বকুল, পর্ব:১১

0
1956

#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি

||১১||

শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময় । এসময়ে কখনও সূর্য্যিমামা হেসে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে দেয় আবার কখনও কালো বাদল ছেয়ে অন্ধকার করে দেয় । সোফার রুমের পরিবেশ আপাতত শান্ত । শক্ত হাতে হাত রেখে পাশের মানুষটি আমায় নিয়ে সোফায় বসে আছেন । অপরপাশে আমার শ্বশুর আদনান সাহেব ও শ্বাশুড়ি সুরভী গম্ভীরভাবে বসে আছেন আর তার থেকে কিছুটা দূরে আমার পালিত মা আকীবা আর বোন নাঈমা কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আমার পানে । কিছুক্ষণ আগে সদর দরজা আমারই নামে মাত্র বোন নাঈমা খোলে দেয় আর তার পেছনে আকীবা মা দাঁড়িয়ে ছিল আমাকে দেখে দুজনের ভ্রূ যুগল কুঁচকে যায় । তারা হয়তো আমাকে এভাবে এখানে আশা করেনি । আমিও অবাক হয়ে যাই তাদের দেখে। এভাবে এখানে থাকবে তারা ধারণার বাহিরে ছিল । বাংলা সিনেমাতে যেমন হয় যে নায়ক তার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করে এনে পরিবারকে বলে যে, ” এই নাও তোমাদের পুত্রবধূ বরণ করে নাও ।” আমার অবস্থা এখন এমন হয়েছে সানিম ভাইয়ার হাতের মুঠোয় আমার হাত দেখে নাঈমা তখন এক চিৎকারে বলেছিল , ‘ এই তোর হাত আমার হবু বর ধরে রেখেছে কেনো ? ছাড় বলছি ছাড় ।’ একপ্রকার হাত টেনে দুজনের হাতের বন্ধন আলাদা করতে যাচ্ছিল তখন আকীবা মা এসে নাঈমাকে টেনে দূরে চলে যায় আর ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । নাঈমার চিল্লানোতে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিচে আসে আর আমাদের এঅবস্থা দেখে অবাক হয়ে যায় । বর্তমানে সবার এমন গম্ভীরভাব দেখে একশত পার্সেন্ট নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানেই ফেরত যেতে হবে আজ । সুরভী আন্টি কেশে বলা শুরু করলেন ,

‘ আমি ভাবতে পারিনি এমন সন্তানকে পেটে ধরেছি যে কি না বাবা মার মান সম্মানের কথা চিন্তা না করে একা নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে করে নিয়ে আসবে । কিসের অভাব দিয়েছি তোকে যে তুই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলি । ‘

‘ মা , তুমি জানো আমি কেমন । তোমার ছেলে কখনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না । এই মেয়ের সাথে অন্যায় হচ্ছিল । যা সে করেনি তার দোষ এই মেয়েটির উপর আরোপ করা হয়েছিল । যেহেতু আমাদের দুজনকেই দোষী মানা হয়েছিল তাই সেই পরিস্থিতিতে বিয়ে করাই শ্রেয় মনে হয়েছিল আমার কাছে ।

সানিম ভাইয়া আমার পাশ থেকে উঠে সুরভী আন্টির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার মার দুহাত ধরে বললেন ।

সুরভী আন্টি খুব ভালো মনের মানুষ মনিমার মতো। ছেলের কথায় কঠোর থাকতে পারলেন না । সোফা থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসে থুতনি উচু করে ধরে বললেন ,
‘ মাশাআল্লাহ , বকুলকে আমার খুবই ভালো লেগেছে সেদিনই । আমার কোন আপত্তি নেই তোদের সম্পর্ককে মিনে নিতে । তোর,,,,,

‘ কিন্তু আমার আপত্তি আছে । আমি তোদের এই বিয়ে মানিনা । চেনা নেই জানা নেই কাকে না কাকে ধরে বিয়ে করে নিয়ে আসবি আর বলবি তোমাদের পুত্রবধূ ! যা এই আদদান মানবেনা ।’

সানিম ভাইয়ার মার কথায় খানিকটা যাও আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম বাবার কথাগুলো শুনে আবার আধারের রাজ্য ছেয়ে এল। এদিকে সানিম ভাইয়ার বাবার সাথে তাল মিলিয়ে আকীবা মা বলা শুরু করলেন ,

‘ ভাই সাহেব একদম উচিত কথা কইছেন । এরে আমি হারে হারে চিনি । সারা গ্রামে কত পুলারে যে নিজের পিছনে নাচাইছে তা আর কি বলব ভাই সাহেব । এই যে আমার মেয়ে নাঈমা । গ্রামের মধ্যে একমাত্র ভদ্র শান্ত মেয়ে । নিচের দিকে চোখ রেখে স্কুলে আসা যাওয়া করতো । পুরা কলেজের মধ্যে টপার ছাত্রী টপার । আর ,,,,

