প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব ১৫

0
248

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৫

ঐশ্বর্যের মিনতি ফেলতে পারল না প্রেম। তবে মুখে কিছু না বলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। ঐশ্বর্য দুর্বল ভঙ্গিতে পিটপিট করে তাকিয়ে রয়েছে। এই চাহনি আর এই মিনতি ফেললে যেন প্রেম আফসোসে মরে যাবে। মৃদু কাঁপছে সে। কারণটা হয়ত ঐশ্বর্যের হাতের ঠান্ডা স্পর্শ। সব অনুভূতির সীমা অতিক্রম করে ঐশ্বর্যের হাত ছাড়ালো প্রেম। ঐশ্বর্যের মুখ পরক্ষণেই ভার হয়ে এলো। প্রেম দুই ধাপ এগিয়ে গেল ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। ঐশ্বর্য বুঝে গেল প্রেমের কাছে অনুরোধ করা বৃথা! তবে সে আশ্চর্য নিজের প্রতি! যে ঐশ্বর্য সারাজীবন শুধু হুকুম আর আদেশ চালিয়েছে। সবার ওপর ছুরি ঘুরিয়েছে সেই ঐশ্বর্য আজ একটা পুরুষের কাছে হার মেনেছে। বিষণ্ণ মনে অন্যদিকে ফিরতেই হঠাৎ প্রেমকে ফিরে আসতে দেখে পুলকিত নয়নে চাইলো সে। সেই নজর এড়ালো না প্রেমের। মেয়েটা এমন কেন? অল্পতেই তার মুখে রাশি রাশি খুশি ফুটে ওঠে। আজ যেন এই খুশি দেখার জন্য হলেও হয়ত এখানে কিছুক্ষণের জন্য থেকে যাবে!

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ঐশ্বর্যের পাশের চেয়ারে বসল প্রেম। বরাবরের মতো গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
“লাভটা কি হলো? এই কনকনে ঠান্ডায় বৃষ্টিতে ভিজে শুধু নিজেরই ক্ষতি করলে।”

“লাভ ক্ষতির হিসেব যদি ধরে থাকেন তবে বলব কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার সঙ্গ পাচ্ছি। এটাই আমার লাভ। এখন যদি আমি সুস্থ থাকতাম তাহলে কি আমার কথা রাখতেন? আমি জানি রাখতেন না। রাগ দেখিয়ে হয়ত চলে যেতেন। সাথে আমি যে পাগল, আমার কমন সেন্স নেই ইত্যাদি ইত্যাদি জ্ঞান দিয়ে চলে যেতেন।”

প্রেম এর উত্তরে কি বলবে তা খুঁজে পেল না। তাও আগের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,
“আমার এতটুকু সঙ্গ পেয়ে তুমি কি পাবে?”

“মানসিক শান্তি, একটা অদ্ভুত ভালো লাগা, এতটুকু সময়ে আমার সর্বোচ্চ সুখ পাওয়া হবে। এতটুকু বলে নিজেকে শান্তনা দেওয়া হবে যে আপনি আমার জন্য একটু হলেও ভাবেন। আমি জানি, আপনি সব মানুষের জন্যই হয়ত এতোটাই ভাবেন। আপনার মতো ভালো মানুষ পাওয়া আজকাল ভাগ্যের ব্যাপার। সেক্ষেত্রে আপনার দেখা পেয়ে নিজেকে লাকি মনে করতে পারি। আপনাকে পাই বা না পাই তবুও যতটুকু সময় আপনি আমাকে দিয়েছেন ততটুকু সময় নিয়ে না হয় স্মৃতি হয়ে থাকলো!”

প্রেম এবার কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকায়। মেয়েটার হলো কি? আজকে হঠাৎ এমন কথাবার্তা বলছে কেন? প্রেমের বুঝতে সময় লাগল যে তার সামনে থাকা মেয়েটা আদেও ঐশ্বর্য কিনা! প্রেমকে এভাবে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঐশ্বর্য দুর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমি আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি না? অনেক ডিস্টার্ব করেছি আবার অনেক ক্ষতি করেছি আপনার!”

