প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব ১২

0
231

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১২

“তোমাদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? মেয়েটা এভাবে আঘাত পেলো কি করে? দেখতে পেলে না তোমরা? তোমরা তো মনে হয় ওর সাথেই এসেছিলে।”

ইনায়া আর সানিয়ার উদ্দেশ্যে ধমকে বলে উঠল প্রেম। দুজন মাথা নিচু করে থাকা অবস্থায় কেঁপে উঠল। কাজটা তো তাদেরই। প্রিন্সেস এর যা জেদ! এমনভাবে কথাগুলো বলছিল যেন তাকে না মারলে সে তাদের মেরে ফেলবে। একথা প্রেমকে কি করে বোঝাবে তারা? সানিয়া মিনমিন করে বলে,
“আসলে আপনি তো জানেন যে প্রি… থুক্কু ঐশ্বর্য কেমন পাগলাটে ধরনের মেয়ে। কখন কি করে বসে কিছুই টের পাওয়া যায় না। আমরাও বুঝতে পারিনি। আমরা সামলে নিতে পারব ওকে। সমস্যা নেই আমরা বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি ঐশ্বর্যকে।”

বলেই ইনায়া আর সানিয়া ঐশ্বর্যকে ধরতে এগিয়ে আসতেই প্রেম এবার রক্তচক্ষু নিয়ে বলল,
“বাড়ি? বাড়িতে নিয়ে গেলে কি করে হবে? পাগল নাকি তোমরা? ওর মাথা থেকে ব্লিডিং হচ্ছে। আর এসময় বাড়ি নয় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত। উফফ… আমি কাদেরই বা বোঝাচ্ছি। যেমন মেয়ে তেমন তাদের বান্ধবী। কিছুই বোঝেনা। ডিজগাস্টিং!”

“আমরা ওকে হস…”

“থাক। আমি ওকে হসপিটাল নিয়ে যাব। তাছাড়া যেদিন থেকে ওর সাথে দেখা হয়েছে সেদিন থেকে তো ওকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার সম্পর্কই আমার! যখনই দেখা হয় ওর কিছু না কিছু হবেই। ওহ গড… প্লিজ সেভ মি।”

কথাটা বলে আর একটুও দেরি করল না প্রেম। তুলে নিল পাঁজকোলে ঐশ্বর্যকে। দ্রুত গাড়ির সিটে নিয়ে গিয়ে বসাতেই পিছু পিছু ছুটে এলো রোজ। প্রেম রোজকে লক্ষ্য করতেই বেশ ভাবুক হয়ে গেল। এতক্ষণ এই মেয়েটার কথা মাথাতেও ছিল না। প্রেম কিছু বলতে উদ্যত হবার আগেই রোজ নিচু আওয়াজে ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে বলল…
“আপনি কিছু মনে না করলে আমি আপনাদের সাথে যেতে পারি?”

“আপনি…”

“হ্যাঁ। মানা করবেন না। আমারও ওর অবস্থা দেখে ভালো লাগছে না। তাই বলছিলাম হেল্প করাটা তো খারাপ নয়। আমি জানি ও আমার সা…”

পুরো কথাটা শেষ করতে দিল না রোজকে প্রেম। তার আগেই সে গাড়িতে বসে বলল,
“ওকে। ইউ হ্যাভ নো টাইম। সো প্লিজ এতো কথা না বলে ঐশ্বর্যকে ধরে রাখুন। আর ওর মাথায় আমার রুমালটা চেপে ধরে রাখুন। অলরেডি অনেক ব্লিডিং হয়ে গেছে।”

প্রেমের বাড়িয়ে দেওয়া রুমালটা নিয়ে ঐশ্বর্যের কাছে বসল রোজ। তাকে বেশ মনোযোগের সহিত একবার দেখে তার মাথায় রুমাল চেপে ধরল সে। প্রেম হাই স্পিডে গাড়ি স্টার্ট দিল। অন্যদিকে বেক্কল হয়ে ইনায়া আর সানিয়া দাঁড়িয়ে রইল। ওরা এখনো শকে রয়েছে ঐশ্বর্যকে মেরে! সুস্থ হয়ে ঐশ্বর্য আবার ওদের মারবে না তো? সেই আশঙ্কায় ওরা!

