ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ২২

0
300

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|বাইশ তম পর্ব |

ধরণীতে নতুন ভোরের আগমন ঘটেছে সাথে আমার জীবনের নতুন সময়ের। ফজরের নামাজের পর পরই সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। আসার সময় শ্বশুর বাবা একশত টাকার পাঁচটা নোট হাতে তুলে দেন। শাশুড়ি মা তখনো ঘুমে ছিলেন। অনেকবার ডাকাডাকির পরও তিনি উঠেননি। আমরাও বুঝতে পেরেছিলাম উনার ঘুম থেকে না উঠার কারণ। কষ্ট করে কাউকে আর ডাকিনি। যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঢাকা শহরের আরেক নাম ব্যস্ত শহর রাখতে। চা ওয়ালা থেকে শুরু করে জজ ব্যারিস্টার সকলেই সকাল হতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজের সূত্রে।
কোনাবাড়ি বাস থামতেই যাবির ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়েন। আমাদের বাসা থেকে কোনাবাড়ির দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। ঢাকা আর যাওয়া হলো না। একটা রিকশা ডেকে যাবির ভাইয়া প্রথম উঠে বসলেন। আমি চারপাশে নজর ঘুরাচ্ছি। এই জায়গাটাও আমার অপরিচিত। ভেবেছিলাম বাবার বাসার আশেপাশে বসবাসের স্থান হবে। দূর থেকে হলেও বাবা,বড়ো মাকে দেখতে পাবো। তার সুযোগ হলো না। যাবির ভাইয়া রিকশায় উঠে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মুখে প্রশস্ত হাসি। আমিও হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে রিকশায় চড়ে বসলাম। রিকশা চলছে অজানা পথে। পিছনে ফেলে রেখে এসেছি যানবাহনের স্তুপগুলোকে। উনি আমার হাত শক্ত করে ধরলেন। আমার হাতের পিঠে অধর ছুঁয়ে বললেন, –” এখন যা হবে, ভালো হবে। তুমি পাশে আছো, সবকিছু ঠিক থাকবে।”
–” আমরা কোথায় যাচ্ছি?
–” আমাদের সংসার সাজাতে।”
–” ভাইয়া ভাবী আমাদের কথা জানেন?”
–” জানে। ভাবীর কাছে যাবে?”
–” এত দূরে গিয়ে কি করব। এমনিতেই জার্নি করে এসেছি। অন্য একদিন যাবো।”
–” ভাইয়ার বাসা পরিবর্তন করে ফেলেছেন। তোমার বাবা বাধ্য করেছে বাসা পরিবর্তন করতে। এখন আমাদের আশেপাশেই থাকবে। চলো আগে ভাইয়াদের বাড়িতে যাই।”

বাবার কথা শুনে চমকে গেলাম। আমাদের চৌধুরী পরিবারের মানুষদের ক্ষমতা সম্পর্কে অজানা নই। একজন মানুষকে একদম পথে নামাতেও দ্বিতীয়বার ভাববে না। তারমানে এই এক মাসে আমার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছুই ঘটেছে। ভেবে নিলাম ভাবীকে জিজ্ঞেস করব।
–” তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো, মায়া?”
–” আপনাকে ভয় পাবো কেন? আপনি থাকলে তো আরো সুখ খুঁজে পাই। আমার কাছে মনে হয় আমিই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ।”

–” আমি তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি মায়া। এই একমাস আমার অনেক কষ্টে কে’টে’ছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলে মনে পড়েছে, একটা ছোট্ট বউকে রেখে এসেছি অদূরে। যাকে ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র বাসনা জাগতো মনে। এখন আর কোনো ভয় নেই না আছে কোনো সংশয় তুমি পাশে আছো আর কি চাই।”

উনার কাঁধে মাথা রাখলাম। মনে মনে বললাম, ‘
আমার দেখা চিরসুখী মানব আপনি। যে কিনা তার ছোট্ট বউয়ের জন্য পাগল।’
———

