বাতাসে তার সৌরভ পর্ব ১০

0
256

#বাতাসে_তার_সৌরভ–১০

মৃদুমন্দ মিউজিকের সাথে মিশেছে কৃত্রিম ঝরণার নিক্কন, স্নিগ্ধ আলোকিত পরিবেশ। এইখানে মানুষ কথা বলেও মৃদু স্বরে। কিন্তু এই স্নিগ্ধতা এখানে কর্মরতদের ঠিক মুগ্ধ করে না।

হাল্কা টুংটাং গ্লাস চামচের আওয়াজের মাঝে মানুষের আদেশ ফরমাশ শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে যায় তুষারের। তবে অনুভবের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে তার নতুন সহকর্মী। নদী! তুষার তাকে মনে মনে ডাকে উথাল-পাথাল নদী। প্রথম দেখার জংধরা ধাতু আজ যেন ধারালো তলোয়ার, একটাই সমস্যা অল্প উচ্চতার পুরুষদের এমন লম্বা মেয়ের পাশে দাঁড়াতে অস্বস্তিবোধ হয়। কিন্তু তুষার ব্যাতিক্রম । কাজের মাঝখানে মাঝখানে বিভিন্ন সূত্র ধরে নদীর পাশে গল্প করতে তার বেশ ভালো লাগে।

নতুন আসা গেস্টের অর্ডার বুঝে কিচেনে স্লিপ পাঠিয়ে নদীকে পাওয়া গেলো লবির কাছে আগত গেস্টদের হাসি বিনিময় রত। শ্যামলা মুখের পুরু ঠোঁট জোড়া অন্য কিছু নিয়েই বিড়বিড় করছে।।

“একা একা কী ভাবো ?”

” বেসিকস ওফ কার্বোহাইড্রেট ”

” মানে? ”

নদী ঘুরে বলল,” শর্করা, ভাত রুটি নুডুলস চিনি এমন যা কিছু খান।কার্বন হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন সমন্বিত বড় ম্যাক্রোমোলিকিউল এবং সাধারণ Cx(H2O)y সূত্র । ”

-ওরে বাপরে এত জটিল চিন্তা?

– কাল থেকে টার্ম শুরু।

-ওহ! তুষারকে একটু ম্লান লাগলো,’ তাহলে তো প্ল্যান ক্যানসেল। ‘

নদী জিজ্ঞেস করতে পারলোনা কিসের প্লান ক্যানসেল।তার কানে লাগানো ব্লটুথ্র এলার্ম বাজছে, আটটা বেজে পঁচিশ। নয় নম্বর টেবিলের অর্ডার সার্ভের সময়। চিফ শেফ কলের আগে গিয়ে পৌঁছাতে হবে।
কাউন্টার কেবিনেটে নোট গুছিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল কিচেনে।
তুষার চেয়ে আছে একদৃষ্টে। পাঁচ ফুট ছয়, তার ওপর দুই ইঞ্জি হিল! মফস্বলে ঢ্যাঙ্গা বলে এমন মেয়েদের, কিন্তু গ্যাব্রিয়েল কিচেনের ইউনিফর্মে চোখ ফেরানো দায়।

মুডিও না, ওভারস্মার্টও না, একটু রিজার্ভ, এটাই টানে। হেসে কথা বলে কিন্তু আড্ডা দেয় না। এমন মেয়ে সিংগেল থাকতে থাকতে ডাঙ্গায় তোলা জরুরি৷কখন কে ছিপ ফেলে দেয় বলা যায় না।
তবে সমস্যা হলো রাবেয়া ম্যামের কেমন আত্মিয়ো । তুষার মাথা আরো ঠান্ডা করলো। এই ক্ষেত্রে মনে হয় স্লো এন্ড স্টেডি চালেই আগাতে হবে।

নদী কিচেনে গিয়ে দেখলো শেফ সালেম একেবারে কাটায় কাটায় ডিশ রেডি করেছেন, সাবধানে চলছে গার্নিশিং। যেটা নদীর জন্য নতুন অভিজ্ঞতা৷ এইখানে চাকরির নাহলে জানতোই না চিরচারিত সিরামিকের ডাল ভাত খাওয়া প্লেট আসলে ইংলিশ বাবুদের স্যুপ প্লেট ।

ধবধবে সাদা প্লেটের ঠিক মাঝামাঝি একটা পুকুরের গভীরতা সেটা নাকি স্যুপ রাখার জন্য। সেই স্যুপের প্লেটে সাবধানে ঘন ক্রিম দিয়ে কয়েলের মতো গার্নিশিং হচ্ছে ওপর সমন্বয় করে মাঝামাঝি দুটো সেদ্ধ মাশরুম।

– অসাধারণ ফ্লেবার সালেম ভাই!

