প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব ৬

0
290

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৬

শুনশান রাত। নীরবতা গ্রাস করছে আশপাশটা। অমাবস্যার রাতের পর হালকা চিকন চাঁদ আকাশে বিদ্যমান। আশেপাশে ঘন জঙ্গল দিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে এলো এক মানবী। তার মায়াবী বড় আঁখিতে রাজ্যের ভয়াবহতা ও নির্মমতা। তার বড় বড় হাতের নখে এখনো রক্ত লেগে আছে। তা দেখে ভ্রু কুঁচকালো সে। চোখ বন্ধ করে মেলতেই স্বাভাবিক হলো সে। ঠোঁটের দুই ধার দিয়ে বের হওয়া দাঁত কোথাও লুকিয়ে পড়ল। লাল চোখজোড়া পরিণত হলো সেই চিরচেনা নীল চোখজোড়াতে। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্ত বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিয়ে রহস্য ঘেরা হাসি দিল সে। সেই হাসির অধিকারিণী আর কেউ নয় ঐশ্বর্য!
“আমার কাছে ভুলে আর আমার অপছন্দের কিছু করার একটাই পানিশমেন্ট। মৃত্যু! বেচারা! জেল থেকে বের না হলেও পারত।”

হাসিটা প্রসারিত হতেই ঐশ্বর্যের চোখেমুখে আলো পড়তেই চোখ বুঁজে ফেলে সে। চোখ মেলতেই দেখে গাড়িটা তার মাত্র দুইহাত সামনে দাঁড়িয়েছে। এর মানে গাড়ির ড্রাইভার অনেক চেষ্টায় নিশ্চয় গাড়ি দাঁড় করিয়েছে! ভেবে মুচকি হাসে ঐশ্বর্য। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির দরজা খুলে ক্লান্তি আর এলোমেলো চুল নিয়ে এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসে এক লম্বা ব্যক্তি। ব্যক্তিটিকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না ঐশ্বর্যের। ব্যক্তিটিটা প্রেম। তবে প্রেমের অঙ্গিভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুটা রেগে আছে। ঐশ্বর্য কিছু বলার আগে প্রেম নিরাশ কন্ঠে বলল,
“আসলে তুমি কি আমার পিছু ছাড়বে না বলে ঠিক করে রেখেছো?”

ঐশ্বর্য একদম নির্লিপ্ত হয়ে বলল,
“এখানে আমি কি করলাম বলুন তো? আমি কি বলেছি নাকি বার বার আপনার সঙ্গে দেখা হতে? হতে পারে আমাদের ভাগ্যটাই এমন। আমাদের চাইছে বার বার দেখা হক। সেটা ভাগ্যকে গিয়ে জিজ্ঞেসা করুন।”

ঐশ্বর্যের এমন কথাতে মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল প্রেমের। এই মেয়ে সবসময় এতো রিল্যাক্সে থাকে কি করে? মানে রাত প্রায় ৯ টা পেরিয়ে গেছে। এতো রাতে এই রাস্তায় একা তাও এভাবে চলাফেরা কি করে করছে?
“আচ্ছা, কাল এতো বড় বিপদ ঘটতে তোমার সঙ্গে। কাল তুমি বোঝোনি? এই দেশ এখনো তোমাদের জন্য একা একা রাতে চলাফেরার যোগ্য হয়নি। আই নো দ্যাট, তুমি বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া মেয়ে। বাট টাইমের দিকেও খেয়াল রাখতে পারো! এতে তোমারই লাভ।”

“আমি কিছু করতে গেলে লাভ লসের হিসেব করি না মি. লাভ আই মিন প্রেম।”

প্রেমের এবার কপাল চাপড়ানোর মতো অবস্থা। মেয়েটা যে শুধু উশৃংখল সেটা নয় অলরেডি প্রেম বুঝে ফেলেছে তাকে জেদি আর একরোখার আওয়ার্ড দেওয়াও যেতে পারে। সে এবার কড়া কন্ঠে বলে,
“গাড়ি কোথায় তোমার?”

