বকুল, পর্ব:৯+১০

0
2217

#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি

||৯||

মধ্যদুপুর । মাথার উপরে থাকা সূর্যটা তীর্যক ভাবে তার আলোক রশ্মি ছড়াচ্ছে। চারপাশে পিনপিন নিরবতা ।

পঞ্চায়েতের শতক মানুষের মুখের বুলি বন্ধ হয়ে গেছে সানিম ভাইয়ার এক কথায় । সানিম ভাই একহাতে শক্ত করে আমাকে আগলিয়ে রেখেছেন । সামনে কাজি বসে খাতায় লিখছেন। কাল রাত থেকে না খাওয়ার ফলে শরীর দুর্বল লাগছে। কিছুক্ষণ আগে সানিম ভাইয়ার কথা শুনে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে সানিম ভাইয়া এসে আগলে নেয় । জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে সানিম ভাইয়ার শুধু কয়েকটা কথাই কানে আসে সে সকলের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলছে যে ,

‘ আপনাদের চোখে যেহেতু আমরা দোষী তাই যা শাস্তি দিচ্ছেন তাই মেনে নিয়েছি । বকুলকে আমি বিয়ে করবো ঠিকই কিন্তু বাকী শাস্তি মেনে নেবো না । আপনারা কি মানুষ ? এতক্ষণ আপনাদের সব কথা শুনলাম । কোন সমাজে বাস করেন আপনারা ! যেখানে আমাদের কোন দোষই নেই সেখানে সত্যতা নিশ্চিত না করে একশত বেত্রাঘাতের আদেশ দিলেন এটা কেমন সমাজ ? ‘

আর শুনতে পেলাম না তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম ।

পানির ছিঁটায় চোখ মেলে তাকালাম । মিরা বিনা আপু করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । আশেপাশে লক্ষ্য করে দেখি গ্রামের কাজী সাহেব উপস্থিত হয়েছেন ।

বর্তমানে মাথায় কাপড় দিয়ে বসে আছি পঞ্চায়েতের সকলের সামনে । কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন কবুল বলতে বলায় হু হু করে কান্না শুরু করি । মেয়েদের জীবন খুবই বৈচিত্রময় নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়ি গিয়ে সকলকে আপন করে নিতে হয় । নতুন পরিবেশে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নিতে হয় । শত শত কটুবাক্য শুনেও সেখানেই পড়ে থাকতে হয়।
তিন তিনবার কবুল বলে সারাজীবনের জন্য সানিম ইয়াসার সাথে অজানা এক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেলাম । সানিম ভাইকে কবুল বলতে বলায় গটগট করে বলে দিলান । কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন রয়ে গেল । সানিম ভাইয়া কি শুধু আমার সম্মান বাঁচাতে বিয়ে করেছেন ? নাকি অন্যকোন কারন আছে । পঞ্চায়েতের বিচারকদের হুঙ্কারে বাস্তবে ফিরে আসি

‘ এই যে শহরের ছেলে বকুলরে তো বিয়া করলা এখন কি করতে চাও ? বকুলরে সাথে নিয়ে যাইবা নাকি রুপনগরে রেখে যাইবা । ‘

‘ বিয়ে যেহেতু করেছি তাই বউকে সাথে করে নিয়ে যাবো । আপনাদের আশায় বউকে রেখে খেলে দেখা যাবে আপনাদের অত্যাচারে বউ আমার সুইসাইড করেছে । অসংখ্য ধন্যবাদ রুপনগরের বাসিন্দাদের। এসেছিলাম ঘুড়তে গ্রামের সহজ সরল মানুষ দেখে কিন্তু এখন বুঝলাম আপনাদের মতো সহজ সরল মানুষের পেছনে জটিলতা রয়েছে অনেক । ‘

কথাগুলো বলে আমার হাত ধরে টেনে সকলের সামনে থেকে নিয়ে আসলো । পেছনে বাকী চারজন কিসব বলে আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে আসছে ।

