ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ২০

0
287

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|বিশ তম পর্ব |

–” আপনাদের সাথেও কী আপনাদের দাদী-নানীরা এমন আচরণ করেছিল?”

যাবির ভাইয়া উপস্থিতিতে সকলেই চমকালেন। যাবির ভাইয়া পুকুর থেকে গোসল করে এসেছেন। তবে গতকালের মতো খালি গায়ে নয় পাঞ্জাবী পরিধান করে কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে আসেন। উপস্থিত মহিলাগণের মধ্যে একজন বলেন, –” কি সব বলছো বাবা।”
যাবির ভাইয়া পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে প্রত্যুওরে বললেন, –” বলছি যে, এতদিন জানতাম বিয়ের আগে হলুদ দিয়ে এভাবে গোসল করায়। বিয়ের পরেরদিন সকালে যে এভাবে গোসল করায় আজ প্রথম দেখলাম। এজন্যই জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের দাদী নানীরাও কী এমন আচরণ করতো?”
যাবির ভাইয়ার চাচী এবার মুখ খুললেন। আমার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বললেন, –” বিয়ের পরের সকালে ফরজ গোসল করবে না। অপবিত্র অবস্থায় উঠোনে পা রাখবে তা তো আর আমরা হতে দিব না।”
উনার কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো এর আগেই যাবির ভাইয়ার চিৎকার কর্ণধারে আসে, –” আপনারা এজন্যই সকাল সকাল আমার বউকে নিয়ে বাহিরে চলে আসেন। পুকুরের ঠান্ডা পানি নিয়ে এসে গোসল করাচ্ছেন। এদিকে রাস্তা দিয়ে যত পুরুষ মানুষ আছে সবাই আমার বউকে ভেজা অবস্থায় গোসল করছে। এখন কী আমার বউ অপবিত্র হচ্ছে না?”

সকলেই নিশ্চুপ। আমি ঠান্ডায় থরথর কাঁপছি। হাত পা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে যতটুকু পারছি ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছি। ইতিমধ্যে একজন ভাবী মুখ খুলেন। তিনি বলেন, –” তুমি গোসল করে এসেছো। বউ কি গোসল করবে না?”

যাবির ভাইয়া রেগে গেলেন। হাতের গামছা মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, –” আমার বউ এখনো ছোট। বিয়ে করেছি বলে বউয়ের বয়সের দিকে খেয়াল রাখবো না ততটা কাপুরুষ নই। আর রইলো গোসলের কথা, সকালে গোয়ালঘর পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম শরীর গন্ধ করছে বলে গোসল করেছি। এই সুযোগে আপনারা, বাহ!”

সকলের মাথা নীচু করে রেখেছে। কারোর মুখে কথা নেই। আমি মাথা উঁচু করে ছলছল চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনার দৃষ্টি আমার দিকেই নিবদ্ধ। এগিয়ে আসলেন আমার কাছে। উঠোনে রশিতে ঝুলে থাকা তোয়াল এনে আমার গায়ে পেঁচিয়ে দিলেন। সকলের সামনে আমাকে কোলে তুলে চলে আসলেন সেখান থেকে।
————

ভেজা কাপড় ছেড়ে গতকালের কিনে দেয়া লাল জামাটা পড়ে নিলাম। আমাকে এই বাড়ি থেকে এখনো কোনো পোশাক দেওয়া হয়নি। যাবির ভাইয়াও ব্যস্ত ছিলেন তাই কোথাও যাননি। বিছানার উপর চুপচাপ বসে আছি। উনি মোটা কাঁথা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আমার কাছে এসে বসলেন।
দুজনের মাঝেই নীরবতা। আমি ভাবছি তখনকার কথা। উনাদের কথার মর্মার্থ বুঝতে অনেকটা দেরি হয়েছে। যখন বুঝতে পারি তখন ভীষণ লজ্জা পাই। উনি আকস্মিক আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমাকে কিছুক্ষণ উনার শরীরের সাথে মিশিয়ে রাখলেন। যখন বুঝতে পারলেন আমার শরীর গরম হয়ে গেছে তখন ছেড়ে দিলেন। আমি উনার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছি। একজন মানুষ কীভাবে এতটা ভালবাসতে পারে তা ভাবছি। আমি ভাবতাম, পৃথিবীতে আমি একজন পাগলি প্রেমিকা যে নাকি একজন পুরুষকে খুব ভালোবাসে কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম আসলে আমার ধারণা ভুল। আমি তো ভালোবাসার মানে বুঝিই না। উনার প্রত্যেকটা কথা আজকে আমার অন্তরে গেঁথে গেছে। আমাকে সাহস যুগিয়েছে পৃথিবীর সাথে যেন লড়তে পারি। উনার কথা কিছুক্ষণ পর আমার কর্ণধার এসে পৌঁছায় উনি বলেন, –” এতটা নরম হয়ো না মায়াবিনী। পৃথিবীর মানুষ খুবই খারাপ। তোমার নরমতার সুযোগ পেয়ে, তোমায় নিস্তেজ করে ফেলবে।”