সালেম মাথা ঝাঁকিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলো – কিসের! মাশরুমগুলো টাটকা হলে ব্যাপারই ভিন্ন ছিলো..,জি এস স্যারকে বলে ছাদে ফার্মিং করতে হবে মনে হচ্ছে।”

” কার এত সময় বলেন, ফার্মিং জিনিসটা আদর যত্ন ছাড়া হয় বিশেষ করে আদরটা লাগে…”

আওয়াজে নদীর স্নায়ু সতর্ক হয়ে গেলো পেছনে শেফ নাফিসের কথা বলার ধরণটা কোথাও শাহবাজের সাথে মেলে,চোখের দৃষ্টিও।কথা বলছে সালেমের সাথে দৃষ্টিটা নদীর পেছনে।

” তুমি দেরি করো না।” সালেম জোর দিলো নদীকে, ” ভি আই পি ক্লায়েন্ট। জটিল জটিল সব অর্ডার। পুরা ফাইভ কোর্স মিইল । স্যুপের পরেই ওয়েস্টার সালাদ সার্ভ হবে। দাঁড়িয়ে থেকো, খেয়াল রেখো মেয়ে…

নদী সালেম ভাইয়ের কাছে ট্রে বুঝে নিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে এগিয়ে যাচ্ছে নয় নম্বর টেবিলের দিকে।নাফিজের মত চরিত্র সব জায়গায় থাকা কি জরুরী? নাকি আসলে তার পোশাক দৃষ্টিকটু?

ইংলিশ বিলো নি পেন্সিল স্কার্ট, ফুল স্লিপ ফ্রিল শার্ট ওপরে কালো কোটি, গলায় ভাঁজকরে বেধে রাখা লাল স্কার্ফ। তার সাথের সহকর্মী লিজার একই ইউনিফর্ম। উঁচু পেন্সিল হিলে ভারসাম্য রেখে, ঘাড় সোজা হয়ে হেঁটে চলতে শুরুতে একটু সমস্যা হতো। এখন অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে নদীর। তবে এখনো হঠাৎ অবাক লাগে সত্যিই কি এমন নতুনছাচে সে নিজেকে ফেলছে না স্বপ্ন দেখছে? যদিও স্বপ্নে এত লড়াই হয়তো থাকে না।

আজিমপুরে সকাল নয়টা থেকে টানা দেড়টা পর্যন্ত কলেজ সেরে মেয়েরা কেউ যায় বাড়িতে কেউ চলে যায় নিউমার্কেটে জামা-কাপড় ঘাটতে, কেউবা নীলক্ষেতের মামার দোকানে বিরানি খেতে আর নদী রিক্সা ধরে চলে আসে ধানমণ্ডির গ্যাব্রিয়েল কিচেনে।

হারিয়ে যাওয়া ঠিকানায় নতুন করে অদ্ভুত জীবন শুরু হয়েছে নদীর। তার এখানে জয়েনের ব্যাপারে রাবেয়া জেনেছেন দিল্লিতে গিয়ে।ফোনে রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু একসময় বুঝে গেছেন।

“তুমি যখন ডিসিশন নিয়ে ফেলেছ আমার কিছু বলার নেই। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোমার জানা প্রয়োজন যে গ্যাব্রিয়েল কিচেনের ম্যানেজমেন্টে সোহরাব বা আমি কেউ হস্তক্ষেপ করি না। এটা সম্পূর্ণ রম্যের তত্ত্বাবধানে চলে । এবং সে খুবই প্রফেশনাল। তোমার জন্য বিষয়টা কতটা সহজ হবে জানি না।তবে আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিতে পারি এখানের ইনভায়োরমেন্টে তুমি অন্তত সুরক্ষিত থাকবে। তবুও দেখো অ্যাডজাস্ট করতে পারো কিনা, আমার স্কিন ট্রিটমেন্টের জন্য লম্বা সময় দিল্লিতে থাকতে হবে। ইনশাল্লাহ ফিরে এসেই দেখা হবে”

গত দুই মাসে রাবেয়া ছেড়ে ছেড়ে মাঝেমধ্যেই ফোন দিয়েছেন। তার কথাবার্তায় বোঝা যায় তিনি চান না নদীর সাথে এই বাড়ির সম্পর্কের ব্যাপারটা বাকিরা ততটা জানুক। নদীর নিজেরো আগ্রহ হয় না। তার পরিচয় মানুষের বিস্ময়ের কারণ হবে সেই বিশ্বাসের সাথে করুণা মেশানো থাকবে। কী দরকার?

ক্লাস সেরে তার ডিউটি শুরু দুপুর তিনটা থেকে রাত দশটা। শুক্র- শনিবার নয়টা থেকে দশটা ফুলডে। দুটো শিফট মিলে সায়েম, আমান, লিজা, তুষার আর নদী ফ্লোর এটেনডেন্স।

জেরিন ম্যাম ম্যানেজার, রাজিয়া ম্যাম সুপারভাইজারের দায়িত্বের সাথে রেস্টুরেন্টের বেকারি ডিপার্টমেন্টটাও দেখেন। কিচেনে কাজ করেন তিনজন শেফ ও তাদের এসিস্ট্যান্ট। থাই আর কন্টিনেন্টাল শেফ সালেম ভাই, চাইনিজ মোগলাই শেফ নাফিজ, যাবতীয় কাবাবের দায়িত্ব রমজান আলির ।

ছিমছাম অভিজাত রেস্টুরেন্টে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের পাঁচ দিন ঠিক উপচেপড়া ভীড় থাকেনা। তবে সপ্তাহ-দুসপ্তাহে বড় বড় কর্পোরেট পার্টি লেগেই থাকে। যেটা রেস্টুরেন্টের জন্য দারুণ লাভজনক।

