বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ১১

0
248

#বাতাসে_তার_সৌরভ–১১

দক্ষ রাঁধুনিরা অনেকটা শিল্পীদের মতো তুষ্টি খোঁজে। বুফেট ডিশে চিকেন পারমিসন মিটবল, রিবোলিটা,আর স্টেকসের আশেপাশে মানুষের ভীড় রম্যকে আচ্ছন্ন করছে তেমন ভাবেই যেমন কোন
প্রদর্শনীতে ছবির দিকে মানুষের মুগ্ধতা শিল্পীকে আচ্ছন্ন করে।আজ ইটালিয়ান ডিশ স্পেশাল ব্রেকফাস্ট ফিস্ট ছিলো। এই জাতির একটা বিষয়ই খুব ভালো,নির্দিষ্ট খাবারে অভ্যস্ত হলেও এরা বিভিন্ন পদ খেতে ভালোবাসে; আর রম্য এদের খেতে দেখতে খুব ভালোবাসে। অফিসরুমে বসে মনোযোগ দিয়ে মানুষের মুখের অভিব্যক্তিগুলো সে পড়ে। এই সময়টায় বাদ বাকি কিছুই তার মাথায় থাকে না। এমনকি মা রেবেকার কন্ঠও না।

” জায়গাটা নিউ অর্লিন্সে বুঝলে, ইন্ডিয়ান কাপলসের ছিলো তারা এখন ক্যানাডায় চলে যাচ্ছে ”

” ওফ কর্স মম”

” তুমি কী বল? ”

” খুব ভালো ডিল মম, আমি খুবই খুশি তোমার জন্য, এগিয়ে যাও .. ”

” রমি,অলরেডি আমি এগিয়ে গেছি৷ এই উইকেন্ডে পেপারওয়ার্ক হয়ে গেছে।আমি নতুন ইনটেরিয়রসের কথা বলছি, তুমি আমার কথা শুনছ না কেন? ”

” শুনেছি তো …”

“আমার মতে তোমায় সাইকিয়াট্রিস্ট কাউন্সিলিংয়ের বসতে হবে। রমি বয়, আমি খুবই চিন্তিত তোমাকে নিয়ে। তুমি স্টাক হয়ে আছ একজায়গায়, পালিয়ে বেড়াচ্ছ আর পালালেও কোথায় একটা ক্লুলেস জায়গায় ”

রম্য হাল্কা গলায় বলল,” এই ক্লুলেস জায়গাতেই তুমি প্রেমে পড়েছিলে মম”

” স্টুপিড জায়গার নিজেস্ব স্পেল থাকে৷ মানুষ স্টুপিডিটি করে ফেলে। ”

মায়ের কথায় রম্য হেসে ফেললো।

” বেবি বোঝ, আমি চাচ্ছি না তুমি তোমার বাবার কাছাকাছি এসে বিরক্ত হও। তার প্রাইভেসির গুরুত্ব দেয়া উচিৎ”

” বাবার প্রাইভেসি, বুঝলাম না” রম্যের চোখ আটকে আছে সিসি মনিটরে। রেবেকা বলে চলেছেন,-

” বুঝতে চেষ্ট করো না।সে তার নিজেস্ব অভাববোধেই স্বদেশে চলে এসেছে। পুরুষদের চাহিদা অবারিত। সে নিজের দেশে এসেছে নিজের মতো উপভোগ করতে। তোমার সঙ্গী যখন মনোপোজে পড়বে তোমারও চাহিদা অপূর্ণ রয়ে পারে… ”

রম্য নিশ্চিত হলো মা তার নার্ভের ওষুধ নিয়োমিত খাচ্ছে না। চেইন রেস্টুরেন্ট দেখাশোনার সময় বাদে অবসরে এই উল্টোপাল্টা চিন্তা তার পিছু ছাড়ে না।

রেবেকা নির্বিকার হয়ে বলে যাচ্ছে,
” আমি বলছি রমি, তোমার বাবাকে ছেড়ে ব্যাক কর সে ডিস্টার্বড হচ্ছে। তোমার কী মনে হয় সে সিংগাপুর একা গিয়েছিল? ওই রাবেয়া তার সাথে যায়নি? ”

” রাবেয়া আন্টি ইন্ডিয়াতে মম” রম্য ছোট নি:শ্বাস ফেলল,” আর তারা একসাথে গেলেও লুকানোর কিছু ছিল না ”

” তবুও লুকিয়েছে সমস্যা এইখানেই৷ এমনকি তারা দেশে ফিরেছে আলাদা আলাদা। তোমার বাবা আগে ফিরেছে তার কিছু পরেই দেখবে রাবেয়া ফিরবে।আমি তোমায় ছবি পাঠালাম দেখ।তোমার বাবস একটা ডিজাইনার লকেটও কিনেছে, তাও আমার ফ্রেন্ডের শপ থেকে।কার জন্য?

” আমি নিশ্চিত সেটার রাবেয়া আন্টির জন্য না মম”

“ঠিক তার এখন রাবেয়াকে ভালো লাগছে না, সে অল্পবয়স্কা খুঁজছে। এক বয়সে গেলে পুরুষরা নিজের ফ্যান্টাসি পূরণ করতে চায়, আই অলসো রেস্পেক্ট দ্যাট, আমি সত্যি বলছি তোমাকে… ”

রম্য ছোট নি:শ্বাস ফেলে কোন মতে মায়ের সাথে কথার ইতি টেনে কাজে মনোযোগ দিলো। গতমাসে প্রায় চারটা বড় বড় ইভেন্ট কভার করেছে রেস্টুরেন্ট। ক্লায়েন্ট যথেষ্ট ছিলো কিন্তু সে তুলনায় লাভের গতিটা একটু ধীরজ। খাবারের র ম্যাটেরিয়েল গুলোর জন্য খরচটা সব সময় উর্ধ্বমুখী। এই দিকে না জিতলে টার্গেট ফুলফিল হবে না। তবে রম্যের কোয়ালিটি নিয়ে কম্প্রোমাইজ করতে ভালো লাগে না।এইদিকে ভূতের একটা গুজব ছড়ানোর ভয় তো আছেই এই বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।বাবার সাথে কথা বলা,দরকার, মা আরেক নতুন ইস্যু তৈরি করেছে এটা কিসের ভিত্তিতে কে জানে।

” স্যার ”

