বকুল, পর্ব:৭+৮

0
2366

#বকুল
#লেখনীতে: আফসানা মিমি

||৭||

গোসল করার পর কাউকে এতোটা স্নিগ্ধ লাগে তা আগে জানতাম না। কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে একহাতে মাথা মুছতে মুছতে কথা বলছে সামনে থাকা সুদর্শন পুরুষটি । অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সানিম ভাইয়ার পানে । কানে কারোর ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজে হুস আসে

‘ এভাবে তাকিয়ে থেকো না বকুলফুল ! এখানে এই বুকে কেমন যেন লাগে ।’

ছিঁটকে সানিম ভাইয়ার থেকে দূরে সরে এলাম । কাল থেকেই কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে । সানিম ভাই আশেপাশে থাকলে হৃদপিন্ডের আওয়াজ বেড়ে যায় ।
সবার দিকে নজর বুলিয়ে দেখি যে যার কাজে ব্যস্ত । হালকা একটু কেঁশে রাফি ভাইকে প্রশ্ন করলাম

‘ কাল রাতে রিসোর্টের বাহিরে বের হয়েছিলেন ?’

আপেলে কামড় বসাতে বসাতে সানিম ভাইয়ার উওর

‘ শুধু গিয়েছিলাম না ভূতকে তাড়া ও করে এসেছিলাম । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমাদের ভয়ে ভূত দৌড়ে পালিয়েছে। ‘ বলেই একদফা হেসে যাচ্ছে সানিম ভাই। হাসি কিছুটা সংযত করে আবার বলতে শুরু করলো
‘ মজার ব্যপারে কি জানো বকুলফুল ? ভূত আবার কানের দুলও পড়ে হা হা হা ।’

সানিম ভাইয়ার কথা শুনে নিজের কানে হাত দিলাম। ওমা , আমার কানের দুল কোথায় ? কাল রাতে দৌড়নোর সময় হয়তো পড়ে গেছে । কিন্তু সানিম ভাই জানলো কিভাবে ? কানের দুল সানিম ভাইয়ার কাছে ! নিজের খালি কান চুল দিয়ে ঢেকে দিলাম যেন কেউ খেয়াল না করে । কিন্তু সানিম ভাইয়া ফল নেয়ার অজুহাতে কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে যে

‘ এখন কান ঢেকে লাভ নেই সুন্দরী ! আমি জানি সেটা আপনি ছিলেন। কিন্তু এতো রাতে রাস্তায় কি করছিলেন আপনি ?’

সানিম ভাইয়ার কথায় অস্বস্তি হতে শুরু করে আমার । সানিম ভাইয়া হয়তো বুঝতে পারে তাই কথা ঘোরানোর জন্য সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে

‘ গাইজ , সকালে আম্মু কল করেছিল। আগামীকাল আমরা ঢাকা ফেরত যাচ্ছি । আরো পাঁচদিন থাকার কথা ছিলো কিন্তু ভার্সিটিতে জার্মান থেকে কোন প্রফেসর আসছে তাই আমাদের যেতে হবে । আর চারমাস পর যেহেতু ফাইনাল পরীক্ষা তাই পরীক্ষার প্রিপারেশনও নিতে হবে । আর সবচেয়ে বড় কথা আমার আম্মাজান জরুরী তলব করেছে বাসায় যাওয়ার জন্য ।’

উদয় ভাইয়া বসা থেকে উঠে বলা শুরু করে

‘ আরে ভাই এই পড়াশোনা কি আর পিছ ছাড়বে না ? জানি চারমাস পর পরীক্ষা তাই বলে একটু ঘুরতে পারবোনা ? এটা ঠিক না । ধ্যাত মনটাই খারাপ হয়ে গেল।’ বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়

