প্রণয় রেখা পর্ব ১৩

0
530

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩.

এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে করতে মোহনা এবার ক্লান্ত। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার পাশের লোকটা বরাবরের মতোই বেশ নিরব। সে যেন মুখ খুলবে না বলে পণ করেছে। মোহনার এবার রাগ হচ্ছে। একেবারে গা জ্বালানো রাগ। লোকটা কিছু বলছে না কেন? এত প্যারা দেওয়ার কোনো মানেই হয়না। মোহনা চট করে উঠে দাঁড়াল। রেগে গিয়ে বলল,

‘সবকিছুর একটা লিমিট থাকে লরিন। আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। আপনি এক্ষুণি আপনার হোটেলে ফিরে যান। তারপর সেখান থেকে সব প্যাক করে নিজের দেশে চলে যান। বাংলাদেশে আর একদিনও আপনি থাকতে পারবেন না। আপনি ভীষণ বাজে একটা লোক। আপনাকে এত অনুরোধ করার পরও আপনি আমাকে কিচ্ছু বলতে চাইছেন না। আপনার এইসব কর্মকান্ড আমার আর সহ্য হচ্ছে না। হয় আমাকে এক্ষুণি সব সত্যি বলুন, নয়তো এক্ষুণি এখান থেকে চলে যান।’

এত কথার পরেও লরিনের মাঝে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে এক পলক তার হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে বলল,

‘দুইটা বাজতে চলল। ঠোমার এখন ঘুমানো উচিত মোহনা।’

মোহনা রেগে বলল,

‘ঘুমাবো না। আপনি আমার কথার জবাব দিন। বলুন, আপনাকে কে সাহায্য করছে? কার কাছ থেকে আপনি আমার সম্পর্কে এত কিছু জেনেছেন? বলুন লরিন, প্লীজ।’

লরিন নরম সুরে জবাব দিল,

‘Calm down mohona. এত হাইপার কেন হচ্ছো? সবকিছুই জানতে পারবে। সময় এলে আমি নিজেই ঠোমাকে সব বলব। এখনই এত উত্তেজিত হইয়ো না। আমি একদিন ঠোমায় সব বলব।’

‘সেই একদিন টা কোনদিন? আমাকে এক্সেক্ট ডেইট বলুন।’

‘Ok fine. সামনে মাসের বারো তারিখ।’

মোহনার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘আপনি তাহলে এতদিন এখানে থাকবেন?’

লরিন হেসে বলল,

‘হ্যাঁ।’

মোহনা বিরক্ত হয়ে আবার বসল। লরিন বলল,

‘এবার শান্তি পেয়েছ?’

মোহনা তার দিকে চেয়ে বলল,

‘আপনি ভীষণ বিরক্তিকর একটা মানুষ লরিন।’

‘I know. But you know what, মানুষকে বিরক্ত করাটা একটা আর্ট। এটা সবাই পারে না। আমি পারছি, তার মানে আমি ট্যালেন্টেট।’

‘কচু আপনি।’

‘কচু? what’s that?’

‘কচু মানে আপনার মাথা।’

লরিন মাথায় হাত দিয়ে বলে,

‘কচু মিনস মাথা। মাথা মিনস হেড। ওহ, It means কচু মিনস হেড?’

মোহনা তার মাথায় হাত দিয়ে বসে। কাকে সে কী বলছে। উফফ! লোকটা তাকে পাগল করে তবেই দম ফেলবে। মোহনা জোরে নিশ্বাস টেনে বলে,

‘কচু মিনস নাথিং। কচুর চিন্তা বাদ দিয়ে আপনি এখন ঘুমাতে যান। আর আমাকেও এবার একটু শান্তি দিন।’

লরিন ভাবুক চোখে চেয়ে বলল,

‘শান্টি কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়? বলো, আমি ঠোমার জন্য কিনে নিয়ে আসি।’

‘মজা করছেন আমার সাথে? আমি কিন্তু একদমই মজার মুডে নেই।’

লরিন হাসল। বলল,

‘ঠুমি সবসময়ই রেগে থাকো। কখনো তো একটু হেসে হেসেও কথা বলতে পারো। বেশি রাগ শরীরের জন্য ভালো নয়।’

‘হয়েছে আপনার বলা? আমি কেবিনে গেলাম। পারলে আপনিও হোটেলে চলে যান। গুড নাইট।’

লরি মৃদু সুরে বলল,

‘গুড নাইট।’

মোহনা তারপর কেবিনে চলে যায়। লরিন কিন্তু যায় না। সে বসে থাকে ঠাঁই। সেখানে বসেই দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুম তার ভাঙে সকাল দশটায়, কারোর কর্কশ সুরে। তাকিয়ে দেখে তার সামনে মোহনা রণমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। লরিন সোজা হয়ে বসে, তার ভাবখানা বোঝার চেষ্টা করে। মোহনার রেগে যাওয়ার কারণ ঘাটতেই তার মনে পড়ে সে সারারাত এই হসপিটালেই ছিল। আর তার জন্যই মোহনা এই মূর্তি ধারণ করেছে। লরিন তখন প্রসন্ন হাসে। চোখ কচলে উঠে দাঁড়ায়। ভারী স্বরে বলে,

‘কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।’

মোহনা নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘আর মিথ্যে বলতে হবে না। আপনি যে ঘাড়ত্যাড়া সেটা আমি জানি। এখন আর মিথ্যে বলে লাভ নেই। চলুন কেবিনে চলুন; আম্মু ডাকছে।’

