পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৭) – সুমাইয়া বিনতে আ. আজিজ

0
1663

পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৭)
– সুমাইয়া বিনতে আ. আজিজ

পুষ্পর কোনো স্মার্ট ফোন ছিল না। পালিয়ে আসার সময় তাকবীরের দেয়া এন্ড্রয়েড ফোনটা সাথে করে নিয়ে আসলেও পরবর্তীতে সেটা এবং তাকবীরদের বাড়ি থেকে দেয়া নাকফুলটা ফেরত পাঠান হয়। এখন একটা আধ-ভাঙা বাটনসেট নিয়ে ঘুরে সে। মাঝে মাঝে এসে আমার ফোনটা হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখত আর বলত, “কবে যে আমার একটা এমন ফোন হইবো! আমার একটা এন্ড্রয়েডের খুব শখ। এমনে বাটন ফোন নিয়া ঘুরতে ভাল্লাগে?”

আমি টিপ্পনী কেটে বলতাম, “এন্ড্রয়েডের বাড়ি রাইখা বাটন ফোনের বাড়িতে তো নিজেই আইছস। সুখ খাইতে আইছস, সুখ খা। এন্ড্রয়েড দিয়া কী করবি?”

ভাবি ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাত। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত, “নন্দি, প্রেম করিস না জীবনে। আর প্রেম করলেও আমার নাগাল বলদামি করিস না ভুলেও।”

ওর চাপা স্বভাবটার সাথে আমি খুব ভালো করেই পরিচিত ছিলাম। আর আমি এটাও জানতাম যে, এই চাপা স্বভাবটা ওর জন্মগত নয়। বরং পরিস্থিতি আজ ওকে চাপা স্বভাবের হতে বাধ্য করেছে।

বিলাসিতার মধ্যে বেড়ে উঠা এই মেয়েটা এই বাড়িতে এসে দিনের পর দিন অভাবের সাথে লড়াই করে ঠিক কিভাবে বেঁচে আছে তা খুব কাছ থেকে দেখেছি। এইযে এত কষ্ট, তবুও মুখে কোনো অভিযোগ নেই, অসন্তোষ নেই, হাহাকার নেই৷ তবে অন্তরে সহস্র-কোটি অভিযোগ, সহস্র কোটি আর্তনাদ, সহস্র কোটি হাহাকার। সেই অভিযোগ, আর্তনাদ আর হাহাকারেরা মন চিড়ে কখনো বাইরে বের হতে পারত না। দিনের পর দিন মনের ভেতরে চাপা পড়ে থাকত। কারো সামনেই প্রকাশ করতে পারত না। না বাবা-মায়ের সামনে, না শ্বশুরবাড়ির কারো সামনে, আর না স্বামীর সামনে। প্রকাশ করবেই বা কিভাবে? নিজের পায়ে তো সে নিজেই কুড়াল মেরেছে। আঘাতটাও তো ওকে এখন একাই সহ্য করতে হবে।

যাই হোক, ওর প্রেগন্যান্সির খবর শুনে কাকি ওভাবে ওকে বিশ্রী ভঙ্গিতে কথা শুনানোর পর ওর রুমে গিয়ে দেখি ভাবি বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। কান্না করছে কি-না সেটা এমনিতে বোঝা যাচ্ছে না। তবে শরীরটা মাঝেমধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি গিয়ে আলতো করে ওর কাঁধে হাত রাখতেই ওর চোখ-মুখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এবোরশোন করলে কি খুব বেশ গুনাহ হইব?”