উনার কথা শুনে হাসলাম। উনার বুকে মাথা রেখে বললাম, –” আপনি আছেন তো, ভয় কীসের।”

এভাবেই সকালের সময়টা কীভাবে অতিবাহিত হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। সকালের নাস্তা আমরা দুজনের একজনও করিনি। মজার ব্যাপার হলো আমার শ্বশুরবাড়িতে কেউ কারোর খবর রাখে না। এত বড়ো পরিবারে কে খেয়েছে, কে ঘুমিয়েছে তার খবর কেউ রাখে না। বিশেষ করে খাবারের ক্ষেত্রে। যে যার খাবার খেয়ে নিতে পারলেই বাঁচে। খাবারের সময়ে এক ঘন্টা পর যদি কেউ খাবার খেতে উপস্থিত হয় তো পাতিলের তলার পুরা ভাত ছাড়া তার কপাল আর কিছুই জুটবে না। এদিকে আমরা দুজন যে না খেয়ে আছি তার খবর কেউ রাখেনি।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো। যাবির ভাইয়া তখন আমার সাথে ঘরেই ছিলেন। অনেক গল্প করলেন সাথে উপদেশ দিলেন। উনার কিছু কিছু কথা মর্মার্থ যা বুঝতে পারলাম উনি আমাকে এখানে রেখে ঢাকা চলে যাবেন।

দুপুরের আহারের সময় ফারিহা এসে উপস্থিত হয়। আমাদের দুজনকে শ্বশুর বাবা ডেকেছেন বলে হাঁক ছাড়ে। উনি আমার হাত ধরে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। শ্বশুর বাবা খেতে বসেছেন মাত্র। আমাকে এবং যাবির ভাইয়াকে বাবার পাশে বসতে ইশারা করলেন।
বড়দের কথা চিরধার্য আমি এবং যাবির ভাইয়া বসে পড়লাম বাবার পাশে। কিছুক্ষণ পর আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। সকাল থেকে অনাহারে আছি। পেটে ক্ষুধায় ম’রে যাচ্ছি। লজ্জায়, ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারিনি। এমনকি যাবির ভাইয়াকেও না।
আমার অপর পাশে শাশুড়ি মা এবং চাচী শাশুড়িরা মুখে আঁচল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মাথা উঁচু করে একবার চারপাশে নজর ঘুরালাম। আমি একমাত্র মেয়ে যে কিনা সব পুরুষের মাঝে বসে খেতে বসেছি। খুবই লজ্জা পেলাম। এই বাড়ির নিয়ম কানুন শিখতে আমার অনেক সময় লাগবে তা বুঝতে পারলাম। আমার ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো শ্বশুর বাবার কথায়, –” বউকে তো ঘরে তুলেছো। এখন তুমি কি করবে? বাবার ঘাড়ে বসে খাবে নাকি চাকরি-বাকরি কিছু করবে।”

–” আমি ভাবছি বাবা, মায়াকে এখানে রেখে ঢাকায় চলে যাব। মায়া বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করবে আর আমি ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করব এবং চাকরি করব।”

–” খুব ভালো সিদ্ধান্ত। মেয়েরা কেন পিছিয়ে থাকবে। আমার বাড়ির ছেলেরা যেমন শিক্ষিত আমি চাই আমার ছেলের বউরাও তেমন শিক্ষিত হোক। তোমার বড় ভাই কবে আসবে? সে কি তোমার বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানে?”