রম্য চমকে গেল রাজিয়া মাথা নিচু করে খুব নি:শব্দে হাটাচলা করতে পারে।বেকারি শেফ ফ্লোর সুপারভাইজার ক্ষিপ্রে স্বভাবের এই মহিলার ব্যবহার নিয়ে সবার অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু রম্য তার কন্ঠে কখনো উঁচু শোনেনি, উলটো সামনে এলেই অদ্ভুত কমলকন্ঠিতে রূপান্তর হন তিনি।

” বল রাজিয়া”

” স্যার নতুন ম্যাটেরিয়েল সব চলে এসেছে৷ আইসিং সুগার আর ফন্টেন্ট ক্রিমের যে ব্রান্ড সেগুলোই নতুন…মানে অতটা ভালো না জেরিন ম্যামকে বলেছিলাম কিন্তু উনি কথার পাত্তা দেননি ”

” আমিই দিতে নিষেধ করেছিলাম”

রাজিয়া তাকিয়ে আছে। গ্যাব্রিয়েল বলল,”এই ব্র‍্যান্ড বেশ জনপ্রিয় কিন্তু তুমি কাজ করনি।আর দামটা যতটা আয়ত্বে থাকবে প্রফিটটাও ততই কন্ট্রোলে থাকে।
জিনিসগুলো যাচাই করেই আনা। কাজ শুরু করে দাও। আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন অতিথির সার্ভে করতে আসার কথা। কোন ঝামেলা যেন না হয় সেদিনের মতো ”

“সেদিনও ঝামেলা হতো না স্যার যদি একজন অ্যামেচার তাদের সাথে ডিল না করত। ”

গ্যাব্রিয়েলের বিষয়টা মনে পড়লো। কিছুদিন আগেই ঘটেছিলো। দুজন অসম্ভব জনপ্রিয় ফুড ব্লগারের সাথে আরো একজন ছিলো শ্রেয়া। তআর মাধ্যমে তিল থেকে তাল হতে যাচ্ছিলো।এই শ্রেয়া চরিত্রটাকে যতটা গ্যাব্রিয়েল এড়াতে চায় ততটাই সে পেছনে লেগে থাকে। মূলত এই গ্যাব্রিয়েল কিচেনের ভৌতিক কর্মকান্ডের অন্যতম হোতা হিসেবেও শ্রেয়া সন্দেহজনক। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে রম্যের হাত-পা বাঁধা। এই দেশে প্রভাবশালীরা ঈশ্বরের কাছাকাছি।

রাজিয়া সেইদিনের জের ধরেই বলল, ” নতুন আসা মেয়েটাকে আমি পাঠাতে নিষেধ করেছিলাম স্যার, বাট জেরিন ম্যাম গুরুত্ব দেননি। মেয়েটা ফুলটাইম ডিউটিও করে না ।লিজার ওপর চাপ পড়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে মিস ম্যানেজমেন্ট চলে আসবে “”

“কী নাম যেন, মেহরোজ সাজ্জাদ, ও
ফুলটাইম নয়?”

“জি না স্যার তিনটা থেকে ডিউটি করে।জেরিনের আশকারায় মামারবাড়ির আবদার পেয়েছে। তবে আজ তাড়াতাড়ি এসেছে ”

গ্যাব্রিয়েল মুখ গম্ভীর করে ফেলল।

” ডেকে পাঠাও ”

” আমাকে হলে চলবে?”

রম্য বেশ হকচকিয়ে গেলো। বিদেশি অতিথীদের সাথে আগত এই চরিত্র তাকে সব সময়ই চমকে দেয়। শ্রেয়া মিষ্টি হেসে ঘরে প্রবেশ করলে রাজিয়া দ্রুত বেরিয়ে গেলো রম্য সামাজিকতার হাসি হাসলো ভেতরে অস্বস্তি” হেই শ্রেয়া”

বিখ্যাত সাংসদ পরিবারের কন্যা শ্রেয়া আবার এত দ্রুত ফিরবে ভাবেনি। আজ যেন আরও তৈরি হয়ে এসেছে।দামী এলভি ব্র‍্যান্ডের ব্যাগ কালো উঁচু হিল, কালো বডি হাগিং ড্রেসের গলার কাট অনেক বেশি গভীর। মুখে আবেদনময়ী হাসি।

“বিজি?”শ্রেয়ার আদুরে কন্ঠ

” কিছুটা ”

” তাহলে ফ্রী হয়ে যাও আমার জন্য”

” নিজের জন্যেই সম্ভব হয় না” রম্যের কন্ঠ শীতল। তার সামনে একটা বিষধর সাপ যাকে আঘাতের জন্য মোক্ষম অস্ত্র নেই আবার বেঁচে সরে যাবার কৌশলও জানা নেই। কিন্তু কেন যেন তীব্র বিতৃষ্ণার একটা নিজেস্ব আকর্ষণ আছে। শ্রেয়া হাসিমুখে এগিয়ে গেল রম্যের দিকে, আরো কাছে…।

****

সময়ের আগে কোন জায়গায় পৌঁছালে নিজেকে কেমন অপাংক্তেয় লাগে। আজ কর্মক্ষেত্রের দিকে সে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। তার এখনও ডিউটি আওয়ার নয়। ভোরে ভার্সিটিতে নিউট্রিশন প্রবলেমের টিউটোরিয়েলের পরে আর কোন প্রফেসরের দেখা নেই। বাসায় যেতেও ইচ্ছে করেনি। আজকাল নিশির সাথে সোজামুখে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। শুরুতে চেষ্টা করেছে বোঝানোর।

” নিশি, খালামনি জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।খালুর কথা ভাব ”

– তারা ভাবে আমার কথা? আমি আমি আমার মতো বাঁচব। তোর সমস্যা হলে ফুটে যা!

ফুটে যাওয়ার স্পর্ধা নেই নদীর তবুও হ্যাংলার মতো শুধায় – বাড়িওয়ালা যদি জানে?

– আই ফা** অফ দ্যাট বাড়িওয়ালা। শালী দুইবছরের ভাড়া নিয়া রাখসে মায়ের কাছ থেকে ”

-সেই মাকেই তুই টেনশন দিচ্ছিস লজ্জা লাগছে না তোর ?

