প্রণয় রেখা পর্ব ১৫

0
465

#প্রণয়_রখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৫.

একসঙ্গে সবাই দুপুরের খাওয়া দাওয়া করেছে। সকাল থেকে দুপুর এই পুরোটা মোহনা বেশ বিস্ময় নিয়ে লরিন কে দেখছিল। লরিনের ব্যবহারে যেন সে ক্রমে ক্রমে কেবল মুগ্ধই হচ্ছিল। ছেলেটা কী সুন্দর ভাবে সবার সাথে মিশে গিয়েছে। যেন এটা তারই পরিবার। মাহিয়ার সাথে সেকি তার দুষ্টুমি। তার গম্ভীর আর রাগী বাবাটাও যেন লরিনকে বেশ পছন্দ করলেন। এত সহজে আজ অবধি কেউ উনার পছন্দের পাত্র হতে পারেনি। তবে লরিন ক্ষণিকের মাঝেই তার সুহৃদ হয়ে উঠল।

খাওয়া দাওয়া শেষ ড্রয়িং রুমে গিয়ে আবার সবাই বসল। মোহনা তখন ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে লরিন কী করছে। দেখল, তাদের আড্ডা আবারও জমে উঠেছে। মোহনা লরিনকে ইশারা দিতে চাইল। কিন্তু লরিন তার খোশগল্পে এত ব্যস্ত যে মোহনা কে দেখার সময় কই তার। বাবার সামনে জোরে যে ডাকবে সেই সুযোগও পাচ্ছে না। পেছন থেকে এশা এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘কিরে, বেটা তো তার শ্বশুর মশাইকে ভালোই হাত করে নিচ্ছে।’

মোহনা চোখ রাঙিয়ে বলে,

‘বাজে বকিস না না তো। এই রাফাতকে মেসেজ দিয়ে আমার রুমে আসতে বল।’

‘উমা, এখান থেকে ডাকলেই তো হয়।’

‘না, বাবার সামনে এখন ডাকা যাবে না। তুই ওকে মেসেজ দে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, দিচ্ছি।’

এশা রাফাতকে মেসেজ দিলেও রাফাত সেটা সিন করল না। ফোন তো তার হাতে নেই, পকেটে। সেও এখন বেশ আড্ডায় মেতেছে। ছেলে মানুষ, খেলা বিষয়ক আলোচনা বেশ পছন্দ করে।

মোহনাও দরজার সামনে থেকে নড়ছে না। আড়াল থেকে তাদের সব কথা বার্তা শোনার চেষ্টা করছে। কথা তালে তালেই মোহনার বাবা হঠাৎ লরিন কে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তোমাদের দেশে এত ইউনিভার্সিটি থাকতে তুমি এখানে এসে কেন ভর্তি হলে? আমি তো আরো ভাবছিলাম মোহনাকে মাস্টার্স এর জন্য লন্ডন পাঠাব। তোমাদের এখানের “ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন” তো বেশ ভালো পড়াশোনার জন্য। আমার তো খুব ইচ্ছা মোহনাকে এটাতেই ভর্তি করব। অনার্সেই ইচ্ছে ছিল তবে কোনো কারণবশত হয়ে উঠেনি। তা তুমি এত ভালো ভালো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে এখানে এলে যে? তোমার মা বাবা কেউ কি বাংলাদেশি?’

বাবার প্রশ্ন শুনে মোহনার পিলে চমকে উঠে। এখনই সব সত্য বেরিয়ে যাবে। এই হাঁদারাম সব সত্যি বলে দিবে নিশ্চিত। এখনই একে না সরালে কেল্লা ফতে। মোহনা আর দেরি না করে এক ছুটে রুমে ঢুকে পড়ে। কী বলবে কী বলবে ভাবতে ভাবতে বলে,

‘লরিন…লরিন ভাইয়া, আপনার না চারটার দিকে একটা ক্লাস আছে? ঐ দেখুন চারটা বাজতে চলল, আপনার এখনই যাওয়া উচিত। নাহলে ক্লাস মিস হয়ে যাবে।’

লরিন হতভম্ব। সে ঠিক শুনছে তো? মোহনা তাকে ভাইয়া বলেছে? সিরিয়াসলি? লরিনের চোখে মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমতে শুরু করে। এত বিষন্ন তাকে আগে কখনো দেখা যায়নি। সে যেন এটা হজম করতে পারছে না। মোহনা তাকে বাসা থেকে বের করার জন্য শেষ পর্যন্ত ভাইও ডাকল। ব্যাপারটাই লরিনের খুবই মনক্ষুন্ন হলো। সে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ওহ হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আংকেল, আমার এখন একটা ক্লাস আছে, আমার তাই যেতে হবে। আপনি আপনার খেয়াল রাখবেন। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’

তারপর সে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মোহনার দিকে একবার চেয়ে বলল,

‘আন্টিকেও আমার সালাম দিও।’

তারপর সে আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল। আশ্চর্য! মোহনা বোকার মতো চেয়ে রইল কেবল। কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে তার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। ছেলেটা তার উপর আবারও ক্ষেপেছে। কিন্তু এখানে তার কী দোষ। সে তাকে এভাবে বিদায় না করলে তো এক্ষুণি সব ফাঁস হয়ে যেত। তবে ভাইয়া ডাকটা সত্যিই বেচারার একেবারে কলিজায় গিয়ে লেগেছে। সেও তো কম হাঁদারাম না, একবার বুঝল না বাবা সামনে বলে ভাইয়া ডেকেছে।

মোহনা জোরে নিশ্বাস ছাড়ে। যাকগে, ও যা খুশি ভাবুক তাতে তার কী।

মোহনা চলে আসতে নিলে মাহবুব সাহেব তাকে ডাকলেন। মোহনা ফিরে বলল,

‘বাবা, কিছু বলবে?’

