প্রণয় রেখা পর্ব ১০

0
526

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১০.

মোহনা অত্যন্ত বিস্ময় নিয়ে ভেবে চলছে এই প্যাকেট তাকে কে পাঠিয়েছে। অনেক ভেবে মস্তিষ্কে একটা উত্তর’ই ছুটে এল, “লরিন” নয়তো। মোহনা প্যাকেট টা এবার খুলল। ভেতরে সেই ঝুমকো গুলো দেখে আরেকদফা চমকাল সে। অতি আশ্চর্যের বিষয়! এই প্যাকেট যদি লরিনও দিয়ে থাকে কিন্তু ও বুঝল কী করে যে মোহনার এই ঝুমকোগুলোই পছন্দ হয়েছিল? তবে কি সে মোহনাকে কোনোভাবে ফলো করছে? মোহনা এবার সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চেয়ে দেখল আশে পাশে কেউ আছে কিনা। না, এইদিকে পরিচিত কেউ নেই। সেই বাচ্চাটাকেও আর খুঁজে পেল না সে। এবার এই ঝুমকা নিয়ে কী করবে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। কে এইগুলো পাঠিয়েছে সেটাও সে শিউর না। এইগুলো যেমন ছুঁড়ে ফেলে দিতেও পারছে না আবার ব্যাগে করে নিতেও পারছে। উফফ, এতো ঝামেলার উপর মহাঝামেলা। সে বিরক্ত হয়ে ঝুমকোগুলো হাতে নিয়েই বাসার দিকে হেঁটে চলল।

বাসার গেইটের সামনে গিয়ে সে ঝুমকোগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। বাবার চোখে পড়লে আবার আরেক ঝামেলায় পড়তে হতে পারে, তাই আর সে রিস্ক নিল না। রুমে এসে ফ্রেশ হতে গেল। গোসল থেকে বেরিয়ে বেলকনিতে গেল ভেজা কাপড় নাড়তে। তখন হঠাৎই চোখ গেল, মনে হলো বাইরের দূরের নারকেল গাছটার আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। মোহনা চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। বোঝার চেষ্টা করল লোকটা কে। অতদূর থেকে চেহারা স্পষ্ট নয় বিধেয় বুঝে উঠতে পারল না। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ তার উপর নজর রাখছে। সে কেউ টা লরিন হতে পারে আবার হতে পারে অন্য কেউ।

বেলকনিতে মোহনা বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। তার অস্বস্তির লাগছিল। রুমে এসে সে চুল মুছছে আর তার সাথে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনাগুলো ভেবে যাচ্ছে। কোনোটার সাথে কোনোটা সে মেলাতে পারছে না। সব যেন কেমন গরমিল লাগছে। লরিন কে খুব রহস্যময় লাগছে। আর দিশাকে সন্দেহজনক। আবার এদের মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আছে কিনা সেটা নিয়েও এখন সে খুব চিন্তিত।

খাওয়া শেষ করে মোহনা আর মাহিয়া রুমে এল। মাহিয়ার মন আজকে ভালো নেই। সে আজকে গণিত স্যারের কাছে খুব বকা খেয়েছে। সহজ একটা অংক সে করতে পারেনি তার জন্য স্যার খুব অপমান করেছে। মাহিয়ার সেটা খুব সম্মানে লেগেছে। না পারলেই কি বকা লাগে? অপমান করা লাগে? মানুষ যে সবসময় সব পারবে এমন তো কোনো কথা নেই। মানুষ মাত্রই ভুল, তারও ভুল হয়েছে। তাই বলে তাকে পুরো ক্লাসের সামনে এত অপমান করবে? এত খারাপ একটা মানুষ কী করে হতে পারে?
মাহিয়া বোনের কাছে একগাদা বিচারের ঝুলি নিয়ে বসেছে। বোন তার কিছু আদৌ শুনছে কিনা সেটাও বোঝা মুশকিল। কিন্তু মাহিয়াও থামার পাত্র না। সেও অনর্গল বলেই যাচ্ছে। স্যারকে যত ধরনের বকা দেয়া যায় সব সে দিয়েছে। তবুও অশান্ত মন তার শান্ত হবার নামই নিচ্ছে না। এক পর্যায়ে হাঁপিয়ে উঠে নিজ থেকেই থেমে যায় সে। এতক্ষণে সে খেয়াল করে মোহনা এসবের কিছুই শুনেনি। সে গালে হাত দিয়ে বসে অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। এতে আরো বেশি জ্বলে উঠে মাহিয়া। জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘তুমি আমার কোনো কথা শুনোনি আপু?’

