#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪.
‘আমার কিন্তু এবার খুব রাগ হচ্ছে লরিন। আপনি আমার সাথে কেন যাচ্ছেন? আরেকটা রিক্সা নিতে পারছেন না?’
লরিন মুচকি হেসে বলল,
‘না, পারছি না। সামান্য রিক্সাও ঠুমি আমার সাথে শেয়ার করতে পারছ না? এত হিংসুটে কেন ঠুমি?’
‘কী? আমি হিংসুটে?’
মোহনা ভীষণ রকম চটে গেল। লরিন ঠোঁট চেপে হাসছে। মোহনা কে রাগিয়ে সে বেশ মজা পাচ্ছে। মোহনা বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আপনি একটা অসভ্য ছেলে। নূন্যতম সভ্যতাও আপনার মাঝে নেই। আপনাকে শুধু আমি কেন জীবনেও কোনো মেয়ে পছন্দ করবে না।’
লরিন শব্দ করে হেসে বলল,
‘Seriously, you think so? Do you know, আমার ইউনিভার্সিটির কত মেয়ে আমার সাথে ডেট করতে চায়? You don’t have any idea, they are crazy for me. আর ঠুমি বলছো, কেউ আমাকে পছন্দই করবে না? আহ, হাসালে আমায়।’
মোহনা দম ছেড়ে বলল,
‘তো যান না আপনার ইউনিভার্সিটির সেইসব পাগলদের কাছেই যান। তাদের সাথেই গিয়ে ডেট ফেট করুন। এখানে কেন পড়ে আছেন? এখানে থেকে আপনার কোনো লাভ নেই, উল্টো অনেক লস হচ্ছে। তাই বেটার হবে, নিজের দেশে ফিরে যান, আর ঐসব মেয়েদের সাথে ডেট করুন।’
লরিন তীক্ষ্ণ চোখে মোহনার দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘By any chance, are you jealous Mohona?’
মোহনা পাল্টা জবাবে চেঁচিয়ে উঠল। বলল,
‘আমি কেন জেলাস হব? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড লাগি নাকি যে আপনার এসব কথা শুনে আমার হিংসে লাগবে? এসব আজগুবি কথা বলা বন্ধ করুন। যা বলেছি এখন সেটা নিয়েই ভাবুন। তাতেই আপনার মঙ্গল।’
লরিন কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর আবার মোহনাই তাকে বলল,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘Yeah, sure.’
‘Are you Muslim?’
‘Yeah, I am Muslim.’
মোহনা জবাব পেয়ে খানিক বিমোহিত হলো। একপলক লরিনের দিকে চেয়ে পরে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চাইল। খানিক সময় চুপ থেকে আবারও মোহনা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘আপনার মা বাবা জানেন আপনি যে বাংলাদেশে এসেছেন?’
লরিন মোহনার দিকে চেয়ে বলল,
‘আমার মা বাবা নেই। আংকেলের কাছে বড়ো হয়েছি। আর উনি জানেন সবকিছু।’
মোহনা নিচু সুরে বলল,
‘স্যরি।’
‘It’s ok.’