ওকে অবশ্য এবোরশোন করতে হলো না। সপ্তাহ দুয়েক পর হঠাৎ করে ওর অসহ্য পেট ব্যাথা শুরু হলো। দুই-তিনদিন বাদে পিরিয়ডের রাস্তা দিয়ে ব্লিডিং-ও শুরু হলো। এবোরশোনের কথা মুখে মুখে বললেও সেইটা ভাবির মনের কথা কখনোই ছিল না। ব্লিডিং শুরু হয়েছে টের পেয়ে দৌড়ে প্রস্রাবখানায় যেতেই মাঝারি সাইজের দুইটা রক্তের দলা পিরিয়ডের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে আসলো। ভাবির বুঝতে বাকি রইলো না যে, এইটা তার শরীরের সেই ছোট্ট প্রাণটাই। কিন্তু রক্তের দলা দুইটা কেন? তাহলে কি ওর গর্ভে জমজ বাচ্চার ভ্রুণ ছিল?

সেদিন ভাবি আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, আট সপ্তাহের ভ্রুণ হারিয়েও কোনো মা এমন বুকফাটা আর্তনাদ করতে পারে!

আমি ওকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, আশার বাণী শুনাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনো কথাই যেন ওর কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। সেদিন ওর চোখে-মুখে আমি বিষাদের পাশাপাশি আতঙ্ক দেখতে পারছিলাম। কিন্তু এই আতঙ্কটা কিসের তা আমি তৎক্ষনাৎ টের পাইনি।

মিসক্যারেজের পর ওর প্রচুর ব্লিডিং হত। ভ্রুণের কিছু অংশ গর্ভথলিতে থেকে যাওয়ায় সেগুলো পরিষ্কার করার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সদরের কোনো ভালো হসপিটাল কিংবা ক্লিনিকে নেয়ার সামর্থ নেই তাদের। তাই গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য যেতে হয়। ওখানে এনেস্থিসিয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওকে অবশ না করেই ওর শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। আর সেটার অভিজ্ঞতা ওর জন্য ছিল কল্পনাতীত ভয়াবহ।

স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বাড়ি অবধি ওকে রিকশায় আনা হয়। রিকশা থেকে নামার পর ও ব্যাথায় হাঁটতে পারছিল না। তাই আকিব ভাই ওকে কোলে করে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। ৮-১০ দিন পর্যন্ত ও স্বাভাবিকভাবে চলতে পারত না, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না, কোনো কাজ-কর্মে হাত দেয়ার মতোও অবস্থা ছিল না ওর। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেও বের হত না। সারাক্ষণ হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে তলপেটে চেপে ধরে বসে থাকত। এসব নিয়েও বাড়ির লোক কম কথা শুনায়নি। বড় কাকি যদিও তেমন কিছু বলতেন না, কিংবা বললেও ওর আড়ালে বলতেন। কিন্তু মেজো কাকি সরাসরি ওর সামনেই ঢাকঢোল পিটিয়ে ওকে যা তা বলতেন। বলার ধরনও ছিল যাচ্ছেতাই।

“তাও বালো ছটি পড়ে নাই তোর। এমুন ঢং দেহাস মনোয় ছটি পড়ছে। কেউর ছটি পড়লেও তো তোর নাগাল এবা করে না লো। আর কেউর পুলাহান পইড়া যায় না? তোর একাই পড়ছে? তুই যে দেহি বিছনা থিকাই উঠবার পারোস না! তোরে কোলে কইরা ঘরে তুলোন নাগে, মুখে তুইলা খাওয়াইয়া দেন নাগে। জীবনে আরো কত কিছু যে দেখমু! বউ মাইনষের এত মোমের পুতুল অইলে চলব?”