– না লাগে না। তোর লাগলে গেট দ্যা ফা** অফ মাই সাইট, ইউ ফ্রাস্ট্রেটেড লুজার । নিজের নাই ঠাইঠিকানা আমাকে মরাল শেখাতে আসে।

” তুই শেখা সবাইকে চুরি করে কিভাবে ঢোল পেটাতে হয়, নির্লজ্জ কোথাকার”

নদী নিচু গলায় বলে চলে এসেছে । নিশির জন্য কেন যেন একই সাথে ঘেন্না হয়, একই সাথে মায়াও। তাকে গন্তব্য দেখিয়েও নিজের ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে। রাগ কমিয়ে সকালে পাউরুটি ডিম দিয়ে ভেজে ফ্রেঞ্চটোস্ট করে নিয়ে গিয়েছিল।

” বাগ অফ! ইউ বি**! রুইন্ড মাই লাইফ লাইক হেল!”

নিশি প্লেট ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে বাকি মেয়েদের উঠিয়েছে। অন্য কামরার মেয়েদের মুখে গুনগুন শব্দ। সে সময়ে নদীর ইচ্ছে করছিল ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু যাবার জায়গা কোথায়? আত্মমর্যাদা জিনিসটা পুষতেও পয়সা লাগে। মর্যাদাবোদব একপাশে সরিয়ে নদীর হিসেব করতে হয়, ঢাকায় চার বছরের অনার্স কোর্স; পড়ার খরচ হোস্টেল খরচ। তার ক্যাম্পাসের প্রিলিমিনারির মেয়েগুলোর দুর্দশা দেখলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়।তার যা জুটেছে অনেকের জোটে না।পাকামো করে উল্টোপাল্টা কোন ডিসিশনে জীবন থেমে যাবে। এখনও সে একটা সাধারণ ওয়েট্রেস তাও পারমানেন্ট হয়নি।তবে শক্ত হয়েছে প্রত্যয়।

গতকাল সোহরাব সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল।দেশে ফিরেছেন দুদিন হলো।ভাগ্যিস তাকে রেস্টুরেন্টে ডিউটি রত দেখেননি।নয়ত তার কলিগদের অনেকে পরিচয় জেনে যেত।

লেকের ধারে বসে নদীই খুলে বলেছে সব।তিনি শুনে দারুণ অবাক হয়েছেন। শুরুতে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। “তোমার কি প্রয়োজন আমাকে বল। আমি ম্যানেজ করব তারপরও পড়াশোনা হ্যাম্পার করে জব করো না, নদী আই ইনসিস্ট”

নদী অনেক কষ্টে সময় নিয়ে তাকে বুঝিয়েছে যে সে নিজেকেই সাহায্য করছে। পড়াশোনা যেন হ্যাম্পার না হয় সেভাবেই তাকে ডিউটি দেওয়া হয়েছে।
সোহরাব সাহেব সম্ভবত সন্তুষ্ট না হয়ে রাবেয়ার সাথে কথা বলেছেন। তিনি তাকে কি বুঝিয়েছেন জানা গেল না। সোহরাব আর কথা বাড়াননি।

তবে এখানে নদীর ওয়েস্ট্রেসের কাজে তার সামর্থন নেই তা স্পষ্ট হয়েছে।বারবারই বলছিলেন, ” ঠিক হলো না একেবারে ঠিক হলো। বিষয় অনেক রিস্কি হয়ে গেল তোমার এখানে এমন জব অনেক রিস্কি…”

নদী বুঝেছিল দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলেও সোহরাব সাহেব এখনো আটপৌরে মধ্যবিত্ত বাঙালির মতোই রক্ষণশীল রয়ে গেছেন একেবারে বড়োমামার মতো। নাকি সোহরাব সাহেবের চিন্তার কারণ টা আলাদা?

এই নতুন ধরনের জীবনে নদীরো যে ভালো লাগে তা না। মনে পড়ে অনেক ছোট্টবেলায় মা-বাবার সাথে চাইনিজ রেস্তোরায় খেতে যেত। বাবা বিলের কাগজের মাঝে কিছু খুচরো টাকা রেখে ফেরত দিতেন। তখন বুঝতো না সেগুলো কী, এখন তেমন টাকার জন্য নদীও অপেক্ষা করে।

দামী এলাকার রেস্টুরেন্ট তাই টিপটাও একশো টাকার নিচে হয় না।
নিতে দ্বিধা হয়, কিন্তু পাবার আকাঙ্ক্ষা তার থেকে বড় তীব্র হয়। এক্সপেনসিভ খাবারের অর্ডারে থাকে আলাদা কমিশন। তবে সেটা পারমানেন্টদের জন্য। নদী যা হবার চেষ্টা করছে। তার আধুনিক কেতাদুরস্ত ইউনিফর্মে অনেক পুরুষ ক্লায়েন্টের চোখের ভাষা বদলে যায়। তাদের রেখে যাওয়া টিপের সাথে কেউ তার ব্যক্তিগত কার্ড ছেড়ে যায়।

এসবে শুরুর দিকে নদীর অস্বস্তি হতো এখন ভাবলেশহীন থাকা শিখে গেছে। লিজা তুষারের থেকে তার খোঁজ বেশিই হয় কিন্তু নদীর লক্ষ্য অন্য দিকে। এতদিনে একটা বিষয় জেনেছে এই রেস্টুরেন্টে ওয়েস্ট্রেস থেকে বেশি বেতন কিচেনে। মূলত একটা ভালো রেস্তোরার প্রাণশক্তিই হলো তাদের রন্ধনশিল্পীদের দক্ষতা। বাহারী ঠাঁটবাট হলেও এই ক্ষেত্রে কোন সমঝোতা নেই। সি ই ও থেকে শুরু করে কিচেনের সবাই রান্নার ওপর রীতিমতো হাতেকলমে প্রশিক্ষিত।

নদীর মাঝে মাঝে চিন্তা হয় সে নিজেও তো ফুডস এন্ড নিউট্রিশনে পড়ছে, রান্নার সাথে যে জানবে খাবারে সঠিক পুষ্টিমূল্য। কিচেনে তার থেকে দক্ষ আর কে হতে পারে? ওয়েস্ট্রেসের কাজ থেকে রান্না সম্মানজনক কি নয়? বিষয়টা আক্ষরিক অর্থে কতটা আকাশ-পাতাল কল্পনা নদী জানেনা। তবে এতটুকু নিঃসন্দেহে বলতে পারে তার সহপাঠীরা শিক্ষিত পুষ্টিবীদ হতে চাইলেও কেউ কোন রেস্তোরাঁর বাবুর্চি অন্তত হতে চায় না।

