প্রণয় রেখা পর্ব ৭

0
547

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭.

গেইটের বাইরে গিয়ে দেখল সত্যি সত্যিই সেখানে লরিন এসে উপস্থিত। মোহনা তাকে দেখে বিরক্ত চোখে এশার দিকে তাকাল। এশার চোখে মুখেও বিরক্তের ছাপ স্পষ্ট। রাফাত এশা আর মোহনা কে দাঁড়াতে বলে নিজে গেল লরিনের কাছে। লরিন তাকে খেয়াল করেনি। রাফাত গিয়েই লরিনের পিঠে চাপড় মেরে বলে উঠল,

‘হেই ডুড, কী খবর?’

লরিনের মাথায় একটা ক্যাপ পরা ছিল। সে ক্যাপটা খুলে খুব মনোযোগী দৃষ্টিতে রাফাতের দিকে তাকাল। হয়তো সে প্রথমে রাফাতকে চিনতে পারেনি। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ে। আর তখন সাথে সাথেই তার অধর কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। উল্লাস নিয়ে বলে,

‘হ্যালো রাফাত, কেমন আছো?’

‘কেমনে ভালা থাকতাম কও, তুমি যা শুরু করছো তাতে কি আর ভালা থাকন যায়?’

রাফাতের কথা লরিন পুরোপুরি বুঝল না। সে প্রশ্ন করল,

‘What did you say?’

রাফাত গরম গলায় বলল,

‘কিচ্ছু কয় নাই। আপনারে আর হেইসব বুঝতে হয়তো না। আপাতত এইডাই বুইঝা লন, আমাগো বান্ধবীর পিছে ঘোরা বন্ধ করেন। হেতি জীবনেও আপনারে পাত্তা দিত না। তাই আজাইরা সময় নষ্ট না করে নিজের দেশে ফিইরা যান। বুঝছেন?’

লরিন বোকার মতো তাকিয়ে রইল। দূর থেকে মোহনা আর এশা বুঝতে পারছে না সেখানে আসলে হচ্ছে টা কী। রাফাতের মুখ দেখে তো তাকে খুব সিরিয়াস লাগছে, কিন্তু লরিন, সে এমন বোকার মতো চেয়ে আছে কেন?

লরিন তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমি ঠোমার কথা বুঝতে পারছি না ব্রো।’

রাফাত তাকে একটা গালি দিল। সেটাও লরিন বুঝতে পারল না। ক্ষণিক বাদে সে লরিনের কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল,

‘দেখো ভাই, তুমি আর আমরা দুজন দুই দেশের মানুষ। আমাদের ভাষা, চাল চলন, ব্যবহার, সংস্কৃতি সবকিছু ভিন্ন। তোমার দেশে তুমি যেভাবে থেকেছো এই দেশে সেভাবে থাকতে পারবে না। কারণ একেক দেশের একেক নিয়ম। তেমনি একেক দেশের মানুষের চিন্তাধারাও একেক রকম। তোমাদের দেশে প্রেম ভালোবাসা খুব ঠুনকো একটা জিনিস। এই প্রেম হচ্ছে তো এই ব্রেকআপ। তোমরা এসবে একদম সিরিয়াস না। কিন্তু আমাদের দেশ এই ক্ষেত্রে পুরো উল্টো। আমাদের দেশের মানুষ ভীষণ আবেগী। তারা খুব নিখুঁত ভাবে ভালোবাসতে জানে। তারা ভালোবাসা ধরে রাখতে জানে। তারা বিচ্ছেদে কষ্ট পায়, কাঁদে। এছাড়াও তোমাদের সাথে আমাদের অনেক ভিন্নতা। আর এতকিছুর পর কখনোই মোহনা একটা ভিনদেশী ছেলেকে ভালোবাসবে না। ও কেমন সেটা তো আমরা জানি। আমাদের জন্যই ও তোমার সাথে দু’দিন প্রেমের নাটক করেছিল। আমরাই ফোর্স করেছিলাম ওকে। আসলে আমরা জানতাম না যে তুমি এত সিরিয়াস হয়ে যাবে। দুই দিনের প্রেমে কেউ দেশ ছেড়ে চলে আসবে সেটা আমাদের কাছে আকাশ কুসুম চিন্তা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাই হলো। তুমি চলে এলে। কিন্তু যার জন্য এলে সে তোমায় ভালোবাসে না। সেটা তুমিও এখন বুঝতে পারছো। তুমি চাইলেই এখন পারো ব্যাপারটাকে এখানেই শেষ করে দিতে। তুমি জানো, মোহনা তোমার জন্য ভালো থাকতে পারছে না। তুমি ওকে খুব ডিস্টার্ব করছো। মেয়েটা রাতে ঘুমাতে পারছে না শুধুমাত্র তোমার দুশ্চিন্তায়। এমন ভাবে চলতে থাকলে তো ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি কি তাই চাও বলো? ওকে পছন্দ করার সুবাদে নিশ্চয়ই তুমি ওর ভালোটাই সবসময় চাইবে। আর ওর ভালো তুমি চলে গেলেই হবে। তুমি ওর পেছন ছেড়ে দাও, আর ওকে জ্বালিয়ও না। She is going to depression just for you. Do you understand what I said, Lorraine?’