ইমারজেন্সি রুমে আছে ঐশ্বর্য। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। নার্সরা দৌড়াদৌড়ি করছে। প্রেম আর রোজ দাঁড়িয়ে আছে। প্রেম মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। মুখটা ভার। চোখেমুখে অস্থিরতা স্পষ্ট। ডক্টর দ্রুত ঐশ্বর্যের সাথে হার্ট রেট মনিটর কানেক্ট করার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে মনিটরে ব্ল্যাঙ্ক দেখা গেল পুরোটাই। মানে মানুষটা মৃত। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল প্রেম। ধড়ফড়িয়ে ডক্টরের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকালো। ডক্টর নিজেও হতবাক। একটু আগেই তো পেশেন্টের পার্লস চলছিল। তড়িঘড়ি করে আবারও পার্লস চেক করল ডক্টর। তারপর বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে বললেন,
“নার্স! মেশিনটা কি নষ্ট হয়ে গিয়েছে? পেশেন্টের পার্লস এখনো চলছে। আর উনি যে নিশ্বাস নিচ্ছেন সেটাও বোঝা যাচ্ছে। মেশিনটা চেক করো।”

নার্স দেরি না করে মেশিনটাকে চেক করতে লাগল। আর ডক্টর বলল,
“আপনারা বাহিরে যান। পেশেন্টের অনেকটা লেগেছে ব্লিডিং এখনো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাজ করতে দিন।”

প্রেম কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। পিছু পিছু বের হলো রোজ। তার মুখেও চিন্তার রেশ। সে একবার প্রেমের দিকে তাকাচ্ছে একবার ইমারজেন্সি রুমের দিকে। তবে সে কিছু বলল না। এখন কিছু বলে লাভও নেই।

বেশ কিছুক্ষণ পর ডক্টর বের হলো। তড়িঘড়ি করে চলল সামনে দিকে। উনার হাতে ছিল রক্তের স্যাম্পল! যতদূর সম্ভব ঐশ্বর্যের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করতে নিয়ে গেলেন উনি। প্রেম কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারল না। এসব নজর এড়ালো না রোজের। সে বলল,
“আপনি মনে খুব টেনশনে আছেন। আমি পাশের দোকান থেকে পানি নিয়ে আসছি। পানি খেলে ভালো লাগবে।”

“লাগবেনা। আই এম অলরাইট।”

রোজ তবুও থামল না। সেও একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই ছুটল। প্রেম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সেদিকে। এই মেয়েটাও কি অদ্ভুত!

প্রায় ১ ঘণ্টা হয়ে গেল। ডক্টর আর একবারও এদিক এলো না ঐশ্বর্যের চিকিৎসা করতে। রোজ আধঘন্টা আগে এসেছে। যদিও বিষয়টা একটু রহস্যময় যে পানির বোতল কিনতে আধঘন্টা লাগে? তবুও কিছু বলেনি প্রেম। সে বিড়বিড় করে বলল,
“জানি না হসপিটালের এ কেমন সিস্টেম! ডক্টর কি ঘুমিয়ে গেলেন ওইদিকে গিয়ে? আশ্চর্য!”

প্রেমের রাগ হয় এবার। হাঁটা দেয় রিসেপশনের দিকে। কয়েক ধাপ এগোতেই রোজ পিছু ডাক দেয়।
“শুনুন, ওই মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে। ও তো তাকিয়েছে।”

