#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬.
সারারাত মোহনা আর ঘুমাতে পারেনি। ভীষণ রকমের এক দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ভর করলে কি আর ঘুম হয়? কে জানতো সামান্য একটা গেইম তার জীবনটা এতটা বেদনাদায়ক করে তুলবে। এমন জানলে কখনোই সে ঐ লোকটাকে মেসেজ দিত না। কখনো তার সাথে প্রেমের অভিনয় করতো না। কিন্তু ঐ যে “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না”, তাই এখন আর ভেবেই বা কী হবে।
.
মোহনা ভার্সিটির জন্য তৈরি হচ্ছিল। আরেকটি রোদ ঝলমলে দীপ্ত সকাল। বিছানার পাশের জানলা দিয়ে অনেক রোদ রুমে এসে তাদের বিশাল অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে মাহিয়াও স্কুলের জন্য বেরিয়েছে। মোহনার মন খুব একটা ভালো নেই। আনমনা হয়ে চুল বাঁধছে আর কী যেন ভাবছে। এতটাই আনমনা সে যে তার পাশে কখন এসে এশা দাঁড়িয়েছে সেই খেয়ালও তার নেই। এশা তার কাঁধে হাত রেখে তাকে ডাকতেই যেন হুঁশ ফিরে পায় সে। এশাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘তুই? বাসায় এলি যে?’
‘তুই আমাদের উপর রেগে আছিস, তাই না?’
মোহনা চুল বাঁধতে বাঁধতেই বলল,
‘কই না তো।’
‘কাল থেকে সবাই কতগুলো মেসেজ দিয়েছি। কারোর মেসেজেরই তো রিপ্লাই দিসনি।’
‘ভালো লাগছিল না, তাই।’
‘আমরা সরি রে দোস্ত। আমাদের জন্যই তোর এখন এত দুশ্চিন্তা।’
মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘এখন আর সরি বলে কী হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। ছেলেটাকে আমি ফেইসবুক মেসেঞ্জার থেকে ব্লক করেছিলাম, ভেবেছিলাম কিছুটা হলেও রেহাই পাবো। কিন্তু এতে জল আরো গড়িয়েছে। ঐ ছেলে কোথ থেকে যেন আমার নাম্বারও পেয়ে গিয়েছে। কাল রাত থেকে কল করে জ্বালিয়ে মারছে। অনেকগুলো নাম্বার আমি ব্লক করেছি। ও এতগুলো বাংলাদেশি সিম কী করে পেল সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। আর নাম্বারই বা কে দিল ওকে? এই রহস্যের সমাধান এখন কে করবে বল? মাথা ব্যথা করছে আমার। ভাবতে ভাবতে নিউরনে নিউরনে জট পেকে গিয়েছে। তাও উত্তর মেলাতে পারছি না। ওকে কেউ সাহায্য না করলে একা ওর পক্ষে এত কিছু করা কখনোই পসিবল না। নিশ্চয়ই ওর পেছনে কেউ আছে। আমার চেনা শোনা কেউ। কিন্তু আমি বুঝবো কী করে সে কে?’
বেশ চিন্তার বিষয়। মোহনার চোখ মুখ দেখেই এশা বুঝল, মেয়েটার রাতে ঘুম হয়নি। চোখে মুখে বিষন্নতা ছেয়ে আছে তার। সেও যে কিছু করতে পারছে না। তাদের জন্যই মেয়েটা এই ঝামেলায় ফেঁসেছে। এখন তারা যদি তাকে এসবের থেকে উদ্ধার করতে না পারে তাহলে ব্যাপারটা আরো খারাপের দিকে যাবে।
এশা অনেক ভেবে বলল,
‘একটা কাজ করতে পারিস, তুই ঐ ছেলের সাথে একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ইনিয়ে বিনিয়ে সব খবর বের করতে পারিস। আমার মনে হচ্ছে, তুই একটু ভালোভাবে কথা বললেই ছেলের পেট থেকে গরগরিয়ে সব বেরিয়ে যাবে।’
মোহনা নাকের পাল্লা ফুলিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
‘হে, আমি তার সাথে আবার একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলি, তারপর উনি আমার পেছনে আরো আঠার মতো লেগে যাক, সেটাই চাও তুমি তাই না?’
‘তাছাড়া তো আর কোনো বুদ্ধিই মাথায় আসছে না। ঐ বেটার পেট থেকে কথা বের করবি কীভাবে?’
‘জানিনা, কিচ্ছু জানি না। মাথা আমার কাজ করছে না। ঝামেলা এত সহজে আমার পিছু ছাড়বে না। নির্ঘাত এই ঝামেলা আরো বড়ো আকার ধারণ করবে। আর হয়তো আমাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে তবেই সে ক্ষান্ত হবে।’
এশা অস্ফুট স্বরে বলল,
‘সব ঠিক হয়ে যাবে দোস্ত। আমরা সবাই তোর পাশে আছি। ঠিক কিছু না কিছু একটা উপায় বের করে ফেলতে পারব। তুই এত দুশ্চিন্তা করিস না। আমরা সবাই মিলে এই ঝামেলাকে একদম গোড়া থেকে নির্মূল করব, ইনশাল্লাহ।’
মোহনা মৃদু হেসে বলল,
‘ঠিক আছে। এখন ডাইনিং এ চল, খেয়ে বেরুতে হবে।’
_________________________
ল্যাবে সাজিয়ে রাখা কেমিকেলগুলো এশা নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছিল। সেখানে তখন রাফাত এসে উপস্থিত হয়। সে এশার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘আমার মনের বিক্রিয়ায় তুই যে পরিমান এসিড ঢালছিস, কবে যেন সেটা আবার ধপ করে ফেটে যায়।’
এশা গরম চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এসিড দিয়ে দিয়ে তোর বক্ষদেশ কে ঝলসে দিয়ে তবেই আমি শান্ত হবো, বুঝেছিস?’
