#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১.
লায়লা বেগম হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। মোহনা আর মাহিয়া মা’কে কোনোমতেই শান্ত করতে পারছে না। তাদের নিজেদের মনও খুব একটা শান্ত নয়। কেবল মা’কে দেখিয়ে তারা সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। মাহিয়ার চোখ থেকেও জল পড়ছে। বাবার কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত তার সাদা শার্ট টা নষ্ট করে দিয়েছে। সেই শার্ট টা তার চোখে ভাসছে। বাবার বুজে থাকা চোখগুলো তাকে পীড়া দিচ্ছে। বাবাকে অমন ভাবে দেখাটা তার মস্তিষ্ক মানিয়ে নিতে পারছে না। বুকের ভেতরে ছটফট করছে। মোহনা নিস্তব্ধ নয়নে বাবাকে দেখেছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে বাবা তার কপালে চুমু খেয়েছিল। তাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিল। আর এই ক্ষণিক সময়ের ব্যবধানে এত কিছু হয়ে গেল, আশ্চর্য!
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর বেরিয়ে এসে বললেন,
‘পেশেন্টের খুব রক্ত গিয়েছে। উনার এখন ইমারজেন্সি রক্ত প্রয়োজন। আপনাদের মধ্যে কারো রক্তের গ্রুপ কি বি পজেটিভ?’
মোহনা তার মা আর বোনের দিকে তাকাল। তাদের তিনজনেরই রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ। মোহনা বলল,
‘না ডাক্তার। আমাদের রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ।’
‘তাহলে এক কাজ করুন, আপনাদের পরিচিত কেউ বি পজেটিভ রক্তের থেকে থাকলে তাকে এক্ষুণি আসতে বলুন। আমাদের ব্লাড ব্যাংকে বর্তমানে এই গ্রুপের রক্ত নেই। আর এই দিকে কোনো ব্যাংককেই এই রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারা একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন পান কিনা। পেলে আমাকে জানাবেন।’
মোহনার খুব ভয় করছে। সে কাঁপাকাঁপা হাতে তার ফোন থেকে তার সকল ফ্রেন্ডদের কল দিল। কিন্তু তাদের কারোরই রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ না। ঐদিকে এশা আর রাফাত এসব শোনার পর তারাও রক্ত খুঁজতে লাগল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এই গ্রুপের রক্ত খুব কম মানুষেরই হয়ে থাকে। তাই এই গ্রুপের রক্ত ম্যানেজ করা খুব কষ্ট সাধ্য।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও মোহনা কোনো রক্তদাতা জোগাড় করতে পারল না। ডাক্তার আবার এল। তাদের তাড়া দিয়ে বলল যা করার একটু তাড়াতাড়ি করতে, পেশেন্টের অবস্থা ভালো নেই। মোহনার মা’র কান্না আরো বেড়ে যায়। মাহিয়াও কাঁদতে আরম্ভ করে। মোহনা কোনো উপায় বের করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তার ছোট কাকার রক্তের গ্রুপ ও বি পজেটিভ। কিন্তু উনি এখন আসতে চাইলেও পারবেন না। এতটা পথ আসতে আসতে অনেক সময় চলে যাবে। ততক্ষণে হয়তো বাবার অবস্থা আরো খারাপের দিকে চলে যাবে। রাফাত আর এশাও হসপিটালে আসে। তারাও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে রক্তের জোগান দেওয়ার জন্য। ফেইসবুকেও পোস্ট দিয়েছে। একজন রক্তদাতাও পেয়েছে। কিন্তু তারও হসপিটালের পৌঁছাতে দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে। কিন্তু এত সময় তাদের হাতে নেই।
মোহনা অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে চলছে। নিজেকে তার বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। বাবার এই কঠিন সময়ে সে বাবাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারছে না। কেমন মেয়ে সে, বাবার জন্য সামান্য রক্তের জোগান দিতে পারছে না?
মোহনা অনেক ভেবে মনে হলো, সবাইকেই যখন বলেছে তখন লাস্ট একবার লরিনকেও বলা উচিত। হতেও তো পারে ওর রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ।
মোহনা তাই করল। আর দেরি না করে লরিন কে মেসেঞ্জারে আনব্লক করে কল করল। কয়েকবার কল করার পর কলটা রিসিভ হলো। মোহনা ইতস্তত কন্ঠে বলল,
‘আমাকে একটা সাহায্য করবেন, লরিন?’
‘সাহায্য? Means help?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেমন সাহায্য?’
মোহনা ঢোক গিলে বলল,
‘আপনার ব্লাড গ্রুপ কী?’
লরিন অবাক হলো। বলল,
‘ব্লাড গ্রুপ দিয়ে কী হবে?’