রিসোর্টে পৌছে স্হির হয়ে বসে আছি রুমে । ভাবছি জীবনের মোড় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে । সানিম ভাই বিয়ে করেছেন শুধুমাত্র আমার সম্মান রক্ষার্থে । আচ্ছা! এখন যদি সানিম ভাই বলেন যে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন তো কি হবে আমার ? কোথায় যাবো আমি ? পুরো গ্রামে আমার বিয়ের কথা রটে গিয়েছে । মা যদি বাসায় আসে তো নিশ্চয়ই এতক্ষণ তার কানেও চলে গিয়েছে বিয়ের খবরটা । কিভাবে আমি বাসায় যাবো কি করবো কিছুই ভাবতে পারছিনা । দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে ফিরে তাকালাম । সানিম ভাইয়া এসেছেন । আস্তে করে দরজা লাগিয়ে এসে বসলেন আমার পাশে । এখন আর আমি কান্না করছি না । চোখের পানি শুকিয়ে গেছে । অনুভূতি শূন্য হয়ে আছে । হাতে সানিম ভাইয়ার স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলাম ।

‘ বকলফুল, আমকে বিশ্বাস করোতো! ‘
‘ নিজের থেকেও বেশি’

সানিম ভাইয়া আমার আরেকটু কাছে এসে দুহাত ধরে নরম সুরে বলতে শুরু করলেন,

‘ আমি জানি তোমার পড়তে অনেক ইচ্ছে আছে। আমি তোমাকে ঢাকায় নিয়ে পড়াশোনা করাব তোমার সকল ইচ্ছে পুরন করব। আজ থেকে তোমার সব দায়িক্ত আমি নিলাম। প্রমিজ করছি তোমার স্বপ্ন পূরনে আমাদের এই বিয়ে বাধা সৃষ্টি করবে না। ‘

সানিম ভাইয়ার কথা শুনে এবার শিওর হলাম উনি শুধু আমার সম্মান রক্ষার্থে বিয়ে করেছেন অন্য কিছু না। যেহেতু আমার ভাগ্যে এই লিখা আছে তাই অমত কারার কোনও প্রশ্নই আসে না কারন আমার এখন যাওয়ার মত আর কোন পথ নেই। তাই সানিম

ভাইয়াকে সরাসরিভাবেই বললাম

‘ আপনি যা বলবেন তাই। কিন্ত আমার বাবা মা? তাদের কি বলব?

সানিম ভাইয়া কিছুটা হেসে উত্তর দিলেন

‘ কাকে তুমি বাবা মা বলছো ? যে কি না তোমার উপর অত্যাচার করবে আবার তোমার পয়সায় বসে বসে খাবে সেই মার কথা বলছো ? আমি তোমার সব খোঁজ নিয়েছি। তোমার বাবা এখন অসুস্থ তার সব খরচ আমি বহন করব। আর তোমার মা এখনও বাসায় আসেনি লতিফ চাচা কে দিয়ে সব খবর আনিয়েছি। তোমার বাবাও সম্মতি দিয়েছে। শুধু তোমার মতামত বাকি ছিল তাও পেয়ে গেলাম। সন্ধায় রাওনা হব যা পড়া আছ তা দিয়েই চলবে। তোমার হাসবেন্ডের যথেষ্ট টাকা আছে তার স্ত্রীর আবদার ইচ্ছে আয়েস পূরণ করতে।’
সানিম ভাইয়ার শেষের কথা কেমন অদ্ভুত মনে হল। কথা বলতে আর ভালো লাগছে না তাই মাথার ইশারায় হ্যাঁ বলে দিলাম ।

শেষ বিকেল । লতিফ চাচার রিসোর্টের সামনে দুটো প্রাইভেট কার দাঁড় করা আছে । লতাফ চাচা , রবিন ভাই আর আরিফা থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে । পেছনে ফেলে রেখে আসলাম রুপনগর । গাড়িতে বসে আছি আমি আর সানিম ভাইয়া । দুটো গাড়ির মধ্যে একটাতে আমি সানিম ভাইয়া আর আরেকটিতে তারা চারজন ।

