বকুল, পর্ব:১৫

0
1983

#বকুল
#লেখনীতে_আফসানা_মিমি

||১৫||

প্রবলভাবে বাতাস বইছে । সাদা রং শুভ্রতার রং । সাদা রং বিধবাদের রং । এই সাদারঙের শাড়ি পড়ে একজন রমণী দাঁড়িয়ে আছে লম্বা আঁচলখানা বাতাসে এলোমেলো হয়ে দুলছে । কোমড় সমান লম্বা কেশবগুলো বাতাসে উড়ছে । হাস্যউজ্জ্বল মুখখানা দেখে চমকে উঠলাম । আরে , এতো স্বয়ং আমি ! কপালে ব্যান্ডেজ করা আর তার মধ্যে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ । মাথার ব্যান্ডেজের জন্য মুখের হাসিটা চোখে লাগছেনা । অদূরে কেউ ডাকছে আমাকে । কাছে গিয়ে আরো ভালো করে শুনতে পেলাম সে আমাকে বলছে , ” বকুল , আয় মা কাছে আয় আমি যে তোর মা ! কাছে আয় মা । কতদিন তোকে দেখিনা! মন ভরে আদর করিনা । আয়তো আমার কাছে তোকে মন ভরে চুমু খেয়ে দেই ।” মায়ের কন্ঠস্বর শুনে মাকে দেখার আর মায়ের আদর পাবার লোভ সামলাতে পারিনি , দৌড়ে চলে গেলাম মার কাছে । কিন্তু , মা কই ? দূর দূরান্তে মার অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না । হঠাৎ মা আবার ডেকে উঠলো ,’ বকুল ‘ আমিও দৌড়ে মার আওয়াজ অনুসরণ করে চলেছি । মার অবয়ব দেখা যাচ্ছে সামনে , আহা ! কি খুশি লাগছে । সামনে অগ্রসর হচ্ছি মার চেহারা দেখবো বলে । কিন্তু , কোথা থেকে সাদা ধোঁয়া চারপাশ আচ্ছন্ন করে ফেলেছে । মাও সেই ধোঁয়ার সাথে সাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে । মায়ের কথা কানে বাজছে মা আমাকে বলছে যে ,’ বকুল আয় মা কাছে আয় ।’

মা বলে চিৎকার দিয়ে শোয়া থেকে বসে পড়লাম । সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে । অনুভব করলাম এতক্ষণ স্বপ্নের দুনিয়াতে ছিলাম । পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো ,

‘ এইতো মা আমি , তোর পাশে আছি । ‘

তাকিয়ে দেখি মনিমা , উনার চোখে পানি । মনিমার চোখের পানি দেখে সহ্য হলো না আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিলাম । আমার স্পর্শ পেয়ে মনিমার কি হলো জানিনা হু হু করে কেঁদে উঠলেন ।
কেঁদে কেঁদে বলতে শুরু করলেন ,

‘ মারে ক্ষমা করে দে আমায় , এভাবে সামনে পেয়েও তোকে চিন্তে পারিনি । ক্ষমা করে দে মা ।’

মনিমার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম , আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আমি সানিম ভাইয়ার কামড়ায় আছি । আর সবাই অশ্রুচোখে তাকিয়ে আছেন । আকীবা মা , নাঈমা , দিশা আর রাহাত ছাড়া । কোথা থেকে সানিম ভাইয়া এসে শক্ত করে আমার হাত ধরে বলতে শুরু করলেন ,

‘ বকুলফুল , তুমি জানো ! কত ভয় পেয়েছিলাম আজ । মনিমা না থাকলে কি হতো আজ তা ভেবেই কেমন লাগছে । আরে ! যখন তুমি দেখেছো সামনে গাড়ি আসছে সরে যাবে না ? না , তা না করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিলে । মরার এত সখ কেন তোমার ? ‘

ব্যাথিত চোখে তাকিয়ে রইলাম উনার পানে , ইশ কি নিষ্ঠুর আমার স্বামীটা । একটুও ভালোবাসে না আমায় , কিভাবে কষ্ট দিচ্ছে আমাকে ।