কোনাবাড়ি থেকে বিশ মিনিটের পথ পেরোতেই রিকশা থেমে গেলো। যাবির ভাইয়া নামলেন আমাকেও নামতে সাহায্য করলেন। দীর্ঘ এক মাস পর এত যত্ন পেয়ে নিজেকে কেমন ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। উনি এক হাতে আমাকে ধরেছেন। অন্য হাতে বড়ো ব্যাগ ধরে রেখেছেন। আমরা যেই পথে হাঁটছি তার দুই পাশের ডোবা মাঝখানের রাস্তা। ভাবছি, এমন বাড়িতে ভাবী থাকেন। দুতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। উনি ভাবী বলে দুইবার হাঁক ছাড়লেন। ভেতর থেকে ভাবি আসছি বলে ছুটে আসেন।
আমাকে দেখামাত্রই গেট খুলে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরেন। বলা হয়নি, ভাবির কোন সন্তান নেই। বিয়ের আজ দশ বছর পার হয়েছে কিন্তু উনাদের কোন সন্তানাদি হয়নি। আমার মনে অনেক প্রশ্ন। এই যেমন, দীর্ঘ একমাস যে আমি শ্বশুর বাড়িতে ছিলাম ভাবী আর ভাইয়া কেন সেখানে যায়নি? আমাদের বিয়ের কথা শুনে কেনো কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি? ভাবী আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে বসালেন।আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন, –” অনেক প্রতীক্ষার পর পেয়েছে তোমাকে সে। আমি দেখেছি তার ছটফটে ভাব। আমি দেখেছি তার অস্থিরতা। আমি দেখেছি তার নির্ঘুমে থাকা প্রতিটা রজনী। কষ্ট পেয়ো না, সে সত্যিই তোমাকে খুব ভালবাসে। তার উপর ভরসা রাখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

–” আমিও তাকে খুব ভালোবাসি, ভাবী।এভাবে বলবেন না আমার কষ্ট হয়।”
যাবির ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করলেন। মুখে মিষ্টি হাসি। আমি বারবার ঘায়েল হয়ে যাই এই হাসিতে। কী আছে সেই হাসিতে, উনার হাসি দেখলে মনে হয় উনি পৃথিবীতে একমাত্র সুখী মানুষ, কেননা আমি তার পাশে আছি।

–” ভাবী ক্ষুধা লেগেছে। খাবার দাও। তোমার এই জা কে খাইয়ে মোটা বানাও। এমনি তো বয়সে বাচ্চা, তারুপর শরীরের হাড্ডি ছাড়া কিছুই নেই। এখন আরো বাচ্চার দেখা যায়।”

–” বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছেন কেনো শুনি? তাও আবার সকলকে না জানিয়ে। তার উপর বাসর তো!”

–” আল্লাহর ওয়াস্তে ভাবি চুপ যাও। এমনি আমার বাচ্চা বউ। কিছু বুঝে না। অবুঝ বাচ্চাটাকে আর পাকা বানিও না।”

ভাবী দেবরের কথা শুনে হাসছি। যাবির ভাইয়া আবারো কোথায় চলে গেলেন এবার আমি ভাবীর দিকে ফিরে বসলাম। ভাবীর হাতে হাত রেখে বললাম, –” সেখান থেকে চলে এসেছে কেনো ভাবী? কি হয়েছিল সেখানে? আমার অবর্তমানে বাবারা কী করেছিল?”

ভাবীর হাসিমাখা মুখ নিমিষে মলিন হয়ে গেলো। লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে ভাবী বলতে শুরু করলেন পূর্বের সেই কথা, –” তোমাদের চলে যাওয়ার ঠিক আধা ঘণ্টা পর যাবার আমাকে ফোন করে বলে, আসল কাহিনী। আমি তখন বিশ্বাস করিনি। যাবির এটাও বলে যেন কাউকে না জানাই। আমি কথা রেখেছি। কাউকে জানাইনি, বুঝতেও দেইনি যে আমি জানি সবকিছু। সময় তখন সন্ধ্যার লগ্ন, হঠাৎ আমাদের ঘরের দরজায় কেউ কাড়াঘাত করে। দরজা খুলে বের হয়ে দেখি তোমার বাবা এবং তোমার মা এসেছেন। তোমার বড়ো মা অদূরে দাঁড়িয়ে মুখে ওড়না চেপে কান্না করছেন। তোমার মা এসে চিৎকার করে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, –” আমার মেয়েকে কী করেছিস তুই বল? তোর সেই দেবর কোথায়? আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় গেছে?”