“তা তো একটু জ্বালিয়েছো বটে। হঠাৎ এই প্রশ্ন করছো?”

“ভাবছি, আপনাকে আর বিরক্ত করব না। এতোদিন সবসময় চেয়েছি কিভাবে আপনার এটেনশন পাব। বাট পাইনি। হয়ত পাবোও না। তার থেকে আপনাকে বিরক্ত এভাবে বিরক্ত না করাই ভালো কি বলেন?”

প্রেম খানিকটা চমকে তাকালো। ঐশ্বর্য অদ্ভুত হেঁসে তাকিয়ে আছে। আজ কি হলো তার? হঠাৎ এমন কথাবার্তা যেন মানায় না ঐশ্বর্যের মুখে। তবুও প্রেম নিজেকে আগের মতো শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
“হঠাৎ মাথায় এই সুবুদ্ধি কোথা থেকে এলো?”

“কেন? আপনার কি মনে হয়? আমার মাথায় শুধু কুবুদ্ধি থাকে?”

প্রেম একটু ভাবুক হওয়ার ভঙ্গি করে বলে,
“হুমম সেটা তো ভেবেছিলাম। কিন্তু তোমার মাথায় দেখি সুবুদ্ধিও আছে!”

“হয়তবা সেটা আপনার দৌলতেই পেয়েছি।”

প্রেম আর প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। ঐশ্বর্যের দিকে একটু ঝুঁকতেই জড়োসড়ো হলো ঐশ্বর্য। গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইল প্রেমের দিকে। প্রেম হাত বাড়িয়ে ঐশ্বর্যের কপালে হাত ছোঁয়ালো। সাথে সাথে কম্পন ধরে গেল ঐশ্বর্যের সারা শরীরে। চোখ বন্ধ করে নিল সে। অন্তর কাঁপতে লাগল। প্রেম মুখ ফ্যাকাশে করে বলল,
“জ্বর এখনো রয়েছে। কিন্তু আগের থেকে কমেছে।”

“তা তো কমবেই। মায়ের সেবা পেয়েছে। মাকে অশান্তি দিলে তো তার শান্তি হয়।”

মাধুর্যের কড়া কন্ঠে দরজার দিকে চেয়ে তাকায় ঐশ্বর্য। সেই সাথে প্রেমও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ঐশ্বর্য জানে এখন তার মা তাকে ভারি ভারি কথা শোনাবে। ঐশ্বর্যের কাছে এসে মাধুর্য বসে পড়ল। হাতে রুমাল আর পানির বাটি। রুমাল পানিতে ভিজিয়ে ঐশ্বর্যের মাথায় রুমালটা দিয়ে মাধুর্য ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“আমাকে অশান্তি না দিলে তোমার তো শান্তি হয় না তাই না? এই অসুস্থ শরীর নিয়ে রাতের বেলায় সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে কেন গিয়েছিলে বাহিরে? আমি তোমাকে বাহিরে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তাও কেন গিয়েছিলে? আমার একটা কথাও কি শুনবে না তুমি? এটা কি প্রতিজ্ঞা করে রেখেছো?”

ঐশ্বর্য কিছু বলল না। শুধু প্রেমের দিকে তাকালো। শুধুমাত্র এই ব্যক্তিটার টানে সে ছুটে গিয়েছিল। মাধুর্য আবারও বলতে শুরু করে,
“বলো কেন বাহিরে গিয়েছিলে? আজকে যদি প্রেম তোমাকে বাড়ি অবধি না নিয়ে আসতো তাহলে কি হতো তোমার ভেবে দেখেছো?”

এবার ফট করে ঐশ্বর্য নির্বিকার হয়ে উত্তর দিল,
“উনাকে তো নিয়ে আসতেই হতো মা। নয়ত উনি কোথায় যেতেন?”

