ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ২৩

0
317

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
| তেইশ তম পর্ব |

শহরের উঁচু দালানের ভীড়ে আমরা আমাদের ছোট্ট নিবাস গড়েছি। কোনাবাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে কাশিমপুর অবস্থিত। ঢাকা শহরে বসবাসরত একজন শিল্পপতি শখ করে কিছু জমি ক্রয় করেন এবং সেখানে দুটো ঘর বানায় খুব সুন্দর ভাবে কিন্তু মানুষের অভাবে সেখানে জমি,বাড়ি এমনি পড়ে ছিল। যাবির ভাইয়ার এক বন্ধুর আংকেল হোন সেই শিল্পপতি। উনার বন্ধুর সাহায্যে এ বাড়ি আমরা ভাড়া পেয়েছি। বাড়িটা আমার খুব মনে ধরেছে। আমার মনে হচ্ছে এই বাড়িতে আমরা বছরের পর বছর অনায়াসে থেকে যেতে পারবো, কোন ক্লান্তি আসবে না। না আসবে কোনো ভয়। দুই রুম বিশিষ্ট বাড়ির চারপাশে গাছ-গাছালিতে ভরপুর এবং চারপাশে দেয়াল উঁচু করে বাউন্ডারি করা হয়তো জমির সুরক্ষাণার্থে দেয়াল গঠন করা হয়েছে কিন্তু আমাদের জন্য বেশি উপকার হয়েছে। মানুষ থাকবে না, ঝামেলাও থাকবে না।
সন্ধ্যা হতে আর কিছু সময় বাকি। আমি ঘর থেকে বের হয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে নিলাম। বাড়ির বাহিরে এক কোণে আরো কিছু স্বল্প জায়গা রয়েছে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম এখানে একটি পলাশ ফুলের গাছ লাগাবো এবং গাছটি যখন বড়ো হব তখনই বাড়িটা মালিকের কাছ থেকে কিনে নেব।

আমার ভাবনার মাঝেই যাবির ভাইয়া আমাকে জোরে হাঁক ছাড়েন। উঠোন থেকে ‘আসছি’ বলে আমি দৌড়ে ঘরে চলে যাই।

আমাদের দুটো ঘর পুরো শূন্য, কিছুই নেই। একটা বিছানা, একটা বালিশ আর চাদর রয়েছে। ঘরের আরেক কোণে ছোট্ট টেবিল রয়েছে। যার মধ্যে একগাদা বই-পুস্তক রয়েছে।

যাবির ভাইয়া বিছানার উপর বসে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন, –” এদিকে আসো তো বউ! হাতে হাতে সাহায্য করো।”
ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে কোথায় রাখবো ভাবছি। পরক্ষণে নজর গেলো জানালার দিকে। ঘরের জানালা আটকানোর পরও কিছু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। সেখানে প্রয়োজনে জিনিসপত্র যেমন: তেল, সাবান, স্নো, পাউডার, কলম ইত্যাদি ছোটখাটো জিনিস রেখে দিলাম। এখন রইলো কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা, সেটা যাবির ভাইয়া করে দিলেন। জানালার গ্রিলের ভাঁজে ভাঁজে একটা একটা করে কাপড় রেখে দিলেন। সবগুলো কাপড় সাজানোর পর দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো দোকানে কাপড় চোপড় বিক্রি করার জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছি। সবকিছু করতে করতে সন্ধ্যা পাড় হয়ে গেলো। পুরো ঘর সাজানোর পর উনি এসে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন।
উনার মুখের মধ্যে দুষ্টুমি ভেসে উঠেছে। কাছে গেলাম না। ঘর থেকে বের হয়ে অন্য ঘরে গেলাম।

একটা ঘরে আসবাবপত্র থাকলে ঘরটাকে ছোট মনে হয় কিন্তু আসবাবপত্র ছাড়া শূন্য লাগে। দ্বিতীয় ঘরে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কবে এই ঘর পূর্ণ হবে তাই ভাবছি। আচমকা কেউ পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে। খুব ভয় পেয়ে যাই। ঘাড় ঘুরে তাকিয়ে দেখে যাবির ভাইয়া জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। আমি সম্মুখে ফিরে তাকালাম। মুখে রাজ্যের লজ্জা। উনি আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, — “বউ লজ্জা পেয়েছো?”
আমি চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলাম, –” অনেক লজ্জা পেয়েছি।”
–“তোমার লজ্জা আমি ভেঙ্গে দেই?”
–” কীভাবে?”
উনি হাসলেন। আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলেন অন্য ঘরে।
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার মুখে মিষ্টি হাসি। আমাকে আলতোভাবে বিছানায় শুয়ে কপালে অধর ছুঁয়ে দিলেন। নাকে নাক ঘষে বললেন, –” লজ্জা পাও লজ্জাবতী। তোমার লজ্জায় আমি সুখ খুঁজি। তুমি লাজুকমুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠবে, আমি তৃপ্তি ভরে তোমার সেই রাঙা মুখে সুখ খুঁজবো।

সত্যিই উনি আমাকে এমন লজ্জা দিয়েছেন যে লজ্জা ভাঙতে আমার কয়েক শত বছর পাড় করতে হবে। পরের দিন ঘুম ভাঙ্গে মিষ্টি কিছু পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনে। বাড়ির আশেপাশে গাছপালা হওয়ার সুবাদে পাখিদের আবাসস্থল গড়ে উঠেছে সেখানে। উনি এখনো ঘুমোচ্ছেন। আলগোছে উনার পাশ থেকে উঠে দরজা খুললাম। সকালের শীতল বাতাস শরীর ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করলো। আমি মিষ্টি হাসি হাসলাম। এক সেট জামা নিয়ে কল পাড়ের দিকে রওনা হলাম।