ঢাকায় পৌছুতেই আমরা আর উদয় ভাইয়ারা আলাদা হয়ে গেলাম । উদয় আর রাফি ভাইয়া মিরা বিনা আপুকে বাসায় দিয়ে তারা নিজেদের বাসায় চলে যাবেন । মাঝ পথে গাড়ি থামালেন সানিম ভাইয়া ।
প্রশ্নবোধক চাহুনিতে সানিম ভাইয়ার পানে তাকালাম।
সানিম ভাইয়া হয়তো আমার কথা বুঝতে পেরেছেন তাই মুচকি হেসে উওর দিলেন

‘ সেই যে দুপুরে পেটে খাবার পড়েছিল এরপর আর কিছু পড়েছে এই পেটে ? এখন রাত নয়টা বাজে চলো কিছু খেয়ে নিবে ।’

ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে এখন না খেলে সোজা আল্লাহ্ র কাছে চলে যাবো । রেস্টুরেন্টে বসে আছি । সানিম ভাইয়া ফোন আসাতে বাহিরে গেল । রেস্টুরেন্টের চারিপাশে লাল নীল মরিচ বাতি জ্বলছে । বিহারি নকশার কাঠের সামগ্রী সুন্দর করে সাজানো রয়েছে । এসব বড় বড় রেস্টুরেন্টে আসা না হলেও ধারণা আছে আমার রবিন ভাইয়ার থেকে শুনেছি । গোলাকার টেবিলের উপর সাদা কাপড় দেয়া আর তার উপর ছোট ছোট রুমালের মতো কাপড় দিয়ে আবৃত টেবিলখানা মিনারেল ওয়াটারের বোতল দুটি রাখা , ছোট ছোট প্লেট তার উপর একটি কাঁটা চামচ , একটি ছুড়ি, আর একটি সাধারণ চামচ , লবন , সস রয়েছে টেবিলের উপর । আশেপাশের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি এমনসময় সানিম ভাইয়া হাজির হলেন । ধপ করে চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন ,’কি খাবে? ‘

সংকোচ না করেই বলে দিলাম

‘ সাদা ভাত খাবো ছোট মাছ দিয়ে যদি না থাকে তো রুটি হলেও চলবে ।’

সানিম ভাইয়া আচ্ছা বলে ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করে ফোন স্ক্রল করতে লাগলেন ।

‘ আমরা এখন কোথায় যাবো ? মানে কার বাসায় থাকবো ? ‘

কথাটা শুনে সানিম ভাইয়া তার ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকালেন

‘ আমার বউ তুমি এখন আমার কাছে থাকবে না তো কি ফুচকা ওয়ালা মামার কাছে থাকবে ?’
সানিম ভাইয়ার এহেন কথায় দতমত খেয়ে যাই । আজব লোক তো সামান্য কথাই তো জিজ্ঞেস করলাভ এমন ত্যাড়াভাবে উওর না দিয়ে ভালোভাবে সহজ ভাষায় উওর দিলেই হয় ! অসভ্য লোক । মনে মনে এমন হাজারটা গালি দিচ্ছি তখনই সানিম ভাইয়া বলে উঠলেন

‘ ও ম্যাডাম স্বপ্নের জগত থেকে বের হয়ে বাস্তবে আসুন ।ওয়েটার সেই কখন খাবার দিয়ে গেল খাওয়া শুরু করো । আর একটা কথা আজ আমরা বাসায় যাচ্ছি না আমাদের ফার্ম হাউজে রাত কাটিয়ে সকালে বাসায় রওনা হবো । ‘

আরে আম্ ,,,
পুরো কথা বলতে না দিয়ে সানিম ভাইয়া একটু কাছে এসে বলতে শুরু করলেন

আর একটাও কথা নয় বকুলফুল , সারাদিন ভালো করে কিছু খাওনি । আগে খেয়ে এনার্জি বাড়াও তারপথ প্রশ্ন করো । আমি আছি সবসময় তোমার পাশে ।’

চলবে……..