এবার ভ্রুযুগল কুঁচকে চেয়ে রইল মাধুর্য। সন্দেহি হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মানে? তোমরা কি আগের থেকে চেনো দুজন দুজনকে?”

“হ্যাঁ। আমরা আগের থেকে চিনি দুজন দুজনকে। ঐশ্বর্যের যখন এক্সিডেন্ট আই মিন ওর মাথায় আঘাত লাগে আমি তখন ওকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার একটা রিকুয়েষ্ট আছে আপনার কাছে! আপনার মেয়ে অনেকটা জেদি। আর এভাবে এতো রাতে বের হওয়া ওর জন্য সেফ নয় এটা ওকে বোঝাবেন। আমি যদি আজকে না আসতাম তাহলে কি হতো আমি জানি না। তাই ওকে সাবধান করবেন।”

“থ্যাংক ইউ প্রেম। আই নো তোমাকে থ্যাংকস দিলে ছোট করা হবে। বাট থ্যাংকস বলা ছাড়া আর কিছু পাচ্ছি না। আমার মেয়েটা কারো কথা শোনেনা এটা হয়ত এতোক্ষণে বুঝে গেছো। আগের বার তোমার সাথে দেখা হয়নি। বাট আজকে দেখা হয়ে গেল। দুইবার ঐশ্বর্যকে বাঁচিয়েছো তুমি। যদি তোমার কখনো আমার হেল্প লাগে অবশ্যই বলবে।”

প্রেম নম্র সুরে বলে,
“এটা আমার দায়িত্ব ছিল। আমি এখন আসছি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হয় এখন যাওয়া দরকার। নয়ত মা টেনশন করবে।”

মাধুর্য আর মানা করল না। রাত প্রায় তিনটে ছুঁইছুঁই। এবার সত্যিই প্রেমের বাড়ি যাওয়া দরকার। কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছিল সে। যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল প্রেম। ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল,
“টেক কেয়ার!”

আর তাকালো না প্রেম। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। হয়ত ঐশ্বর্যের ওই মারাত্মক চোখের চাহনি ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হতো প্রেম। সেকারণেই আর তাকায় নি। তাছাড়া ঐশ্বর্য তো বলল সে আর এভাবে ডিস্টার্ব করবে না প্রেমকে। এর মানে হতে পারে এটাই তাদের শেষ দেখা!

মাধুর্য এগিয়ে দিতে যায় প্রেমকে। ঐশ্বর্য অন্যদিক ফিরে নিজের কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকে। সবকিছু গোলমেলে লাগছে। মনে হচ্ছে মানুষটার মন পাবে না সে। সে অন্যকারো হতে চাইছে। এর মাঝে ঐশ্বর্যের স্থান কোথায়? নেই কোথাও নেই! তার ওপর কয়েকদিনের মাঝে সে ভুলে গিয়েছিল সে একজন ভ্যাম্পায়ার। শুধু তাই নয় সে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। তার একটা সাধারণ মানুষের স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। প্রেম যদি কখনো জানে সে ভ্যাম্পায়ার কখনো তাকে মানবে না। তার থেকে কি সরে আসা উচিত না? এসব ভেবে ঐশ্বর্য দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

“আমি ভুল ব্যক্তির দিকে হাত বাড়িয়েছি। যার সঙ্গে আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমি আর সে আলাদা। সে মানুষ। অ্যা গুড পারসন। আর আমি মানুষও না আবার ভালোও না। দুনিয়ার সব খারাপ যেন আমার মধ্যেই লুকায়িত মনে হয়। কেন এমন মনে হয়?”