তবে তাদের অনিচ্ছা আর নদীর বাচা-মরার লড়াইয়ের মাঝে তফাৎ অনেক। তারা জানে না গেস্টদের নষ্টকরা খাবার গুলো সরিয়ে রাখতে বুকে চিনচিন ব্যথা কাকে বলে; তারা জানে না কখনো কখনো বেভারেজ ফ্রিজ থেকে ড্রিংকস সরাতে বুক কতটা কেঁপে ওঠে। অথচ এই বাড়ির চারদেওয়ালেই মা তাকে শিখিয়েছিল না বলে কারোটা খেতে নেই। মা কি তার কন্যার এমন পরিণতি ঘুণাক্ষরে টের পেয়েছিলেন?এমন সব এলোমেলো চিন্তা মাথায় নিয়ে লেকের ধারে ঘুরলো কিছুক্ষণ।

ক্ষুধায় পেট জ্বলছে।তার কাছে একেবারে টাকা নেই তাও নয়,মাসের শুরুতে বড় মামা কিছু দেন। গত দুই মাসের বেতন আর টিপ মিলে যা পায় বাজার খরচ বাদে কিছু টাকা সে জমায়। ন্যাশনাল আইডি দিয়ে একটা বিকাশ একাউন্ট খুলে সেখানে লোড করে রাখে।মরনপণ করেছে প্রচন্ড জটিল অবস্থা ছাড়া এইটাকা সে ধরবেও না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এই হ্যাংলা ক্ষিদেটা তাকে অন্ধ করে দেয়। এই যেমন এখন নাকের মাঝে কষা মাংশের সৌরভ ভেসে আসছে।

হাঁটতে হাঁটতে একজন বাদাম বিক্রেতা কিশোরীকে ডেকে নিলো। খিদে কমিয়ে ফেলার ভালো বুদ্ধি হলো এক ঠোঙা বাদাম খাওয়া। খোসা ছাড়িয়ে চিনেবাদাম মুখে দিতেই মনে পড়ল,
বাদামের ভর্তা দিয়ে গরম ভাত খাওয়া হয় না অনেকদিন। নদীকে এই ভর্তা বানানো শিখিয়েছিল রানুখালার শাশুড়ী। এই মহিলাও নাকি দারুণ রাঁধুনী ছিলেন। অনেক কিছুই তিনি নদীকে শিখিয়েছেন।আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বুড়িকে আজকাল মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। শরীরে বিষফোঁড়া থাকলে একসময় সেটাও অভ্যস্ত হয়ে যায় আর এটা তো আস্ত মানুষ ।নিশিকে দেখলে মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ স্মৃতিতে বুড়ির কণ্ঠ ভেসে আসে ….

” একটা মনে রাখবি বু, বিটাগুলোন হইলো ইবলিশির বাড়া।মেইয়ে মানুষ না পালি কুকুরির কাছে যাবে হাল্কা হতি!এগের সব মিথ্যে, মিষ্টি মিষ্টি কতা বইলে মেইয়ে মানুষের মধ্যি জ্বালা জুড়োনোর ধান্দা আর কিছু নয় রে বু। ”

রানুখালার শাশুড়ির আরেক ঝামেলা ছিলো রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেললে কথা ঘোরাতে মুখে খইয়ের ফোঁটানো। মাঝরাতে ঘুম চোখে সেসব কথায় নদীর শরীর ঝাঁ ঝাঁ করতো। অবিশ্বাস্য সব গল্প কাহিনী —

“আরে ফাঁকা ঘরি বাপ – ভাইয়ের বিশ্বেস নেই! আবার নাকি নাগর।মাগিগুলোন কি বোঝে না? আমাগের সময়ে মক্তবে পড়তো আমারই সই.. মা মইরেসিল সেই তার জন্মির পরপরই।সেই না পরির মতোন মেইয়ে, তার তেরো বছরে বিষ দে মাইরলো বাপটা। কেউ কিছু কতি পারে না এই আমি জানি, আমার প্রাণের সই ছিলো, আমারে বইলেসিলো । আপন বাপ তার সব্বনাশ কইরেসিলো রে! তিন মাস শরীর খারাপ হয়নি । মসজিদির ইমাম সাহেব কি নুরানী চেহারা..এগের মুখে থু!

কিশোরী নদীর গা গুলিয়ে বমি আসতো, তবুও কি বিচিত্র অবৈধ আকর্ষণে শুনে যেত বুড়ির কথাগুলো।

” তোর তো সাতকুলি কেউ নেই, তুই কলাম কাউরি বিশ্বাস করিসনে। সবার সামনি তিন কবুল না বললি সব বিটা রাক্ষস রে। স্বামী হলিও রাক্ষস তবে তারি বশে করার মন্ত্র থাকে। পরপুরুষ বশে আসে নারে বু, তারা আমগের বশ করতি চায়। তাগের ওই এক জায়গায় দখল পালিই হইলো, মেইয়েমানুষ আর মেইয়েমানুষ থাকে না,তাগের জন্যি বদনা হই যায়। পা*ছা ধোয়ার কাজে লাগাবে, তবে ঘরে ঢোকাবে না”

নদী বুড়ির কথাগুলো মাথা থেকে তাড়িয়ে রেস্তোরার দিকে পা বাড়ালো।বুকের ভিতরে স্থিরতা নেই। ভালো মন্দ সব পুরুষ কি আসলেই তাই চায়? নিশির মতো যদি নদী বিপদে পড়ে? নদীর কি এত সাহসী সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা হবে? আগে মন অস্থির হলে রানু খালার বাড়িতে থাকতে একরাশ পেয়াজ ছিলতে বসতো। এখন কি করা যায়?.নিচের বুফেটে ভিড় হলেও ওপরে মেনু সার্ভিসেও দেখা গেলো কয়েকজন ক্লায়েন্ট বসে আছেন। নদী ত্রস্ত পায়ে এগোলো।

” আসলেন মহারানী বগা ”

নদীকে দেখে লিজা বিড়বিড় কর‍তে করতে বের হলো। এই মেয়েটার সমস্যা কী নদী এখনো বের করতে পারেনি৷ কিচেনের দিকে উঁকি দিতেই দেখা গেলো শেফ সালেম হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে দ্রুত জোগাড় যন্ত্র করছেন। হাসিখুশি আমুদে মোটাসোটা মানুষটা রান্নায় দারুণ।
নদীর সাথে চোখাচোখি হলে, ” কীরে নদনদী খালবিল আজ এত তাড়াতাড়ি? ”

” ক্লাস সাসপেন্ড হয়ে গেছে । কিন্তু আপনার কি হয়েছে? ”

সালামের মুখ ব্যথাতুর হয়ে গেল, ” আরে বইলো না, ভোর সকালে ভাইকে এয়ারপোর্ট দিয়ে আসতে গিয়েছিলাম, ট্যাক্সির দরজায় এমন চাপা খাইসি।”

তুষার চিন্তিত হয়ে বলল,” আজকে মিনুও আসে নাই কাটাকাটি করবেন ক্যামনে বিশ মিনিটে সাপ্লাই”

নদী খেয়াল করলো সালেম ভাইয়ের হাত ভালোভাবেই থেতলে গেছে।বলল,” সব্জিগুলো আগে কেটে ভাপ দিয়ে রাখতেন না?