মিরা আপুর মন খারাপ হয়ে যায় সানিম ভাইয়ার কথা শুনে । তাই মন ফ্রেস করতে রিসোর্টের পুলের পাশটায় চলে যায় । মিরা আপুর পেছনে রাফি ভাইয়াও চলে যায় । বিনা আপু ব্যাগ গোছাতে চলে যায় । রুমে বাকি রইলাম আমি আর সানিম ভাই ।
কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে । এত বছর রিসোর্টে কাজ করছি আজ পর্যন্ত কারোর জন্য এতো খারাপ লাগেনি যতটা এদের জন্য লাগছে তার কারনটা কি সানিম ভাইয়া ? এর উওর আমার কাছে নেই ।

নিরবতা কাটিয়ে সানিম ভাইয়া বলা শুরু করলেন

‘ খুব মিস করবো তোমাদের । এই তিনদিন খুব ভালো কেটেছে আমার ।’

‘আগামীকাল কখন রওনা হবেন আপনারা ? ‘

‘ এইতো সন্ধ্যায় । রাতের ভ্রমন আমার খুব পছন্দের ।’

আচ্ছা বলে চলে আসলাম সেখান থেকে । মন আর মানছে না সেখানে থাকতে ।
———————-

দুপুরে বাঙ্গালি খাবার রান্না করেছি । আজ রবিন ভাইকে রান্নার ধারে কাছে আসতে দেইনি । একাই সব সামলাচ্ছি । দুপুরে খাবারের টেবিলে বাঙালি খাবারের ভরপুর । আমাদের রিসোর্টের নিয়ম অতিথিদের জন্য একদিন শুধু বাঙালি খাবার রান্না করা হয় । যেহেতু উনারা কাল চলে যাবেন তাই আজ রান্না করলাম । খাবারের ঘ্রাণে সারা রিসোর্ট মৌ মৌ করছে । দেখা গেল অতিথি পাঁচজন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই খাবার টেবিলে হাজির। রাফি ভাই খাবারের কাছে নাকে লম্বা ঘ্রাণ নিয়ে বলে

‘ আহ ! খাবারের কি গন্ধ ।’

পাশ থেকে মিরা আপু রাফি ভাইয়ার মাথায় চাটি মেরে বলে ‘ আরে বোকা ঐটা ঘ্রাণ হবে গন্ধ না । তুই কি খাবারকে বাজে কিছু ভিবছিস যে গন্ধ বলছিস ? এই সামিন এই গাধাকে কিছু শেখাতে পারিস না ? যত্তসব উগান্ডার দল আমার কপালেই জুটে ‘

হা হয়ে তাকিয়ে আছি মিরা অপুর দিকে । কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে গেল আল্লাহ্ । আর রাফি ভাইয়া! তার জবান এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে । সামিন ভাইয়া একে একে খাবারের টেবিলে চোখ ঘোড়াচ্ছে ।
‘ এই সব খাবার কি তুমি রান্না করেছো?’

নিজের মাথাকে উপর নিচ ঝাকালাম যার অর্থ হ্যাঁ ।
এতো আইটেম যে টেবিলে জায়গা হচ্ছে না ।

‘ এখানে কি কি আছে ? ‘ বিনা আপু বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন

সবার প্লেটে ভাত পরিবেশন করে একে একে খাবারের নাম বলে যাচ্ছি আমি

‘ আজ বাঙালি খাবার রান্নায় সবচেয়ে মজার খাবার হলো দশ পদের ভর্তা । ‘

‘কি কি ভর্তা নাম বলো তো বকুলফুল ?’
দুগালে হাত দিয়ে কিউট করে প্রশ্ন করলো সানিম ভাইয়া । আমিও মিষ্টি হেসে বলতে শুরু করলাম

‘ দশ পদের মধ্যে প্রথমত আলু ভর্তা করেছি যা আমাদের বাঙালিদের কমন খাবার । তারপর বেগুন ভর্তা , মরিচ ভর্তা , ডাল ভর্তা , মাছ ভর্তা, শুঁটকির ভর্তা , পেঁপে ভর্তা, দুনদুল ভর্তা, ঢেড়স ভর্তা আর কচুশাক ভর্তা । ব্যস এটুকুই ।’

‘আর অন্যান্য আইটেমগুলো ?’