‘আগে বলুন না।’
লরিন বলল,
‘বি পজেটিভ।’
মোহনা যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। কেঁদে ফেলল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘লরিন, আপনাকে এক্ষুণি একবার হসপিটালে আসতে হবে। আমার বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন। আমার বাবাকে বাঁচাতে হবে। প্লীজ, আমাকে আপনি সাহায্য করুন। আমার বাবাকে এক ব্যাগ রক্ত দিন। প্লীজ লরিন।’
‘ঠিক আছে, আপনি আমাখে ঠিকানা দিন। আমি এখনি আসছি।’
মোহনা ঠিকানা দিল। তারপর ফোন কেটে মা’র কাছে দৌড়ে গেল। বলল,
‘মা, রক্তের জোগান হয়ে গিয়েছে।’
লায়লা বেগম খুশি মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। এশা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
‘লরিন কে কল করেছিলি?’
মোহনা তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল।
.
.
লরিন এল। মোহনা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে গেল। ডাক্তার প্রথমে তার একটু রক্ত নিয়ে ভালোভাবে টেস্ট করে নিল। টেস্টের সব রিপোর্ট ভালো এসেছে। মোহনা এতে ভীষণ খুশি হয়। ডাক্তার লরিন কে একটা বেডে শুইয়ে তার হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে দেন। মোহনা তার পাশেই ছিল। লরিন মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে,
‘ঠোমার বাবার কী হয়েছে?’
মোহনা থমথমে স্বরে বলে,
‘এক্সিডেন্ট।’
‘ও মাই গড। এখন উনি কেমন আছেন?’
‘ভালো নেই। খুব রক্ত গিয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে রক্ত লেগেছে। কোথাও পাচ্ছিলাম না। অবশেষে আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন। ধন্যবাদ লরিন।’
লরিন জবাব দিল না। সে তার হাতের ক্যানোলার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
‘শুধুই ঢন্যবাদ?’
প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে বললেন,
‘উনার অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। মাথায় পাঁচটা সেলাই লেগেছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিলে গিয়েছে, সেগুলো ড্রেসিং করে দিয়েছি। আপাতত উনার জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো চলে আসবে। আপনারা এখন বাইরেই অপেক্ষা করুন। উনার জ্ঞান ফিরলে নার্স এসে আপনাদের বলবে।’
পাঁচটার সেলাই এর কথা শুনে মাহিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘বাবার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে আপু, তাই না?’
মোহনা ঠোঁট গুঁজ করে মাথা নাড়াল। লায়লা বেগম মাহিয়াকে বুকে টেনে আদর করলেন। তারপর হঠাৎ লরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ওই তো রক্ত দিয়েছে? ও কে মোহনা?’
মোহনা লরিনের দিকে এক পলক চেয়ে বলল,
‘আমার বন্ধু মা।’
লরিন অবাক হলো ভীষণ। বড়ো বড়ো চোখ করে সে মোহনার দিকে তাকাল। লায়লা বেগম তখন লরিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা। তুমি ছিলে বলেই আমার স্বামীর আজ এত বড়ো উপকার হয়েছে। রক্ত না পেলে না জানি কী হতো। তোমার এই ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারব না।’
লরিন আলতো হেসে বলল,
‘It’s my pleasure aunty. আপনাদের সাহায্য করতে পেরে আমার নিজেরও খুব ভালো লাগছে।’
লায়লা বেগম প্রসন্ন গলায় বললেন,
‘তুমি খুব ভালো ছেলে বাবা। দোয়া করি তুমি অনেক বড়ো হও।’
মোহনা আড়চোখে লরিনের দিকে তাকাল। লরিনের চোখ মুখ খুশিতে যেন ঝলমল করছে। যেন বাংলাদেশে আসা আজ তার স্বার্থক হয়েছে। সে মোহনার দিকে তাকাতেই মোহনা চোখ সরিয়ে ফেলে। লরিন অতঃপর মুচকি হেসে দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে আরাম করে বসে।
মাহবুব সাহেবের জ্ঞান ফিরলে একে একে কেবিনে সবাই প্রবেশ করে। জ্ঞান ফিরলেও তিনি এখনো কথা বলার অবস্থাতে নেই। মাথায় উনার খুব আঘাত লেগেছে। তিনি নিষ্পলক চোখে চেয়ে কেবল উনার স্ত্রী আর দুই মেয়েকে দেখছেন। উনাকে ছাড়া এই মানুষগুলো কতটা অসহায়। এই কিছুটা সময়ে একেক জনের চেহারা কেমন হয়ে গিয়েছে। যদি কখনো সত্যি সত্যিই উনি একেবারে হারিয়ে যান তখন এই মানুষগুলোর কী হবে। কীভাবে নিজেদের ওরা সামলে নিবে। আহ, ভাবতেই উনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। উনি না থাকলে কে এই মানুষগুলোকে আগলে রাখবে? কে?
মাহিয়া কাঁদছে। মোহনা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বাবা ইশারা দিয়ে তাদের কষ্ট পেতে বারণ করে। তাও মাহিয়া কাঁদছে। বাবার ঐ রুক্ষ কঠিন মুখটাতে এই নরম অসহায়ত্বের ছোঁয়া তারা মেনে নিতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে। লায়লা বেগমও নিরব চোখে তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে। এই মানুষটাকে ছাড়া তিনি যে ঠিক কতটা অসহায় এই কিছুটা সময়ে সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
চলবে…