এই ধরনের আরো অনেক কথা। বিষ মাখানো কথা। ভাবি নীরবে শুনত। ভালো-মন্দ কোনো জবাব দিত না কখনো। কিংবা কখনো জবাবে একটা ক্লেশ মিশ্রিত হাসি দিত শুধু।

সেইবার বৈশাখী মেলার সময় আকিব ভাই ভাবিকে নিয়ে মেলায় গেল। ভাবি আমাকে ছাড়া কিছুতেই যাবে না। বাধ্য হয়ে আমাকেও যেতে হলো ওদের সাথে। মেলায় গিয়ে আমাদের কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে, নাগরদোলায় চড়িয়েই আকিব ভাই পাড়ার অন্যান্যদের সাথে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। চুড়ির দোকানগুলোর সামনে দিয়ে ঘুরার সময় ভাবিকে দেখছিলাম ও বেশমি চুড়িগুলোর উপর দিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন দোকানের সামনে গিয়ে বিভিন্ন জিনিস হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, “সুন্দর না নন্দি?”
হয়তো ওর কিনতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ভাই টাকা পাবে কই ভেবে সেই নিষিদ্ধ ইচ্ছে থেকে নিজেকে মনেপ্রাণে বিরত রাখার চেষ্টায় মত্ত ছিল। ওর নিশ্চয়ই তখন ওর প্রাক্তন শ্বশুরের কথা মনে পড়ছিল, যিনি ওকে বৈশাখী মেলায় নিয়ে গিয়ে হাতভর্তি করে ওর পছন্দের সব জিনিস কিনে দিতেন। সেসব ভেবে ভাবি কি তখন অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল?

পরের দিন ভোরে অভ্যাসমতো বাড়ির সামনের পুকুরপাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রতিদিন ফজরের নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত শেষে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে ভোরের মিষ্টি হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে একটু-আধটু লিখতে চেষ্টা করা কিংবা উপন্যাসের পাতা উলটানো আমার পুরনো অভ্যাস। আমাদের পুকুর ঘাটটা আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। ভীষণরকম সুন্দর। পুকুর ভর্তি কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ কালো জল, যে জল গ্রীষ্মেও পুরোপুরি শুকায় না… পুকুরের চারপাশে দম্ভভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি ইউক্যালিপটাস গাছ, বাঁধানো ঘাটের ডান পাশে ইয়া বড় এক কৃষ্ণচূড়া গাছ; সব মিলিয়ে যেন এক নৈসর্গিকতা সারাক্ষণ পুকুরঘাটকে ঘিরে রাখে। এবং ভোরে সেই নৈসর্গিকতার পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

সেদিন কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলো রক্তলালে ছেয়ে গিয়েছিল। রক্তলালে ছেয়ে গিয়েছিল নিচের জমিনটুকুও৷ কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়ানোর পর মনে হচ্ছিল যে, আমি কোনো এক অরুণ রাজ্যে ঢুকে পড়েছি হয়তো। পুকুরঘাটের সিঁড়িগুলোও নিজেদের কৃষ্ণচূড়ার লাল চাদরে মুড়িয়ে নিয়েছিল। বিমোহিত ভঙ্গিতে সিঁড়ির ধাপগুলো মাড়িয়ে লালের সমুদ্র পেরিয়ে যখন নিচের দিকে নামছিলাম অবচেতন মনে নিজেকে তখন অরুণ রাজ্যের একমাত্র অরুণকুমারী বলেই মনে হচ্ছিল। বিভোর হয়ে ডুবে যাচ্ছিলাম রব প্রদত্ত এত সুন্দর নিয়ামতের গভীরে। আচমকা ভাবির উচ্ছ্বসিত ভঙ্গির ‘নন্দি’ ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম ভাবি দৌড়ে এদিকেই আসছে। ভাবির পরনে লাল বাটিকের থ্রিপিস। ভাবির হাতে সাদা রঙের এক খন্ড কাপড়।

আসতে আসতে ভাবি যখন অরুণ রাজ্যে প্রবেশ করল তখন আমার আচমকা মনে হলো, এই অরুণরাজ্যে আমার কোনো আধিপত্য নেই। সমস্ত আধিপত্য ছোট্ট এই পুতুল পুতুল লালপরীটার। এবং এই পরীটাই এই রাজ্যের একমাত্র রাজকুমারী। আমি বড়জোর তার সখী হওয়ার যোগ্যতা রাখি।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দৌড়ে আসা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কোন পুষ্প বেশি সুন্দর? গাছের ওই প্রস্ফুটন পুষ্প, নাকি ওই মানব পুষ্প?