রাফাত মুচকি হেসে বলল,
‘পরে তোর থেকে থেকে প্রেমক্ষার নিয়ে নিয়ে আমি বিক্রিয়াকে প্রশমিত করে দিব। ভালো আইডিয়া না?’
‘কচুর আইডিয়া। যা ভাগ এখান থেকে।’
রাফাত এশার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘বেশি করলে এসব কেমিকেলে চুবিয়ে মারবো কিন্তু।’
এশা রাফাতের চুলে টান দিয়ে বলল,
‘সাহস থাকলে চুবিয়ে দেখা।’
রাফাত বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,
‘আমার সাহস নিয়ে তোর কোনো সন্দেহ আছে? দাঁড়া দেখাচ্ছি..’
এই বলে সে এশার হাত থেকে একটা কেমিকেলের টেস্টটিউব কেড়ে নিল। এশা সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘স্যার, রাফাত আমার টেস্টটিউব নিয়ে গিয়েছে।’
ল্যাবের স্যার অন্য একটা গ্রুপ কে বোঝাচ্ছিলেন। এশার চিৎকারে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘এই জন্যই আপনাদের আমি এক গ্রুপে দিতে চাই না। কিন্তু দুজনে আবার আলাদা গ্রুপেও যেতে চাননা। আপনাদের নিয়ে আমি কী করব বলুন তো? সারাক্ষণ বাচ্চাদের মতো লেগে থাকেন। এই রাফাত, আপনি উনার টেস্টটিউব কেন নিয়েছেন? অন্য একটা নিতে পারছেন না?’
রাফাত ভদ্র ছেলের মতো বলল,
‘স্যার, আমি তো আসলে ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু ওই সবসময় বাড়াবাড়ি করে। এতে আমার কোনো দোষ নেই স্যার। স্যার এক কাজ করুন, আমাকে ইশিতার গ্রুপে দিয়ে দিন। এশার সাথে থাকলে আমাদের পড়াশোনা কম, ঝগড়া হবে বেশি।’
এশা সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল,
‘না স্যার, ও আমার গ্রুপেই থাকবে। সেমিস্টারের মাঝামাঝি এসে ও গ্রুপ চেঞ্জ করবে কেন? এটা নিয়মে নেই। স্যার ওকে বলে দিন, ওর যদি এতই ইশিতার গ্রুপে যাওয়ার ইচ্ছে হয়, তাহলে যেন পরের সেমিস্টারে যায়। এই সেমিস্টারে ও কোনোভাবেই যেতে পারবে না।’
স্যার জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘ঠিক আছে যাবে না। আর আপনিও একটু রাগ কমান। একই গ্রুপের হয়ে কাজ করলে দুজনেই সমান সুযোগ পাবে, এটা মাথায় রাখবেন।’
স্যার আবার উনার কাজে মনোযোগ দিলেন। এশা রেগে দাঁতে দাঁত চেপে রাফাতকে বলল,
‘ইশিতার কাছে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে তাই না? শালা, তোর চোখ খারাপ। এক চোখে কয়জনরে দেখিস? মন চায় একদম চোখগুলোর মধ্যে এসিড মেরে দেই। আর একবার যদি গ্রুপ পাল্টানোর কথা বলবি তো খবর আছে তোর। তোর জন্য আমি আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর গ্রুপে গেলাম না আর সেই তুই কিনা একশো বার গ্রুপ পাল্টানোর কথা বলিস? একদম মেরে ফেলব তোকে।’
রাফাত মুচকি মুচকি হাসে। আহ, মেয়েটাকে জ্বালাতে তার বেশ মজা লাগে।
মোহনা তার ক্লাসের অন্য একটা ছেলের গ্রুপে ছিল। ওদের গ্রুপে ছিল তিনজন। মোহনা, দিশা আর ওদের একটা ছেলে ক্লাসমেট। ছেলেটা ছিল দারুণ মেধাবী। মোহনা আর দিশার কিছু করতেই হয়না, ছেলেটাই সব করে ফেলে। আজও তাই। একের পর এক বিক্রিয়া ঐ ছেলেটাই করছে। দিশা তার সাথে বকবক করলেও মোহনা চুপচাপ কেবল দেখছে। না বিক্রিয়ার কিছু সে বুঝছে আর না বুঝতে চায়ছে। এই মুহুর্তে তার মাথার ভেতরে যে বিক্রিয়া চলছে সেই বিক্রিয়ারই সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না সে।
ল্যাব শেষ করে বাইরে বেরিয়ে ফোনটা হাতে নেয় মোহনা। স্ক্রিনের উপর দেখে একটা মেসেজ। লেখা ছিল,
“ক্লাস শেষ হলে বলো, ঠোমাকে নিতে আসবো।”
এই ছোট্ট একটা মেসেজেই মোহনার বিগাড়ানো মনটা আরো বেশি বিগড়ে গেল। রাফাত আর এশাকে দেখাল মেসেজটা। রাফাত প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল,
‘চল একসাথে দেখা করি। দেখি বেটা এবার কী বলে।’
চলবে…