লরিন মাথা ঝাঁকাল। এতক্ষণে রাফাতের বলা কথা সব অক্ষরে অক্ষরে না বুঝলেও অনেকটাই বুঝেছে সে। কিন্তু তার জবাবে কিছু বলতে পারছে না। তার কাছে ভালোবাসা যত সহজ এই দেশের মানুষের কাছে ভালোবাসা ততই কঠিন। তাদের দেশের মানুষ হুট হাট ভালোবেসে ফেলতে পারে তবে এই দেশের মানুষ খুব ভেবে চিন্তে ভালোবাসে। যেন তারা ভালোবাসতে ভয় পায়। অথচ সে ভেবেছিল ভালোবাসা বুঝি খুব সহজতম বস্তু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চাইলেই ভালোবাসা যায় না।
লরিন কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,

‘আমি কি এখবার মোহানার সাথে দেখা করঠে পারি?’

রাফাত খানিক ভেবে বলল,

‘দাঁড়াও, আমি ওদের নিয়ে আসছি।’

লরিন তার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। রাফাত মোহনা আর এশার কাছে গিয়ে বলল,

‘মনে হয় বেটা বুঝেছে। মোহনার সাথে এখন কথা বলতে চায়ছে। মনে হয় বিদায় নিয়ে দেশে ফিরে যাবে। চল মোহনা।’

মোহনার মনে শান্তির বাতাস বইল। বুকের ভেতরের বিশাল পাথর যেন এবার নামতে চলল। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো। এবার যেন একটু শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে।

মোহনা লরিনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লরিনের চোখ মুখ কেমন যেন পরিশ্রান্ত। সে মোহনাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

‘আমি কি ঠোমায় ডিস্টার্ব করছি, মোহানা?’

মোহনার রাফাত আর এশার মুখের দিকে তাকাল। এশা তাকে ইশারা দিয়ে সত্যি বলতে বলল। মোহনা লরিনের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ।’

‘আমি চলে গেলে ঠুমি খুশি হবে?’

আগের মতো হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকাল সে। লরিন এটা দেখে অনেকক্ষণ নিরব ছিল। মোহনা ভাবছে এবার লরিন কী বলবে। নিশ্চয়ই চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু লরিন তা বলল না। সে স্মিত সুরে বলল,

‘But, I love you Mohona.’

মোহনা এটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে যেন বেকুব বনে গেল। বিস্ময় নিয়ে রাফাত আর এশার দিকে তাকাল। তাদের চোখে মুখেও একই বিস্ময়। মোহনা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে চোখ বুঝে জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর বলল,

‘আমার আর কিছু বলার নেই লরিন। আপনি হয়তো বুঝতেই চাইছেন না। আর যে বুঝতে চায় না তাকে জোর করেও বোঝানো যায় না। এখন আপনার যা খুশি আপনি তাই করেন। কতদিন আমার পেছনে ঘুরবেন, একদিন না একদিন তো ঠিকই বিরক্ত হবেন। আমি না হয় ততদিন পর্যন্ত আপনাকে সহ্য করে নিব।’

মোহনা তার কথা শেষ করে এশার হাত ধরে চলে যাচ্ছিল। লরিন তখনই পেছন থেকে ডেকে বলল,

‘আচ্ছা, আমরা কি ভালো বন্ঢু হতে পারিনা?’

মোহনা পেছন ফিরে চাইল। লরিনের চোখে কেন যেন খুব আকুতি দেখল সে। একজন বিদেশী মানুষও যে এত বেশি আবেগী হয় সেটা লরিনকে না দেখলে সে বুঝত না। লরিনের উৎসুক মনে মোহনার উত্তরের অপেক্ষা করছে। মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘সরি, আমার পক্ষে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করাও সম্ভব না। আপনার জন্য এখন এটাই ভালো হবে যে আপনি এইসব কিছু ভুলে এবার দেশে ফিরে যান। সেখানে নিশ্চয় আপনার পরিবার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

মোহনা রিক্সা ডেকে রিক্সায় উঠে গেল। লরিন নির্বাক চোখে চেয়ে থেকে মোহনার যাওয়া দেখল। রাফাতও চলে গেল। পেছন থেকে তখনই কে যেন বলে উঠল,

‘হাই লরিন!’

লরিন পেছন ফিরে তাকাল। মেয়েটিকে চিনল না বোধ হয়। মেয়েটি হেসে বলল,

‘আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি দিশা, মোহনার ফ্রেন্ড।’

লরিন চিনল। মৃদু হেসে বলল,

‘হে হে চিনেছি।’

দিশা তার দিকে দু কদম এগিয়ে এসে বলল,

‘মোহনা আজও আপনার সাথে রাগ দেখিয়েছে? আপনি ওর পেছনে কেন পড়ে আছেন? ও তো আপনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না, শুধু শুধু অপমানিত হচ্ছেন। আপনার আশে পাশে তো আরো মেয়ে আছে, তাদের কাউকে চোখে পড়ছে না? যে মেয়ে পাত্তা দেয় না তার পেছনেই ঘুরছেন।’

লরিন হতাশ গলায় বলল,

‘Because I like her.’

‘উফফ, এমন পছন্দ হয়েই থাকে। পছন্দ হলেই যে একদম পিছে পড়ে যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আপনি বরং এখন আমার সাথে চলুন। আমাদের দেশে এসেছেন, আমাদের দেশটা একটু ঘুরে দেখবেন না?’

এই বলেই দিশা লরিনের হাত ধরে বলল,

‘চলুন, আপনাকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাই। দেখবেন সেখানে গেলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।’

লরিন না করল না। ছেলে মানুষ আবার মেয়েদের সরাসরি না করতে পারে না। তাই সেও পারেনি। দিশার সাথে এক ক্ষণিক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here