দুইমাসে কর্মক্ষেত্রে নদীর পরিচিতর তালিকাভুক্ত হয়েছে সবার সাথেই।শুধু বাকিদের ” জি এস স্যার” মানে গ্যাব্রিয়েল স্যার ছাড়া।

তরুণ, তবে বয়স আন্দাজ করা যায় না, পঁচিশ থেকে হয়তো ত্রিশ। বাবা সোহরাব সামদানীর মতো হাসিখুশি নয় ; গোমড়ামুখো। এবং এই লোকের সম্ভবত নদীকে সিলেকট করাও পছন্দ হয়নি।এপয়েন্ট হবার দিন শুধু একঝলক শীতল দৃষ্টিদান করে কৃতার্থ করেছিলেন । ডিউটি রত যেতে আসতে পথে দেখা হয়। নদী ঝুকে সালাম দেয়, দেখে তিনি শুধু বলেন- “মেহরোজ ”

নদীর ভালো নাম উচ্চারণ করেই কেন চলে যান শুরুতে বোঝা যায়নি, পরে বুঝেছে শুধু নাম নেওয়াটা একটা বিলিতি কুশল বিনিময়৷ এইদেশে তার আগে পরে কেমন আছ বা সালাম জুড়ে দেয় হয়।সেটা এই লোক করে না, বিচিত্র নিরাসক্ত মুখটা দেখে নদীরও আড়ষ্টতা কাটে না।

দামী হোটেল তুলনায় কর্মচারী অল্প তবে সবাই নিজের কাজে দারুণ দক্ষ। তাই কাজের চাপ যখন বেড়ে যায়, অনেক বেড়ে যায়।

একটা ভালো বিষয় হলো, ডিউটিতে লাঞ্চ আর ডিনারের সুবিধাটা। এখানে কর্মচারীদের জন্য খাবার আলাদাই তৈরি হয়। নদীর যেহেতু দুপরের পরের শিফট, সেহেতু তার জন্য ডিনার বরাদ্দ থাকে। দুপুরে ডিউটির আগে নদী হাল্কা কিছু বাইরে খেয়ে আসে নয়তো খালি পেটেই মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে(!!) ইউনিফর্ম চড়িয়ে কাজে নেমে পড়ে। সুবাসিত খাবারের গন্ধ নাকে নিয়ে তা পরিবেশন করা বেশ কষ্টসাধ্য হয় ; তবে সেই যুদ্ধের গল্প আলাদা। দ্বিধা আর লজ্জার চাদরে স্পৃহাগুলো দমন করাই হয়তো মানবসভ্যতা।

চিফ শেফ সালেম ভাই, শেফ নাফিজ আর তুষার থাকে রেস্টুরেন্টের নিচতালাতেই ; কিচেনের পাশের রুমে । দোতালায় বাম পাশে দুটা ঘর জুড়ে একটা বুটিকহাউজ। এখানে আগে নাকি দুজন মেয়ে অ্যাটেনডেন্স থাকার ব্যবস্থাও ছিলো। আপাতত কেউ থাকছে না।বিশেষ বিশেষ পার্টির আয়োজনে জেরিন ম্যাম সবাইকে নিজ নিজ ডিউটি বুঝিয়ে দেন।

ডিউটির সাথে সাথে নদীর এখানের রান্নাবান্না নিয়েও আগ্রহ জন্মায়। তবে কুকিং চলা কালে রেস্টুরেন্ট অ্যাটেনডেন্সরা কিচেনে ঢোকার অনুমতি পায় না। এমনকি জেরিন ম্যামও নয়।এটা একেবারেই ক্লাসিফায়েড জোন। সেখানে সালেম ভাইই মূলত চিফশেফ শুধু শুক্র শনিবার ছাড়া।এই দুইদিনে কিচেনের দায়িত্বে থাকেন গ্যাব্রিয়েল কিচেনের সি ই ও খোদ।সেদিন সালেম ভাই আর নাফিজের মধ্যে তর্কাতর্কিটা শোনা যায় না। কেতাদুরুস্ত সাদা শেফ এপ্রোনপরা বিলিতি মানুষটার সামনে কিচেনের ছয়জন স্টাফ উলটো ঘেমে-নেয়ে যায় ।

তিনি কি রাঁধেন জানা যায় না। তবে স্টাফদের মতে তার হাতে না কি জাদু আছে।বুফেটে তার হাতের ফ্রেঞ্চ আর ইটালিয়ান বাংলআদেশি ফিউশন আইটেমগুলো খুব এক্সক্লুসিভ হয়।সেগুলো খুব অল্পসংখ্যাকই চেখে দেখার জন্য বাচে আর যাও থাকে রাজিয়া ম্যাম তা বক্সবন্দী করে বাড়ি নিয়ে যান।

সপ্তাহের যে দুইদিনে বুফেট ওপেন থাকে, সেসময় মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখার মতো হয়। তাদের সামাল দিতে তীব্র ব্যস্ততায় নদীর রান্না নিয়ে কৌতুহলটা কোথাও উড়ে যায়।