উদয় ভাইয়া প্রশ্নে হেসে দিলাম কারন উনার চোখদুটো এতো বড় বড় করে রেখেছে যে কেউ দেখলে ভয় পাবে ।

‘ গরু মুরগির মাংস করেছি , ইলিশ মাছের মাথা লেজ দিয়ে মুড়িগন্ড , পাবদা মাছের ভুনা , শিং মাছের ঝোল , শুঁটকি ভুনা আর ডাল ।’

‘আর মিষ্টির মধ্যে ?’

‘ মিষ্টির মধ্যে সেমাই , পায়েস করেছি। কথা না বলে খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে ।’

মিরা আপু হাত ধরে তাদের সাথে বসিয়ে দিলেন
‘ এখন থেকে আমারা ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি আমাদের সাথে থাকবে এবং খাবেও ।’

মিরা আপুর কথায় চিন্তায় পড়ে গেলাম । বাসায় অসুস্থ বাবাকে রেখে এখানে থাকা সম্ভব না কিন্তু তাদের কি করে বলি ?

‘ আহ ! কি স্বাদ । এই মিরু শুঁটকি ভর্তাটা খেয়ে দেখ সেই মজা ।’
‘ ইয়াক শুঁটকি , এটা কেউ খায় ? কি বাজে গন্ধ । এই রাফি এই শুঁটকি আমার থেকে চল্লিশ হাত দূরে থাকবি । একদম ঘেঁষবি না আমার সাথে । ‘
মিরা আপুর কথার প্রেক্ষিতে একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারলাম না
‘ আচ্ছা আপু তোমাদের মধ্যে কি সত্যি সত্যিই বন্ধুত্ব আছে নাকি অন্যকিছু?’
আমার কথাতে মিরা আপু অস্বস্তিতে পড়ে যায় পাশ থেকে সামিন ভাইয়া শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো

‘ বুঝলে বকুলফুল , দেখতে এদের টম এন্ড জেরি মনে হয় আসলে তারা ভেতরে ভেতরে একে অপরকে ভালোবাসে কিন্তু কেউ প্রকাশ করেনা ।’

একথা শুনে মিরা আপু রাফি ভাইয়া দুজনের দৃষ্টিই নিচের দিকে ছিলো । আর আমিও আমার উওর পেয়ে গেলাম।

বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছি রিসোর্টের এক দোলনায় । চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছি । দুপুরের খাবারের পর সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে । বাবার জন্য চিন্তা করছি কাল নাঈম ভাইয়াকে বলার পর ভাইয়ার হেলদোল দেখলাম না । পাঁচ লক্ষ্য টাকা কোথায় পাবো আমি ? কে দিবে আমায় । লতিফ চাচা ! সারাজীবন তো লতিফ চাচাই সাহায্য করে আসলো এখন কি সাহায্য করবে ? আচ্ছা! শহরে গেলে কি কোন ব্যবস্থা হবে ? যদি না হয় তো বাবাকে বাচাবো কিভাবে? এসব হাজারো চিন্তা করছি তখন কারোর কাশির আওয়াজে চোখ মেলে তাকালাম। সামনে তাকিয়ে দেখি সানিম ভাইয়া মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।

‘ কি নিয়ে চিন্তা করছো বকুলফুল । আমাকে বলা যাবে ? ‘
‘তেমন কিছুনা ভাইয়া। বাবা অসুস্থ তাই একটু চিন্তা হচ্ছে ।’

‘কি হয়েছে তোমার বাবার ?’