পরে আর কেউই কোনো কথা বলেনি। মোহনার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল লরিনের হয়তো তার প্রশ্ন শুনে খারাপ লাগছে। মোহনা একবার চেয়েছিল লরিনের সাথে আরেকবার কথা বলবে। কিন্তু দ্বিধা দ্বন্দ্বের পাহাড় সরিয়ে কথা বলা আর হয়ে উঠেনি। এর মাঝে মোহনাও তার বাসায় এসে পৌঁছে যায়। রিক্সা থেকে নেমে টাকা বের করতে নিলেই লরিন তাকে বাঁধা দিয়ে বলে, সে একেবারে হোটেলে নেমে টাকা দিয়ে দিবে। মোহনা আর কিছু বলে না। লরিন হালকা করে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।
গোসল শেষ করে এসে মোহনা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দুপুরের ঝলসানো সূর্য একেবারে মাথার উপর। চারদিকে তার ভীষণ কিরন। উত্তপ্ত দহনে তার জনজীবন অতিষ্ঠ। তার এত কিসের তেজ? সারাক্ষণ এত দাউ দাউ করে কেন জ্বলে? একটু শান্ত হতে পারে না, অসহ্য। সূর্যকে এতসব কথা শুনিয়ে তবেই মোহনা ক্ষান্ত হলো। আজকাল সূর্যের এই তেজ তার পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হওয়ার কারণ তার জানা নেই। তবে মনে তার সূক্ষ যন্ত্রণা হচ্ছে। শীতকালকে কেন যেন খুব মিস করছে সে। সেই হাড় হিম করা শীত এখন আর আসে না। আগে শীতে গ্রামে গেলে সে শীতের কঠিন দাপট টের পেত। এখন আর গ্রামে যাওয়া হয় না। ঢাকা শহরে শীতের খুব একটা দেখা মেলে না। এত এত দালানকোঠার ভীড়ে শীত আসলে পাশ কাটিয়ে আসতে পারে না। তার মোটা শরীর নিয়ে মাঝখানেই আটকে যায়। তাই তো শীতের কথা আজকাল খুব মনে পড়ে। মনে হয়, এই অসহ্য উত্তাপের পরে এবার একটু শীতলতার খুব প্রয়োজন। আর কত সময় সেই মহান সময়ের অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মোহনার চুল শুকানো হয়ে গিয়েছে। সে রুমে এসে মুখে অল্প একটু ক্রিম মাখে। তারপর ওড়না টা গায়ে জড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। গেইটে তালা দিয়ে বাইরে বের হয়ে মোহনা রিক্সা খুঁজতে লাগে। এই ভর দুপুরে সে তেমন কোনো রিক্সা’ই দেখছে না। অনেক্ষণ সে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। পরে কোনো রিক্সার হদিস না পেয়ে পায়ে হেঁটেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পর সে থামল। সূর্যের তাপে ঘেমে একাকার। আর হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না। দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়ে হয় সে। তবে তার সেই খুশী বেশিক্ষণ টিকে না। রিক্সাটা একটু কাছে আসার পরই মোহনা বুঝতে পারে এতে মানুষ আছে। হতাশ হয়ে পড়ে সে। মন খারাপ করে সাইড হয়ে দাঁড়ায়। রিক্সাটা তার কাছে এসেই থামে। মোহনা ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখে রিক্সায় আর কেউ না লরিন। তাকে দেখে মোহনা দুই হাত বুকের উপর ভাঁজ করে বিরক্ত সুরে বলে,
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ, উঠে পড়।’
‘না, আমি আপনার সাথে যাব না।’
‘শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে? এখানে এখন কোনো গাড়ি পাবে না। চল আমার সাথে, ঠোমাকে আমি নামিয়ে দিয়ে চলে যাব।’
মোহনা ভেবে আর কোনো উপায় বের করতে পারল না। লরিনের সাথে না গেলে তাকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে লরিনের পাশে রিক্সায় উঠে বসল সে। রিক্সা অতঃপর চলতে আরম্ভ করল।
দুজনেই খুব চুপচাপ। ফাঁকা রাস্তায় খুব একটা গাড়ি নেই। মেশিনের রিক্সাটা তাই খুব ছুটছে। মোহনা খোলা চুল বাতাসের তালে তালে যেন এক নৃত্য তে মেতেছে। একপাশের চুল বারবার লরিনের মুখের উপর গিয়ে পড়ছে। মোহনা সেগুলো কে দ্রুত গুছিয়ে নিলেও বাতাসের বেগে সে আটকাতে পারছে না। এক পর্যায়ে চুলগুলো সব একপাশে নিয়ে এল। লরিন তখন ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘চুলগুলোকেও কি একটু স্বাধীনতা দেওয়া যায় না?’
