প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব ১৮

0
231

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮

“তোমার জায়গা আর আমার জায়গা এক নয় ঐশ্বর্য। তুমি নিজের অনুভূতি দিয়ে আমার কাজকে বিচার করছো। আমার কাজ হারালে আমাদের পথে বসতে হবে। এক্ষেত্রে তোমার আর আমার জায়গা এক নয়।”

কঠোর ভাবে জবাব দেয় প্রেম। তবে ঐশ্বর্য নিজের সিদ্ধান্তে অটল।
“আই লাভ ইউ মি. আনস্মাইলিং!”

প্রেম দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। এই মেয়েকে কোনো কিছুতে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে ঐশ্বর্যের একটু আগে বলা কয়েকটি ওয়ার্ড তার শক্তি কেন জানি না শুষে নিয়েছে। প্রতিত্তোরে কিছু বলার শক্তিটুকু জুগিয়ে উঠতে পারছে না। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“তুমি আমার প্রজেক্ট কেন রিজেক্ট করেছো সেটার কারণ তুমি সবার সামনে বলতে পারো নি। কোনো ভ্যালিড রিজন দেখাও নি। আর কারণ ছাড়া প্রজেক্ট রিজেক্ট করা উচিত না।”

“কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত সেটা দেখে ঐশ্বর্য কাজ করে না। ঐশ্বর্যের মন আর মস্তিষ্ক যেই কথা বলে সেটাই করে। এসব উচিতের কাজ আপনার মতো গুড পারসনের জেনে নেওয়া উচিত। আমার মতো ব্যাড গার্ল যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।”

“তার মানে তুমি কোনো মতেই আমার প্রজেক্ট কনফার্ম করবে না?”

“নেভার এভার!”

প্রেম এবার অগ্নিশর্মা হয়ে বলে,
“কি চাইছো কি তুমি?”

“আপনার অসহায়ত্ব দেখতে।”

প্রেম আর কিছু বলে না। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে। অতঃকর কিছুক্ষণ নিরব থেকে প্রশ্ন করে,
“এতো নিষ্ঠুরতা কি করে দেখাও?”

ঐশ্বর্য হাসে। কিছুটা শব্দ করেই হাসে। হাসি থামিয়ে অদ্ভুত মোহনীয় গলায় বলল,
“নিষ্ঠুরতা তো আমার জন্মের স্বভাব। এটা কখনো যাবেনা। আপনার জন্য হয়ত একটু হলেও মনে মায়া আনতাম। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। আমি তো এমনিই নিষ্ঠুর। কিন্তু আপনি তো ভালো মানুষ। তবে আপনি কেন পাথর? আমার প্রতি এমন নির্বিকার কেন?”

“মাঝে মাঝে নির্বিকার হতে হয়। নিজের জন্য নয় নিজেরই আপনজনের জন্য। না চাওয়া সত্ত্বেও তা করতে হয় যার জন্য আমি রাজি নই। তোমার জীবনে হয়ত এমন বাধ্যবাধকতা নেই বা মানো না। কিন্তু আমাকে মানতে হয়।”

“যেটা আপনার ইচ্ছেতে হয় না সেটাতে কেন সায় দেয় মি. আনস্মাইলিং?”

প্রেম স্মিত হেসে বলে,
“কেন জানি না তাদের খুশি দেখতে ভালো লাগে। লেট ইট গো! আমি যাচ্ছি। গুড লাক ফর ইউ!”

ঐশ্বর্য কিছু বলে না আর। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রেম ফিরে যাচ্ছে। এলোমেলো তার চলন। ঐশ্বর্যের ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার তৈরি করা স্বপ্ন রাজ্য যেটা সে কল্পনায় প্রেমের সঙ্গে সাজিয়েছিল।

রাত প্রায় বারোটা বাজছে। শুনশান রাতে গাছের পাতাগুলোর শব্দ আর বাতাসের শনশন শব্দ চারিদিকে উন্মাদনা সৃষ্টি করছে। তীব্র বাতাসে উড়ে উড়ে উঠছে জানালায় থাকা পর্দাগুলো। ঐশ্বর্য উপুড় হয়ে শুয়ে এক ধ্যানে জানালা দিয়ে বাহিরের বিশাল আকাশের দিকের তাকিয়ে আছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। শীতের মাঝে ঘনঘন বর্ষা এই সময়টাকে অন্যরকম করে দিচ্ছে। ঐশ্বর্য গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছে।

