প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব ১৩

0
223

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৩

পুরো দুইদিন কেটে গেছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ত সব রুটিনে নিজেকে আবার আগের মতো করে নিয়েছে প্রেম। তার একটাই কাজ! অফিস যাওয়া আর কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। তবে এবার কাজের চাপটা বেশিই। প্রেমের বাবা এবার নিজের সব দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়ে সব দায়িত্ব ছেলের ওপরে দিয়েছেন। এবার কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করে প্রজেক্ট সহ প্রেজেন্টেশন করা হয়েছে। নামি-দামি ইন্ডাস্ট্রির সাথে ডিল ফাইনাল করতে হবে। একবার ডিল ক্যান্সেল করলে সব শেষ। তাই নিজেকে সমান ভাবে কাজে সময় দিচ্ছে প্রেম। কাজের ফাঁকে গতকাল গিয়েছিল হসপিটালে। ঐশ্বর্য মেয়েটার একটু দেখা পেতে। এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গিয়েছে। না দেখলে মন থেকে খচখচানি যায় না। তবে দুর্ভাগ্যবশত সে দেখা পায়নি ঐশ্বর্যের। তারপর থেকে কেমন জানি হতাশা কাজ করছে প্রেমের মাঝে। তবে কাজে সেটা ভুলতে বসেছে। আর মনে এই শান্তনা দিয়েছে যে, মেয়েটা হয়ত নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছে। ওর মা-বাবা নিয়ে গিয়েছে। আর দেখা হবার কোনো সম্ভবনা নেই।

চারিদিকে পিনপিনে নিরবতা। বড় রাস্তায় শাঁই শাঁই করে মাঝেমধ্যে দ্রুত গতিতে গাড়ি চলেছে। শীতটা বেশ ভালোই পড়েছে এবার। রাতে কুয়াশায় এপাশ ওপাশ দেখা অনেকটা মুশকিল। রাস্তায় একপাশে বড় বাগানের সরু রাস্তা বেরিয়ে পাশাপাশি দুটো বড় বড় বিল্ডিং। বিল্ডিং এর ওপরে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘The Sheikh Industry’। নামটাতে লাল লাইট জ্বলছে। সামনের বিল্ডিং এর গেট থেকে বের হতে দেখা হলো এক কালো কোট পরিহিত ব্যক্তিকে। ঘাড় এদিক ওদিক বাঁকিয়ে সোজা হাঁটতে থাকল সে। সামনে দাঁড় করানো আছে তার গাড়ি। যেতে যেতে নিজের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকালো প্রেম। ব্যক্তিটি প্রেম। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এট লাস্ট এতো রাতে কাজ শেষ হলো। আই হোপ এতো পরিশ্রমের ফল সুইট হবে। সিনহা ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে কেউ না করতে পারবে না।”

গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে গাড়ির লক খুলতে চাইতেই প্রেমের খেয়ালে এলো লক করা নেই গাড়িতে। সেই সাথে গাড়ির ভেতর থেকে গানের আওয়াজও আসছে। পরক্ষণেই সন্দেহ হলো প্রেমের। সাথে সাথে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে দ্রুত গাড়ির দরজা খুলল সে।

চক্ষুদ্বয় কপালে উঠল এবার প্রেমের। চরম বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বলল,
“তুমি? এখানে? আমার গাড়িতে? কি করে?”

গাড়িতে অনবরত গান বদলিয়ে চলছিল ঐশ্বর্য। চোখেমুখে ছিল বিষাদ। তবে চেহারার পরিবর্তন হয়েছে। চোখমুখ বসে গিয়েছিল একেবারে মেয়েটার। তা বদলে আবার সেই উজ্জ্বলতা ফিরেছে তা চোখজোড়া ঝলসে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেই আর্কষণ আছে ঐশ্বর্যের চোখে যখন যার দিকে তার চাহনি থাকবে তখনই তার মাঝে কম্পন সৃষ্টি হতে বাধ্য। তবে প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। ও কোনোদিন ঐশ্বর্যের চোখের দিকে চোখ রেখে তাকায় নি। কোনোদিন ঐশ্বর্যের সেই চাহনির স্বীকার হয়নি। এবার ব্যাপারটা উল্টো। ঐশ্বর্য প্রেমের চাহনির স্বীকার হয়েছে। নিজের কঠিনতম মনকে ছিন্নভিন্ন করে তৈরি করেছে নতুন এক মনের। ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেসের মনে উদ্ভব হয়েছে ভালোবাসার। কিন্তু প্রেম? তার মনে কি কোনোদিন ভালোবাসার উদ্ভব হবে ঐশ্বর্যের জন্য?