‘এক্সিডেন্ট হয়েছিল এখন পেরালাইজ্ড কথা বলতে পারেনা । ‘
আমি নিজের কষ্ট কাউকে বলতে পছন্দ করিনা আর সেখানে সানিম ভাইয়ার সাথে তো দুদিনের পরিচয় মাত্র । তাই কথা ঘোরানোর জন্য বললাম

‘ ঐসব কথা বাদ দিন আপনি এসময়ে এখানে ? কোন দরকার ছিলো ? ‘

সানিম ভাইয়া বসা থেকে উঠে বলতে শুরু করলো

‘ আসলে তোমাদের রুপনগর গ্রামটা ভালো করে দেয়া হয়নি তাই ইচ্ছে হলো রুপনগরের রুপখানা দেখতে । তো ম্যাডাম বকুলফুল! আপনাদের রুপনগরের সব রকমের রুপ দেখাতে সাহায্য করবেন তো আমায়?’

মুচকি হেসে বললাম অবশ্যই সাহায্য করব ।

চলবে ……

#বকুল
#লেখনীতে: আফসানা মিমি

||৮||

রাতের আধার পেরিয়ে নীল আকাশের বুকে কিছুক্ষণ আগেই সূর্য উদিত হয়েছে । গ্রামের পঞ্চায়েতে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর সামিন ভাই। দু হাতে ওড়ঁনা মুঠ করে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি । পাশে সনিম ভাই শক্ত চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে । অদূরে কয়েকজন লোকেদের হাতের বাঁধনে রাফি, উদয় ভাইয়া বিনা ,মিরা আপু অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন । সামনে উপস্থিত শতক নারী পুরুষের কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে । নিজেকে এই মুহূর্তে অনেক অসহায় লাগছে । কখনও ভাবিনি এভাবে এতটা অপমানিত হবো । আজ আমার সাহায্য করার মত কেউ নেই। কয়েকঘন্টার ব্যবধানে কি হয়ে গেল আমার সাথে। কয়েকঘন্টা আগেও মনে হচ্ছিল কোন স্বপ্নের সাম্রাজ্যে অবস্থান করছি। কিন্তু হঠাৎ কি হলো এসব।
ভাবছি কয়েকঘন্টার আগের কথা।

রিসোর্ট থেকে বের হয়ে রিকশা ডেকে সানিম ভাইয়া রিকশায় উঠে পড়েন । রিকশায় সানিম ভাইয়ার পাশে বসবো কি বসবোনা তা নিয়ে দ্বিধায় আছি । সত্যি বলতে কখনো কোন ছেলের পাশে বসিনি তাই লজ্জা লাগছে।
সানিম ভাইয়ার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে আমার

‘ কি ব্যাপার বকুলফুল আমার পাশে রিকশায় বসতে কোন সমস্যা হবে ?

একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললাম

‘ ভাইয়া আমরা অটোতে চড়ে যাই ? মানে কখনো কোন ছেলের পাশে বসিনি তাই আরকি ।’

রিকশা থেকে সানিম ভাইয়ার এক হাত আমার দিকে বাড়িয়ে বললো
‘ বিশ্বাস করতে পারো আমাকে । নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও তোমার কোন ক্ষতি হতে দেবো না ।’

কেন যেন এই হাতজোড়ার মালিকের কথায় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে হচ্ছে করছে । আচ্ছা দুদিনের পরিচয়ে এতটা ভরসা কিভাবে সম্ভব । আমি কি সানিম ভাইকে মন দিয়ে দিচ্ছি ? নিজের হাত বাড়িয়ে সানিম ভাইয়ার হাতে হাত রেখে রিকশায় উঠে বসলাম । যদিও এটা ছোট একটা রিকশা কিন্তু তবুও সানিম ভাইয়ার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসেছি । সানিম ভাইয়া রিকশার হুডি তুলে দিলেন । অস্বস্তিতে হাত পা ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে ।
ভয়ে আশেপাশে নজর বুলাচ্ছি এই না কেউ দেখে ফেলে ভেবে। আশেপাশে দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনই হঠাৎ কানে কারোর হাতের ছোঁয়া পেলাম তড়িৎ গতিতে পাশ ফিরলাম যার ফলে সানিম ভাইয়ার মাথার সাথে আমার মাথা ঠুস মানে আঘাত পেয়েছি । কানে হাত দিয়ে দেখি কিছুক্ষণ আগের অনুভব করা খালি কানে কানের দুল দুলছে । করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সানিম ভাইয়ার পানে । সানিম ভাই আউচ বলে মাথা ডলতে ডলতে বলল

‘ আরে বকুলফুল আস্ত নির্দয় মেয়ে তো তুমি।’
সানিম ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন কররাম ‘ কি করেছি আমি ?’