বাতাসে গা শিরশিরে অনুভূতি দিলে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ঐশ্বর্য। বিরক্তির রেশ টেনে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা লাগিয়ে দিতে যায় সে। এরই মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পর্দা এক ঝটকায় টানতেই বাহিরের সদর দরজায় কারো অবয়ব দেখে ভ্রূকুটি কুঁচকে ফেলে ঐশ্বর্য। ভালো করে লক্ষ্য করে সে। তার পক্ষে অন্ধকার জায়গা ভালো করে দেখে ফেলা অসম্ভব কিছুই নয়। চকিতে বলে ওঠে,
“প্রেম! এখনো এখানেই রয়েছেন?”

নিজের শক্তি প্রয়োগ করে হুট করেই দ্রুত গতিতে বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে পৌঁছে ঐশ্বর্য। আশেপাশে কোনো ওয়াচম্যান নেই। বৃষ্টির কারণে হয়ত গ্যারেজে গিয়েছে। ঐশ্বর্যের হাতে ছাতা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে আকাশ গুড়গুড় শব্দ করছে। আশেপাশের পরিবেশ অন্যরকমভাবে যেন উল্লাসিত হয়ে পড়েছে। প্রেমের গাড়ি সামনেই দাঁড় করানো। অথচ প্রেম এখনো বাড়ি যায়নি। বা গাড়িতে গিয়েও বসেনি। সমানে ভিজে যাচ্ছে তাতে যেন প্রেমের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

চাবি দিয়ে দরজা খুলল ঐশ্বর্য। ক্যাচক্যাচ শব্দ হলো। তবুও যেন প্রেমের কোনো খেয়াল নেই। সে হারিয়ে গেছে যেন অন্য জগতে। বাহিরে এলো ঐশ্বর্য। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল প্রেম কাকভেজা হয়ে গিয়েছে একেবারে। দ্রুত এগিয়ে এসে হাত উঁচু করে ছাতা ধরল সে। তবুও কোনোরকম হেলদোল নেই প্রেমের। সে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে। ঐশ্বর্যের কপালে চিন্তার রেশ ফুটে ওঠে। সে বলে ওঠে,
“আপনি এখনো এখানে বৃষ্টির মধ্যে কি করছেন? বাড়িতে যান নি কেন?”

প্রেম এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ঐশ্বর্যের পানে। তার দৃষ্টি পলকহীন। মুখটা ফ্যাকাশে। প্রেমের চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। যা দেখে বেশ খানিকটা ভড়কে যায় ঐশ্বর্য। প্রেম শুধু চেয়েই থাকে তার দিকে। কোনো শব্দ মুখ থেকে বের করে না। ঐশ্বর্য কাতর গলায় বলে,
“আপনি তো অনেকটা ভিজে গেছেন। শরীর খারাপ করবে আপনার। বাড়ি যান।”

“কোন মুখে বাড়ি যাব? বাড়িতে যাওয়ামাত্র বাবা জিজ্ঞেস করবে ডিলের কি হলো? তখন আমি উত্তর দেব?”

রোবটের ন্যায় বলে ওঠে প্রেম। ঐশ্বর্যের অন্তর কেঁপে ওঠে। প্রেম পিছুপা হতে চেয়ে তার এলোমেলো পায়ের ধাপ দেখে বুঝে যায় সে নিজের মাঝে নেই। প্রেম পড়ে যেতে নিলে তার হাত ধরে ফেলে ঐশ্বর্য। প্রেম পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়। তার মাথা ঘুরছে। চারিদিকটা ঘোলাটে দেখছে। ঐশ্বর্যকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না সে। ঐশ্বর্য চিন্তিত সুরে বলে,
“আমি তো আমার বাবাকে বলেই দিয়েছি কালকের মধ্যে যেন আবার মিটিং করে আপনাদের কোম্পানির সাথে। আমি তো শুধু দেখাতে চেয়েছিলাম নিজের প্রিয় জিনিস হারিয়ে ফেললে ঠিক কেমন লাগে। আমি আপনার এমন অবস্থা দেখতে চাইনি।”

