প্রণয় রেখা পর্ব ১২

0
491

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২.

রাতে কেবল একটা স্যুপ’ই মাহবুব সাহেব কে দেওয়া হলো। বেশি ভারী খাবার তিনি আপাতত খেতে পারবেন না। মাহিয়ার এতে খুব মনক্ষুন্ন হলো। ঐটুকু একটা স্যুপে কি আর কারো পেট ভরে? বাবার মতো এমন বলিষ্ঠ দেহী মানুষদের সুস্থ থাকার জন্য আরো বেশি খাবারের প্রয়োজন, ডাক্তাররা কি এসব বোঝেন না? মাহিয়ার অভিযোগের আর অন্ত নেই। মাহবুব সাহেব এই শরীরেও মেয়ের কথা শুনে প্রসন্ন হাসলেন। বাবার পেট ভরল না বলে মেয়ের কত কষ্ট। আহ, মেয়ের কী চিন্তা, কী ভালোবাসা!

মোহনা দেখে দেখে বাবাকে ঔষধ খাইয়ে দিল। রাতে তাদের একটা বড়ো কেবিনে শিফট করা হলো। মাহবুব সাহেব সারাদিনের অসুস্থতায় ঘুমিয়ে পড়লেন। এতক্ষণ মোহনা মাহিয়া আর তাদের মা কেবিনেই ছিল। মাহবুব সাহেব ঘুমিয়ে পড়ায় এখন তারা কেবিনের বাইরে বেরিয়েছে। বাইরে এশা রাফাতের সাথে দূরে একটা বেঞ্চে লরিনও বসে আছে। লরিন কে দেখেই মোহনা তার কাছে যায়। গিয়ে বলে,

‘আপনি এখনো যাননি কেন?’

‘ঠোমার বাবা ঘুমিয়েছেন?’

‘জ্বি, কিন্তু আপনি এখনো এখানে বসে আছেন যে? আপনি হোটেলে ফিরে যান। আপনারও রেস্ট প্রয়োজন।’

‘না না, আমি ঠিক আছি। ঠোমরা তো কিছু খাওনি তাই না? আমি খাবার নিয়ে এসেছি সবার জন্য। এগুলো খেয়ে নিও।’

এই বলে লরিন মোহনার দিকে খাবারের প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিল। মোহনা যেন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। লরিন কখন গিয়ে খাবার আনল তার কোনো ধারণা নেই। সে ইতস্তত করছে খাবারের প্যাকেটগুলো নিবে কী নিবে না। এশা পেছন থেকে এসে বলল,

‘কী হলো নে।’

মোহনা এশার দিকে তাকালে এশা তাকে ইশারা দিয়ে আশ্বস্ত করে। মোহনা প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ। তবে খাবার না আনলেও চলতো। আমরা ক্যান্টিনে খেয়ে নিতে পারতাম। তবে কষ্ট করে আনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি খেয়েছেন?’

লরিন মাথা নাড়িয়ে না করল। মোহনা বলল,

‘চলুন, আমাদের সাথে খেয়ে নিবেন।’

লরিন খুশি হলো। তার ক্ষুদ্র মন যেন এইটুকু আহ্বানেই বারবার প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। এই আহ্বানে আনন্দ আছে, আছে ভালোলাগা। লরিন তার পেছন পেছন গেল। মোহনা মা’র কাছে গিয়ে বলল,

‘আম্মু দেখো, লরিন আমদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে।’

লায়লা বেগম আরো বেশি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়লেন। আপ্লুত কন্ঠে বললেন,

‘আমাদের জন্য আর কত কষ্ট করবে বাবা? এমনিতেই তুমি এতকিছু করলে, তার উপর এত খাবার আনার কী দরকার ছিল?’