সকাল হয়েছে ঘন্টা দুয়েক আগে কিন্তু খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। এদিকে আমি ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করছি। এমন না যে নিজে রান্না পারি। বড়ো মা কখনোই আমাকে রান্না শেখায়নি। শ্বশুরবাড়িতে যতদিন থেকেছি কা’টা’কু’টি করেছি। রন্ধন কাজে শাশুড়ি মা এবং চাচী শাশুড়ি ছিলেন।
কথিত আছে,” ক্ষুধা মানে না পান্তা ভাত, প্রেম মানে না জাত বেজাত।”
বারান্দায় ছোট্ট একটা রুম রয়েছে। যেখানে রান্না করার কিছু পাতিল রয়েছে। কয়েকটা পাতিল ঢাকনা দিয়ে ঢাকা ছিল। ঢাকনা উঠিয়েও কিছু পেলাম না। হতাশা হয়ে পুরো ঘরের আশপাশের তাকালাম। না কিছু নেই। কি যে করি! ক্ষুধার তাড়নায় ম’রে যাচ্ছি

শেষে আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না। উনার পাশে বসে আস্তে করে ডাকলাম। উনি হু হা করে উত্তর দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি অসহায় চোখে উনাকে বললাম, –” খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ঘরে কিছু নেই। বাজার করবেন না?”
উনি লাফিয়ে উঠলেন বিছানা থেকে। ঘড়ি বের করে সময় দেখে নিলেন। এরপর আমাকে তাগাদা দিলেন গামছা এবং ট্রাউজার নিয়ে আসার জন্য।
কলপাড়ে কল চেপে দিচ্ছি। পানি জমা হচ্ছে একটি স্টিলের বালতিতে। যাবির ভাইয়া সেই পানি দিয়ে গোসল করছেন। বিগত এক মাসে কল চাপা শিখে গিয়েছি। এখন আর তেমন কঠিন কাজ মনে হয় না। বর্তমানে নিজেকে অনেক সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। একজন স্বামীর সেবা করাই তো একজন স্ত্রীর কর্তব্য। উনি গোসল করছেন আবার কিছুক্ষণ পর পর এটা সেটা বলে আমাকে লজ্জায় ফেলছেন। আমিও লজ্জায় লাল হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। হঠাৎ উনি একটা কাণ্ড করে বসলেন। মায়া বলে আমাকে তাকাতে বলে, আমার দিকে পানি ছুঁড়ে মারতে শুরু করেন। আমি হাসছি। উনার কান্ডে হাসতে হাসতে পিছনে চলে যাচ্ছি।
–” আমি গোসল করেছি। এইভাবে ভিজাবেন না।”

পানির ঝাপটা থেকে বাঁচতে দুই হাত সামনে এনে রেখেছি। পরপর উনার লাজুক কথায় লজ্জা পাই, –” তোমাকে তো আমার রঙে অনেক রাঙিয়েছি। এবার না হয় প্রকৃতির পানি দিয়ে ভিজাই!”

–” ইস মুখে কিছু বাঁধে না। তাড়াতাড়ি যান বাজার করে নিয়ে আসেন। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”

গোসলকার্য সেরে একটা পাঞ্জাবি পড়ে উনি চলে গেলেন বাজার করতে। আমিও ওড়না কোমড়ে গুঁজে বিছানা ঠিক করতে লেগে পরলাম। একটা ঝাড়ু দিয়ে পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে বাহিরে লতা পাতা পরিস্কার করে ফেললাম।

প্রায় আধা ঘন্টা পর উনি আসেন। আমাকে এক প্রকার টেনে ঘরে নিয়ে যান।

–” বউ, দেখি তো হা করো?”

গরম গরম রুটি এবং ডাল ভাজি। উনি পরম যত্নে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন হঠাৎ আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। উনি খাওয়ানো বাদ দিয়ে বিচলিত হয়ে আমার আমার গালে হাত রাখলেন, –” কি হয়েছে আমার মায়াবিনীর? ব্যথা করছে? অসুখ বেঁধেছে? খারাপ লাগছে? কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”

উনার কথার প্রত্যুত্তরে ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলাম, –” আমি বাবা,বড়ো মাকে দেখব। আমাকে নিয়ে যাবেন? আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তাদের সাথে একটু কথা বলে চলে আসব।”

উনি চমকালেন, থমকালেন। রুটির টুকরো হাত থেকে খসে পড়ে গেল নিচে। আমি কান্না করেই যাচ্ছি অনেক। উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন। অবশেষে মুখ খুলে বললেন, –” সেখানে গেলে তোমার কষ্ট আরো বাড়বে। তুমি কি পারবে সহ্য করতে?”

–” আমার বাবা এবং বড়ো মা আমাকে খুব ভালোবাসে। দেখবেন আমরা যদি উনাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তাহলে ওনারা আমাদের মেনে নেবেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বিশ্বাস করুন উনাদের ছাড়া আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”

থেমে থেমে কান্না করছি। হঠাৎ উনার একটা কথা শুনে আমার কান্না থেমে যায়।

–” তুমি কি আমায় ছেড়ে চলে যাবে, মায়া?”

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here