মোহনা কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। লরিনও তার পেছন পেছন যায়। কেবিনে গিয়ে দেখে এশা আর রাফাতও চলে এসেছে। লরিন অবাক হয়। ওরা দূরে থেকেও এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। আর সে কাছে থেকেও এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। কী সাংঘাতিক ঘুম তার!
লায়লা বেগম লরিন কে দেখে বসতে বললেন। রাফাত আসার সময় নাস্তা নিয়ে এসেছে। সবাই এখন নাস্তা খাবে। লরিন ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে। মাহবুব সাহেব হালকা খাবার খেয়ে রেস্ট নিচ্ছেলেন। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার তিনি লরিনকে খেয়াল করলেন। অপরিচিত লাগল তাকে। মাহবুব সাহেব আস্তে করে লায়লা বেগমকে ডাকলেন। লায়লা বেগম কাছে গেলে তিনি তাকে লরিনের কথা জিজ্ঞেস করলেন। লায়লা বেগম বললেন, লরিন মোহনার বন্ধু আরো বললেন সেই তাকে কে রক্ত দিয়ে সাহায্য করেছে। মাহবুব সাহেব বেশ খুশি হলেন। লরিনকে আস্তে করে ডাকলেন। লরিন তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মাহবুব সাহেব নিচু স্বরে বললেন,

‘ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি না থাকলে হয়তো আজ আমার অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেত। তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া রইল বাবা।’

লরিন খুশি খুশি গলায় বলল,

‘আমি কৃতজ্ঞ আংকেল। আপনার সুস্থতা কামনা করছি।’

মাহবুব সাহেব আলতো হেসে বললেন,

‘আচ্ছা, যাও খেতে বসো।’

সবাই একসাথে বসে সকালের নাস্তা করল। মাহবুব সাহেব বেডে হেলান দিয়ে বসে সবাইকে দেখছিলেন। লরিনকে একটু বেশিই খেয়াল করছিলেন। সে যে বিদেশি সেটা বুঝতে মাহবুব সাহেবের বেশি একটা সময় নিল না। তার কথাবার্তা, তার শারীরিক গঠন খুব সহজেই এটা বুঝিয়ে দেয় যে সে বিদেশি। তাও ছেলেটার মাঝে একটা দেশি দেশি ভাব আছে। কেমন খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। মাহবুব সাহেবের মনে বেশ কৌতূহল জাগে ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু জানার জন্য। মোহনাও কখনো তার এই বন্ধুর সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়নি। নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে হয়তো। হ্যাঁ, হয়তো এইজন্যই মোহনা ওকে আপনি আপনি করে সম্বোধন করছে।
.

মোহনা বাবাকে একটা ঔষধ দিয়ে বলল,

‘বাবা, নাও। এই ঔষধটা এখন খেতে হবে।’

মাহবুব সাহেব ঔষধটা খেয়ে নিলেন। রুমে তখন মোহনার বন্ধুরা কেউ নেই। মোহনা ঔষধের প্যাকেট নিয়ে বক্সে রাখছিল। তার বাবা তখন বলল,

‘লরিন কি বিদেশি, মোহনা?’

মোহনা তাকিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল,

‘হ্যাঁ বাবা, ও বিদেশি।’

‘আচ্ছা। তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?’

মোহনা ঢোক গিলে। আবারও মিথ্যে বলতে হবে। তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে সে বলে দিল,

‘হ্যাঁ।’

‘তোমরা কি একই ব্যাচের?’

মোহনা মাথা খাটিয়ে বলল,

‘না বাবা, ও আমার এক ব্যাচ সিনিয়র।’

‘ওহহ আচ্ছা। ছেলেটা ভালোই। বিদেশি হলেও খুব সুন্দর বাংলা বলতে পারে। ওর সাথে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে।’

মোহনা প্রত্যুত্তরে ম্লান হাসে। বাবা বলেন,

‘কালকে থেকে তো তোমাদের উপরও কম ধকল যাইনি। তাই যাও এখন তোমাদের মা’কে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি এখানে একাই থাকতে পারবো। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।’

‘না বাবা, একসাথে সবার যাওয়ার দরকার নেই। মা আর মাহিয়া এখন যাক। তারপর ওরা এলে আবার আমি যাবো।’

‘আহা, এত ঝামেলা করার কী দরকার। একসাথে যাও একসাথে চলে আসবে। আমি এখানে একা থাকতে পারব।’

ওয়াশরুম থেকে মোহনার মা এসে বললেন,

‘মোহনা যা বলেছে তাই হবে। তোমার একা থাকার দরকার নেই। আমি আর মাহিয়া আগে গিয়ে আসি তারপর মোহনা যাবে।’

মাহবুব সাহেব তর্কে হেরে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মহিলা মানুষ সব এক কথায় থাকলে তখন তর্ক না করে চুপ থাকায় শ্রেয়।

মা আর মাহিয়া বাসায় গেল। মোহনা হসপিটালে একাই। মাহবুব সাহেব চোখ বুজে শুয়ে আছেন। এশা আছে তবে রাফাত কোথাও গিয়েছে। সকালের খাবারের পর মোহনা আর লরিন কে দেখেনি। হয়তো সেও হোটেলে ফিরে গিয়েছে।

কিছুক্ষণ বাদেই লায়লা বেগম আর মাহিয়া ফিরে আসে। মা একেবারে দুপুরের রান্নাবান্না করে নিয়ে এসেছেন। মোহনা এবার বাসার দিকে যায়। সে রিক্সা ডেকে রিক্সায় উঠার সঙ্গে সঙ্গেই কোথ থেকে যেন লরিন এসে হাজির হয়। মোহনা অবাক চিত্তে বলে,

‘আপনি আবার কোথ থেকে এলেন?’

লরিন জবাব না দিয়ে রিক্সায় উঠে তার পাশে বসে পড়ল। মোহনা বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,

‘আরে কী হলো?’

লরিন তাকে পাত্তা না দিয়েই রিক্সাওয়ালকে বলল,

‘মামা চলেন..’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here