#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি

||১০||

গভীর রাত । নিস্তব্ধ চারিদিক । শহরের রাস্তা ধরে গোটা কয়েক গাড়ি চলাচল করছে । শো শো বাতাস বইছে চারপাশে । গাড়ি চলছে আপন গতিতে । কারোর মুখে কোন কথা নেই । আশেপাশে ঝি ঝি পোকার আওয়াজে বুঝা যাচ্ছে শহর থেকে অনেকটা ভেতরেই চলে আসছি । ভয় লাগছে প্রচন্ড যেই পরিস্থিতিতে বিয়ে হোক না কেন ? কতই বা চিনি পাশে বসা মানুষটিকে যদি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে আসে তো ?

‘ কি চিন্তা করছো বকুলফুল ? ‘

ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি সানিম ভাইয়ার পানে মানুষটা না তাকিয়ে কিভাবে বুঝল আমি কিছু একটা চিন্তা করছি ?

‘ বললে না বকুলফুল কি চিন্তা করছো ? এই নির্জন স্থানে তোমাকে মেরে যদি গুম করে দেই কেমন হবে এসব চিন্তা করছো ?’

সানিম ভাইয়ার কথা শুনে শুকনো ঢুক গিলে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম । আমার অবস্থা দেখে উনি হা হা করে অট্টহাসিতে হাসতে লাগলেন ।

‘ লাইক সিরিয়াসলি বকুলফুল , তোমার মনে হচ্ছে যে আমি তোমাকে মারবো হা হা । ‘

গাড়ি থামিয়ে আমার আরেকটু কাছে এসে বলতে শুরু করলেন ,

‘ তুমি তো বকুলফুল, তোমাকে কেউ ফুলের মত টোকা দেয়ার দুঃসাহস করলে তার ঐ দিনই মৃত্যু হবে ।
তুমি এখনও জানোনা আমার কাছে ঠিক তুমি টা কি।’

সানিম ভাইয়ার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে আছি । এতক্ষণ যা বললেন মহাশয় তা শুনে মনে একটা প্রশ্নই
আসে যে সে আমায় ভালোবাসে নাকি দায়িত্বের জন্য ? মনের কথা মনেই রেখে দিলাম প্রকাশ করলাম না ।
সানিম ভাইয়ার ফার্ম হাউজে পৌছুতে পৌছুতে রাত দুইটা বেজে গেল । অন্ধকারে যতটুকু বুঝলাম বাড়ির আশেপাশে হরেক জাতের ফুলের গাছ রয়েছে যার কারনে নাকে হাস্নাহেনার বেলিফুলের ঘ্রাণ সহ আরো বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গন্ধে মুহিত হয়ে আছে চারপাশ।

কলিং বেল বাজালেন সানিম ভাই । হাসিমুখে সদর দরজা খুলে মিষ্টি হাসিতে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা । বয়স বিয়াল্লিশের কাছাকাছি হবে । এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে উনি পাশে বসলেন । কপালে আদরের চুমু দিয়ে বললেন

‘ মাশাআল্লাহ সানিম বাবা , তোমার বর্ণনার চেয়েও তোমার বকুলফুল আরো বেশি রূপবতী । নজর না লাগুক। খুব মিষ্টি মেয়ে । ‘

‘এই মিষ্টি মেয়েটা এখন তোমার সানিমের একমাত্র বউ মনিমা ।’

সানিম ভাইয়ার কথা শুনে মনিমার চোখ ছলছল করে উঠলেন । খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে আদর করে বলতে শুরু করলেন