চোখের কার্নিশ বেয়ে আচমকা টুপ করে অশ্রু পড়ল। বালিশে পড়ল অশ্রুকণা। চোখমুখ খিঁচে কেঁদে ফেলল সে। গুমরে কাঁদার শব্দ হতেই এলিনার কন্ঠস্বরে কিছুটা চমকে তাকালো ঐশ্বর্য। নিজের প্রচেষ্টায় উঠে বসল সে এলিনাকে দেখে। এলিনা দরজার কাছে হা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিস্ময় যেন দুচোখ থেকে যাচ্ছেই না। ঐশ্বর্য এলিনার এমন ভঙ্গি দেখে গমগমে আওয়াজে বলল,
“কি হলো? এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভূত দেখেছো নাকি?”

“তার থেকেও বেশি কিছু দেখেছি।”

“কি দেখেছো?”

হুড়মুড় করে ঐশ্বর্যের কাছে এসে ধপ করে বসে এলিনা। ঐশ্বর্যের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,
“এটা কি তুমি প্রিন্সেস? তুমি কাঁদছো?”

“কেন? কাউকে কাঁদতে প্রথমবার দেখলে?”

এলিনা বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে,
“তোমাকে আমি জীবনে প্রথম কাঁদতে দেখলাম। তোমাকে জন্ম থেকে দেখছি আমি প্রিন্সেস। তোমার জন্মের সময়ও তোমায় কাঁদতে দেখা যায়নি। ডক্টর ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যে তোমার মতো একটা বেবি কি করে না কেঁদে সুস্থ থাকতে পারে? তারপর তোমাকে ছোট থেকেও কাঁদতে দেখিনি। শুধু রাগতে দেখেছি আর অদ্ভুত ভাবে হাসতে। সেই তুমি কাঁদছো? কেন? এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?”

এবার ঐশ্বর্য খেয়াল করে ব্যাপারটা। সত্যিই তো! সে কাঁদছে! চোখের অশ্রু মুছে সে বলল,
“আমি নিজে নিজেকে কষ্ট দিয়েছি। আমার নিজের পরিচয় আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আমি যাকে ভালোবাসি এই পরিচয়ের জন্য তার আর আমার মাঝে কোনোরকম বন্ধন তৈরি করতে পারে না।”

“কেন হতে পারে না? কেন এই পরিচয় তোমার ভালোবাসায় বাঁধা হবে?”

ঐশ্বর্য এবার এলিনার দিকে হতবাক চাহনি নিয়ে তাকায়। এলিনা বলতে শুরু করে,
“মানুষ সবথেকে শ্রেষ্ঠ জীব। আমার ভ্যাম্পায়ার কিংডমে একজন আছে যে মানুষকে বিয়ে করেছে আর ভালোবেসেছে। এতে পরিচয় কোনো বাঁধা দেয় না। ভালোবাসা তোমার থাকবে প্রিন্সেস। তুমি যদি সত্যি তাকে ভালোবাসো তাহলে এই পরিচয় সেখানে বাঁধা হবে না।”
ঐশ্বর্য এবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোনোকিছু গভীরভাবে ভাবতে থাকে সে।

বাড়িতে এসেই নিজের হাতে থাকা ঘড়ি আর গায়ে থাকা ব্লেজার ছুঁড়ে ফেলে দিল প্রেম। মেজাজ চড়ে গেছে তার। আজকে সে পরিকল্পনা করে এসেছিল যে পরিবারের সবাইকে বলবে যে সে এখন বিয়ে করতে পারবে না। তার মত নেই। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল তার বাবা। তার বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিল বিয়ের কথাবার্তা হয়ে গেছে আর এক সপ্তাহ পর বিয়ের আয়োজন শুরু করা হবে। আর রোজের ফ্যামিলির সাথে বিজনেস ডিলিং এর কারণে বিয়েতে না করতে পারবে না প্রেম। সবকিছু বিগড়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আর ঐশ্বর্য? সে কি সত্যিই এবার থেকে আর দেখা দেবে না?

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। পরের পর্বে চমক আসতে চলেছে।]

লেখিকার গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here