‘ কি করোনি সেটা বলো ? এই যে এতো কষ্ট করে কাউকে কিছু না জানিয়ে তোমার এতবড় উপকার করলাম একটা ধন্যবাদ দিবা তা না দিয়ে মাথায় আঘাত করলে ? ছিহ বকুলফুল ছিহ!’
সানিম ভাইয়ার এমন আজব কথা শুনে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছি। কি অদ্ভুত এই লোক সবসময় উল্টা পাল্টা কথা বলে ।

দুপাশে সারি সারি তালগাছ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে তার আশেপাশে ধান ক্ষেত । হালকা বাতাসে আমার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । আমি সেগুলো গোছাতে ব্যস্ত পাশ থেকে সানিম ভাইয়া গান ধরলেন

‘ এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলো তো ! ‘

সানিম ভাইয়ার গান শুনে হাসতে হাসতে উওর দিলাম
‘ কেমন আর হবে ? আজীবন এই প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকতে পারবেন । ‘

সানিম ভাইয়া আমার দিকে ফিরে বললেন
‘ আমিতো চাই ই সারাজীবন এই প্রকৃতির সৌন্দর্যে ডুবে থাকতে ।’
সানিম ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি । এচোখ যে আমাকে অনেক কথা বলতে চায় বুঝতে পারছি। সানিম ভাইয়া আলতো হাতে আমার এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুছিয়ে দিলেন । উনার এমন উষ্ণ ছোঁয়াতে আপনাআপনি চোখ বন্ধ হয়ে আসল আমার।
হঠাৎ রিকশার থামাতে দুজনেরই হুঁশ আসে । একে অপরের থেকে ছিটকে সরে গেলাম । মিনিট পাঁচেক আগে কি হলো আমার সাথে তা ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছি ।

‘এই যে লজ্জাবতী রানী , কৃপা করে নেমে আসুন । আপনি নামলে রিকশাওয়ালা ভাই চলে যাবে। ‘

রিকশা থেকে নেমে কটমট চোখে তাকালাম সানিম ভাইয়ার পানে। লোকটা সুদর্শন হলে কি হবে আস্ত একটা বজ্জাত কথায় কথায় শুধু লজ্জা দেয় ।

পড়ন্ত বিকেল। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে । পাখিরা দিন শেষে তাদের নিবাসে ফিরে যাচ্ছে । সানিম ভাইয়াকে নিয়ে এসেছি এক বিলের পারে । ঠান্ডা বাতাস বইছে চারপাশে ।
ঘাসের উপর শুয়ে আছে সানিম ভাই । মাথার নিচে দুহাত রেখে আকাশ দেখতে ব্যস্ত । পাশে আমি বসে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতি অনুভব করছি। তখনই কারোর নেশাতুর কন্ঠস্বর কানে আসে

‘ বকুলফুল ?’

সানিম ভাইয়ার ডাক শুনে মুখ দিয়ে আনমনে ‘হুম !’ বলে ফেলি ।

‘ তোমাকে কিছু বলার আছে। জানিনা কথাগুলো তুমি কিভাবে নিবে। সত্যি বলতে তোমাকে ,,,,,

অদূর কারোর হইচই শুনে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ি যার কারনে সানিম ভাইয়ার কথা শোনা সেখানেই সমাপ্ত হয়।