শুরু শুরুতে নদীর যা কাজ তার সহকর্মী লিজার বুঝিয়ে দেওয়ার তেমন আগ্রহ ছিলো না।সোজামুখে কথাই বলতো না। বেকারী সুপারভাইজার রাজিয়ার মতে সেগুলো অলঙ্ঘনীয় কঠিন নিয়ম কানুন। কিন্তু সেগুলো সহজ হয়ে যায় রাবেয়া আন্টির পি এ জেরিন ম্যাডামের কল্যানে।রাবেয়া আন্টির হয়তো কিছু নির্দেশনা ছিল, তুষারের পর তিনিই নদীর দিকে কিছুটা মমতাময় হাত বাড়িয়েছেন — –

” ভয় পাবে না, মরিয়া হবে না। এটা হোটেল নয় তবে ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টের ইক্যুভ্যালেন্ট, যেখানে প্রেজেন্টেশন খুব জরুরি। তুমিও সেই প্রেজেন্টেশনের অংশ। যোগ্য বলেই সিলেক্ট হয়েছ। কাজেই সাহস রাখ। পোলাইট থাকো, ক্লায়েন্টের কথা কিছু না বুঝলেও মুখে একটা হাসি এনে রাখবে। আমি তো থাকবোই। ক্লায়েন্টদের সাথে বিহেইভ এমন হবে যেন নিজের বাড়িতেই ওয়েলকাম করছ।”

নদীর মনে হয়েছিলো গ্যাব্রিয়েল কিচেনের দেয়ালের দামী আস্তরের নিচে কেউ হেসে উঠলো। নদীও তাই চেষ্টা করেছে। কারণ আর অপশন ছিলো না।শুরুতে নিশির জুতো পরে পরে এসে পায়ে ঠোস পড়ে যাচ্ছিলো।একমাস পর জেরিন তার একটা জুতো দিয়ে দিলো। ইউনিফর্ম রাবেয়া আন্টির বুটিকের থেকে ম্যানেজ করে দেয়া হলো। দেড় তালা মিলে প্রায় সাড়ে চারহাজার স্কয়ারফিট রেস্টুরেন্টের একপাশেই বুটিক চালায় রাবেয়া।জেরিম তার অনুপস্থিতিতিতে সেটা দেখে। গ্যাব্রিয়েল কিচেনে কাজ করে এই দুই মাসে নদীর মনে চন্দ্রমল্লিকা খুব যে জেগে ওঠে না তাও না। তবে তুষার বেশ বন্ধু ভাবাপন্ন। তার কাছে কথায় কথায় বেশ কিছু অদ্ভুত গল্প
শুনেছে–

‘ রাতের দিকে ভুলক্রমেও একা ব্যাকইয়ার্ড বা ছাদের দিকে যাবে না। অনেক পুরোনো বাসায় কিছু দোষ থাকে , আর তাছাড়া এইবাড়ির ইতিহাস খুব একটা ভালো না ”

” কেমন? ”

” পুরানো মালিক থাকতে কাজের লোক ডাকাতি করতে গিয়ে নাকি মহিলা, ছেলে মেয়ে সবাইকে খুন করে… ”

” সবাইকে? ”

” নাহলে আর কী, হাজবেন্ডটা আগেই মারা গিয়েছিল,তখন এই বাড়ি ব্যাংকে মডগেজ ছিল, সব মরার পর বাকি আত্মীয়রা লোন ছাড়াতে পারেনি ব্যাংক প্রোপার্টি ক্রোক করে লিজে দিয়ে দেয়।কিন্তু এইসব কুকথায় অনেকদিন কেউ নিতেও চায়নি। যদিও সব গুজব৷ ”

নদী আর কথা বাড়ায়নি। তবে তুষারের কথাটা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলেছে! এই কথাই প্রচলিত? নদীর মাথা ঝিমঝিম করে। তবে অসমাপ্ত হিসাব খুললেও বর্তমান লড়াই থেমে থাকে না।

জীবনের লড়াই আসলে থামে না শুধু তার রূপ বদলে ফেলে। সাতক্ষীরার রসুইয়ে কাটানো দিন থেকে ঝড়ের স্বরূপ বদলে গেলেও তান্ডব বদলায়নি। পড়ার দমকের সাথে নতুন চাকরির দমক, এরপর ব্যক্তিগত জীবনে অন্যই একটা হোঁচট। নিশির বিষয়টা একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।ভাবলে নদীরই কেমন দিশাহারা লাগে। কিন্তু নিশিটা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাতক্ষীরা বা আমেরিকায় এখনো খবর যায়নি। গেলে কী কেয়ামত চলে আসবে সেটা নদী ভাবতে চায় না। মূলত কাজের মধ্যে নদী কিছুতেই এই ঝামেলাগুলো মাথায় স্থান দিতে চায় না কিন্তু দুশ্চিন্তার স্বভাবই হ্যাংলার মতো চলে আসা।