বিরক্তি প্রেমের কন্ঠে পরক্ষণেই কেটে যায়। ঐশ্বর্যের চোখেমুখে ফুটে ওঠে উৎফুল্ল। অতঃপর নির্বিঘ্নে উত্তর দেয়,
“ইটস অ্যা ম্যাজিক মি. আনস্মাইলিং! এসব আপনার মাথায় ঢুকবে না। আপনার মাথায় তো কাজের চিন্তা গুঁজে রাখা।”

ঐশ্বর্যের এমন উত্তর শুনে আরো অস্থির প্রেম। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“তুমি এখানে কেন? তাও এতো রাতে। তোমার তো এখন নিজের বাড়িতে রেস্ট নেওয়া উচিত। এতো রাতে করছোটা কি তুমি বাড়ির বাহিরে? এমনিতে এর আগেও বলেছিলাম মেয়েদের এতো রাতে বাহিরে থাকা সেফ নয়। আর এটা লোকে ভালো চোখে দেখে না।”

“লোকের কথা বাদ দিন। কে কি বলল, কে কি করল আই ডোন্ট কেয়ার। বাঙালি জাতির সো কলড স্বভাবে এতো পাত্তা দিতে নেই।”

“সে না হয় বুঝলাম। বাট তুমি এতো রাতে আমার অফিসের সামনে করছো টা কি?”

এবার প্রেমের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো ঐশ্বর্য। প্রেমের দৃষ্টি গেল ঐশ্বর্যের কপালে। এখনো বেশ মোটাসোটা ব্যান্ডেজ ওর মাথায় পেঁচিয়ে রাখা। যা চুলের ওপর দিয়ে বাঁধা। এলোমেলো কোঁকড়ানো ঢেউ খেলানো চুল এদিক ওদিক নেতিয়ে পড়ে আছে। প্রেমকে চমকে দিয়ে ঐশ্বর্য এক ঘোর লাগানো কন্ঠে ঐশ্বর্য বলে উঠল,
“ধরে নিন, আমি এক অসহায় তৃষ্ণার্ত পথিক। যে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে এখানে ছুটে এসেছে। সেই তৃষ্ণা আর সেই ছটফটে মন শুধু আপনাকে দেখে শান্ত হবে।”

প্রেম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর একটু নিচু হয়ে গাড়ির ভেতরে হেলতেই হকচকিয়ে উঠল ঐশ্বর্য। তৎক্ষনাৎ প্রেম হাত বাড়িয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে এগিয়ে দিয়ে উৎকন্ঠা হয়ে বলল,
“এই নাও পানি। তৃষ্ণার জন্য এতোদূর আসতে হয়েছে কেন? তোমার বাসায় পানি নেই? সাপ্লাই বন্ধ নাকি? বাহিরে থেকে কিনে নিতে পারতে। তোমাকে দেখে তো বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া মেয়ে বলেই মনে হয়। পানির জন্য এতোদূর ছুটে আসতে হলো? টেক দিস।”

চিকন ও সুগঠিত ওষ্ঠদ্বয় আপনাআপনি হা হয়ে গেল ঐশ্বর্যের। থম মেরে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ঠোঁট উল্টে নিজের মাথা চাপড়ে ওপর দিকে তাকিয়ে বলল,
“এ আমি কার প্রেমে পড়েছি! এতো প্রেম নয় আস্ত একটা নিরামিষাশী!”

প্রেম ভ্রু কুঁচকাতেই ঐশ্বর্য ঝাঁঝালো গলায় বলে,
“আমি আপনার কথা বলছিলাম মি. অপ্রেম!”

প্রেমের বুকের হাত রেখে একটু ধাক্কা দিতেই সর যায় প্রেম। গাড়ি থেকে বেরিয়ে চোখ ছোট করে তাকায় ঐশ্বর্য। এবার তার বড়সড় আফসোস হচ্ছে। এ কার পাল্লায় পড়েছে সে?

প্রেম এবার ভুলটা বুঝে গলা খাঁকারি দেয়। গম্ভীর হয়ে বলে,
“তুমি আমার গাড়ির লক খুললে কি করে? আমার গাড়িতে তো লক ছিল!”

ঐশ্বর্য ঠোঁট প্রসারিত করে হাসি দেয়। সামনের চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে একটু ভাব নিয়ে বলে,
“এটা আমার কাছে জাস্ট ৫ সেকেন্ডের ব্যাপার। একটু শক্তি প্রয়োগ করলেই চলে।”

“সিরিয়াসলি? এটা একটা পুরুষের শক্তি প্রয়োগ করলেও খুলবে না। আর তোমার মতো একটা শুঁকনো পাতার মতো মেয়ে গাড়ির দরজা খুলবে। আমার গাড়ির চাবিও তো আমার কাছে দরজা খুললে কি করে বলো তো?”

“নাথিং ইজ ইম্পসিবল ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। শুধুমাত্র আপনার প্রেমে পড়া ছাড়া।”

প্রেম এবার শান্ত চোখে তাকিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো।
“হয়েছে বকবক? বাড়ি আজকে যাবে নাকি এখানেই থাকার প্ল্যানিং করে এসেছো?”

“যদি বলি আপনার সঙ্গে প্রতি মূহুর্তে থাকার প্ল্যানিং করে এসেছি। তখন কি আপনার সঙ্গে থাকতে দেবেন?”