“গাড়ি তো সকালেই আপনার সাথে আসার সময় ড্রাইভারকে বলে সেখানে রেখে এসেছিলাম। তারপর গাড়ি কই গেল সেটা তো জানি না।”

বেশ ভাবুক কন্ঠে উত্তর দিল ঐশ্বর্য। প্রেমের মেজাজ গেল চড়ে।
“উফফ… আমি যে কেন তোমার সাথে কথা বলছি কে জানে! আমি যাচ্ছি। তোমার যা ইচ্ছে তাই করো।”

“হ্যাঁ তাই তো করছি।”

প্রেম আর কথা বাড়ালো না। নিজের গাড়ির দিকে ফিরে গটগট করে হেঁটে যেতে লাগল। ঐশ্বর্য সেই পানেই মনোযোগ দিয়ে চেয়ে রইল। লোকটার হাঁটার অঙ্গিভঙ্গিও যেন মারাত্মক। নাকি ঐশ্বর্যের কাছেই তা মারাত্মক লাগছে সেটা বুঝছে না ঐশ্বর্য। নিজের গাড়ির কাছে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো প্রেম। কিছুটা চেঁচিয়ে বলল,
“পরে কোনো বিপদ হলে আফসোস করবে কিন্তু।”

ঐশ্বর্য আবারও দায়সারা ভাবে জবাব দিল,
“আফসোস তো আমি করব। তার জন্য আপনি চিন্তা করছেন কেন?”

প্রেমের মনে এবার উঁকি দেয় এক প্রশ্ন সেটা হলো, সত্যি তো! প্রেম কেন ভাবছে? আজকাল সে অন্যদের নিয়ে বেশি ভাবে। বিশেষ করে এমন মেয়ে যার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই তাকে নিয়ে ভাবার কি দরকার? এদিকে প্রেমের যে অসহ্যকর মাথাব্যাথা শুরু হয়েছে সেটা সে ভুলেই গেছিল। বাড়িতে গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম দিতে পারলে তার শান্তি!

গাড়িতে উঠে বসল প্রেম। গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়েও দিল না সে। তার হাত চলছে না। মন সায় দিচ্ছে না ওই মেয়েটাকে একা ফেলে যেতে। এবার সে গাড়ির জানালা থেকে মাথা বের করে দিয়ে ঐশ্বর্যের উদ্দেশ্যে জোরে জোরে বলল,
“আমি সত্যি চলে যাচ্ছি কিন্তু!”

ঐশ্বর্য এবার চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। শক্ত কন্ঠে বলল,
“তো যান না? আপনাকে মনে হচ্ছে জাপ্টে ধরে আছি?”

এবার প্রেম মনের ওপর জোর খাটিয়েই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলল।
ঐশ্বর্য দুহাত জ্যাকেটের পকেটে গুটিয়ে প্রেমের কান্ড দেখল আর বিরবির করে বলল,
“আজ যদি উনি এখান থেকে চলে যান তাহলে ভাববো উনাকে চিনতে ভুল করেছি আমি।”

কথাটুকু শেষ না হতে না হতেই একটু দূরে গিয়েই থেমে গেল গাড়ি। সেখান থেকে দ্রুত গতিতে নেমে পড়ল প্রেম। ঐশ্বর্যের কাছে এসে দাঁড়িয়ে একপ্রকার ধমক দিয়ে সে বলে উঠল,
“এই মেয়ে যাও গাড়িতে বসো।”

ধমকে কিছুটা চমকে উঠলেও হাসি পেল ঐশ্বর্যের। অথচ প্রেমের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে সে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থায় থাকতো কিনা ঐশ্বর্য জানে না।

“কি হলো কথা শুনতে পাও না নাকি? গাড়িতে উঠো গিয়ে।”

ঐশ্বর্য হাসতে গিয়েও হাসল না। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে উঠল গাড়িতে। পেছন পেছন প্রেমও গিয়ে উঠল। মুখ ফুলিয়ে রেখেছে সে। তার ধারণা ছিল ঐশ্বর্য নিজেই প্রেমকে ডাকবে। কিন্তু সে ভুল ছিল!