মোহনা চমকে তাকায়। বলে,

‘তোকে একটা জিনিস দেখাব?’

ভ্রু কুঁচকে মাহিয়া বলে,

‘কী জিনিস?’

মাহিয়া তার ব্যাগটা নিয়ে আসে। প্রথম চেইন খুলে সেই ঝুমকো জোড়া বের করে। সেগুলো দেখে মাহিয়া প্রচন্ড খুশি হয়ে বলে,

‘আমার জন্য এনেছ বুঝি?’

মোহনা কপাল কুঁচকে বলে,

‘আজ্ঞে না। এগুলো কেউ একজন আমাকে দিয়েছে। কিন্তু সে কে সেটা আমি জানিনা।’

‘ও মাই আল্লাহ! তারমানে গোপন প্রেমিক? বাহ, আপু; তোমার এই ছোট্ট জীবনে তুমি সবকিছুই পেলে এই যেমন, দেশি প্রেমিক, বিদেশি প্রেমিক এখন আবার একজন গোপন প্রেমিক। আর কী লাগে তোমার।’

মোহনা চেতে গিয়ে বলে,

‘একটা থাপ্পড় দিব তোকে। আমি কী ঝামেলায় আছি সেটা শুধু আমি বুঝতে পারছি। তুই ছোট, তাই এই ব্যাপারগুলো তুই আবেগের চোখে দেখছিস। কিন্ত এই জিনিসগুলো যে কতটা প্যারাদায়ক সেটা কেবল আমিই জানি। এখন এগুলো নিয়ে কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কে দিয়েছে সেটাও জানি না। রাখব নাকি ফেলে দিব? এত সুন্দর জিনিস, ফেলে দিতেও মায়া হয়। আবার রাখতে গেলেও মন খচখচ করে। উফফ, কী যে এক জ্বালা।’

‘এক কাজ করো, এইগুলো কাউকে দান করে দাও।’

‘দান আবার কাকে করব?’

‘কেন, আমাকে।’

মোহনা শক্ত চোখে তাকালে মাহিয়া বলে,

‘এভাবে তাকানোর কী আছে? তুমিই তো বললে যে তুমি এটা রাখতেও পারছো না আবার ফেলতেও পারছো না তাই বেটার হবে তুমি এইগুলো আমাকে দিয়ে দাও। তাহলে আর এই নিয়ে তোমার আর এত দুটানায় পড়তে হবে না। ভালো আইডিয়া না, বলো?’

মোহনা জোরে শ্বাস ছেড়ে ঝুমকো গুলো মাহিয়ার হাতে দিয়ে বলল,

‘নে এগুলো তোর। এবার শান্তি?’

মাহিয়া সেগুলো কানে লাগিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ। দেখো, কী সুন্দর লাগছে!’
.
.

আজ সন্ধ্যায় মোহনার বাবা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। মাহিয়া একবার খুশি হচ্ছে তো আরেকবার কষ্ট পাচ্ছে। বাবা থাকলে তাকে সারাক্ষণ খুব বকা খেতে হয়, আবার বাবা না থাকলে বাবার জন্য খুব কষ্টও হয়। তবে মোহনার বিকেল থেকেই মন খারাপ। বাবা তাকে খুব বেশি শাসন করলেও বাবার অনুপস্থিতি তাকে খুব কষ্ট দেয়। প্রতিবারই বাবা যাওয়ার সময় সে কাঁদে। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। নিয়মমাফিক বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে খুব কেঁদেছে। আর মাহবুব সাহেবও প্রতিবারের মতোই মেয়েদের একগাদা জ্ঞান দিয়ে কপালে চুমু এঁকে তবেই যাত্রা শুরু করলেন। আবার হয়তো অনেকদিন পর আসবেন। কিন্তু সেটা কতদিন সেটা কেউ নিশ্চিত জানে না।

.

