেই আমরা এমন কোন সম্পর্কে থাকবো কেন? আমিতো এটা করেছি.. ”

” আমাকে আরো বেশী আশ্রয়হীন করার জন্য… ” নদী শান্তস্বরে জবাব দিলো।

” এক্সকিউজ মি, বুঝলাম না”

“বোঝার প্রয়োজন নেই। আপনার থেকে ভালো ওই মাছের ঘেরের মালিক তার সাথে আমার বিয়ে হলে সে যেভাবে পারতো আমায় অন্তত আগলে রাখতো”– নদীর বন্ধ ঠোঁটে এই কথাগুলো বল্কে উঠছিল কিন্তু বলতে অপারগ! কেন সে এত দুর্বল,এই মুহূর্তে নিজেকে এতটা মেরুদণ্ডহীন ভেবে মরে যেতে মন চাইছে৷

রম্য বলছে” ড্যাডের ধারণা আমি এই দেশের আইন নিয়ে খেলছি,এমন কিছু করে তোমায় আরো ইনসিকিউরিটিতে ফেলছি কিন্তু আসলে তো এটাই তোমার সিকিউরিটি ..”

রম্য বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল, স্থিরদৃষ্টিতে এক ঝলক নদীকে পেরিয়ে সামনে দেখে একটা বিচিত্র কাজ করে বসলো। নদীকে হঠাৎ হ্যাচকা টান দিয়ে একপাশে সরিয়ে নিয়ে এলো, ঘটনার আকস্মিকতায় নদী কিছু বুঝলো না।পরমুহূর্তেই খেয়াল করলো তার ঠিক পেছনে পার্ক করা গাড়ির ডিকির ওপর কেউ সজোরে পানি ছুড়েছে, কিন্তু বিচিত্র ভাবে পানি লাগা অংশটায় নতুন গাড়ির ডিস্টেম্পার পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে।রম্যের তড়িৎ সঞ্চালনে অল্পের জন্য নদীর গায়ে লাগেনি৷

” আল্লা এটা কি, এসিড! ” পাশ থেকে কেউ চিৎকার করছে।

“ওই শালার বাচ্চা খাড়া, ওই!

গাড়ির ড্রাইভার রেগে মেগে তাড়া করছে আচমকা হামলাকারিকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করতে গিয়ে নদীর রক্তহীম হয়ে এলো –এই গরমে চাদর দিয়ে মুখ ঢাকা হলেও, লম্বা মুশকো জোয়ান শাহীনকে চিনতে ভুল হলো না৷ মুখে তখনও লক্ষ্যভেদ না করতে পারার আক্রোশ৷
পালানোর আগে হাতের বোতলটা তরল সহ নদীর দিকে আরেকবার ছুড়ে দিলে। রম্য তখন নদীকে আড়াল করে আবারও সরে এলো কাছের একটা পিলারের দিক্র।

– ও মাই গড নদী, এটা তোমার সাইকো কাজিন, নয় ?

কিছুক্ষণ আগে মনে মনে ধিক্কার জানানো রম্যের শার্ট খামছে নদী তীব্র আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে। মৃত্যু ছুঁয়ে যাওয়া কি একেই বলে?

( চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম
দুইটা পর্ব মিলিয়ে দিলাম এই জন্য দেরি হলো। যার জন্য বিনীত ভাবে দুঃখিত। টাইপো থাকলে পরে ঠিক করব। ভয়ংকর ব্যস্ততা যাচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here