বকুল, পর্ব:৬

0
1993

#বকুল
#লেখনীতে: আফসানা মিমি

||৬||

অন্ধকারে ছেয়ে আছে আকাশ । যেকোনো সময় বৃষ্টির আগমন ঘটতে পারে । বৃষ্টির পূর্বাভাস তাই চারদিকে মানুষ দ্রুতগতিতে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটছে যেন বৃষ্টি তাদের শরীরকে ছুঁয়ে দিতে না পারে ।

ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে আমি নিজেকে শান্ত করছি । কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পরতে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছি । সানিম ভাইয়ার এত কাছাকাছি ছিলাম আমি ভাবতেই কেমন অস্বস্তি লাগছে । আর সানিম ভাই , সে তো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে । কথা বলার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না তাই সামনের চুড়ির দোকানে চলে গেলাম । লাল-নীল , হলুদ-সবুজ আরো হরেক রংয়ের চুড়ির মেলা এখানে। নীল রংয়ের রেশমি চুড়ি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি । খুব মানিয়েছে আমার হাতে। কিন্তু টাটা ! টাকা পাবো কোথায় ? সকালে পঞ্চাশ টাকা থেকে দশ টাকা খরচ হয়েছে বাকী রইলো চল্লিশ টাকা । আজ যাওয়ার সময় রিসোর্টের গাড়ি দিয়েই যাবো তাই দশ টাকা বেচে গেল কিন্তু আর বাকীদিন! মাসের মধ্যে সময় এখন । হেঁটে হেঁটে যতই রিসোর্টে যাই না কেন কিন্তু বিপদ তো বলে আসে না ? এখন যদি চুড়ি কিনি তো বাকীদিন কষ্ট হবে । এমন হাজারো কথা ভেবে চুড়িগুলো রেখে দিলাম। এসব সখ আমার জন্য না । যেদিন টাকা হবে সেদিন কিনবো।

মেয়েদের অলংকারের দোকানের সামনে দেখি মিরা আপু নিজের কানে কানের দুল পড়তে ব্যস্ত আর তার পাশে দুগালে হাত রেখে রাফি ভাই একমনে তাকিয়ে আছে । রাফি ভাই আর মিরা আপুর বিষয়টা খুব ভাবায় আমাকে । এই দেখি দুজন টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়া করছে তো এই দেখি দুজন এমনভাবে একে অপরের সাথে মিশছে যেন বন্ধুত্বের চেয়েও আরো গভীর সম্পর্ক তাদের । যেমন এখন রাফি ভাইয়ের দৃষ্টি একদম অন্যরকম মনে হচ্ছে আমার কাছে ।

‘ আরে বকুল ঐখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? এখানে আসো দেখতো এই ঝুমকো জোড়া কেমন ?’
মিরা আপুর ডাকে উনার কাছে গেলাম । হরেক ডিজাইনের কানের দুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার সামনে । এক কানের দুল পাল্টে অন্য কানের দুল পড়ছে মিরা আপু কিন্তু কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না উনার। অবশেষে আমি একজোড়া ঝুমকো মিরা আপুর হাতে দিলাম সেটাই পছন্দ করেছেন উনি ।

‘ বাহ্ বকুল , তুমি যেমন মিষ্টি তোমার পছন্দও তোমার মতো মিষ্টি । ‘
মিরা আপুর কথার ফাঁকে সবাই হাজির হলো একসাথে । বিনা আপু বলে উঠলো

‘ তোমার বর ও অনেক মিষ্টি হবে দেখিও ।’
বিনা আপুর মুখের কথা টেনে নিয়ে মিরা আপু বলে উঠলো ,

‘ হ্যাঁ হবেই তো আমাদের সানিম বলে ,,,

‘ মিরু তোর কানের দুল কিনা শেষ হলে চল রিসোর্টে ফিরতে হবে আমাদের । আর বকুল তোমাকে লতিফ চাচা ডাকছে যাও শুনে এসো ।’

মিরা আপুর পুরো কথা বলতে না দিয়ে বিনা আপু আমাকে লতিফ চাচা ডাকছে বলে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন । আমি আর কি করবো লতিফ চাচার নিকট যাওয়ার জন্য আগালাম।

—————————

আজ আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে বাবা নাকি বেশি অসুস্থ পাখি ফোন করেছিল । সকলে মিলে স্বপ্নের পাহাড় থেকে বের হয়ে রিসোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । রাস্তায় মিরা আপু একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে বললেন এটা নাকি আমার । এতো করে বললাম আমি নিতে পারবোনা কিন্তু উনি শুনলেনই না । আমাকে বাড়ির রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বাকী সবাই রিসোর্টে চলে খেলেন। সানিম ভাইয়া যাওয়ার সময় কেমনভাবে যেন তাকিয়ে ছিলেন । উনার তাকানো দেখে আজ অন্যরকম লাগছে মনে হচ্ছে ঐ চোখজোড়া অনেক কিছু বলতে চায় আমাকে ।