নদী টেবিলে সার্ভ করতে করতে থেমে গেল,জেরিন ম্যাম নক করেছেন
ইয়েস ম্যাম
সোজা হাঁটো, বার বার বলেছি কুঁজো হয়ে চলবে না!আনস্মার্ট লাগে”
” সরি ম্যাম ” নদী সোজা হলো। মফস্বলে বাড়াবাড়ি লম্বা হয়ে এই একটা অভ্যাস হয়েছে।
” সোজা স্ট্রেইট মেরুদণ্ড করে আগাও কনফিডেন্সের সাথে,” নদী এগোলো মুখে হাসি ” এই তো গুড গার্ল’
নয় নাম্বার টেবিলের মানুষগুলো ফোনে লাইভ করছে মনে হলো। এদিকে
ব্লুটুথে আবার সিগনাল আসছে নিশি ফোন করেছে। নদী তার কল কেটে সামনে আগালো।
******

ঘরের ঠিক মাঝামাঝি বিছানা, বিছানার উলটো পাশে আয়না অন্য পাশে অর্ধবৃত্তাকার বারান্দার দরজা। তার উলটো দিকে ছয়দরজার সুদৃশ্য ওয়াল ক্যাবিনেট। রম্য তার ক্যাবিনেট খুলে হ্যাঙ্গারের কাপড় সরালো। ক্যাবিনেটের দেয়ালে সাঁটানো একটা গোপন দরজা বেরিয়ে এলো। কাঠের স্লাইড। সাবধানে সরালে নতুন একটা ঘর। দুইপাশে এল পুরোটা শেপ করে জানালা ঘেরা ঘর আরেক পাশের দেয়ালে কেমন ওয়াল ক্যাবিনেট। বেশকিছু পুরোনো বই এখনো আছে।।রম্য বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে,

” এই অদ্ভুত ব্যবস্থা থাকতো আগেকার দিকের বাড়িগুলোতে। কিছু কিছু ঘরে যেতে হলে একটা ঘর পার হয়েই যেতে হতো। এই ঘরটা এর আগের মালিক কী পারপাসে বানিয়েছেন বলা মুশকিল তবে সম্ভবত এটা ছিল ভদ্রলোকের স্টাডি রুম।”

” হতে পারি ট্যামি, শুনেছি এর পুরনো মালিক প্রফেসর ছিলেন ”

“ইন্টারেস্টিং চরিত্রের ছিলেন” ঘুরে দেখতে দেখতে তামান্না হেসে বলল,” তুই উত্তর দিকে দেয়ালে চিকন একটা দরজা দেখছিস ”

” হ্যাঁ আছে ” রম্য অবাক হয়ে এগিয়ে গেলো।

দরজাটা খুলে দেখা গেল ওটা চলে গেছে একেবারে নিচে। নিচতলার রান্নাঘরের পেছনেও এমন একটা দরজা সেই থেকে দোতালায় আর তার থেকে উঠে গেছে তিনতালায়।

রম্য বলল “খেয়াল কর এই সিড়িটা বাড়ির একেবারে পেছনে”

” সেটাই তো কথা, সম্ভবত ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট ছিল।এই জন্যই আমি এটা রিমুভ করিনি। তবে চাবি পালটে দিয়েছিলাম সেটা তো আছে ”

রম্য বুক শেলফ থেকে বের করলো তিনটা চাবি”

” তিনটা নাতো চারটা চাবি হওয়ার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে চারটা চাবি আমি নজরুলকে দিয়ে এসেছিলাম “তামান্না বিস্ময়ের সাথে বলল।

” সাইট ইঞ্জিনিয়ার নজরুল?”

” হ্যাঁ কিন্তু সে তো ও মাই গড রমি..”

“বল ট্যামি”

” এটা তো মনে হচ্ছে অনেক বড় কন্সপেরেসি রে। কারো হাতে তোর বাড়ির এক্সেস চলে গেছে। আমি শিওর এই সব বাঁদরামো গুলো তারাই করছে। অতি দ্রুত একশনে যাওয়া দরকার তুই মিস্ত্রী ডেকে এই চাবি বদলে ফেল।”

” হাতেনাতে না ধরেই, যারাই করছে তারা আশেপাশেই আছে। তাদের আত্মবিশ্বাসটা বাড়িয়ে দেই আগে ”

” আই এম শিওর ধরে ফেলবি। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে যেহেতু সাহসের সাথে এগুলো মোকাবেলা করছিস সেটাইতো প্রশংসার দাবিদার ”

” প্রশংসা করতে একদিন হাবিকে নিয়ে চলে আয় ”

তামান্না বিরক্তি ঝেড়ে বলল “ওর তো সময়ই হয় না। ক্যান্টমেন্ট থেকে যা বিশ্রী এক চাকরি পেয়েছে…। ফ্রী হলে আসব , তোর রেস্টুরেন্টের ব্যাপারটা আমার এক আংকেলকে বলেছি । তিনি বেশ ইন্টারেস্টেড।একটু খোঁজ নিলে চিনতে পারবি ফ্রীডম চ্যানেলের নিউজ এডিটর নিতিন মন্ডল। তিনি হয়তো আসবেন। প্রচন্ড ক্ষুরধার নজর, তোর ভূত রহস্য ঠিকই বের করে ফেলবেন দেখিস”