‘ মারে , আমি খুব খুশি হয়েছি তোর সাথে সানিমের বিয়ে হয়েছে বলে । জানিস মা , সানিম যখন ফোনে তোর কথা বলেছিলো তখন ভাবতাম ছেলেটা আমার কিছুদিনের মোহে পড়ে আছে তাই আজেবাজে বকছে। কিন্তু এখন তোমাকে সামনে দেখে বুঝতে পারছি আমার ছেলে আস্ত এক পরিকে নিয়ে এসেছে।’

সানিম ভাইয়ার মনিমার কথা কিছুই মাথায় ঢুকছেনা । কিন্তু উনার কাছে থাকতে বেশ ভালো লাগছে । আলাদা এক প্রশান্তি পাচ্ছি উনার কাছে । মা মা ঘ্রাণের আভাস পাচ্ছি উনার কাছে যা এতদিনেও আকীবা মায়ের কাছে পাইনি । আকীবা মা তো কখনও আদর করে ডেকেছে কি না মনে পড়ছে না আমার । আজ মায়ের কথা খুব মনে পরছে মার চেহারা কেমন ছিলো ভুলে গিয়েছি ।

‘ মনিমা আমি ফ্রেস হয়ে আসি । আর বকুলফুল তুমিও ফ্রেস হবে আসো রাত অনেক হয়েছে ।’

সানিম ভাইয়ার ডাকে একদম যেতে ইচ্ছে করছে না আমার । ইচ্ছে হচ্ছে ঘাপটি মেরে বসে থাকি মনিমার পাশে । জার্নির কারনে শরীর দুর্বল লাগছে তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মনিমার থেকে বিদায় নিয়ে সানিম ভাইয়ার পিছু পিছু চললাম ।

বিশাল বড় বারান্দায় সাড়ি সাড়ি ফুলের টব দাঁড়িয়ে আছে । মনে হচ্ছে এরা আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে । বারান্দা পেরিয়ে এক দরজার সামনে দাড়ালেন সানিম ভাইয়া তার পেছনে আমি । আকস্মিক উনি পেছনে ফিরে তাকালেন । সানিম ভাইয়ার ঠিক পেছনে ছিলাম বিধায় এদিকে ফেরাতে ভয় পেয়ে যাই আর ঝটপট পিছিয়ে যাই ।

‘ এ কেমন কান্ড , ভয় পেয়েছি তো ।’

ভয়ে কিছুটা তুতলিয়ে বললাম

‘ ও মোর আল্লাহ্, ভয় পেয়েছো তুমি ? লাইক সিরিয়াসলি ! যে মেয়ে গ্রামের পথে রাত বিরাতে হাঁটাচলা করে সে আবার ভয় পায় ? তুমি জানো সেদিন তোমাকে পেত্নী ভেবেছিল ওরা ।’

সানিম ভাইয়ার কথায় আহাম্মক বনে যাই তাই জিজ্ঞেস করলাম ,
‘ আমি কি করলাম ? সেদিন বাবার ঔষধের খুবই প্রয়োজন ছিল তাই রাতে বের হয়েছিলাম । আর আর এখন আপনি আমাকে পেত্নী বলছেন ? ‘

সানিম ভাইয়া কক্ষের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে উওর দিলেন

‘ শুধু পেত্নী না নিশ্চুপ পেত্নী তুমি । চুপিচুপি মানুষের মন চুরি করতে জানো । ‘

‘ কি , আমি পেত্নী ? তাহলে তো আপনি আপনি অসুদর্শন পুরুষ । দেখতে তেজপাতা গাছের মতো ।’

‘ এই মেয়ে মাথা ঠিক আছে তোমার ? স্বামীকে এসব কি বলো । পাপ হবে পাপ বুঝলে ? আমি জানি আমি দেখতে সুদর্শন। আর কেউ কেউ তো লুকিয়ে লুকিয়ে এই সুদর্শন পুরুষটিকেই দেখে তাও জানি । যাকগে আমি ফ্রেস হতে চললাম । বকুলফুল , পাশের ওয়াড্রপে শাড়ি জামা সব রাখা আছে । পছন্দ মত পাশের রুপের ওয়াস্রুম আছে ফ্রেস হয়ে নাও নয়তো অপেক্ষা করো আমি আসছি । ‘