হতভম্ব হয়ে পিছু ফিরে তাকায় প্রেম। ডক্টর এলো না। চিকিৎসা হলো না। অথচ ঐশ্বর্যের সেন্স চলে এলো? পিছন ফিরে ইমারজেন্সি রুমের দিকে আসে প্রেম। দরজার কাঁচ দিয়ে দৃঢ় নজরে তাকায়। ঐশ্বর্য পিটপিট করে চোখ মেলছে। তার তীক্ষ্ণ চাহনি হয়ে এসেছে দুর্বল। সঙ্গে সঙ্গে নার্স একটা ইনজেকশন পুশ করতেই আবার চোখ বন্ধ করে সে। অতঃপর বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। নার্স নিজেই আশ্চর্য হয়ে বলে,
“ইটস অ্যা মিরাকল! এমন ঘটনা ঘটেনি কখনো আমাদের হসপিটালে। যে কোনো পেশেন্টের এতো ব্লিডিং এর পরেও তার জ্ঞান কোনো চিকিৎসা বা ব্লাড দেওয়ার আগেই ফিরল। এমনটা কি করে হয় বুঝতে পারছি। পেশেন্ট বিরবির করছিল। তাই ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি। অন্যদিকে স্যার ১ ঘন্টা হয়ে গেল আসছেন না। আমরা তো ভেবেছিলাম উনাকে বাঁচাতে পারব না। আর অন্যদিকে হার্ট রেট মনিটরও সাপোর্ট করছিল না। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি আসছি স্যারকে ডেকে।”

প্রেম বাকহারা হয়ে দরজার কাঁচের মাধ্যমে ঐশ্বর্যের চেহারার দিকে। মাথায় আবারও মোটা করে ব্যান্ডেজ করা। অক্সিজেন মাস্কও খুলে দেওয়া হয়েছে। অলরেডি একটা আকাশি রঙের শার্টে আবৃত করা হয়েছে তাকে। ফর্সা এবং টান টান সুন্দর মুখটাতে মলিনতা ছেয়ে রয়েছে। এমনটা কখনো দেখেনি প্রেম। ঐশ্বর্যকে শুধু হাসতে বা রাগতেই দেখেছে। এমন মলিনতা যেন ঐশ্বর্যের জন্য বেমানান!

ইনায়া আর সানিয়া এসেছে আধঘন্টা পর। অন্যদিকে প্রেমকে অফিস থেকে ডাকছে। আর্জেন্ট কাজ। প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হবে। এবার বিগ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ডিল হবে। যেখানে ডিল করতে না পারলে তাদের পথেও বসতে হতে পারে। ব্যাপারটা খুব রিস্কই।

ঐশ্বর্যের রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল প্রেম। আবার কল এলো। রিং বাজলো। প্রেম বিরক্তি নিয়ে কেটে দিল কল। তা দেখে সানিয়া বলল,
“বলছিলাম, আপনাকে যখন অফিস থেকে বার বার কল করছে আপনারা যান। আমরা এদিকটা সামলে নেব। তাছাড়া কুই… সরি আই মিন ঐশ্বর্যের মা-বাবা আসছে। কল করেছিলাম। তো আপনি চিন্তা ছাড়াই যেতে পারেন।”

প্রেম নির্লিপ্ত। সে যেতেও চাইছে না আবার থাকতেও চাইছে না। এক দোটানায় ক্লান্ত সে। নার্স পারমিশন দিয়েছে একজনকে ঐশ্বর্যের রুমে গিয়ে দেখে আসার জন্য। অন্যদিকে খবর পাওয়া গেছে যেই ডক্টর ঐশ্বর্যের ট্রিটমেন্টের দায়িত্বে ছিল সেই ডক্টর ল্যাবের দরজা ওপাশ থেকে লক করে রেখেছেন। আর উনার কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। সবাই ব্যস্ত সেদিকে।