কোমড়ে গামছা বেধে হাতে লম্বা লাঠি নিয়ে কয়েকজন লোক এদিকে আসছে । তাঁদের দেখে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে । ভয়ে সানিম ভাইয়ার পেছনে চলে গেলাম কারন তারা আর কেউ না আমাদের এলাকার চেয়ারম্যানের লোক । জানিনা আমার কি হলো শক্ত করে সানিম ভাইয়ার শার্ট ধরে রেখেছি । লাঠি হাতে একজন লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন

‘কি রে মাইয়া এইখানে কি করিস ? আরে তুই বকুল না ! আকীবার ঐ পালক মাইয়া এইখানে কি ? ‘
পেছনে ফিরে সানিম ভাইয়াকে দেখে হাতের ইশারায় আবার প্রশ্ন করলেন
‘ কি রে কথা কস না কেন ? আর পিছনের পুলাটা কে ?’

ভয়ে ভয়ে উওর দিলাম ‘ লতিফ চাচার ভাগ্নে আর রিসোর্টের অতিথি ‘ পাশ থেকে আরেক লোক টেনে বলে উঠলো
‘ ছিহ ! ছিহ ছিহ লতিফ মিয়া শেষমেশ ঐ রিসোর্টে মাইয়া ব্যবসা শুরু করছে ছিহ।’

আপনার ভুল ভাবছেন আমরা শুধু ঘুরতে এসেছি আর কিছুনা ‘সানিম ভাইয়া গম্ভীরভাবে উওর দিলেন

‘ ইয়েহ্ ঘুরতে আসছি কইলেই হইলো ! আমরা বুঝি না তোমরা এখানে কি করতে আসছো ? আর বকুল ,তোরে খুব ভালো মনে করতাম আর তুই এইখানে ছিহ ছিহ ।’
প্রথম লাঠিয়াল ভাই আমাদের উদ্দেশ্য জোড় গলায় বললেন
‘ যাই হোক আমগোর গ্রামে এমন মেলামেশা খারাপ । তোমগোর মতো মানুষের জন্য সমাজ খারাপ হচ্ছে তাই বকুল আর এই পুলা আমগোর সাথে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি যেতে হইবো । ‘

এবার সানিম ভাইয়া রেগে তাদের দিকে তেড়ে যেতে লাগলেন । পেছন থেকে শক্ত করে সানিম ভাইয়ার শার্ট ধরে রেখেছি । সানিম ভাইয়া করুন চোখে আমার দিকে তাকালেন আমি ইশারায় মাথা ঝাকালাম যার অর্থ এদের সাথে কিছু করলে সমস্যা হবে অগত্য সানিম ভাই চুপ হয়ে গেলেন আর তাদের পেছনে আমাদেরকে নিয়ে রওনা হলেন ।

চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে সব বলার পর উনি বললেন যে , ‘ তোমরা দুইজন পাপ করেছ পাপ যার ক্ষমা নেই । আগামীকাল পঞ্চায়েতে তোমাদের বিচার হবে । এই রফিক ! এদের আলাদা আলাদা ঘরে বন্দি করে রাখ যেন পালাতে না পারে । ‘ বলে চেয়ারম্যান চাচা চলে গেলেন ।

বর্তমানে ,

পঞ্চায়েতে বড় বড় রাজকীয় আসন পাতা হয়েছে । ছয় থেকে সাতটা রাজকীয় চেয়ার পাতা হয়েছে একসাথে সারিবদ্ধভাবে ।তারা হচ্ছেন পঞ্চায়েতের মূল বিচারক। আর তার থেকে একটু দূরে আড়াআড়ি করে চার থেকে পাঁচটা চেয়ার পাতা হয়েছে যেখানে গ্রামের চেয়ারম্যান কাউন্সিলর সহ অন্যান্যদের। সবার মধ্যমণি আমি আর সামিন ভাই । গ্রামের শতক মানুষের উপস্থিতি বলে দিচ্ছে আজ আমার সাথে খুব খারাপ হবে । পঞ্চায়েতের প্রধান বিচারকগন একে একে উপস্থিত হয়ে যার যার জায়গা দখল করে নিলেন । গ্রামের কাউন্সিলর , চেয়ারম্যান সহ উঁচু নিচু সকল মানুজ হাজির হলেন ।