ডিউটি ফিরতি পথে বন্ধুর রেস্তোরায় ঢু দিয়ে তরুণ স্থপতি আর বেশি বসলেন না।
তামান্নার সাথে কথা বলে রম্য কিছুটা আশ্বস্ত হলো। তবে মনে রাগটা পুরোপুরি প্রশমিত হলো না। প্রচন্ড রেগে গেলে দুটো জিনিস আমাকে শান্ত করতে পারে। এক রান্না কঠিন থেকে কঠিন রেসিপিতে মাথা মন সব ঢেলে দেবে। নতুন একটা স্বাদ আবিষ্কার করবে আরেকটা হলো বিশেষ কারো সঙ্গ। তবে যে সে কেউ নয়.. এমন একজন যে সময় থামানোর জাদু জানে।
যদিও এমন একজন একবারই আসে।
রম্য সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। কখনো কখনো অক্ষমতাই মানুষকে অন্য কিছু পছন্দ করতে বাধ্য করে। ।
রম্য ছোট নি:শ্বাস ফেলে তার অফিসরুমের দিকে আগালো। সরগরম রেস্তোরায় প্রতিটি সঞ্চালনের দিকে নীরব দৃষ্টি তার।

প্রতিটি টেবিলে আলাদা আলাদা জীবনের টুকরো গল্প। এক কোনার দিকের টেবিলে বসেছে অল্প বয়সে কপোত-কপোতী। অন্য দিকে হইচইরত একঝাঁক তরুণী, কারো বার্থডে আজ।আরেক টেবিলে তরুণ বাবা-মা সাথে প্রামে তাদের ছোট্ট বেবি। বয়স্ক দম্পতি আছে আজ তাদের চল্লিশতম এনিভার্সারি।চল্লিশটা বছর একসাথে একপি মুখ দেখে পার করা ভয়ংকর কষ্টসাধ্য।জেরিনকে বলতে হবে তাদের পক্ষ থেকে বিশ পার্সেন্ট ডিস্কাউন্ট যেন দেয়া হয়। ভাবনার মধ্যেও রম্যের চোখ আটকে গেল নয় নম্বর টেবিলে। দুইজন বিদেশি যারা ক্রমাগত ফোন ক্যামেরার সামনে বকবক করে যাচ্ছে এবং একজন রাশভারি মহিলা মুখ শক্ত করে বসে আছে।
এদের মধ্যে দুজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ফুড ব্লগার ও রিভিউয়ার…। আরেকজন কন্ট্রোভার্সি কুইন শানায়া। ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ। এরা আজ এখানে? রম্য জানে না কেন?
নতুন ওয়েস্ট্রেস মেয়েটা স্যুপের ট্রে নিয়ে সাবলীল ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আগাথেকে গোড়া ঝকঝক করছে তারুণ্যের দীপ্তিতে। তখনও সে জানে না তার আড়ালে আরেকজোড়া চোখ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে তাকে।

” আর ইউ গুড এনাফ ফর মি গার্ল, আর ইউ?”

*********

“তুমি অনলাইনে নাই কেন? ”

” আমার ইচ্ছা”

মেয়ের কথা শুনে কন্ঠ তিক্ষ্ণ করে ফেলল শানু “তোমার ইচ্ছা! পড়া শোনা নেই, কাজ কর্ম নাই, দিনের পর দিন ঘরে শেকড় গেড়ে বসে থাকা কারো মুখে ইচ্ছার কথাটা কি সুট করে?”

” আমাকে চার্জ করাও তোমাকে সুট করে না আম্মু “.

” সেটা তো তুমি উত্তর দিয়েই দিলা”

” আমি রাখি আজাইরা কথা বলতে ইচ্ছা করতেসে না৷ তোমার হট বয়ফ্রেন্ডকে হাই বলো আমার” নিশি বিরক্ত হয়ে মোবাইল কারতে যাচ্ছিল, শানু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ” নিশি আই হ্যাভন্ট ফিনিশ ইয়েট, তোমার.. গলা এমন লাগছে কেন?

” ঠিকই আছে কেমন লাগবে? ”

” মানে কেমন বসা বসা… তুই কি আইসক্রিম খাইসিলি? ”

নিশি ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল”হে খাইছিলাম আর শোনো আম্মু আমাকে তুই করে ডাকবেনা তুমি জানো আমার এটা ভালো লাগেনা ”

“আমি কালকে তোকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম … দেখি তোর অনেক জ্বর, আমি তোর বডি স্পঞ্জ করে দিচ্ছি কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। টেম্পারেচার নামছে না। তুই ছোটকালের মত জ্বরের ঘোরে মেরি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্প গানটা জ্বরের ঘোরে গাইছিস খুব ভয় লাগলো …”

” দুই মাস পর আমাকে তুমি ফোন দিয়েছ এই স্বপ্ন দেখার কারণে? স্বপ্নটা না দেখলে কি কল দিতা না?