বাড়ির পরিবেশ একদম থমথমে ।পৃথিবীর বুকে গোধূলি নেমে গেছে অনেক আগে । বাড়ির এমন থমথমে পরিবেশ দেখে আৎকে উঠলাম আমি । কোন খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে কি আমার জন্য ! হাতের শপিং ব্যাগ রেখে নিজের জামা কাপড় ছেড়ে বাবার রুমের দিকে গেলাম । গ্রামের ডাক্তার চাচা এসেছে বাসায় ।কাছে যেতেই বললো যে

‘ বকুল মা , তোমার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম । তোমার বাবার অবস্থা বেশি ভালোনা । এক্সিডেন্টে মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছিলেন । সেসময়ে ঔষধের মাধ্যমে সেরেছিল কিন্তু এখন আবির সমস্যা দেখা দিয়েছে । অপারেশন করাতে হবে ঢাকা নিয়ে । ‘

‘ ডাক্তার চাচা অপারেশন করতে খরচ কেমন হবে ?’

‘ তা হবে পাঁচ লক্ষ্যের মতো । আজ আমি আসি । আরেকটা কথা , তোমার বাবাকে একা রেখো না কখনো । কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না ।’

ডাক্তার চাচা চলে গেলেন আমিও বাবার পাশে বসে কান্না করে যাচ্ছি । জানিনা আজ পাখির কি হলো আমার পাশে এসে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলছে

‘ আফা কান্না করবেন না । বড় আব্বা ঠিক হয়ে যাবে।
কান্নামিশ্রিত কন্ঠে পাখিকে জিজ্ঞেস করলাম

‘ মা কোথায় পাখি ?’
‘ আম্মা তো বাসায় নাই । সেই সকালে বের হইছে । খালি কইয়া গেছে কোন এক কামে শহরে যাইবো । সাথে আবার নাঈমা আফারেও লইয়া গেছে । ‘

পাখির কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম । কি আশ্চর্য, মা শহরে গিয়েছে ! যেই আকিবা গ্রামের রাস্তা ঠিকমতো চিনেনা সে আবার শহরে যাবে ? বিষয়টা খুব ভাবাচ্ছে । কারোর হাতের আলতো ছোঁয়ায় টনক নড়ে আমার । তাকিয়ে দেখি বাবা আমার হাত ধরে আছে তার চোখে পানি । আস্তে করে বাবার চোখ থেকে পানি মুছে বললাম
‘ চিন্তা করো না বাবা। ঠিক হয়ে যাবে তুমি । আমি আছি তো ! আর ভাইয়া সেদিন বলেছে তোমার চিকিৎসার জন্য টাকা জমাচ্ছে। দাঁড়াও ভাইয়া কে কল করি ভাইয়া একটা না একটা ব্যবস্থা করবে । ‘

নাঈম ভাইয়াকে দুইবার কল দেয়ার পর কল রিসিভ করলো
‘ হ্যাঁ বকুল যা বলার তাড়াতাড়ি বল। আমার অনলাইনে ক্লাস আছে । ‘
‘ ভাইয়া বাবা অনেক অসুস্থ । ডাক্তার বলেছে টাকা লাগবে অনেক টাটা,,,, ভাইয়া ভা,,,,,’

ভাইয়া ভাইয়া ডেকেও লাভ হলো না কারন ভাইয়া আরো অনেক আগে লাইন কেটে দিয়েছে । যা বুঝার বুঝলাম।
পাখিকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা ঔষধ খেয়েছে কি না। উওরে পাখি বললো

‘ বড় আব্বার ঔষধ শেষ বকুলআফা । আজ সারাদিন ঔষধ খায়নি তাই এমন অসুস্থ হয়ে পরেছে ।’

পাখির কথায় খেয়াল হলো কাল রাতে মা আমার থেকে টাকা নিয়েছিল বাবার ঔষধ আনার জন্য । কিন্তু মা ঔষধ না এনে ঢাকা চলে গেলো তাও আবার বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে । পাখিকে বাসায় রেখে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ফার্মেসী থেকে বাকী ঔষধ আনতে নয়তো বাবা আরো অসুস্থ হয়ে পরবে ।