পঞ্চায়েতের প্রধান বিচারকের মধ্যে একজন শুরু করলেন

‘ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম । পঞ্চায়েতের কার্যক্রম শুরু করছি । অত্র রুপনগর গ্রামের নিয়ম অনুসারে উপস্থিত তরুণ তরুণী নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। এবিষয়ে বিচার সভা শুরু করা হল।’

‘ তা বকুল , তুমি জানো না আমাদের গ্রামে ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা বারন ? তাহলে কেন তুমি এমন নিকৃষ্ট কাজ করলে ? ‘

আরেকজন প্রশ্ন করলেন

‘আকীবার মেয়ে তো তুমি তা তোমার মা কোথায়? ডাকো তাকে তার মেয়ে যে এমন মুখে চুনকালি মাখিয়েছে তা শুনাই ।’
‘ আরে এরা তো এই মাইয়ার আসল মা বাপ না । এর আসল মা মনেহয় বাজারের মেয়েই ছিলো তাই এই মেয়ের এই অবস্থা । ‘

‘ আমাদের গ্রাম খুবই সৎ , পবিত্র । এখানে খারাপ কাজ কেউ করেনা । তুমি এখন এই রুপনগর গ্রামের জন্য অপবিত্র । তাই আমরা যা শাস্তি দেবো তাই মানতে হবে ।

এদের একেকজনের কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে করছে । এতটা অপমান লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারছিনা। কি দোষ আমার যে এতটা অপদস্থ হতে হবে ? খারাপ কিছু তো করিনি আমি ।
এতক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম কিন্তু এদের কথা শুনে জোড়ে জোড়ে কাঁদছি । কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একজন সুস্থ মানুষও বিনা দোষে আসামি হয়ে যাবে এতটাই ভয়ংকর এই পরিস্থিতি।

‘ তা মাইয়া তুমি প্রস্তুত তো শাস্তির কথা শুনতে ?
তোমার শাস্তি হলো একশত বেতের বেত্রাঘাত সইতে হবে । তার সাথে ঐ শহরের ছেলেটাকে বিয়ে করতে হবে ‘

একজন মুরুব্বির কথা শুনে চোখ তুলে তাকালাম । দুহাত জোর করে অনুনয়ের সাথে বললাম

‘ আপনারা বিশ্বাস করুন আমি নির্দোষ । আমি একদম পবিত্র ইনি লতিফ চাচার রিসোর্টের অতিথি মাত্র । তাকে রুপনগর ঘুড়াতেই বের হয়েছিলাম ।’

আমার কথার প্রেক্ষিতে উপস্থিত জনগণের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন

‘ মাইয়া শিখাও আমাদের ? তুমি যা কইবা তাই বুঝবো আমরা ? এই ভর দুপুরে নির্জন স্থানে একটা ছেলে একটা মেয়ে একা থাকা মানে আমরা বুঝিনা ? ‘
পাশ থেকে আরেকজন দাঁড়িয়ে উঠে বলতে শুরু করলো
‘ আমরা তো শুনছি শহর থেইকা পুলাপাইন একজন না অনেকজন আসছে তো তুমি একজনকে নিয়ে একা কি করতে গেছো বুঝিনা আমরা ?’

উনাদের এসব কথার কোন উওর নেই আমার কাছে । কি বলবো আমি ? কেন গিয়েছিলাম? সত্যি বলার পরও কেউ বিশ্বাস করছেনা আমার কথা ।

সকলের মতামত দেয়া শেষ হবার পর চেয়ারম্যান সাহেব সানিম ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন

‘ এই ছেলে তুমি কি করতে চাও ?’

সানিম ভাইয়ার এক কথার উওর

‘ আমি বকুলফুলকে বিয়ে করতে চাই ‘

চলবে ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here