শানু দ্রুত কিছু বলতে গেলেন, নিশি মাকে থামিয়ে বলল, ” আমি মনে হয় স্বপ্নে এসেও তোমার মুড খারাপ করে দিয়েছি। সরি ফর দ্যাট। এখন রাখি।ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি বহাল তবিয়তে আছি আমার জ্বর-টর কিছু হয় নাই ”

নিশি মোবাইল কেটে দিলো। বিচিত্র বিষয় হলো তার সত্যিই জ্বর জ্বর লাগছে। গলার কাছে কিছু শক্ত জমাট হয়ে যাচ্ছে টনসিলের সমস্যা কিনা কে জানে। ডাক্তার দেখাতে হবে, যদিও এই মুহূর্তে সে ডাক্তারের কাছেই আছে। এই ঘরটাকে post-operative রুম বলে কিনা ঠিক জানে না নিশি। পেছনের ফিতা ওয়ালা বিচিত্র একটা জামা তাকে পড়ানো হয়েছে। ক্লিনিকটায় নার্স বয় সবাই নির্দ্বিধায় এই রুমে আসা-যাওয়া করছে। নিশির অস্বস্তি হলেও কিছু কারো যায় আসে না। যদিও এখানে আসা তার জন্য সহজ ছিল না। প্রথমত ভয়, যদি ব্যথা হয়…দ্বিতীয়ত ফাইনান্স, তৃতীয়ত নদী।আঁতকে উঠেছিল খবর শুনে।

– এখন কী হবে নিশি এখন কী হবে?

– জানি না,” নিশির হাই তোলা জবাব ” এত জটিল কিছু ভাবতে মন চায় না। ”

– তু তু তুই কিছু করবি না? মানে এভাবে..এইটা তো স্বাভাবিক না!

– অ্যাবনরমালের কি আছে, এই বয়সে একটা ছেলে একটা মেয়ে একজন আরেকজনের প্রতি অ্যাট্রাকশন ফিল করবে এটাই স্বাভাবিক, তাদের মতে ইন্টিমেসি হবে সেটাও স্বাভাবিক, আর তার ফলে…

– তুই এই স্বাভাবিক হওয়ার ডায়লগ দুনিয়ায় ঢোল পিটিয়ে বল,দেখিস তোর অবস্থা স্বাভাবিক থাকে কিনা।

– ফ্যামিলির কেয়ার আমি করি না

– ফ্যামিলি বাদ দে এই আশেপাশের রুমের মেয়েগুলো শুধু জানতে পারলেই হলো! ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। তোকে তো অবশ্যই আমাকেও বের করবে।

– আরে ভাগ, ওই শালীগুলো কত সতী-সাধ্বী রে ব্যাগ ঘেটে দেখ, কনডম নিয়ে ঘোরে …

নিশির কেন যেন সত্যি ভয় লাগছিল না, শরীরের ম্যাজম্যাজে ভাবটা বেড়ে যাচ্ছিলো। ভেতর ভেতর অন্য একটা পৈশাচিক আনন্দ পৃথিবী জেলার সাথে সাথে এক সময় খবর যাবে আমেরিকাতে ।একসাথে ভিডিও কলে বাবা আর মায়ের চেহারাটা কেমন হবে নিশির জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নদীর ঘ্যানঘ্যানের জ্বালায় এই চিন্তাটা বেশি একটা উৎসাহ পেল না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলো। দিনশেষে সবাই নিজের স্বার্থ নিয়েই পড়ে থাকে। নদীর চিন্তা বাড়িটা হাত ছাড়া না হয়।এখন টুকিটাকি বাজারও করে। ডিউটি শেষে ফিরতি পথে নিশির জন্য খাবারও নিয়ে আসে। টাকা গুরুত্ব বাড়ানোর বড় অস্ত্র। নদী প্রথমে রাফিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলো। নিশি ধমকে ফিরিয়েছে।কিন্তু থেমে থাকলে চলবে না প্রতিমুহূর্তে একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছিলো যেটা ব্যবস্থা নিতে হতো।

শুরুতে দুজনে মিলে চিন্তা করেছিল ওষুধ খেয়ে কিভাবে ঝামেলাটা সরানো যায়। ইন্টারনেট ঘেটে কিছু ওষুধের সিরিয়াল তো পেল কিন্তু এটা কোন কোম্পানি কোন নামে বের করে সেটা জানতে পারল না। একে-তাকে জিজ্ঞেস করবে নদীটা প্যানপ্যান করা শুরু করতো। বাধ্য হয়ে নদী সাতক্ষীরার রানুখালার পাশের বাসার এক ডাক্তারের কাছে ফোন দিয়েছিলো। তাকে বিষয়টা বলার পর তিনি ধরে নিয়েছেন নদীই কোন ঝামেলা পাকিয়েছে।

ফোনে কথা কি হল জানা গেল না।
ফোন রেখে নদী মুখ কালো করে ফেলল,” কোন ধরনের ওষুধ খেতে নিষেধ করসে৷ তিনমাসের ওপর হয়ে গেছে এটা নাকি ওয়াশ করাই লাগবে। ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। মিরপুরে একটা ঠিকানা দিয়েছে, উনার ফ্রেন্ডের ক্লিনিক। বলেছে সেখানে যেতে তিনি সব সামলে নেবেন।

-বাদ দে, আমিও খোঁজ নিসি। পাশের রুমের দিপার কেমন খালা ভালো পারে এগুলো তিনি করে দেবে বলসে।খরচও বেশি না।

– উনি এটাই মানা করসে। ডাক্তার ছাড়া না করতে। অনেক রিস্ক । ফরসেপ দিয়ে গুতিয়ে তোর পেট ছিদ্র করে দেবে। ইনফেকশন হয়ে যাবে টেরও পাবি না।অকালে মরবি!