প্রেম দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। সে ভুল ছিল। ভেবেছিল ঐশ্বর্য সব ভুলে গেছে কিন্তু না। তার পাগলামি বাড়ছে দিন যাচ্ছে। সে নিরাশ হয়ে বলল,
“ঐশ্বর্য, তুমি হয়ত ভুলে গেছো যে তুমি বলেছিলে রোজ যদি আমার পছন্দ হয় তুমি দূরে সরে যাবে। এসব বন্ধ করবে আর নিজে নিজের মতো থাকবে। তুমি ভুলে গেছো?”

ঐশ্বর্য ইশারায় থামায় প্রেমকে। প্রেমের চারিপাশে ঘুরতে ঘুরতে নিজের আঙ্গুল ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
“ওয়েট ওয়েট! আমি এটা কখন বললাম যে আমি দূরে সরে যাব? ভুলে তো আপনি গেছেন। আমি বলেছিলাম আমি ওই মেয়ের কোনো ক্ষতি করব না। ব্যাস… এতটুকুই তো বলেছিলাম। আর আমি তো নিজের মতোই আছি। কারণ আমি আপনার মাঝে নতুন আমিকে খুঁজে পেয়েছি।”

প্রেম আর কিছু বলতে পারে না। গলা শুঁকিয়ে এসেছে তার। প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায় সে। হুড়মুড়িয়ে বলে ওঠে,
“বাড়িতে যাবেনা তুমি? আমার গাড়িতে বসো। আমি বাড়িতে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে যাব। ইটস অলরেডি লেট। ১১ টা বাজছে।”

“চলে যাব। শুধু এটা বলুন যে আপনি রোজকে পছন্দ করেননি। ওর সঙ্গে আপনার বিয়ে হবেনা। এটা বললেই আমি চলে যাব।”

প্রেম এবার সত্যিই হতাশ। এই মেয়েটার এতো জেদ কেন? অন্যদিকে রোজের পরিবারের সাথে তার পরিবারের বিয়ের কথাবার্তা অনেকটা এগিয়ে গেছে। প্রেম তার মাকে মানা করেছিল কয়েকবার। তার মা শোনেনি। শুধু রোজের খুঁত জানতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রেম সেটা বলতে ব্যর্থ হওয়ায় বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে একপ্রকার। মাকে নিরাশ করতে তার মন টানছে না। অন্যদিকে রয়েছে ঐশ্বর্য! প্রেম নিজের কাঠিন্যতা বজায় রেখে বলে,
“ইটস ইম্পসিবল।”

“তাহলে আমিও এখান থেকে এক পাও নড়ব না।”

অপকট উত্তর দিল ঐশ্বর্য। প্রেম এবার রাগবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না। দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে,
“তুমি থাকো তবে এখানে আমি যাচ্ছি। আমিও দেখব তুমি কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো।”

“দেখতে চান? ঠিক আছে? আমি যতক্ষণ না এই কথা আমাকে দেবেন আমি এখানেই থাকব। আপনার অফিসের সামনে।”

প্রেম কিছু বলল না। তার রাগ লাগছে ভীষণ। একটা মেয়ে এতোটা জেদি হয় কি করে? তবে প্রেম এটা জানে যে ও এখানে সারারাত অন্তত থাকতে পারবে না। মুখে বলছে ঠিকই। অন্যদিকে মিসেস. পরিণীতা তাকে কল দিয়ে চলেছে। প্রেম গাড়িতে উঠে বসে। ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে,
“বাড়িতে যাবে? তাহলে তোমায় ছেড়ে দিয়ে আসি?”

“নো ওয়ে। যাব না আমি বাড়ি।”

প্রেম দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেটে সামনে আছে। গেটের সামনেই ছিল ওয়াচম্যান। তাকে দেখে গাড়ি থামালো প্রেম। ইশারায় গাড়ির কাছে ডাকতেই এগিয়ে এলো ওয়াচম্যান। প্রেম তাকে কটাক্ষ করে জিজ্ঞেস করল,
“আমার অফিস এরিয়ায় একটা মেয়ে এসেছে। তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে? ও করে ঢুকল? আর আমাকে ইনফর্মও করোনি।”

“স…সরি স্যার। ওকে ঢুকতে দিতে চাইনি কিন্তু জোর করে ঢুকে গিয়েছে। ওকে খুঁজতে গিয়েছিলাম কিন্তু ওকে পাইনি। ভেবেছি ও ভয়ে আবার বাহিরে চলে এসেছে।”

প্রেম ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“ম্যামকে একটা গাড়িতে তুলে দেবে একটু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চয় অফিসের গার্ডেন থেকে বেরিয়ে আসবে তখন গাড়িতে তুলে দেবে। মনে থাকে যেন।”

ওয়াচম্যান মাথা ঝাঁকায়। এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় প্রেম। আবার স্টার্ট দিয়ে স্টেয়ারিং রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে ফেলে। কুয়াশার মাঝে হারিয়ে যায় গাড়িটা।

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। সকলে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন।]

লেখিকার গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here