যাবির ভাইয়া চুপ হয়ে রইলেন। আমারও বিগত দিনগুলোতে ভাইয়া ভাবীর কথা একটুও মনে পড়েনি। উনারা কি কিছুই জানেন না? হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো, ভাইয়া ভাবী জানতে পারলে তো অবশ্যই উনারা চলে আসতেন অথবা যাবির ভাইয়া কিছু বলতেন। যাবির ভাইয়ের উত্তর শুনে আমি স্তব্ধ বনে গেলাম উনি বাবার উদ্দেশ্য বললেন, –” ভাইয়া ভাবী কিছুই জানে না।”

–” জানানোর প্রয়োজন ছিল। এতদিন তার বাড়িতে থেকে খেয়ে, পড়াশোনা করে এমন একটা ঘটনা ঘটালে। তার জানার উচিত ছিল। আর আমি যতদূর জানি, তোমার ভাইয়ের বাসা থেকে বউমার বাসার দূরত্ব বেশি না। সুতরাং যদি কোন চাপ দেওয়া হয় তাহলে তোমার ভাইকে দেওয়া হবে।”
যাবির ভাইয়া নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। উনার চেহারায় স্পষ্টত চিন্তার ভাব বিদ্যমান। শ্বশুর বাবা আবারো বলেন, –” আজ মাহমুদকে ফোন দিবে এবং সেখানকার পরিস্থিতি জানবে।”

বাবা ছেলের মাঝে আর কোন কথা হলো না। ইতিমধ্যে আমাদের খাবারের পর্ব শেষ। উনার সাথে বাড়ির পিছনটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সামনে বড়ো পুকুর রয়েছে। দূর দূরান্তে ধান চাষ করা হয়েছে। চোখের সামনে সবুজে সমারোহ। যাবির ভাইয়া পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কাঁধে থুতনি রেখে বললেন, –” তোমার আরেকটু বড়ো হলে কী হতো? না পারি তোমাকে কাছে টানতে, না পারি তোমাকে ছেড়ে যেতে।”

–” ছাড়তে কে বলেছে।”
–” আমার বিবেক। তোমাকে ছুঁয়ে দিতে চাই কিন্তু ভাবি, তোমায় কীভাবে ছুঁয়ে দিবো। আমার ছোঁয়াতে যদি মূর্ছা যাও?”

যাবির ভাইয়ার কথায় লজ্জা পেলাম। আমার লাজুক রাঙা মুখ দেখে উনি আবারো বলেন, –” এভাবে লাজরাঙা হয়ো না প্রিয়া, তোমার লাজরাঙা মুখশ্রী দেখে ম’রে যাবো।”
———–

বিয়ের দশদিন পরই যাবির ভাইয়া আমাকে রেখে ঢাকা চলে যান। উনি চলে যাওয়ার পর আমাকে আর ফারিহাকে এক রুমে থাকতে দেন শ্বশুর বাবা। আজ প্রায় একমাস পার হলো আমি সিরাজগঞ্জে এসেছি। এক মাসে অনেক কিছুই সহ্য করেছি। আবার অনেক কিছু সয়ে নিয়েছি আবার অনেক কাজ শিখেছি। যেমন: পাতিল মাজা, ধান মারিয়ে নেওয়া, ছোট মাছ কা’টা,বড় মাছ কা’টা, সবজি কা’টা, রুটি বানানো। এগুলো সব শিখিয়ে ফেলেছি। এমনি এমনি শিখিনি। শাশুড়ির ত্যাড়া কথা, চাচীদের খোঁচা কথা এগুলো শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। শাশুড়ি মা এবং চাচীরা মিলে তিন বেলা রান্না করেন। তরকারি বা প্রয়োজনীয় কাজ এতদিন কাজের লোক করতো। আমি আসার পর কাজের লোকরা অন্য কাজ করে আর আমি উনাদের রান্নার কাজে সহায়তা করি।