‘ ব্যাস অনেঈ বলেছেন আপনি ‘

এতক্ষণ আকীবা মায়ের কথা শুনে কান্না করছিলাম । হঠাৎ সানিম ভাইয়ার চিল্লানোতে কেঁপে উঠলাম । বসা থেকে দাঁড়িয়ে অগ্নিচোখে তাকিয়ে তাদের বলা শুরু করলেন ।

‘ আপনার মেয়ে যে কেমন তা আমি এবাড়িতে প্রবেশ করার সময়ই বুজতে পেরেছি । যে মেয়ে বড়দের সম্মান করতে জানেনা সে কেমন হবে তা জানা আছে । আর স্কুলের টপারের কথা বলছেন ! আমি খুব ভালো করেই জানি কার ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন। কোন কিছু না বিবেচনা করে আমি কাজ করিনা । আর আপনি যে কতটুকু ভালো মহিলা জানা আছে যে কি না তার শয্যাশায়ী স্বামীকে ফেলে শহরে ঘুরে ফিরতে পারে । সে আরো খারাপ কাজও করতে পারে । ‘

ইয়েমানে বাবা জীবন আমি কাজেই শহরে এসেছি শুনো আমার কথ,,,,
‘ হয়েছে আর একটা কথাও না। এতদিন খাইয়ে আশ্রয় দিয়ে আমার স্ত্রীকে আপনার বাসায় ঠায় দিয়েছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ । ভবিষ্যতে আমার স্ত্রীর সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলার আগে ভেবে নিবেন কার স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন ।’

সানিম ভাইয়া আকীবা মাকে এত কথা শোনাচ্ছেন তা শুনে আমার চোখের পানি থামার নামই নিচ্ছে না । এতটুকু বুঝতে পেরেছি আমি জীবনে সঠিক মানুষকেই পাশে পাব সবসময় । সানিম ভাইয়া আর আকীবা মায়ের কথার শেষে আদনান সাহেব অর্থাৎ আমার শ্বশুর বলা শুরু করলেন যে ,

‘ আমি কিছুতেই মেনে নিবোনা তোমাদের । এই মেয়েকে যেন আমার আশেপাশে না দেখি কখনও।’
কথাটি বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেননা গটগট করে উপরে চলে গেলেন । আর এদিকে আকীবা মা ও নাঈমা রগচটা হয়ে একমুহূর্ত ও দাঁড়ালেন না চলেন গেলেন । সানিম ভাইয়ার মা আমাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন ,

‘ চিন্তা করোনা বকুল সানিমের বাবা এতটাও খারাপ না যতটা এখন করে গেল । একটামাত্র ছেলে তো তাই একটু কষ্ট পেয়েছে । সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে । আর সানিম তোমার সামনে পরীক্ষা মনে আছে তো ? প্রিপারেশন নাও । বকুলকেও ভর্তি করে দেব ভার্সিটিতে । পড়াশোনা করতে হবে আমি চাই আমার পুত্রবধূ অনেক শিক্ষিত হবে । তার উপর যেন কখনও কেউ আঙ্গুল তুলে কথা বলতে না পারে । যাও তোমরা উপরে যাও । ‘

‘ আন্টি আমি আপনার সাথে থাকব ।’

আমার কথায় আন্টি রাগিভাবে বললেন ,
‘ এই মেয়ে তোর আন্টি কে রে ? মা বলবি আমাকে ।’

‘ আচ্ছা মা ডাকব ।’

উপরে গিয়ে মনিমার সাথে কথা বলিয়ে দিলেন উনি । মনিমার কথা জিজ্ঞেস কথায় বললেন উনি নাকি সানিম ভাইয়ার একমাত্র ফুফু । সানিম ভাইয়া তখন ছোট ছিলেন তখন ফুফুর বিয়ে হয় তারপর কয়েক বছর বিদেশে যাবার নাম করে ফুফুর স্বামী লাপাত্তা ছিল মনিমা সহ । কয়েকবছর পর যখন মনিমা এবাড়িতে আসেন তখন ছিলেন উনি জীর্ণশীর্ণ । কথা বলার মত অবস্থায় ছিলেন না । কিছুদিন চিকিৎসার পর বলেন যে ফুফা নাকি মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন । দিনরাত মনিমার উপর অত্যাচার করতেন । তাদের নাকি ছোট এক পরি ও ছিল । কিন্তু পরির কথা জিজ্ঞেস করায় মনিমা কখনও কিছু উওর দেননি । সেই পরিটা বেচে আছে না মরে গেছে তা কেউ জানেনা ।