” আরে নাহ, ওটা চাইনিজে করে।থাই রান্নায় টাটকা সবজি লাগে। নয়তো ফ্লেবার তৈরি হয় না ”

নদীর এই তথ্যটা জানা ছিলো না। এদিকে সালেম আহত হাতেই দ্রুত কাটছেন, তবে মুখ যন্ত্রণায় বিগড়ে যাচ্ছে।

” আমি কেটে দেই সালেমভাই ,আপনাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে, আমার ডিউটি তিনটা থেকে।বসেই তো থাকবো।এই অবস্থায় হাতে চাপ নিলে আপনার উলটো ক্ষতি হবে, আমি খুব ফাস্ট কাটতে পারি দেখেন …”

তুষার আর জেরিনও দেখা গেল সমর্থন দিল। অত:পর মিনুর রেখে যাওয়া এপ্রোন পরে অচিরেই হাতে কাটিং নাইফ ধরলো নদী। সালেম প্রথমে একটা পিস করে দেখিয়ে দিলো, শুরুতে একটু সংকোচ হচ্ছিল। ক্রমে নদীর হাতের গতি বেড়ে গেল।অস্থিরতা কমে মাথার মধ্যে অন্য একটা চিন্তা উঁকি দিচ্ছে।গ্যাব্রিয়েল কিচেনে বেতন অনেক!

দুটা অর্ডার সালেম ভাইয়ের নির্দেশনায় নদী বেশ সময় মতোই রেডি করে ফেলল। রান্নার তড়কা, কতদিন পর বড় উনুন সামলানো, নতুন কৌশল,টাটকা সব্জিরর ধোঁয়া তোলা সৌরভে মনটাকে ভালো করে দিলো।

” রান্নাটান্না কর ভালোই “সালেম ভাইয়ের চোখে প্রশংসা।

নদী হাসলো। ঝানু মানুষের সামনে নিজের দক্ষতার গল্প একটা বড় বোকামো।সালেম মাথা নেড়ে বললেন, “তোমার হাত নাড়ার ধরন দেখেই বোঝা যায় তুমি পাকা রাঁধুনি।আগুনরে ভয় পাও না ঝড়ের মতো ছুরি চালাও। কিচেনেই তো জয়েন করতে পারো। সকালের ব্রেকফাস্টে কাজ বেশি থাকে।

কথাটা শুনে নদীর হৃদয় নেচে উঠলো তবে শান্ত গলায় বলল ” সকালে ক্লাস থাকে সালেম ভাই”

” ক্লাস থাকে, কিসে পড়ো “সালেম ভাই যারপরনাই অবাক হলেন। সব শুনে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ” নাক নকশা দেখেই বুঝছিলাম বড় ঘরের মেয়ে।আহারে! এরে বলে ভাগ্য। তোমার ইতিহাস তো আমার মতোন,বক্সীবাজারে আবুল বিরানীহাউজে হেল্পার হয়ে যখন ঢুকছি তখন সেভেনে পড়ি। সকালে স্কুলে যাইতাম দুপুরে ঢুকতাম হোটেলে। টানা আটবছর কাজ করসি। ওস্তাদে আমারে আইএ পর্যন্ত পড়াইছিল । এরপর গেলাম দুবাই, কিন্তু তুমি ভার্সিটিতে পড়ে এখানে কাম কর! ইনভারসিটির পোলাপানদের শরীরে যে তেল ”

” আমার তেলও মাখার সামর্থ্য নাই সালাম ভাই ”

” এই মেয়ে তুমি কিচেনে কী করছ?”

রাজিয়া ম্যামের চিৎকারে নদী চমকে উঠলো।

” আমিই বলেছি সালেমভাই হাত নাড়াতে পারছিলেন না ইমার্জেন্সিতে কেউ ছিলোও না”জেরিন এগিয়ে এলো।

” বাহ ভালোই তো। সদরঘাটের হোটেল বলে কথা, যে সে যখন ইচ্ছা ঢুকে যাবে”

” সদরঘাটের হোটেলের বাবুর্চি হতে এলেম লাগে রাজিয়া। মানুষ শখ করেই খেতে যায় সেখানে তুমি সাহায্য করতে না পারলে এখানে ঝামেলা করতে এসো না”
জেরিনের কন্ঠে ঝাঁজ।

উত্তর না দিয়ে রাজিয়া নদীকে সরাসরি বলল,” জি এস স্যার ডাকেন তোমাকে”

” আমাকে কেন ম্যাম ”

” উনি কি আমাকে এক্সপ্লেইন করবেন? গেলেই বুঝবে”

নদীর মুখ মুহূর্তে চুন হয়ে গেল।নরমাল স্টাফ হয়ে কিচেনে ঢোকা কঠিন নিয়ম লঙ্ঘনের একটা।কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়ে কোন ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ কাম্য ছিল না। চাকরিটাই যদি চলে যায়? যেতে যেতে রাবেয়ার চোখে চকচকে ক্রূরতা দেখে বুক কেঁপে উঠলো

*******

নিশি সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিজের পা মন্থর করে নিলো।প্রচন্ড উত্তেজনা সামলে ভাবলেশহীন থাকার কৌশলটা দ্রুত রপ্ত করতে হবে। নিচে রাফিনকে দেখে মুখে বিরক্তি আনার চেষ্টা করেও হচ্ছে কিনা এই বিষয়ে শিওর নয়। রাফিনের উস্কোখুস্কো চুল আর চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি দেখে নিশির শান্তি লাগলো। এখন হয়ত কথার মাঝখানে টুস করে পায়ে ধরে কান্না শুরু করবে। তখন নিশি গলে না গেলেই হলো,

” কেমন আছ জান ”

” কী চাস তুই? “নিশির কন্ঠে বিরক্তি

“কল তুলতেস না এইজন্য চিন্তা হচ্ছিল,কিছু করে-টরে ফেলস নাকি।আমি তো কম প্যারা দেই নাই”রাফিনের কন্ঠ নমনীয়।