ঐশ্বর্যের সব কথা প্রেমের কানে পৌঁছায় না। ও নিজের মাঝেই নেই। ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারছে না। ঐশ্বর্য হাত ধরে রেখেছে প্রেমের ভিজে হাত। প্রেমের এমন অবস্থা দেখে সে অসহায় নয়নে চেয়ে বলল,
“আপনার অবস্থা ভালো নয়। আগে আমার বাড়ি চলুন। ভিজে শরীরে থাকলে আরো প্রবলেম হয়ে যাবে। পরে নিজের বাড়ি যাবেন।”

কোনো জবাবই দিল না প্রেম। শুধু ঢুলতে থাকল। ঐশ্বর্য প্রেমের হাত নিজের বাম কাঁধে রেখে প্রেমকে নিজের কাছে টেনে নেয়। প্রেমকে একহাত দিয়ে বেশ কষ্ট করে ধরে বলে,
“উফফ… এতো মোটা হতে কে বলেছে? ধরে নিয়ে যাব কি করে এখন?”

প্রেম সরে আসতে চাইলেও পারে না। সারাদিন না কিছু মুখে দেয়নি সে। পানি অবধি না। সবশেষে এমন দুর্বল অবস্থায় বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল অবস্থায় সে। অনেক কষ্ট করে প্রেমের বলিষ্ঠ দেহের সমেত বেশ চোরের মতো লুকিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল ঐশ্বর্য। অতঃপর প্রেমকে বেডে শুইয়ে দিল সে। প্রেম নিভু নিভু চোখে চারিদিক দেখছে। কথা বলার মতো জোর নেই মুখে। ঐশ্বর্য রুম থেকে বেরিয়ে আশপাশটা দেখে নিল ভালো করে। হঠাৎ করে সে গোল গোল করে তাকালো এলিনার দিকে। এলিনা বিপরীত করিডোরে হাতে খাবার নিয়ে ঐশ্বর্যের ঘরের দিকে আসছে। এলিনা ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। মাধুর্য ও অনুভব ভ্যাম্পায়ার কিংডমে গেছে। এখন এলিনাকে কি করে ম্যানেজ করবে সে? ঢক গিলে তাড়াহুড়ো করে দরজা লাগিয়ে দেয় ঐশ্বর্য। বড় বড় শ্বাস ফেলে প্রেমের দিকে তাকায়। প্রেম মৃদু কাঁপছে। হয়তবা ঠান্ডায়! পরনে এখনো ভিজে জামাকাপড়। ঐশ্বর্যের দৃষ্টি মলিন হয়ে আসে।

হাতে টাওয়াল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রেমের পাশে বসল। বেশ মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকালো মানুষটার দিকে। চুল ভিজে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। কপালে এক হয়ে আছে চুল। মুখমন্ডলে পানির একেকটা বিন্দু চিকচিক করছে। চাপ দাড়িতেও পানির বিন্দু লেগে রয়েছে। কাপড় গায়ের সাথে লেগে গেছে। দেরি না করে বেশ আদুরে ভঙ্গিতে প্রেমের চুলে টাওয়াল রাখে ঐশ্বর্য। আস্তে আস্তে করে মুছতে থাকে প্রেমের চুল। তারপর তার মুখ আস্তে করে মুছে দিয়ে নিজমনে বলে,
“জানেন, কোনোদিন এভাবে কারো সেবা করিনি। আজকে হঠাৎ করছি। আর করে এক অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছি। যেন এটা যদি সারাজীবন করতে পারি তাহলে এর থেকে বেশি আনন্দের যেন আমার কাছে কিছুই নেই।”

ঐশ্বর্য থামে। আবারও বলে,
“আপনি অত্যন্ত মোহনীয় একজন ব্যক্তি প্রেম। যার মোহতে ডুবে গেলে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না। যাকে না ভালোবেসে থাকা যাবেনা!”