—————————-

কেটে গেল বর্ষার আরো কয়েকটা প্রহর । সানিম ভাইয়া এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত । দিনের বেশিরভাগ সময় মা মানে শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কাটাই রান্না বান্না করে আর গল্প করে । আমার জন্য শ্বাশুড়ি মা ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছেন । সানিম ভাইয়ার পরীক্ষা শেষে আমাকে ভর্তি করাবেন । আমার শ্বশুর বাবা এখনও আমাকে মেনে নেননি কিন্তু আমার করা রান্না প্রকাশ্যে না খেলেও রাতের আধারে লুকিয়ে ঠিকই খান আর ধরা পরেন শ্বাশুড়ি মায়ের হাতে । আকীবা মা সেদিনের পরদিনই রুপনগরে চলে যান । সানিম ভাইয়া আর আমার মাঝে এখন ভালোই বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । এখন আর উনাকে ভাইয়া ডাকিনা । ” এই যে শুনছেন বা ব্যস্ত মানুষ বা কখনো কখনো সুদর্শন পুরুষ বলে ডাকি । আমাদের কক্ষ আপাতত আলাদা আলাদা। মাঝে মাঝে মাথা যন্ত্রণার বাহানায় আমি স্বামীটা মাথা মাসাজ করতে আসেন ঠিক পরমুহূর্তেই চলে যান কপালে ছোট একটা চুমু এঁকে । আর আমি লজ্জাবতী পাতার মত নুয়ে গিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করি। আমার শ্বশুর বাবা যতদিন না আমাদের মেনে নিবেন সেদিনই আমি এবাড়ির বউ হিসেবে দায়িত্ব পালন করব না হয় ততদিন এবাড়ির মেয়ে হিসেবেই থাকি ।

সানিম ভাইয়ার পরীক্ষার আর দশদিন বাকি । আজ উনার চার জানের দোস্ত রাফি উদয় ভাইয়া আর বিনা মিরা আপু এই বাসায় আসবেন । পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সকলে এখানেই থাকবেন গ্রুপ স্টাডি করার জন্য । সকাল থেকে রান্নায় ব্যস্ত আমি মাকে আজ রান্না ঘরে ঢুকতেই দিচ্ছি না তার কারন একটাই আজ মেহমান আসবে । বাড়ির মেয়ে হিসেবে একটা কর্তব্য আছে আমার । আমার কথা হচ্ছে মা কে কেন কষ্ট করতে দেবো যেখানে স্বয়ং আমি আছি। আমি থাকতে মা কোন কষ্ট করতে পারে না । নায়ক চাচা আর আমি মিলে সব কাজ শেষ করলাম । নায়ক চাচা এবাড়িরতে কাজ করে । নায়ক চাচার নাম হচ্ছে নায়ক আজমল শাহ্ আলম বেপারি । নায়ক চাচার মূল নাম আজমল শাহ্ আলম। উনার নাম এত বড় হবার কারন উনার বাবার নাকি স্বপ্ন ছিল ছেলে বড়মাপের নায়ক হবেন কিন্তু গরিবের ঘরে জন্ম নেয়াতে তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি তাই নামের শুরুতে নায়ক নাম রেখে দিয়েছিলেন শান্তনা হিসেবে । নায়ক চাচার পূর্বপুরুষরা সরিষা তেল বিক্রি করত বিধায় তাদের বেপারি বলে হত সেই সূত্রে নায়ক চাচার নামের শেষে বেপারি যুক্ত হয়েছে । সবাই নায়ক বলেই ডাকে আর আমি নায়ক চাচা। নায়ক চাচা খুব হাসি প্রবণ মানুষ । রান্না করার সময় একথা সেকথা বলে মাতিয়ে রাখেন । আমি এবাড়িতে আসার তিনদিন পর উনি গ্রাম থেকে আসেন ।

ফালুদা বানাতে কিছু ফল আনতে পাঠিয়েছি নায়ক চাচাকে । রান্নাঘরে ছুড়ি দিয়ে আপেল কাটছি এমন সময় পেছনে কারোর উপস্থিতি টের পাই । আমি জানি মানুষটি কে । পেছনের দাঁড়ানো ব্যক্তিটি আমার থেকে কোন পাত্তা না পেয়ে আস্তে আস্তে তার দুহাতে আমার কোমড় চেপে ধরেন । এই প্রথম স্বামীর থেকে পাওয়া এমন স্পর্শে খানিকটা কেঁপে উঠলাম হাত থেকে ছুরি অপনাআপনি পরে গেল । উনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাইলে আরো শক্ত করে কোমড় চেপে ধরেন । কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করলেন ,

‘ সুন্দরী , কেন এলোমেলো করে দিচ্ছো আমায়। প্রতিটা মুহূর্তে অজানা এক পীরায় আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছি বার বার । তুমি জানো , যখন খোলা চুলে তোমাকে দেখি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় আমার ইচ্ছে হয় সব ভুলে গিয়ে ডুবে থাকি ঐ কেশবের সুগন্ধিতে । আচ্ছা কি মাখো তোমার ঐ মোলায়েম কেশে ? জাফরান নাকি অন্য কিছু । আমি তো প্রতিনিয়ত পাগল হচ্ছি তোমার মোহেতে । সামলাতে পারবে তো আমায় । সুযোগ দিবে কি বকুলফুল ?’

সানিম নামের সুদর্শন পুরুষটি যে নাকি আভার স্বামী তার একেকটা কথায় পাগল করে দিচ্ছে আমায় । তবে কি আমার মত সেও একই ফিল করে ? এটাই কি স্বামীর সুখ । অবশেষে আমিও কি সুখের সন্ধান পেয়েছি !

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here