” তোর মতো ছুঁচোর জন্য সুইসাইট করব আমি? ফাপড়বাজি করতে আসছিস এইখানে? ”

রাফিন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ” আল্লাহর কসম ফাপড়বাজি না। তোমারে একটু এলার্ম করতে আসছি। একটু খুব কমপ্লেক্স সিচুয়েশন চলে আসছে। নাহলে তোমাকে ডিস্টার্বও করতাম না”

নিশি রাফিনের কথা বুঝলো না। রাফিন তার মোবাইল থেকে একটা ভিডিও দেখালো সেটা নাকি আজ সকালে তার কোন বন্ধু হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে। নিশি স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। হাটুর নিচ থেকে কেমন অসাড়তা,পেয়েছে। ভিডিওর ঘটনাগুলো বেশিদিন পুরান নয় এইবার বান্দরবানের, ঘরের কোনাকোনি সেট করা ক্যামেরা। সম্ভবত বেড সাইট ল্যাম্পের সাথে। মধুরতম মুহূর্তগুলোর মেয়াদ ফুরালে দিনের আলোয় ততটাই কদর্য লাগে।নিশির কেমন গা গুলিয়ে বমি আসছে।।

– শয়তানটা হুমকি দিচ্ছে দুই লাখ টাকা না দিলে কোন পর্ণ ওয়েবসাইটে সেল করে দেবে এখন তুমিই বল জান আমি কী করব

– সেল করে দিতে বল।তোর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

– কী বললা?

– এজ এ মেইল স্কর্ট তোমার পারফর্মেন্সের লাইভ ফুটেজ ভালো এডভেটাইজমেন্ট হয়ে যাবে। না খেয়ে থাকতে হবে না

– আমার সাথে তুমিও পারফর্ম করতেসিলা।

– তোর মনে হয় এই জন্য ভয়ে কাতর হয়ে আমি টাকা দিয়ে দিবো? তোর ফাতরামি আমি বুঝি না ইউ সান ওফ এ… ”

” ইউ বিচ,হর! ‘ রাফিন তার মুখোভঙ্গি কুৎসিত করে ফেললে মুহূর্তে,” শালী তুই দোকান দিয়ে বসছিস আগে বলবি না? পেট বাধায় আমারে ভয় দেখাচ্ছিলি, এটা কার কে জানে। তোর এগুলোতে সমস্যা নাও থাকতে পারে কিন্তু আমেরিকায় হবে আর আমি জানি তাদের ভালোই সমস্যা হবে ”

” ওই ছ্যাবলা কু**ত্তা যা বল তাদের এই করে করে বিজনেস করগা আমার যায় আসে না ”

” ক্যামনে যাবে ক্যামনে আসবে সেটা তো আমিই বুঝবো, দশটারে নিয়ে এসে যখন ভ*রে দিবো … ”

নিশি বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ
“শয়তান তুই ছাড় আমাকে , বাঁচাও কেউ বাঁচাও…. ছাড় রাফিন… ”

নিশির আচমকা রাফিনদের দিকে ধাবিত হয়ে হঠাৎ চিৎকার শুরু করলে নিচতালার ভাড়াটিয়া দরজা খুলে উঁকি মারলেন। উপর তালা থেকে দুজন সাবলেটের মেয়ে চলে এলো। রাফিন কোনমতে গা ঝাড়া দিয়ে নিশির বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করল।

” কাজটা ভালো করলি না নিশি।”

” হ্যাঁ ঠিক বলসিস তোরে জুতা দিয়া পিটাইলে কাজটা ভালো করতাম ”

নিশির সমস্ত শরীর কাঁপছে। এই ছিল তার এককালের বেপরোয়া প্রেমের কুৎসিততম রূপ।চরম ধ্বংস হবে জেনেও কেন নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল লাগামহীন? মনকে উপযাচকের অবতারে দেখে বিরক্ত লাগলেও এড়ানোর উপায় ছিল না।

” তুমি প্রেগন্যান্ট নাকি নিশি? ” নিশি শুনে থমকে গেল। তার সামনে পাশের সাবলেটের তানিয়া দাঁড়িয়ে, চোখে
সন্ধিগ্ধতা।

******

” বুকের বোতাম লাগাও ঠিকমতো ”

রাজিয়ার ঝাজদেয়া কন্ঠে নদী দ্রুত ইউনিফর্মের বোতাম লাগালো। যদিও তার শার্টের বোতামের ফাঁক আপত্তিকর পর্যায়ে কখনো যায় না।আজ তার হাত কাঁপছে। রাজিয়া চোখ ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে।নদীকে তার আরো কিছু বলার জন্য মুখ চুলকাচ্ছে বোঝা যায়। এদিকে গ্যাব্রিয়েল স্যার অপেক্ষা করছে। নদী দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাবার দিকে আবার বাধা,

” বেশি না পাকামো করবা না বুঝলা?রাজিয়ার হিসহিসে কন্ঠ,” জেরিন ম্যামের চামচামি করে বেশি উপরে ওঠা যাবে না এটা মনে রাখবা ”

” আমি কেন চামচামি করব? ”

” কী করতেস তো দেখতেই পাচ্ছি, উনার প্রত্যেকটা প্রশ্নের ঠিক জবাব দিবা। ঠাস করে গ্যাব্রিয়েল কিচেনে ঢুকস জানো কাদের সাথে ডিল করতেস? গতবার স্যুপ নিয়ে ফাজলামি করসিলা।জানো উনি কে ছিলো? ”

নদীর স্যুপের কথাটা মনে পড়লো।দুজন বিদেশি ব্লগার নিয়ে একজন মহিলা এসেছিলেন।তিনি স্যুপ সার্ভ করার সময় বিগড়ে গেলেন৷ তার বক্তব্য মতে মাশরুম ক্রিম স্যুপ তিনি অর্ডারই করেননি। নদীর কথার পাত্তা না দিয়ে জেরিনকে ডেকে চিৎকার করতে লাগলেন, জিএস স্যারকেও খোঁজ করা হলো। তিরিক্ষী কন্ঠে কিছু ছিলো নদীর ভয় লাগলেও তার ওয়াটস এপ ভিডিও রেকর্ড অন করলো। মহিলার কন্ঠ স্পষ্ট।

” ম্যাম আমি নতুন তো তাই অর্ডার নেবার সময় রেকর্ড করে শেফের কাছে সাথে সাথে পাঠাই। আপনিই শুনুন এটা আপনার অর্ডারই ছিলো সম্ভবত আপনি ভুলে গেছেন”