‘ ইশ অপেক্ষা করো ! বললেই হলো করবোনা আমি অপেক্ষা। এমনিই এমনি অসুদর্শন পুরুষ বলে ডাকলাম ? উনি নামে সুদর্শন কাজে না । কিসব উল্টা পাল্টা কথা বলে আমাকে গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। সানিম ভাইয়া ফ্রেস হতে চলে গেলেন আমিও পাশের রুমে ফ্রেস হয়ে সুতি এক থ্রি-পিস পড়ে নিলাম।

এখন রাত দুইটা বাজে । সারাদিনের ক্লান্তিতে আরামদায়ক বিছানা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি ।শুয়ে পরলাম । চিন্তা করছি আজকের দিনের কথা কি থেকে কি হয়ে গেল আমার সাথে । সারাদিনের কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি জানি না ।

কারোর ভারী নিশ্বাসের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি কারোর বক্ষে খুব গভীরভাবে লেপটে শুয়ে আছি আর সেই বক্ষের মালিকের দু হাতখান জোড়া আষ্টেপিষ্টে ধরে জড়িয়ে আরামে নিদ্রায় শায়িত আছে। মাথা খানিকটা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি মহারাজ মনের সুখে আরামে ঘুমাচ্ছেন । মনে হচ্ছে হাজারো বছর ঘুমাননি । কোন ছেলের সন্নিকটে থাকার ধ্যান হওয়ায় ছিটকে দুরে সরে গেলাম । আর সানিম ভাইয়া সে ঘুম ঘুম কন্ঠস্বরে কি যেন বলছে । একটু কাছে গিয়ে শুনতে পেলাম বলছে যে ,

‘ উফ বকুলফুল ঘুমাও তো আমাকেও ঘুমাতে দাও । এমনিতেও সারারাত তোমাকে দেখে পার করেছি এখন একটু ঘুমাতে দাও ।’

বেটা থুরি এখনতো আমার জামাই কি বলে উনি , সারারাত আমাকে দেখেছে মানে ? চারপাশে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে বুঝতে পেলাম সকাল হয়ে গেছে । পুরো রাত এক কক্ষে এক বিছানায় আমি সানিম ভাইয়ার সাথে ছিলাম তা ভেবেই রাগ উঠে গেল । যতই উনি আমির স্বামী হোক না কেন উনিতো আমাকে পরিস্থিতির চাপে বিয়ে করেছেন তা আমি ভুলিনি ।

‘ এই উঠুন আপনি উঠুন । আপনি কেমন পুরুষ হু সারারাত একটা মেয়ের সাথে এক বিছানায় থাকতে লজ্জা করলো না ? উঠুন বলছি উঠুন । ‘

‘ উফ বকুলফুল ঘুমাতে দাও এখন আটটা বাজে দশটায় ডেকে দিও আর তোমার মত বোকা মেয়ের মাথায় এত প্রেশার দিও না । বাম পাশের রুমটায় মনিমা থাকে যাও তার কাছে আমি একটু ঘুমিয়ে নেই রাতে মনিমা অনেকবার তোমাকে ডেকে গিয়েছিল উঠোনি যাও দেখা করে আসো ।’

‘ ইয়েহ ঘুমিয়ে নেই বলি সারারাত কি ঘোড়ার ঘাস কেটেছেন ? একে বলে লাভ হবে না আমি বরং মনিমার কাছে যাই । ‘

মনিমার কক্ষে এসে শান্ত হয়ে গেলাম । পশ্চিম দিকে ফিরে জায়নামাজে বসে কোরআন তেলওয়াত করছেন । আমাকে দেখে মুচকি হেসে কোরআন শরীফে চুমু খেয়ে বন্ধ করে দিলেন । কিছুটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন ,