দুপুরে গোসল করে এসে আয়নার সামনে বসি। এক দৃষ্টিতে আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখি। লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ভাবছি, পরীক্ষার আর কয়েক মাস আছে। যাবির ভাইয়া ফারিহাকে দিয়ে কিছু বই অনিয়ে দিয়েছেন। আরো কিছু বাকি আছে। একা একা যতটুকু সম্ভব রাতের আঁধারে ততটুকু পড়ি। যাবির ভাইয়া আমাকে যেই ফোন দিয়ে গিয়েছিল, এক সপ্তাহ পর শাশুড়ি মা এসে সেই ফোন নিয়ে চলে যায়। এই বলে যে, উনার ফোনটা দরকার আছে। আমিও আর সাহস করে চাইনি। উনিও আর দিয়ে যাননি। এই এক মাসে যাবির ভাইয়া যতবার ফোন করেছে মা ফোন ধরেছে। যখন আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে তখন মা মিথ্যা বলেছে যে, আমি কাজ করছি নয়তো গোসল করছি নয়তো ফারিহার সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছি। সমস্ত কথা মিথ্যা। উনি যখন ফোন করেন তখন আমি শাশুড়ি মায়ের আশেপাশেই থাকি। কিছু বলার মতো অবশিষ্ট নেই। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

এই বাড়িতে সবচেয়ে আপনজন হচ্ছেন আমার শ্বশুর বাবা। আমাকে খুব আদর করেন। এইতো সেদিনকার ঘটনা, আমার গোসলের সাবান শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে আমার অভিভাবক আমার শ্বশুর বাবা এবং শাশুড়ি মা। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অন্য কাউকে তো আর বলা যায় না। মধ্যাহ্নভোজের বাবা মা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তখন উনাদের ঘরে যাই। মাথা নিচু করে আস্তে করে বলি, –” বাবা একটা কথা বলার ছিল।”
বাবা আমাকে দেখে হাসেন। জিজ্ঞেস করেন, –” কি বলবে মা?”

ইতস্ততঃ করে বললাম, –” আমার না গোসলের সাবান শেষ হয়ে গেছে।”
শ্বশুর বাবা শোয়া থেকে উঠে বসে বলেন, –” কি বলো,মা! আমাকে আগে বলবে না? শুনো মেয়ে কোন কিছু যদি শেষ হয়ে যায়, শেষ হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে আমাকে বলে রাখবে। একদম শেষ হয়ে গেলে বলবে না। আমি থাকতে তোমার কোনো কিছু চাইতে লজ্জা পেতে হবে না।”

শ্বশুর বাবার কথা শেষ হতে না হতেই শাশুড়ি মা গর্জে উঠেন। মুখ বাঁ’ কিয়ে বলেন, –” এই পনের দিন আগে না তোমাকে গোসলের সাবান দিয়ে আসলাম, এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে? সাবান কই মাখো, গায়ে না কাপড়ে?”

শাশুড়ি মার কথার প্রত্যুওরে কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু শ্বশুর বাবা শাশুড়ি মাকে ঠিকই ধমক দেন, –”
এটা কেমন কথা মাহমুদের মা, আর একবার যদি বউমার সাথে তোমাকে খারাপ ব্যবহার করতে দেখি তাহলে আমি বরখাস্ত করব না।”

শাশুড়ি মা সেখান থেকে চলে যান আমিও নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে আসি।
এভাবেই আমার জীবন চলছে। এই এক মাসে বাবা-মার কথা মনে করিনি তা কিন্তু না। খুব মনে পড়ে বাবার কথা বড়ো মার কথা। না জানি আমার অনুপস্থিতিতে বড়োমার সাথে কি করেছে। মা কি বড়ো মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে? নাকি বড়োমার উপর অ’ত্যা’চা’র করছে। কিছুই জানি না। আমার অনেক ইচ্ছা হয় বাবার মুখ থেকে একবার আম্মাজান ডাক শোনার, বড়ো মার হাত থেকে ভাত খাওয়ার এবং মালা মেহেদীর সাথে অনেক গল্প করতে কিন্তু তা এখন সম্ভব না। কেননা আমি তাদের থেকে অনেক অনেক অনেক দূরে। আদৌও কি তারা আমার চিন্তা করে? প্রশ্ন রইল।

চলবে ……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here