আমি প্রত্যুওরে বলেছিলাম, –” আমরা কিছুই জানিনা।”

আমার কথা উনারা বিশ্বাস করেনি। আমার ঘরে এসে কিছু জিনিস ভা’ঙ’চু’র করে তারপর চলে যান। তোমার বাবা-মা যেতেই তোমার বড়ো মা আমার কাছে আসেন। হাত ধরে বলেন অনুনয়ের স্বরে বলেন, –” এত বছর পর একটু সুখের মুখ দেখেছিলাম। মেয়েটা আবারো আমাকে অভাগী করে চলে গেলো। বলো না কোথায় আমার মেয়ে? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার মেয়েটাকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার মেয়ে ভালো আছে তো?”

বিশ্বাস করো মায়া! আমার তখন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। একজন মায়ের কান্না আমি সহ্য করতে পারিনি। তবুও বুকে পাথর জমিয়ে চুপ করে ছিলাম। আমি জানি তুমি যাবিরের সাথে ভালো থাকবে এবং তোমার মা যা করতে চেয়েছিল তাদের অন্যায় ছিল।

পরের দিনের ঘটনা, তোমার চাচারা এবং কিছু নেতারা আসে। আমাদের বাসায় এসে হু’ম’কি দিয়ে যায় যে, যদি তোমাদের কথা না বলি তাহলে আমাদের মুখে কালি মাখিয়ে রাস্তায় ঘোরাবে। আমরা তখন খুব ভয় পেয়ে যাই। আমি এবং তোমার ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি পরিবর্তন করার। সেদিন যাবির রাতের অন্ধকারে আমাদের বাসায় আসে এবং তার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। যাবিরের সিদ্ধান্তেই বাড়ি পরিবর্তন করে এখানে চলে আসি।”

ভাবীর কথা শেষ হতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম।
আমি জানি বড়ো মা ভালো নেই। এখন নিশ্চয়ই মা এই সুযোগে বড়ো মার সাথে আরো খারাপ আচরণ করে। বাবাও হয়তো পরিবর্তন হয়ে গেছে বড়ো মাকে দোষারোপ করে।
সন্ধ্যা হতেই ভাবীকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে আসলাম। বাতাস বইছে, গাছের পাতাগুলো হেলেদুলে খেলা করছে। আজ তো আমার মন ভালো কিন্তু প্রকৃতি কেনো মন খারাপ? বুঝতে পারলাম না। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে যাবির ভাইয়া চান না আমরা ভাইয়াদের সাথে থাকি। উনি চান আমরা আলাদা কোথাও নতুন করে সংসার পাতি। আমিও অমত করিনি। নিজ হাতে সংসার সাজাবো এর মাঝে আনন্দ অনেক।

–” তুমি জানো মায়া, আমরা যেখানে থাকব সেখানে এখন কিছুই নেই। আছে শুধু একটা বালিশ, আরেকটা তোষক আর চাদর।তুমি কি সেই ঘরে আমার সাথে থাকতে পারবে?”

–” অবশ্যই পারব।”
–” দেখো শেষে না অভাবে পড়লে তোমার ভালবাসা দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়।”
উনার কথা শুনে হাসলাম উনার হাত শক্ত করে ধরে বললাম, –” আপনাদের শহরে ফাগুন মাসে পলাশ ফুল ফোটে না? ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গান গায় না? একটা পলাশ ফুলের চাড়া নিয়ে আসবেন। আমি লাগাবো। সেটা পরিচর্যা করব। যখন ফুল ফুটবে তখন মালা গেঁথে আপনার গলায় পরিয়ে দিব। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে।”

জাবের ভাইয়া হাসলেন। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, –” তোমার চারা পলাশ গাছ বড়ো হতে হতে আমি দশ বাচ্চার বাবা হয়ে যাবো, মায়াবিনী। তখন না হয় আমার ডজনখানেক বাচ্চার সাথে আমাকেও মালা পরিয়ে দিও!”

উনার কথায় লজ্জা পেলাম। উনার বুকে মুখ গুঁজে রইলাম। আমার কাণ্ডে উনি হাসলেন। আমাকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন নিজ নিবাসে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here