‘ ঘুম ভেঙেছে মা ? অনেক রাত অবধি জেগে থাকায় তোমাদের সকালে ডাকিনি । চল নাস্তা করবে বেলা অনেক হয়েছে । সানিম বাবা দশটার আগে ঘুম থেকে উঠবেনা । ‘

মনিমার সাথে খাবার টেবিলে চলে গেলাম । রাতে ভালো করে বাড়িটা দেখা হয়নি এখন দেখছি । বিশাল বড় এরিয়া জুড়ে এই বাড়িটা । গোলাকৃতি বাড়িটায় চার থেকে পাঁচটি কামড়া আর মাঝখানে ডাইনিং সিস্টেম ।

নাস্তা করার মাঝখানেই সানিম ভাই হাজির। ঘুম ঘুম চোখ , এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল পরিধানে ঢিলে টাউজার টি-শার্ট দেখতে কুরিয়ান নায়কের মতো লাগছে । ধুপ করে আমার পাশের চেয়ারে বসে বলা শুরু করলেন ,

‘ মনিমা, তোমার মেয়ের জন্য কিছু আদর তুলে রাখো অন্য সময় এসে পুষিয়ে দিও আজ একটু পর বাসায় রওনা হব । মা জননী পাগল হয়ে বারবার ফোন করছেন । অতি জরুরী তলব । বাসায় কে যেন আসছে তাদের সাথে দরকার আছে । আর বকুলফুলকে নিয়েও যেতে হবে মার পুত্রবধূকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আর চারমাস পর আমার ফাইনাল পরীক্ষা তুমি তো জানোই সো যেতেই হবে । ‘

মনিমা কিছু বলতে চাচ্ছিলের তার আগেই আমি সানিম ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম ,

‘ আপনার মা যদি আমাকে মেনে না নেয় তো ? এর চেয়ে ভালো আমি মনিমার সাথেই থাকি । শুধু শুধু চাপে পরে মিথ্যা বলতে হবে না আপনার ।’

‘ বকুলফুল বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করিনা । তোমার বার বার এমন কেন মনে হয় যে তোমাকে আমি মেনে নেইনি । ‘

সানিম ভাইয়ার একথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম সত্যিই তো যা ভাবার আমিই ভাবি উনি তো কখনও কিছু মুখে বলেননি ।

‘ হয়েছে থাম তোরা কাল বিয়ে হয়েছে আর আজ তারা ঝগড়া করছে । আমি সবসময় তোর পড়াশোনাকে আগে প্রাধান্য দিতে বলেছি । পরীক্ষা শেষ হলে অবশ্যই বকুলকে নিয়ে আসবি মেয়েটার সাথে মনের মত কথা বলতে পারিনি । আর তোর মা কোন জামেলা করলে আমায় বলবি চলে আসবো তোর মাকে বকে দিতে । ‘

‘ আচ্ছা বলবো । তুমি চিন্তা করিও না নিজের খেয়াল রেখো ।’

মনিমার থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম আসল শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে । জানিনা সেই বাড়িতে সবাই কেমন হবে । আমার তিক্ত অতীত কি ভুলতে পারবো তাদের পেয়ে নাকি ভাগ্যে অন্য কিছু আছে । এসব শত শত চিন্তা করে সানিম ভাইয়ার বাসা মানে আমার শ্বশুর বাড়ি চলে আসলাম । গাড়ি থেকে বেরিয়ে সানিম ভাইয়া শক্ত করে আমার হাত ধরে সদর দরজার সামনে দাঁড়ালেন । কলিং বেল চাপ দিতেই কেউ একজন দরজা খুলে দিলেন । অপর পাশের মানুষদ্বয়দের দেখে অবাক হয়ে যাই । মুখ থেকে আপনা আপনি বের হয়ে যায়,

‘ নাঈমা , আকীবা মা ?’

চলবে …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here