মহিলা তার অজান্তেই রেকর্ড করার জন্য আরও ঝামেলা করা শুরু করলেন। তবে বিস্ময়কর ভাবে সেই সমস্যাটা হুট করে শেষ হয়ে গেল। মহিলাকে সম্ভবত জি এস স্যার ফোনে কিছু বললেন।তিনিও দ্রুত কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। রীতিমতো আজব চরিত্র ছিলেন।

” সে শ্রেয়া ম্যাম ছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইফতেখারর আহমেদের কাজিন। জি এস স্যারের জি এফ কাম হবু ফিয়োন্সে। ওনার চিন্তা বাদ, গেস্টদের অগোচরে ভিডিও নেয়া, ইন্সট্রাকশন না নেয়া,কিচেন প্রপার্টিজ সরানো কোন সেই সাথে কিচেনেও এন্ট্রি তোমার তো লম্বা ফিরিস্তি ”

নদী বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে৷ রাজিয়া ক্রুর হেসে বলল,”অনেক ট্যালেন্ট তোমার,কিন্তু গেছ যে তুমি এখনো পারমানেন্টও হও নাই।বসের কাছে গিয়এ এই বিষয় গুলো একটু এক্সপ্লেইন করো”

নদী কথা না বাড়িয়ে হেঁটে এগোলো,
” বেস্ট অফ লাক, তবে হ্যাঁ, উনি যা বলবেন তা করবা। হাফ বিদেশি হলেও ভয়ংকর পাওয়ারফুল, তর্কে গেলে পিপড়ার মতো পিষে ফেলবে”

রাজিয়া হাসিমুখে নদীকে বসের রুমের সামনে ছেড়ে চলে এলো। অনেক বাড় বেড়েছিল। এই মেয়ে সাইজ হলে জেরিনের মাতবরি যদি কিছু কমে।
” মে আই কাম ইন স্যার?”
” ইয়েস’
নির্দেশনা দিয়ে রম্য দ্রুত নিজের মুখ ঠোঁট লিপস্টিকের দাগ সরিয়ে ধাতস্ত হয়েছে। প্রচন্ড বিরক্তি আর অসহায়ত্বে প্রলেপ সরিয়ে তাকে দ্রুত গ্যাব্রিয়েল সামদানী হতে হলো। তবে কখনো কখনো মুখোশ পরায় ক্লান্তি আসে।

কিছুক্ষণ পরের দৃশ্যপট।নদী তাদের মেন্যু লাউন্সের একটা কর্ণার কেবিনে হাসিমুখে দুজন থাই নাগরিকের অর্ডার নিচ্ছে। অর্ডার এর পাশাপাশি টুকটাক প্রধান হচ্ছে। অল্পবয়সী ইন্টারমিডিয়েট পাস মেয়ের এত হেসে কি কথা বলছে রাজিয়ার মাথায় ঢুকলো না। এদের সাথে আসা শ্রেয়া ম্যামও দেখা গেল খুশি। দূর থেকে রম্যের চোখাচোখি হতেই প্রশংসার দৃষ্টি বিনিময় হলো।

নদী দ্রুত সালেমভাইকে অর্ডার বুঝিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছে।বিষয়টা ততটা কঠিন ছিল না যতটা মনে হয়েছিল ।অথচ কিছু আগে বসের রুমে ঢুকতে ঢুকতে তার পায়ের শক্তি কমে আসছিলো। গলায় যেন দীর্ঘদিন পানি পড়েনি।

” মেহরোজ ! অনেক সুনাম শুনছি তোমার”

নদী কী বলবে বুঝে পেলো না। জি এস স্যার তার সাথে স্পষ্ট বাংলায় বলছেন৷ এই প্রথমবার।

” অল্পদিনেই তুমি বেশ জনপ্রিয়, শুনেছি খুব স্মার্টলি ডিল কড়ো! সবাই বেশ ইম্প্রেস্ট ”

নদী সহজ হয়ে নড়ে চড়ে বসেছিল।

“জেরিনের মতে তোর পারসোনালিটির মধ্যে কিছু আছে মানুষ খুব দ্রুতই এট্রাকট্রড হয়। এটা একটা ব্লেসিংস”

মানুষটা গোমড়া মুখে কথাগুলো বলছে, নদী ঠিক বুঝলো না এটা প্রশংসা ছিলো কিনা তবুও বলল “থ্যাংকস স্যার ‘

” আমি চাই তুমি আজকে আমাকেও ইম্প্রেস কড়ো ”

নদী প্রশ্নটা বুঝলো না গ্যাব্রিয়েল অল্প হেসে বললেন,

” আমাকে খুশি কড়ো। ইভেন আই উড লাইক টু নো এবাউট ইউর স্কিল এন্ড ট্যালেন্ট ”

রিভলভিং উঁচু চেয়ারে হেলান দেয়া জি এস স্যার সরাসরি তাকিয়ে আছে, সাপের মতো শীতল দৃষ্টি যা দারুণভাবে দুর্বোধ্য।
নদীর হঠাৎ মনে হলো তার পা জোড়ায় কেউ পেরেক পুঁতে দিয়েছে। আরো চমকে দিয়ে জি এস স্যার হঠাৎ উঠে নদীর চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। প্রতিক্রিয়ায় নদী চেয়ার থেকে ওঠার চেষ্টাতেও ব্যর্থ হলো, গ্যাব্রিয়েল তার ঘাড়ে দুই হাত রেখে বসিয়ে দিলেন। নদীর গলা দিয়ে আওয়াজটা হঠাৎ যেন গায়েব।

” সামনে তাকাও মেয়ে’গ্যাব্রিয়েল ইংলিশে বলছেন।

জি এস স্যারের নির্দেশে সামনে তাকিয়েছিল নদী। গ্যাব্রিয়েল ঝুঁকে এলো তার কানের কাছে, নীচু ষড়যন্ত্রীর কন্ঠে বললেন,’ কর্নার কেবিনে বসা দুইজন থাই নাগরিকের একজন থাই এম্বাসির ফার্স্ট সেক্রেটারি।অন্যজন থাইল্যান্ডের প্রচন্ড নামী শেফ ”

নদী স্বচকিত হলো, হুট করে আসা ঘন সান্নিধ্য আর দামী পারফিউমের ধাক্কায় তার স্নায়ু ততক্ষণে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল, দ্রুত সামলে সামনে দেখতে মনোযোগী হলো।