ঠাটবাটের সাথে নদীর ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছু শক্ত ব্যাপার চলে এসেছে। নিশি তর্কে যায়নি কিন্তু নদীর কথামতো আসা ঝামেলাও কম ছিলো না হাতের টাকা সব শেষ হয়ে আসছে। কপাল ভালো গেলবার মা বাড়িওয়ালাকে একবছরের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে রেখেছিল। ডাক্তার যে খরচের বহর দেখালো সেটা তুলতে দিশাহারা। মায়ের দেয়া আঠেরো কেরেটের ইটালিয়ান গোল্ড ব্রেসলেটটা কাজে এলো৷ পাশের রুমের দিপাই বিক্রি করে দিলো–” পনেরো হাজার দিলো বুঝলি নিশি বলল সোনাটা নাকি ভালো না৷ এই দেশে চলে না।”
ছয় গ্রাম সোনার ব্রেসলেটের এত কমদাম সম্ভবত নয় তবে নিশি ঝামেলায় যায়নি। টাকাটা দরকার ছিলো নিয়ে চলে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পরই তাকে নেওয়া হবে।
” লোকাল দিয়ে করবেন না? ” একজন আয়া এসে ঢুকেছে ।
” হ্যাঁ লোকাল ”

” স্বামী আসছে?

নিশি ভ্রুকুটি করে তাকালো। সবাই সবকিছু জেনেও আসে বিকৃত আনন্দ নিতে।

” বলেন আসছে? ”

” আসতো কিন্তু আপনারে দেখে লজ্জা পায়, বউয়ের সামনে আসলে ধরা পড়ে যাবে না? “নিশির কথায় মহিলা শুরুতে বুঝতে পারল না পরে রাগে গজগিজ করে তাকিয়ে রইলো।
” ডাক্তার কি আসছে,?কতক্ষণ লাগবে? . ” নদীর গলা। নিশিকে ভেতর ডুকিয়ে বাইরে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে। নিশি চাইলে গিয়ে দেখা করতে পারে ইচ্ছা করছে না বিবশতা পেয়ে যাচ্ছে।

” তোমাকে যতবার ফোন দেই তুমি আমার মনটাকে ক্ষত বিক্ষত করে দাও। তারপরেও ফোন দেই, কারন আমার গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমি যত বেশি বিরক্তই হও আমার চিন্তা তোমার জন্য কমবে না। আমি সত্যি তোমাকে নিয়ে চিন্তিত। দয়া করে নিজের খেয়াল রাখ, আর মনে রেখো মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে ”

নদী আজ কলেজে যায়নি। নিশির নিশ্চিত খবর না জেনে সে শান্ত হতে পারছে না। তবে আসার পথেও অদ্ভুত দ্বিধা৷ কলেজের মিনারার কাছ থেকে বোরখা পড়ে এসেছে যেন কেউ না বোঝে। নদীর ভাবতে কেমন একটু লজ্জা লাগলো, নিশির উপর কি যাচ্ছে জানে না সে পড়ে আছে নিজের ইমেজের সুরক্ষা নিয়ে।
” আপনে একটু ভেতরে আসেন আপনার রোগী ভ্যাজাল করতেসে ” একজন আয়ার কথায় নদী তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল ।
ভেতরে গিয়ে দেখা গেল ডাক্তার মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে। নিশি তার কাপড় পরে ফেলেছে। হাসিমুখ, বেশ সুস্থই লাগছে।
নদী একটু বিভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করলো।
-হয়ে গেছে?
– হ্যাঁ হ্যাঁ চল যাই। নিশি যেতে উদ্যত।
– কিছুই হয়নি। আপনার বোন মাইন্ড চেইঞ্জ করসে। করাবে না।
নদী হতভম্ব হয়ে তাকালো নিশির দিকে।
– রাফিন ফোন দিসিলো বুঝলি।
কান্নাকাটি করলো তাই আই চেইঞ্জ মাই মাইন্ড! বিয়েটা করেই ফেলি।
– এইসব শিওর হয়ে আসতে পারো না তোমরা সব কিছু কি ফাজলামো?
নার্স মেয়েটা গজগজ করতে করতে চলে গেলো। নিশি হাসিমুখে নদীকে নিয়ে বের হলো।।
– রাফিন কী বলল ফোনে.
দুশ্চিন্তার চাপ কমলেও নদীর দ্বিধা কাটছিল না।
– ফোন করেছিল নাকি যে বলবে
– তাহলে তুই যে বললি…
– অ্যাবরশন করবো না।
– কেন?? তুই জানি এটা..
– আমি জানি যে এটা আমার।
– যেটার বাপ নাই।
– আমার তো ছিলো, কীইবা লাইফ দিসে?
মমকে আমাকে জঞ্জালের মতো ছুড়ে ফেলে নিজে ফুর্তি করতেসে।
– নিশি তুই..
– তুই চুপ থাক। ইটস মাই লাইফ মাই ডিসিশন। পোষালে থাক নয়ত ভাগ। চাকরি করছিস এখন থাকা সমস্যা না। আমারটা আমি টেকেল নেব।
নদী ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে, তাকে পেছনে রেখে নিশি গটগট করে চলে যাচ্ছে ।কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here