লরিন জবাব না দিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিল। তারপর সবাই কেবিনের ভেতরের একটা টেবিলে খেতে বসল। খাবারের প্যাকেটগুলো খুলে মোহনা অবাক হলো খুব। এতসব বাঙালী খাবার লরিন খুঁজে খুঁজে আনল কী করে। সে লরিনের দিকে তাকাতেই লরিন তার বিস্ময় বুঝতে পারে। মোহনা প্রশ্ন করার আগেই তাই সে জবাব দিয়ে উঠে,

‘রাফাতকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই খাবারগুলো কিনতে আমাখে সাহায্য করেছে।’

মোহনা ম্লান হেসে সবার প্লেটে খাবার বাড়তে লাগল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাফাত আর এশা চলে গেল তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও তারা কেউই যেতে চাচ্ছিল না তবে মোহনা তাদের জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। কেবিনের ভেতরে আরেকটা বেডে মাহিয়া আর তার মা শুয়ে পড়েছে। মোহনা একটা সোফায় কিছুক্ষণ শুয়েছিল। তবে তার ঘুম আসছিল না। উঠে আস্তে আস্তে বাইরে বের হলো সে। যদিও এখন অনেক রাত। তবে হসপিটালের বাইরের পরিবেশ যেন অন্য কথা বলছে। বাইরে এখনো বেশ মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন। বেশ কিছু ডাক্তার নিজস্ব পেশেন্ট দেখায় ব্যস্ত হয়ে আছেন। এর মাঝেই মোহনা বাইরে লম্বা বারান্দায় হাঁটতে লাগল। কিছুটা সামনে যেতেই সে থেমে যায়। দূর থেকে লরিন কে আসতে দেখে কপালে চওড়া ভাঁজ ফেলে। লরিনের হতে ধোঁয়া উঠা ওয়ান টাইম কফির গ্লাসটা তো অন্য সুর গাইছে। তারমানে লরিন এতক্ষণ এইখানেই ছিল, সে হোটেলে ফিরে যায়নি? লরিন আরো কিছুটা পথ এগিয়ে এসেই মোহনা কে দেখে থমকে দাঁড়ায় তারপর মুচকি হেসে আবারও সামনের দিকে এগুতে থাকে। মোহনার একেবারে কাছে আসার পর মোহনা বিচেলিত গলায় বলে উঠে,

‘আপনি এখনও যাননি?’

‘না।’

‘কেন?’

‘সবাই চলে গেলে এখানে কে ঠাকবে?’

মোহনা বলল,

‘আমরা আছি তো।’

‘তাও মনে হলো আমার ঠাকার প্রয়োজন। তাই ঠেকেছি।’

এই বলে সে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল। তার পেছন পেছন মোহনাও গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

‘আপনার হোটেলে ফিরে যাওয়া উচিত লরিন। আমরা সবাই এখানে আছি। কোনো অসুবিধা হলে আমি আপনাকে বলবো। আপাতত আপনি ফিরে যান।’

লরিন চোখ উপরে করে চেয়ে বলল,

‘আমার এখানে ঠাকাতে ঠোমার এত কিসের আপত্তি? আমি তো আর ঠোমাকে বিরক্ত করছি না। ঠুমি বরং কেবিনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়, ঠোমার এখন রেস্টের প্রয়োজন।’

মোহনা ঈষৎ চটে গেল। বলল,

‘আপনারও রেস্টের প্রয়োজন মি. ডানিয়েল লরিন। এখানে বসে বসে কফি খেয়ে ঘুমের বারোটা না বাজিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়ে একটা ঘুম দেন। তারপর না হয় কাল সকালে এসে আবার দেখা করে যাবেন। আর এটাতেই আপনার ভালো, বুঝেছেন?’

‘আমার ভালো ঠুমি বুঝবে না। থাক বাড দাও, কফি খাবে?’

মোহনা কোমরে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস টানল। তা দেখে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল লরিন। লরিনের হাসিতে মোহনা কেমন বিব্রত বোধ করল। তাই সে কোমর থেকে হাত সরিয়ে বলল,

‘হাসছেন কেন?’

‘You are just looking a angry bird. My angry bird.’