মাহবুব সাহেব গম্ভীর সুরে বললেন,

‘ছেলেটা কে তো এক কাপ চাও খেতে দিলে না, এত তাড়া দিয়ে বের করে দিলে কেন?’

মোহনা ইতস্তত কন্ঠে বলল,

‘বাবা, আমি উনাকে তাড়া দেইনি তো। উনার এখন ক্লাস আছে, সেটাই বলেছি শুধু। ক্লাসটা বোধ হয় খুব জরুরি ছিল, তাই হয়তো নিজেই এত তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন। সমস্যা নেই, আবার অন্য একদিন আসতে বলবনি।’

‘ঠিক আছে।’

রুমে ফিরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মোহনা। উফ, বাবাও যেভাবে প্রশ্ন করে তার তো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে বিছানায় গিয়ে এশার পাশে বসল। তখনই মাহিয়া বেলকনি থেকে ছুটে এসে রাগ দেখিয়ে বলতে লাগল,

‘ভাইয়া আরেকটু থাকলে কী হতো, হে?’

মোহনা ধমক দিয়ে বলল,

‘এত ভাইয়া ভাইয়া করছিস কেন? মনে হচ্ছে যেন ও তোর মায়ের পেটের ভাই।’

মাহিয়া নাক মুখ ফুলিয়ে অভিমানের সুরে বলল,

‘মায়ের পেটের ভাই হলে ভালোই হতো। ভাইয়া খুব ভালো। তোমার মতো এত ঝগড়াটে না। কী সুন্দর করে কথা বলে। একটুও রাগ নেই।’

‘আহা, প্রথম দেখাতেই এত কিছু বুঝে গেলি? শোন, অপরিচিত মানুষের সাথে সবাই এমন সুন্দর করে কথা বলে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো তুই যদি ওর বোন হতি তাহলে তুই জীবনেও ওর এত প্রশংসা করতে পারতি না। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের নিজের ভাই বোন ব্যতিত পৃথিবীর অন্য সব ভাই বোনকে পছন্দ করে। আর কী, ওর রাগ নেই বলছিলি? বেটা নিমচা শয়তান। যত শয়তানি পেটে পেটে। মানুষের সামনে একেবারে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যায়।’

মাহিয়া খুব রাগ দেখিয়ে বিছানার অপর প্রান্তে গিয়ে বসল। ফ্যাচফ্যাচ করতে করতে বলল,

‘হ্যাঁ, যেন উনিই খুব ভালো। পৃথিবীতে আর কোনো ভালো মানুষ নেই। বেচারা ভাইয়ার মুখটা কী চুপসে ছিল। জানো, নিচ থেকে আমাকে হাত নাড়িয়ে বাই বলেছে। হাসি আসছিল না তাও আমাকে দেখে জোর করে হেসেছে। তুমি নিশ্চয়ই ভাইয়াকে খুব কষ্ট দিয়েছ তাই ভাইয়ার মুখটা অমন হয়ে গিয়েছে।’

বোনের ক্যাচাল শুনতে শুনতে মোহনা বিরক্ত হয়ে কানে হাত দিয়ে বসে। উফ, মেয়েটার মায়া যেন উপচে পড়ছে। কই এত মায়া তো কোনোদিন তার জন্যও দেখায়নি। আজ লরিনের জন্য যেন বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। যতসব অদ্ভুত বিষয়!

.

বিকেলের দিকে এশা আর রাফাতও তাদের বাড়িতে ফিয়ে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পর মোহনা আর মাহিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। বেশ অনেকটা সময় দুজনে ঘুমায়। প্রায় রাত আটটার দিকে তাদের ঘুমের ইতি ঘটে। মাহিয়া একটু আগেই উঠে যায়। সে ঘুম থেকে উঠেই মোহনার ফোনটা আস্তে করে হাতে নেয়। গোপনে ভাবে কিছু একটা করবে। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল হবার আগেই মোহনার ঘুম ভেঙে যায়। তাকে দেখেই মাহিয়া দ্রুত ফোনটা রেখে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মোহনাও আর ঘুমের ঘোরে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।

_______________

রাতের খাবার শেষ করে মাহবুব সাহেব সকলকে তার রুমে যেতে বললেন। কী যেন জরুরি কথা বলবেন। তার আদেশ মতো সবাই তার রুমে গেল। মাহবুব সাহেব বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন। তার হাত পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হলেও মাথার টা এখনো খোলা হয়নি। মাহিয়া আর মোহনা বাবার পায়ের নিচে বসল। তাদের মা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করছিলেন। মাহবুব সাহেব কিছুক্ষণ ভাবুক মনে বসে থেকে অতঃপর বললেন,

‘মোহনা, কাল কি তোমার ক্লাস আছে?’

‘জি বাবা, আছে তো।’

‘কালকে তোমার ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার নেই।’

মোহনা বেশ অবাক হলো। বাবা তাকে ভার্সিটিতে যেতে বারণ করছে? সে বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘কেন বাবা? কাল কি কিছু আছে?’

‘হ্যাঁ, কাল আমাদের বাসায় মেহমান আসবেন। তুমি কাল বাসায়ই থেকো, মা’কে কাজে সাহায্য করতে পারবে।’

মাহিয়া ভীষণ উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘কারা আসবেন বাবা?’

‘তোমার অরূপ ভাইয়া আর তার মা বাবা।’

মাহিয়া খুব খুশি হলো। অরূপ ভাইয়া তাকে ভীষণ ভালোবাসে। বিদেশ থেকে আসার সময় নিশ্চয়ই তার জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছে। সে তো সেই খুশিতে আজ রাতে আর ঘুমাতে পারবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here