‘এখনও কাঁদছো আপু?’

মোহনা ওড়না কিনারা দিয়ে চোখ মুখ মুছে বলল,

‘কই না তো।’

‘তোমার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি কাঁদছিলে। বাবা তো আবার কিছুদিন পর চলে আসবেন, এত কেঁদো না প্লীজ। তুমি কাঁদলে আমারও কান্না আসে।’

মোহনা হেসে বোনকে টেনে তার পাশে বসাল। বলল,

‘জানিস, ছোটবেলায় তুইও খুব কাঁদতি। একেবারে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতি। তখন তোকে দেখলে আমার কী যে হাসি পেত। তুই খুব সুর টেনে কাঁদতি। কীভাবে যেন, এএএএএ করে জোরে টান দিয়ে..’

মোহনা কথাটা বলে খুব হাসে। মাহিয়া মন খারাপ করে তখন বলে,

‘আগে এত কাঁদতাম, তাহলে এখন কেন বাবার জন্য কাঁদি না? আমার কি বাবার প্রতি মায়া এখন কমে গিয়েছে আপু?’

‘ধুর, তা কেন হবে। মা বাবার প্রতি সন্তানদের মায়া কখনো কমে নাকি? শুধু সেই মায়াটা প্রকাশ করার মাধ্যমটা বদলে যায়। কেউ কেঁদে কেটে সেটা প্রকাশ করে আবার কেউ হেসে হেসে। না কাঁদলেই যে তার কোনো মায়া নেই এমন কোনো কথা নেই। যে মানুষগুলো খুব কম কাঁদে তাদের মায়ার পরিমাণ আরো বেশি হয়ে থাকে। তারা কেবল সেটা প্রকাশ করতে পারে না। ব্যাস শুধু এইটুকুই। এখানে কাঁদা না কাঁদা নিয়ে কোনো পার্থক্য নেই, বুঝেছিস?’

মাহিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। মোহনা আলতো হেসে বলল,

‘আচ্ছা, তুই বস। আমি একটু চা বানিয়ে আনি, চা খেতে ইচ্ছে করছে।’

মোহনা চা বানাতে যায়। মাহিয়া তখন তার ফোনটা নেয় গেমস খেলার জন্য। কিন্তু গেইম টা ওপেন করার আগেই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। মাহিয়া কেটে দেয় কলটা। কিন্তু কল আবার আসে। পরপর অনেকগুলো। বিরক্ত হয়ে একপর্যায়ে কল রিসিভ করে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘জ্বি, আমি হসপিটাল থেকে বলছি। এখানে একজন বয়স্ক লোক ভর্তি হয়েছেন। আমি উনার ফোন থেকেই এই নাম্বারটা নিয়ে আপনাকে কল করেছি। আসলে উনার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই আপনাকে এক্ষুণি একবার হসপিটালে আসতে হবে।’

মাহিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলল,

‘আমাকে কি বোকা পেয়েছেন, হ্যাঁ? আপনি বলবেন আর আপনার বলা এড্রেসে আমি সুরসুর করে চলে যাবো? আর তারপর আপনি আমাকে কিডন্যাপ করে আমার মা বাবার কাছে মুক্তিপণ দাবি করবেন তাই তো? এসব চালাকি আমার খুব ভালো করে জানা আছে। ফোন রাখেন।’

লোকটি রেগে গিয়ে বলে,

‘আরে আজব তো, কী বলছেন এসব। এক মিনিট দাঁড়ান, আমি উনার শার্টের পকেট থেকে একটা কার্ড পেয়েছি। উনার নাম মেবি মাহবুব রহমান। পল্লি বিদ্যুত অফিসের একজন সিনিয়র কর্মচারী। উনি আপনার কে হোন? উনার ফোনের ডায়েল লিস্টে আমি প্রথমে আপনার নাম্বারটাই পেয়েছি। তাই আপনাকে কল করছি, উনার এক্সিডেন্ট হয়েছে, পারলে এক্ষুণি হসপিটালে আসুন।’

মাহিয়া কিছুক্ষণ থ মেরে থেকে হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠল,

‘আপু, বাবাআআআআ…’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here