প্রেম আর এতোসব না ভেবে ঐশ্বর্যের কেবিনে ঢুকে গেল। পা টিপে টিপে গিয়ে ঐশ্বর্যের কাছে দাঁড়াল সে। মেয়েটার মুখ দেখে একটুখানি হাসিও পেল প্রেমের। কে বলবে? মেয়েটা সজ্ঞানে থাকলে হুমকির উপর হুমকি দেয়? বেডের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই অজান্তেই ঐশ্বর্যের হাতের সাথে প্রেমের হাতের ছোঁয়া লাগল। ঠান্ডা ঐশ্বর্যের স্পর্শ সত্যিই অদ্ভুত! গা শিউরে ওঠে! প্রেম তৎক্ষনাৎ সরে আসতে চাইলে আচমকা ঐশ্বর্য নিজের হাত দিয়ে প্রেমের হাত আগলে নেয়। তার হাতে আবদ্ধ করে ঐশ্বর্যের হাত। এই স্পর্শ যেন কোনো ভিন্ন অনুভূতি দিয়ে তৈরি! প্রেম ইতস্ততবোধ করে ছাড়িয়ে নিতে চায় নিজের হাত। তবে ঐশ্বর্য আবারও আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে। প্রেম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এই মূহুর্তে সে অনুভূতিশূন্য! না পারছে সরতে না পারছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে।

তখনি রুমে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ইনায়া আর সানিয়া। প্রেম আবার ছাড়িয়ে দূরে সরে এসে গম্ভীর মুখে তাকালো। থেমে থেমে বলল,
“আমি অফিস যাচ্ছি। আশা করছি তোমরা ওর খেয়াল রাখবে। ওর মা-বাবা আসলে ভালো হতো। একটু ভালো করে বুঝিয়ে বলতাম যে মেয়েটাকে স্বাভাবিক বানাতে! গড নোজ আর কি কি সহ্য করতে হবে।”

প্রেম এবার বেরিয়ে আসে। যাওয়ার সময় দেখতে পায় রোজকে। নিরীহ তার দৃষ্টি। রোজ বলল,
“আপনি কি অফিস যাচ্ছেন?”

প্রেম মাথা নাড়লো। রোজ বলল,
“আপনি চলে যান। আমি বাড়ি চলে যাব। এখান থেকে আমার বাড়ি অনেকটা কাছে। আমি ওই মেয়েটাকে একবার দেখে চলে যাব।”

“আর ইউ সিউর?”

রোজ হালকা হেঁসে মাথা নাড়ায়। প্রেম চলে যায়। রোজ কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। ইনায়া আর সানিয়া কি যেন কথা বলছিল রোজকে দেখেই তারা থেমে যায়। রোজ জিজ্ঞেস করে,
“ও কেমন আছে এখন?”

“ভালো। বাট ঘুমোচ্ছে।”

উত্তরে ইনায়া বলে। রোজ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বসে পড়ে ঐশ্বর্যের পাশে।
“ইটস অ্যা মিরাকল ইউ নো? কোনো ট্রিটমেন্ট বেঁচে গেছে।”

কথা বলতে বলতে ঐশ্বর্যের বাম হাতের ওপর থেকে একটু একটু করে কাপড় সরিয়ে দেয় রোজ। শেষ পর্যন্ত মিলে দেখা আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটির। জ্বলজ্বল করে ওঠে ঐশ্বর্যের হাতের সেই অজানা চিহ্ন। অন্যদিকে কারো চিৎকার ভেসে আসে,
“আমাদের ডক্টর আরহাম মারা গেছেন। উনার লাশ পাওয়া গেছে ল্যাবে।”

তা কানে আসতেই চমকে ওঠে ইনায়া আর সানিয়া। চমকায় না রোজ। চোখজোড়া লাল হয়ে আসে তার। জ্বলজ্বল করতে শুরু করে। মুখের কোণে ফুটে ওঠে এক রহস্যময় হাসি!

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। নিয়মিত হতে চেয়ে পারছি না। একটা না একটা সমস্যা লেগেই রয়েছে। গতকাল থেকে বেশ অসুস্থ আমি। অসুস্থতা সারলে গল্প পাবেন নিয়মিত। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অনেকে দেখছি গুলিয়ে ফেলেছেন ঐশ্বর্য চরিত্রটা। ঐশ্বর্য মানুষ নয় ভুলে গেছেন। যার কারণে ভাবছেন সব বেশি হয়ে যাচ্ছে। ও যেহেতু মানুষ নয় সেহেতু ওর আচরণও স্বাভাবিক হবেনা সেটা আপনাদের জানা। তবুও যারা বুঝবেন না তাদের গল্প না পড়ার অনুরোধ রইল।]
লেখিকার গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here