‘ বকুল , মা আমার এখন কেমন লাগছে ? ‘ শ্বশুর আব্বুর কথায় উনার দিকে ফিরলাম ‘ ভালো লাগছে বাবা । আমি পুরাই ফিট কিন্তু এতক্ষণ তো আল্লাহ্ র কাছে থাকার কথা ছিল বেঁচে গেলাম কিভাবে ?
আমার কথা শুনে শ্বাশুড়ি আম্মু কাছে এসে মাথায় হালকা থাপ্পড় মেরে বলে উঠলেন ,

‘ পাজি মেয়ে , এভাবে মাঝ রাস্তায় কেউ হাঁটে ? ভাগ্যিস হাসি তোকে দেখে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসছিলো । আর তুই তাৎক্ষণাৎ ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাস । তারপর সানিম তোকে কোলে করে বাসায় নিয়ে আসে । ‘

শ্বাশুড়ি আম্মুর কথা মাঝে পালিত আব্বু বলা উঠলেন ,

‘ আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে , হাসি আজ না আসলে তুইও জানতে পারতি না তোর জন্মদাত্রী মা কে ?’

বাবার কথা শুনে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলাম । মা শব্দটা শুনে স্বপ্নের কথা মনে পড়লো । অবিরাম চোখের পানি ঝড়ছে কাঁপা কাঁপা গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম , ‘ আমার জন্মদাত্রী মা মানে ? ‘

বাবা হুইলচেয়ারে সামান্য কিছুটা এগিয়ে এসে বললেন ,
‘ মা রে , আমি এখন তোকে একটা গল্প শুনাবো । মনোযোগ দিয়ে শুনবি ।’ বাবার কথা শুনে নিজের মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম । আমার সম্মতি পেয়ে বাবা বলতে শুরু করলেন ,

‘ একটা মেয়ে ছিল , পরিবার বলতে বড় ভাই ছিল । মেয়েটা তার ভাইকে প্রচুর ভালোবাসতো সম্মান করতো তাই কখনো প্রেম-ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিতনা। সে মনে করতো পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র আপনজন তার বড় ভাই । বড় ভাই তার জন্য যে ছেলেকে পছন্দ করবে চোখ বন্ধ করে সেই ছেলেকেই সে বিয়ে করবে। কলেজে উঠার পরে বড় ভাই একটা সুন্দর সমন্ধ নিয়ে আসেন বোনটির জন্য । ছেলে দেখতে-শুনতে ছিল ভালো বড়লোকের ছেলে। খুব ধুমধামের সহিত ছোটবোনকে বিদায় করে দেন। বিয়ের মাসেক ছয়ের পর হঠাৎ ছোট বোন আর তার হাসবেন্ড লাপাত্তা হয়ে যায় । মাস যায় বছর যায় ছোট বোনের খোঁজ পাওয়া যায়না । এমন করতে করতে চার থেকে পাঁচ বছর অতিক্রম হয় একদিন ছোট বোন ফিরে আসে নিজের ভাইয়ের কাছে । লোকমুখে শোনা যায় মেয়েটি তখন মানসিক ভারসাম্যহীন একজন পাগল ছিল। আস্তে আস্তে বছরের-পর-বছর যাওয়ার পর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । এই মেয়েটাই তোর মা । তোর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তোর মা তোর বাবার ভয়ে পালিয়ে আসে আর আমাদের কাছে তোকে রেখে যায় । এরপর থেকে তোকে আমরা লালন পালন করি। হাসিই তোর জন্মদাত্রী মা ।

কাঁপা কাঁপা গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম , ‘ তুমি সত্যি বলছো বাবা ? মনিমা আমারই মা ?’ বাবা কান্নামাখা মুখে জবাব দিলেন , ‘ হ্যাঁ ‘

চোখ বন্ধ করে কান্না নিবারণের চেষ্টা করে আবার চোখ মেলে তাকালাম । পেছন থেকে মনিমা ডেকে উঠলেন , ‘ বকুল , মা আমার কথা বলবি না ? তোর মুখে মা ডাক শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি । ‘

দুহাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে বসে আছি । দুচোখ বেয়ে অনবরত পানি পরছে । মাথা শূন্য শূন্য লাগছে এত বছর পর যখন শুনলাম নিজের মার জীবনের করুন কাহিনী । আর এজন্যই আমার জীবনের এতটা বছর কষ্টের কেটেছে । এখন নিজেকে নিজেই বলছি , ‘ বকুল তুই কি কষ্ট করেছিস তোর চেয়ে বেশি কষ্ট করেছে তো তোর মা , তার কষ্টের পাল্লা তোর চেয়েও শতগুন ভারী । চোখ মুছে ভারীস্বরে সকলের উদ্দেশ্যে বললাম ,
‘ একটু একা থাকতে চাই মায়ের সাথে । আশা করি সবাই বুঝবেন ।’ একে একে সকলে কামড়া হতে বের হয়ে গেলেন । সারা কামড়া জুড়ে পিনপিন নিরবতা । বিছানার একপাশে মা মাথা নীচু করে বসে আছেন আর আমি একপাশে । আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে মার কোলে শুয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করে দিলাম মাও আমায় জাপটে ধরে সারা মুখে চুমু খেয়ে কান্না করে যাচ্ছেন । আজ আমাদের মা মেয়ের কান্নাতেই কথা হচ্ছে সব ।
রাতের নয়টা বাজে । মা আমাকে জরিয়ে ধরে সোফার রুমে বসে আছেন । সানিম ভাইয়া দূরে মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন তার কথা হচ্ছে আমি নাকি উনার আদরও কেড়ে নিয়ে নিয়েছি । মনিমা অনেকবার কাছে ডেকেছেন উনাকে কিন্তু উনি ছোট বাচ্চাদের মত অভিমান করে বসে আছেন । মনিমা আমাকে রেখে এবার সানিম ভাইয়ার কাছে গেলেন । এক হাতে কানে টেনে টেনে এখানে নিয়ে আসছেন । আর আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি । যেহেতু এখন ডিনারের সময় সকলেই বসে আড্ডা দিচ্ছেন একসাথে । একে একে সকলের পানে তাকাচ্ছি আর ভাবছি আজ আমিও পরিপূর্ণ আমারও পরিবার আছে । সকলের পানে চোখ বুলাতে বুলাতে এক কোনায় আকীবা মা , নাঈমা, দিশা আর রাহাতকে একসাথে বসে থাকতে দেখলাম । গভীরভাবে কি যেন আলোচনা করছে তারা । আমার তাকানোতে দিশার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল । দিশা আমাকে দেখে সৌজন্যমূক হাসি দিলো আমিও বিনিময়ে হাসি দিয়ে ফোনে একজনকে কিছু বার্তা পাঠিয়ে দিলাম ।

হাসি মজার মাঝে তিন চারদিন পার হয়ে গেল । কাল আমাদের গায়ে হলুদ হবে আর তার পরেরদিন বিয়ে । আজ সন্ধ্যায় আমার আর সানিম ভাইয়ার আংটি বদল হবে । সারাবাড়ি সাজানো হচ্ছে । রং বেরংয়ের পর্দা, লাইট , বাহারি রংয়ের ফুল আরো কত কি ।
এর মাঝেও আকীবা মা, নাঈমা দিশা আর রাহাত এদের ব্যবহার কেমন যেন লাগছে । রাহাত ছেলেটাকে বাহিরে একজন আর ভেতরে অন্যজন এমন মনে হচ্ছে ।

সাদা সিল্কশাড়িতে সাদা পরী মনে হচ্ছে নিজেকে । এতদিন মার সাথে সারাদিন সারারাত থেকেছি । এনিয়ে সানিম ভাইয়া খুব অভিমান করেছেন আমার উপর । কথা বলেন না অভিমান করে । আজ অনেকবার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিবারে এড়িয়ে চলেছেন উনি আমাকে । কোন উপায় না পেয়ে একটা ছোট চিরকুট লিখে উনার রুমে টেবিলের উপর রেখে আসলাম ।

রুমে একা একা বসে আছি । মা নীচে শ্বাশুড়ি আম্মুকে সাহায্য করতে গিয়েছে । হঠাৎ বারান্দায় কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে গেলাম । বারান্দার পা রাখতেই কে যেন কোনকিছু বোঝার আগেই শক্ত কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করল । মা বলে এক চিৎকার দিয়ে পেছনে ফিরে তাকালাম ।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে আমার পানে । হাতে তার মোটা লোহার রড । আবারও আঘাত করতে যাবে তার আগেই জ্ঞান হারালাম । জ্ঞান হারানোর আগে মানুষটার নাম উচ্চারণ করতে ভুললাম না

‘ রাহাত ‘

চলবে …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here