গ্যাব্রিয়েল বলল,” এরা তাদের ফুড ফেস্টিভালের বড় ভেন্যু খুঁজছে। সাধারণত বড় ফাইভস্টার হোটেলেই এটা আয়োজন হয় কিন্তু এইখানে ব্যাপারটা কিছু আলাদা। মূলত গ্যাব্রিয়েল কিচেনে ওয়াইড স্পেস, রিজেনেবল প্রাইজ আর রান্নার সুনাম শুনে তারা এসেছে, বা শ্রেয়া তাদের কনভিন্স করে এনেছে।শ্রেয়া আমার বন্ধু খুব ভালো বন্ধু।

নদী মনোযোগী হয়ে খুঁজতে লাগলো এই শ্রেয়াটাকে। তবে দুজন ছোট চোখের চিনেম্যান ছাড়া কাউকেই দেখলো না।

গ্যাব্রিয়েল বলল,” এই ইভেন্টের সাথে আরেকটা বিষয় হলো থাই ফুড প্রডাক্টের মার্কেটিং।যাতে আমাদের প্রিভিলেজ থাকবে। বিশাল একটা সুযোগ। নামীদামী থাই শেফরা এসে রান্না করবে, আমাদের শেফদেরও একটা ভালো ট্রেনিং হয়ে যাবে, তোমাকে আজ এদের ডিল করতে হবে। সেল দেম দ্যা মোস্ট এক্সজটিক ফুড ওফ গ্যাব্রিয়েল কিচেন।গিভ দেম দ্যা বেস্ট সার্ভিস, গেট দেম হ্যাপি এন্ড ইউ উইল বি পারমানেন্ট। সেলারিও বাড়বে দেড়্গুন। আমি দেখতে চাই তুমি তোমার কাজে কতটা প্যাশানেট”

” চেষ্টা করব স্যার ”

গ্যাব্রিয়েল টেনে টেনে বলল,”চেষ্টা না বলো, কড়বো”

“কড়বো…” নদীও বসের মতো বলে দ্রুত শুধরে নেয়, ” মানে করব স্যার, ইনশাল্লাহ ”

গ্যাব্রিয়েল হাসলো,গাঢ় বাদামী চোখে স্পষ্ট নদীর ছায়া,”তুমি কড়তে পারলে, আমিও টোমাকে অনেক আদড় কড়বো ”

নদী তাকিয়ে আছে । তার চোখের বদলে ভাষায় কিছু ছিলো গ্যাব্রিয়েল শুধরে বলল” খুসি,খুসি কড়বো,বাই দ্যা ওয়ে আদড় খুসি একই জিনিস তাই না? ”

” জি না এক না, জটিল তফাত, কিসের তফাত আপাতত বলতে মন চাচ্ছে না, আপনার “আদড়” ওই শ্রেয়ার জন্যই রাখেন” নদী কথাটা মুখের মধ্যে হজম করেই উঠে দাঁড়িয়েছিল।

” স্যার একটা ছোট সমস্যা ”

” ইয়েস ”

” মাই ইংলিশ ইজ নট দ্যাট গুড ”

গ্যাব্রিয়েল স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ।থেমে থেমে বলল ” গ্যাব্রিয়েলস কিচেনে এটা ছোট সমস্যা না, ইংলিশ শেখা কম্পালসারি। তবে আরামের কথা হলো তাদেরও ইংলিশ তত ভালো না। কাজেই তুমি বেনিফিটে থাকবে”

নদীর জন্য সত্যিই বেনিফিটের ছিলো। চিনেম্যানগুলোর সাথে ভেঙে ভেঙে মিষ্টি কন্ঠে কথা বললে তারাও দেখা গেল সহজ হয়ে গেল।নিজের মতো কাজ করে গেলেও বুঝতে পারছিলো একটা মনোযোগী দৃষ্টি সর্বদাই তাকে নিরিখ করছে।কাজের সময় নদীর এই অনুভবটা আগেও হতো কিন্তু আজ জানে এই চোখ জোড়া কার। গেস্ট এটেন্ট করতে শ্রেয়া মেয়েটাকেও দেখলো। সেদিনকার সেই একই চরিত্র কিন্তু আজ মুড দারুণ ভালো।এমন একটা টপ পরেছে যা দেখতে অস্বস্তি হয়। তবে শ্রেয়ার তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই,আজ নদীকে যেন ঠিক চিনলোই না। খাবার আসার ফাঁকে বিদেশিদের ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়ারস দেখাতে লাগলো। যেন তারই সম্পত্তি।

হঠাৎ একটা ঘটনায় নদী মাঝে থমকে গেল। স্যুপের পর মেইনডিশের প্রস্তুতি নিতে ক্লায়েন্টের ব্যবহৃত প্লেট নিয়ে কিচেনের দিকে যাচ্ছিলো, তখনই পাশের চিকন করিডোর দিয়ে একটা কিশোরি যেন ব্যাকইয়ার্ডের দিকে ছুটে গেল…। তার সাথে আরেকটা বাচ্চাটা ছেলে যে সামনে ছুটছে।

বাচ্চারা রেস্টুরেন্টের আগত গেস্টের কেউ হতেই পারে। কিন্তু সেই সম্ভবনা ক্ষীণ কারণ বাচ্চা দুটার কাপড় বেশ মলিন, যা এত দামী রেস্তোরার ক্লায়েন্টদের সাথে যায় না।আরেকটা বিষয় হলো নদীর মনে হলো মেয়েটার জামায় ছোপ ছোপ রক্ত লাগানো। কারা এই বাচ্চারা?কী চাইছে? কেউ কি এদের দেখছে না? কয়েক মুহুর্তের জন্যে বাচ্চা দুটো সরাসরি তার দিকেই যেন তাকিয়ে ছিল। নদী ত্রস্তপায়ে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে যেতে…

” আমার রিং কোথায়?এইখানেই ছিলো ওয়াশরুমে যাবার আগে আমি টেবিলে খুলে গিয়েছিলাম ”

শ্রেয়ার তিরিক্ষি কন্ঠ নদীর পা থামিয়ে দিলো। অচিরেই জেরিন নদীর খোঁজে নিচে নেমে এলো–

“মেহরোজ টেবিল নাম্বার টুয়েলভের ডিউটি তোমার ছিলো না?”

” জি ম্যাম”

“একটু ওপরে এসো গ্যাব্রিয়েল স্যার ডাকছে তোমাকে, একটা ঝামেলা হয়েছে শ্রেয়া ম্যাম তার ডায়মন্ড রিং পাচ্ছে না”

(চলবে).
#শারমিন_আঞ্জুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here