মোহনা বুঝল না। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি তে তাকালে লরিন বলে,
‘বুঝনি? থাক আর বুঝতে হবে না।’
মোহনা কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে চেয়ে থেকে চোখ সরাল। লরিন পুনরায় বলল,
‘আচ্ছা, ঠোমার বাবার এক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছিল?’
‘জানি না, এই ব্যাপারে এখনো বাবার সাথে কথা হয়নি।’
লরিন আর কোনো প্রশ্ন করল না। রিক্সা তার গন্তব্যে এসে থামে। মোহনা নেমে এবার জোর করেই ভাড়া টা দিয়ে দেয়। এতে লরিন খুব রেগে যায়। সে আর সেই রিক্সা দিয়ে যায় না। মোহনার সাথে কোনো কথা না বলেই সোজা রাস্তায় হাঁটা ধরে। লরিনের এমন ব্যবহারে মোহনা খুব অবাক হলেও ব্যাপারটা খুব একটা আমলে নিল না নিয়ে সে ভেতরে চলে যায়।
মোহনা কেবিনে গিয়ে দেখল তার বাবা খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছে। মা আর বোন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল, সে আসলে এক সঙ্গে খাবে বলে।
খাওয়া শেষ করে মোহনা মা’কে সাহায্য করে সবকিছু গোছাতে। কাজ করতে করতেই মা’কে সে জিজ্ঞেস করে,
‘আম্মু, বাবার এক্সিডেন্ট টা কীভাবে হয়েছিল? বাবা কিছু বলেছে?’
‘হু, রিক্সা দিয়ে বাস স্টেশনে যাওয়ার সময় নাকি একটা ছোট ট্রাক এসে পেছন দিয়ে জোরে ধাক্কা দেয়। তোর বাবা তাল সামলাতে না পেরে ডিরেক্ট গিয়ে রাস্তায় পড়েন। অত জোরে পড়ার কারণে মাথায় অনেক ব্যাথা পান। রাস্তাতেই নাকি অনেক রক্ত গিয়েছে। পরে সেই রিক্সাওয়ালা সহ আরো কিছু লোক উনাকে হসপিটালে নিয়ে আসেন।’
‘আর ঐ ট্রাক ড্রাইভার? ওকে কেউ ধরতে পারেনি? ও কেন ধাক্কা দিল?’
‘সেকি আর দাঁড়িয়েছে নাকি? ধাক্কা দিয়েই তো পালিয়ে গিয়েছে।’
‘ওর নামে মামলা করতে হবে আম্মু। এভাবে কে গাড়ি চালায়? দেখে শুনে চালাবে না? আমি ওর নামে থানায় মামলা করব।’
‘থাক মা, এখন আর এত ঝামেলা করে কোনো লাভ হবে না। আল্লাহ যে তোমার বাবাকে সুস্থ করে দিয়েছেন সেটাই আমাদের জন্য অনেক।’
মোহনার সেই ট্রাক ড্রাইভারের উপর খুব রাগ হয়। সামনে পেলে হয়তো খুব কেলানি দিত। ঐ লোকের ছোট্ট ভুলের জন্য আরেকটু হলেই তো সে তার বাবাকে একেবারের জন্যই হারিয়ে ফেলছিল। কী ভয়ানক ব্যাপার, ভাবতেই তো বুকে মোচড় দিয়ে উঠে তার।
________________________________________
পরদিন মাহবুব সাহেবকে নিয়ে হসপিটাল থেকে সবাই বাসায় ফিরে। এশা আর রাফাতের সাথে সেখানে লরিনও ছিল। যাকে মোহনা একটু পরপর চোখ রাঙিয়ে বলছিল বাসা থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লরিন তার বাবার সাথে যে আড্ডা জুড়িয়েছে মনে হচ্ছে না সে এত সহজে যাবে। মোহনার যেমন এতে বিরক্ত লাগছে অন্যদিকে আবার ভয়ও করছে। হুট করে লরিন আবার সবকিছু বলে না দেয়। ওর যা ঠোঁট কাটা স্বভাব, ভুল করেও যদি কিছু বলে ফেলে তাহলেই মোহনা শেষ।
চলবে….