রাত নয়টা বাজে । চারপাশের একদম নিরব । গ্রামের মধ্যে রাত নয়টা মানে অনেক রাত। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই সবাই নিজ নিজ কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে যায় । ফার্মেসীর দোকানদার কে অনেক হাতে পায়ে ধরে ঔষধ নিয়ে এসেছি ।এমনি এমনি দেয়নি সাদা কাগজের স্টাম্পে স্বাক্ষর করে আনতে হয়েছে ঔষধ।
খানিকটা ভয় করছে । দিনে গ্রামে চলাচলে সমস্যা হয়না কিন্তু রাতে গ্রামে চোর ডাকাতের উৎপাত বেশি তাই ভয় করছে ।

‘ এই কে এখানে ? ‘

কারোর কথার আওয়াজ শুনে আল্লাহ র নাম নিয়ে চোখ খিচে দৌড় দিলাম । পেছন থেকে কেউ বলে আসছে দাঁড়াও দাঁড়াও । শুনেও দৌড়াতে শুরু করলাম । আমার বাবার জন্য হলেও এখন বাঁচতে হবে আমার । বাড়ির সামনে এসে হাঁপাচ্ছি বুকের সাথে চেপে ধরে ঔষধগুলো । কপালের ঘাম মুছে বাবার কক্ষে গেলাম । বাবা ঘুমাচ্ছে । ডেকে তুলে ঔষধ খাইয়ে চলে আসলাম রুমে। ক্ষুধায় সারা শরীর কাঁপছে । রান্না ঘরি গিয়ে কোন খাবার পেলাম না । বয়াম থেকে দুটো বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি পান করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম । শুয়ে শুয়ে ভাবতেছি পাঁচ লক্ষ্য টাকা কোথায় পাবো । আমি রিসোর্টে যা কাজ করি তাতে বাবার চিকিৎসা করানো সম্ভব না । উনি যতই আমার পালিত বাবা হোক না কেন অনেক ভালোবাসেন আমাকে আমি জানি।
শপিং ব্যাগের দিকে নজর গেল । খুলে দেখি ঐ চুড়ির দোকানে দেখা নীল চুড়ি আর ছোট ঝুমকো জোড়া সাথে এক পাতা কালো টিপ।আমি যতটুকু জানি মিরা আপু আমাকে চুড়ির দোকানে দেখেনি তাহলে সে কিভাবে জানলো এই চুড়ির কথা ? কাল গিয়ে জিজ্ঞেস করবো এই ভেবে ঘুমিয়ে গেলাম।

মা বাসায় নেই তাই আজ একটু দেরি হয়ে গেল রিসোর্টে পৌছুতে । পাখিকে সবকিছু বুঝিয়ে শুনিয়ে বাবার পাশে রেখে এসেছি । রিসোর্টে এসে বুঝলাম আজ রবিন ভাই আর আরিফা সব সামলে নিয়েছেন । সকলের জন্য কিছু ফল-ফ্রুটস নিয়ে মেহমানদের কক্ষের দিকে আগালাম।

‘ আচ্ছা বকুল, তোমাদের গ্রামে কি ভূত আছে আসলে ভূত না পেত্নি! পেত্নি আছে? ‘

কক্ষে ঢুকেই রাফি ভাইয়ার এমন প্রশ্নে বোকা বনে গেলাম । হাতের ট্রে টেবিলে রেখে উওর দিলাম

‘ ভূত পেত্নি সবই আছে এখন আপনার কোনটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে সেটা বলেন ।’

শুকনো ঢুক গিলে মিরা আপু বললেন

‘ দেখো বকুল একদম ভয় দেখাবে না । আ’ আমরা ভয় পাই না বুঝলে ?’

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা ভয় পাই না । আচ্ছা এই রিসোর্টেও কি ভূত আছে? ভূতরা কি দিনেও আসে ? ‘

বিনা আপুর ভীতু প্রশ্ন

‘ বিনু আজেবাজে বকবি না এমনিতেই আমার ফাটছে আর এখানে তুই কি বকছিস ‘

উনাদের এসব উল্টা পাল্টা কথা শুনে জোরে জোরে হাসতে লাগলাম । কোনরকম হাসি থামিয়ে বললাম যে ‘ এখানে ভূত প্রেত কিছুই নেই । আপনারা শিক্ষিত হয়ে এখনও ভূত প্রেত বিশ্বাস করেন হা হা হা।’
পেট চেপে ধরে হেসে যাচ্ছি আমি ।

‘ বকুলফুল , তুমি এদের কথায় কান দিও না এমনিতেও কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি এদের ক্যাঁচ ক্যাঁচের জন্য । কেন যে কাল রাতে বাহিরে বের হয়েছিলাম আল্লাহ্ জানে । ‘
ভয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠলো কালকের কথা মনে করে । চোখ উপরে তুলে সানিম ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে নজর আটকে গেল আমার ….

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here