আমার ভাবনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে কাছে এসে ও হাঁফাতে লাগল। হাতে রাখা কাপড়টার দিকে ইশারা করতেই দেখলাম সেটা লাল পাড়ের একটা সাদা তাঁতের শাড়ি। সাথে দু’মুঠো লাল রেশমি চুড়িও আছে। ভাবির চোখমুখে আনন্দের দ্যুতি উপচে উপচে পড়ছে। আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম, ভাবিকে এত বেশি খুশি হতে আগে কখনো দেখেছি কিনা!

ভাবি উচ্ছ্বসিত স্বরে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, “কাল রাইতে দেখি আমার স্বামী মেলা থিকা নিয়া আসছে এগুলা আমার জন্য।”

ননদ-জা সম্পর্কিত কারো সামনে আকিব ভাইকে সে নাম ধরে ডাকত না। বরং ‘আমার স্বামী’ বলেই সম্বোধন করত।

ওর কথা শুনে আমি উদাস ভঙ্গিতে আফসোরের স্বরে বললাম, “আহ্! আজ যদি আমার একটা স্বামী থাকত!”

ও আমার আফসোসবাণী উপেক্ষা করে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে শাড়িটা মেলে ধরতে ধরতে বলল, “সুন্দর না রে শাড়িটা?”

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ফের বলতে শুরু করল, “জানোস? এই পুকুরঘাটটা দেখার পর থিকা এইরকম একটা শাড়ি পইরা ভরা বর্ষায় পুকুরের পানিতে পা ডুবাইয়া ছবি তুলতে কী যে ইচ্ছা করত আমার! কিন্তু স্বামীরে কখনো মুখ ফুইটা বলতে ইচ্ছা করে নাই। না বলার পরেও ও কেমনে আমার মনের খবর পাইয়া গেল ক তো!” শেষের লাইনটার প্রতিটি শব্দে তৃপ্তির মুক্তো ঝড়ছিল।

সেইবার বর্ষার এক বিকেলেই ওকে সেই শাড়িটা পরিয়ে দিলাম আমি। দু’হাতে পরল লাল সেই রেশমি চুড়ি। ভীষণ যত্নে হালকা একটু সাজিয়েও দিলাম পুতুলটাকে। নিয়ে আসলাম পুকুরঘাটে। বর্ষায় সে পুকুরে পদ্মর মেলা বসে। বাঁশের কঞ্চির সাহায্যে গুণে গুণে পাঁচটা লালপদ্ম গোড়া থেকে তুলে আনলাম আমি। সেগুলো ওর হাতে তুলে দিয়ে ফোনের ক্যামেরাটা অন করে ছবি তোলার জন্য পোজ দিতে বললাম। কিন্তু ও যখন পোজ নিয়ে বসল তখন আমি মুহূর্তখানেক সময়ের জন্য জগৎ-সংসার ভুলে গেলাম যেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ছবি তোলার জন্য পদ্ম হাতে পোজ দিয়ে বসে থাকা পুষ্পর প্রতি।

আমার টুকটাক লিখালিখির অভ্যাস দেখে ভাবি প্রায়ই বলত, “আমাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখিস তো নন্দি।”

ও কথাটা এমনি এমনিই বলত। কখনো সিরিয়াস ভঙ্গিতে এমন আবদার করেনি। আর আমিও সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার অবকাশ পাইনি কখনো। কিন্তু ওই মুহূর্তে আচমকা আমার মনে হলো, আমি অবশ্যই লিখব ওকে নিয়ে একটা উপন্যাস। আর সেই উপন্যাসের নাম হবে ‘পুষ্পের হাতে পদ্ম’।

চলবে ইন-শা-আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here