ঐশ্বর্য নিজের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামে। নেমে যাওয়ার সময় একবার দেখে নেয় প্রেমের চেহারা। সে বোধহয় অনেকটা ক্লান্ত। সকালে যা তাড়াহুড়ো করছিল! মাথায় ব্যান্ডেজ জ্বলজ্বল করছে। সকালে ঐশ্বর্যের জন্যই তার লেগেছিল ভাবতেই অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন বাড়ির মেইন গেট দিয়ে ঢুকবে ঐশ্বর্য তখনি ডাক পরে প্রেমের। তৎক্ষনাৎ পিছু ফিরে তাকায় সে। প্রেম এগিয়ে এসে ঐশ্বর্যের একটা ব্রেসলেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“গাড়িতে পরে গিয়েছিল। টেক ইট।”

ঐশ্বর্য হাতে নেয় ব্রেসলেট টা। প্রেম ফিরে যায়। যেতে যেতে বিরবির করে বলে,
“আর যেন এই বিপদের মুখ দেখতে না হয়। এই মেয়েটা সবসময় বিপদ নিয়ে আসে আর আমিও তাকে ফেলতে পারি না! ওহ গড, হেল্প মি!”

গাড়ির কাছে এসে পা যেন থেমে গেল প্রেমের। আর চলতে পারছে না সে। কে যেন তাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরেছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো প্রেমের। তখনই তার কানে ফুঁ দিল কেউ। কেঁপে উঠল সে। কানে কানে ফিসফিস করে মেয়েলি কন্ঠ বাজলো।
“সবার মনেই কি এভাবে প্রেম জাগান নাকি? আমার মতো এমন ভয়াবহ এক ব্যক্তিত্ব আপনার মতো একজন সাধারণ ব্যক্তিত্বে কাবু হয়ে গেছে। দেবেন কি জায়গা মনের কুঠুরিতে? আমি ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।”

গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেল প্রেমের। ঐশ্বর্যের কন্ঠ চিনতে দেরি হলেও চিনে ফেলে সে। কষ্ট করে পিছন ফিরতেই হতভম্ব হয়ে যায় সে। আশেপাশে কেউ নেই। ঐশ্বর্যও নেই। তাহলে এতক্ষণ সে কি ভ্রমের মাঝে ছিল? মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে প্রেম নিজমনে বলে,
“সারাদিন অফিস আর ওই মেয়ের ঝামেলায় পরে আমার মাথা পুরোপুরি গিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিতে হবে।”

নিঝুম রাত। চারপাশে কঠিন নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে এলো একটা মন মাতানো সুরে। সিনহা মেনশনের এক খোলা বারান্দায় রেলিং এ ভর দিয়ে এক মারাত্মক সুন্দরী ভায়োলেন বাজাচ্ছে নিজ ছন্দে। হালকা কোঁকড়ানো খোলা চুল হালকা হাওয়ায় নিজ তালে দুলছে। বড় চোখ দুটো বুঁজে রাখা। সে হচ্ছে ঐশ্বর্য। এবার ঠোঁট নাড়িয়ে সে ভায়োলেনের তালে তালে সুর করে গেয়ে উঠল,
“ঠিক এমন এভাবে
তুই থেকে যা স্বভাবে!
আমি বুঝেছি ক্ষতি নেই
আর তুই ছাড়া গতি নেই!
ছুঁয়ে দে আঙ্গুল, ফুটে যাবে ফুল
ভিজে যাবে গা!
কথা দেওয়া থাক
গেলে যাবি চোখের বাহিরে না!”

ভায়োলেন বাজানো থামালো ঐশ্বর্য। এমনিতে সে এসব ভায়োলেন বাজায় না। অনুভবের ভায়োলেন এটা। হঠাৎ আজ যেন মনে রঙ লেগেছে তার। তাই সে অনুভবের ঘর থেকে এনে ভায়োলেন বাজাচ্ছে। মুচকি হেঁসে ঐশ্বর্য বলে,
“আমার এই কঠিন হৃদয় ভেঙে প্রেমে সঞ্চার করেছেন আপনি। এই কঠিন অপরাধে এই ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য আপনাকে ভালোবাসা নামক শাস্তিতে দন্ডিত করবেই করবে।”

চলবে…

[বি.দ্র. ভু্ল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]

লেখিকার গ্রুপ … আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here