এবার ভিজে জামাকাপড়ের দিকে চোখ যায় ঐশ্বর্যের। তিক্ত সুরে বলে,
“উহু, এখন এই জামাকাপড় কি করে কি করব? আপনার তো ঠান্ডা লাগবে।”

তারপর ঐশ্বর্যের খেয়ালে আসে প্রেমের হুঁশ নেই। সে নিজের কপাল চাপড়ে বলে,
“আমি কার সঙ্গে কথা বলছি? আমি তো পাগল হয়ে গেছি!”

তখনি দরজায় টোকা পড়তেই ঢক গিলে দরজার দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকালো। এলিনা বাহির থেকে বলল,
“প্রিন্সেস! তোমার খাবার নিয়ে এসেছি।”

ঐশ্বর্য জবাব দিলো না। চুপটি করে রইল। জবাব না পেয়ে আবারও দরজায় কড়া নাড়ে এলিনা। তবুও জবাব দেয় না ঐশ্বর্য। আবারও দরজায় জোরে কড়া নাড়তেই ঐশ্বর্য গলা খাঁকারি দিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠ করার চেষ্টা করে বলে,
“ওহ হো এলিনা! ঘুমোচ্ছি আমি। ডোন্ট ডিস্টার্ব অ্যান্ড গো!”

“কিন্তু ডিনার করলে না যে!”

“একদিন না খেলে কেউ মরে যায় না। ঘুম আমার জন্য এখন বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। যাও তো এখন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

পায়ের ধাপ ফেলার তীব্র শব্দ পেলো ঐশ্বর্য। এর মানে এলিনা চলে যাচ্ছে। হাফ ছেড়ে নিশ্বাস ফেলল ঐশ্বর্য। অতঃপর গাঢ় দৃষ্টিতে প্রেমের দিকে তাকালো।
“আপনার জন্য মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে।”

বেশ সাহস নিয়ে এবার প্রেমের গায়ের শার্টের বোতামের দিকে হাত বাড়ালো ঐশ্বর্য। কি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! নিশ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে। তবুও একটা বোতাম খুলল ঐশ্বর্য। তারপর দ্বিতীয় বোতাম খুলতেই নিজের চোখ চেপে ধরল ঐশ্বর্য। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল সে। এতোক্ষণ যেন শ্বাস নিতে পারছিল না। চোখ চেপে তাড়াতাড়ি বাহিরে চলে এলো সে।
“আমার দ্বারা হবেনা।”

ঐশ্বর্য তার বাবার একটা টিশার্ট আর প্যান্ট নিয়ে এলো। একজন স্টাফের হাতে তুলে দিয়ে শ্বাসিয়ে বলল,
“ভেতরে একজন শুয়ে রয়েছে তাকে চেঞ্জ করিয়ে দাও।”

স্টাফ মাথা নিচু করে নেড়ে ঐশ্বর্যের রুমের দিকে পা বাড়াতে গেলেই ঐশ্বর্য শ্বাসিয়ে বলে,
“আর আমার রুমে যে কেউ আছে এই কথা যদি অন্য কারো কানে যায় তাহলে বুঝতেই পারছো কি হতে পারে! বি কেয়ারফুল ওকে?”

স্টাফ ঘাবড়ে বলল,
“কেউ জানবে না।”

প্রেমকে চেঞ্জ করিয়ে দেওয়া শেষে এবারও গিয়ে প্রেমের কাছে বসল ঐশ্বর্য। লোকটার এমন অবস্থার জন্য নিজের রাগ আর জেদকে দায়ি করল ঐশ্বর্য। তার চোখে অশ্রুর দেখা মিলল। আচমকা প্রেমের ঠান্ডা হাত ধরে নিজের কাছে হাতটা নিয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,
“আই এম সরি মি. আনস্মাইলিং। আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি।”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। আর ঐশ্বর্যের চরিত্রটাই এমন। রাগ, জেদ দিয়ে পরিপূর্ণ। সেটা আশা করি ভুলছেন না।]

লেখিকার গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here