এই বলে সে কফির কাপে চুমুক দেয়। মোহনা অবাক চিত্তে ভাবতে থাকে, ছেলেটা বাঙালী না হয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। যদি সে বাঙালী হতো তবে একটা খাঁটি প্রেমিক পুরুষ হতে পারতো। দেবদাসের মতো কঠিন হতো তার সেই প্রেম। রবীন্দ্রনাথের মতো তখন তীক্ষ্ণ হতো তার প্রেমের কবিতা। ইশ, বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে বাঙালী না হয়ে। তবে মোহনাও হতে পারতো তার একনিষ্ঠ সুদর্শনা, তার কোমল হৃদয়ের প্রেমপূজারী। আহ, কী একটা সুযোগ মিস হয়ে গেল।

মোহনা এক সিট জায়গা ফাঁকা রেখে বসল। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। অতঃপর বলল,

‘আপনি কি আজ ঐ ঝুমকোগুলো কিনেছিলেন?’

লরিন তাকাল তার দিকে। ভ্রু খানিক কুঁচকে বলল,

‘ঝুমকা মিনস?’

‘Earing.’

‘ওহ।’

“ওহ” বলে লরিন আবার তার কফি পানে মনোযোগ দিল। মোহনা তাকিয়ে আছে তার জবাবের জন্য। লরিন তাতে পাত্তা না দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে এদিক ওদিক দেখছে আর কফি খাচ্ছে। মোহনা বিরক্ত হয়ে গলা ঝাড়ে। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি লরিন; উত্তর দিচ্ছেন না কেন?’

লরিন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আহ্লাদিত কন্ঠে বলল,

‘কফি খাবে?’

মোহনা নাকের পাল্লা ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। লোকটার সাথে কথা বলাই বৃথা। লরিন মোহনার রাগকে খুব একটা আমলে নিল না। সে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বলল,

‘আরো দু কাপ কফি আনছি। একসাথে খাবো।’

এই বলেই সে কফি আনতে চলে গেল। আর মোহনা আহাম্মকের মতো চেয়ে তার যাওয়া দেখল। লোকটার কি আজ কফির পিনিক উঠেছে নাকি? খালি কফি কফি করছে কেন, আশ্চর্য!

মোহনার সাথে কফি খেয়ে তবেই হাল ছাড়ল লরিন। সে এবার তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ল। মোহনার দিকে চেয়ে দেখল তার চোখ মুখ এখনো আগের মতোই বিরক্তের সাগরে ডুবে আছে। মোহনার দুই ভ্রু’র মাঝে কুঁচকে যাওয়া অংশটা যেন খুব নিখুঁত ভাবে তার নিরব রাগটা ফুটিয়ে তুলছে। মেয়েদের এমন নিরব রাগ বেশ সুন্দর। মোহনা এমনিতেই সুন্দর, এখন তাকে আরো সুন্দর লাগছে। লরিন চেয়ে থেকে ম্লান সুরে বলল,

‘ঠুমি খুব সুন্দর মোহনা।’

মোহনা লরিনের দিকে তাকাতেই লরিন অপ্রস্তুত ভঙিতে হাসল। মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমার সৌন্দর্যের মোহে’ই হয়তো আপনি পড়েছেন।’

লরিন আলতো হেসে বলল,

‘ভালোবাসতে কি সৌন্দর্যের প্রয়োজন হয়?’

মোহনা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

‘জানি না।’

লরিন বলল,

‘মানুষ সুন্দরের প্রেমে পড়ে, আমিও পড়েছি। তবে সেই সৌন্দর্যঠা আত্মিক। আর এই সৌন্দর্য অবিনশ্বর। আর ঠাই আমার প্রেমও অবিনশ্বর।’

মোহনা অবাক হয়ে তাকাল। বলল,

‘এসব কথা আপনাকে কে শিখেয়েছে লরিন? এত কঠিন কথা আপনি কার থেকে শিখলেন?’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here