পারিজাত পর্ব ১২

0
905

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১২

ভোরবেলা তীব্র চিৎকারের আওয়াজে নিদ্রাভঙ্গ হয় বাড়ির প্রতিটি মানুষের। শব্দের উৎস খুজতে সুগন্ধার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সবাই। পারিজাও আতংকে ঘুম ভেঙে গেছে। পারিজা আর ওয়াহেদ বাইরে এসে দেখলো। সুগন্ধা উন্মাদের মতো অশ্রু ফেলছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে বারবার। ওয়াহেদ দৌড়ে নিজের জন্মদাতা বাবার কাছে গেল। সেখানে গিয়ে সকলের মাথায় হাত। শয্যাশায়ী আলী আকবর মৃত্যু বরন করেছেন। পিতৃ হারানোর শোকে তিন ভাইয়ের নাজেহাল অবস্থা। ইতিমধ্যে আলী আকবরের দুই কন্যার শশুর বাড়িতেও খবর পাঠানো হয়েছে। তাঁরাও নিজের বাবাকে শেষ দেখা দেখতে আসবে।

বাড়িভর্তি মানুষের আনাগোনা। সবাই জমিদার বাড়ির কর্তাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছেন। ওয়াহেদ প্রচন্ড ভেঙে পরেছে। বাবার মতো একটা বটগাছ মাথার ওপরে ছিল এতদিন। এখন আর কিছুই রইলো না। পারিজা যে একেবারে খুশি;তা কিন্তু নয়। আলী আকবর তাঁকে মেয়ের মতো দেখতে পারেননি। কিন্তু, আলী আকবরের জন্য পারিজার মনের জায়গাটুকু বাবার স্থানেই ছিল। একদিন হলেও পারিজা মানুষটাকে বাবা ডেকেছে।মৃত মানুষের ওপরে কখনো রাগ রাখতে নেই। পারিজারও কোনো রাগ নেই পিতৃসম মানুষটার প্রতি।
আলী আকবরের দুই মেয়ে লতা,রিভু বাবাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য বাপের বাড়িতে এসেছে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দুজনেই অস্থির। পারিজা,বড় বউ,মেজো বউ বেশ কয়েকবার তাঁদের সান্ত্বনা দিয়েছে। কিন্তু, বাবা হারানোর শোক কী সান্ত্বনায় কাটে?এই দুঃখ কী ঘোচাবার মতো?

বিকেলের দিকে আলী আকবরের দেহটাকে গোসল করানো হলো। কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে দেহটিকে খাটিয়ায় তোলা হলো। তিন ভাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে খাটিয়া কাঁধে তুললো। খাটিয়ার আরেক পাশ ধরলো লতার স্বামী তিতাস। লতা আর রিভু অশ্রু ফেলতে ফেলতে নিজের বাবাকে বিদায় জানালো। সুগন্ধা পাগলের মতো বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারালো। পারিজা দক্ষিনের ঘরটার বেলকনি থেকে সকলের চলে যাওয়া দেখলো। দুঃখে কয়েক ফোঁটা জল তাঁর চোখ হতেও গড়িয়ে পরলো।

— উমা দিদি, তুমি তরকারিটা বারো। আমি ভাত বারছি। মা সকাল থেকে কিছু মুখে দেয়নি। মায়ের মুখে কিছ একটা তো দিতে হবে। নাহলে মানুষটা বাঁচবে কী করে?”

পারিজা থালায় ভাত বাড়তে বারতে কথাটা উমাকে বললো। মৃতের বাড়িতে তিনদিন রান্নাবান্না করা নিষেধ। এই খাবারগুলো এসেছে রিভুর শশুর বাড়ি থেকে। উমা তরকারি বেড়ে দিয়ে বললো,

— তোর যত আদিক্ষ্যাতা! ওনাকে খাওয়াবার জন্য ওনার মেয়ে দুটো আছেন। তোর এত চিন্তা করতে হবে না। তোকে তো কম কিছু শোনায়নি।”

পারিজা হেসে বললো,
— আমি ওনাকে মা ডেকেছি দিদি। মা ডাকটার মানেটা উনি না জানলেও আমি জানি। আমি ওনার কন্যাসম। ওনাকে মায়ের আসনে বসিয়েছি। মা ডাকটার তো এভাবে অপমান করতে পারি না।”

পারিজার কথা শুনে উমা চুপ করে গেল। এই মেয়ের সঙ্গে যুক্তিতে পেরে ওঠা দুষ্কর। উমা তরকারি বেড়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গেল।

ওয়াহেদের শিলাস্তরের মতো হৃদয় আজ অর্ধ গলিত। পারিজাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ সে কেঁদে ফেললো। পারিজা পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। পিতৃ স্নেহ হতে বঞ্চিত হলেও পারিজা পিতার মর্ম জানে। তাই হয়তো ওয়াহেদের এই বুক ভাঙ্গা কষ্টে তাঁরও বুক ভাঙছে। পারিজার কষ্ট কিছুটা হলেও আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে ওয়াহেদ। জীবনে মা বাবার মূল্য অনেক। চাইলেও পারিজাকে এরপরে কখনো তাঁর মাকে নিয়ে কথা শোনাতে পারবে বা ওয়াহেদ। আজ সবকিছুই বুঝতে পেরেছে সে। জীবন যতকিছুই হোক না কেন। সন্তানের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা তাঁদের বাবা মা। বাবা মা যেভাবে নিজের সন্তানদের আগলে রাখেন। সন্তানরাও সেভাবেই নিজের মা বাবাদের আগলে রাখতে চায়।

পরদিন সকালে উঠে পারিজা দেখলো বাড়ির সকলে তখনও শোকাচ্ছন্য। পারিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠোনে বসলো। সুগন্ধা হঠাৎ পারিজাকে দেখে তেড়ে আসলেন। পারিজা হঠাৎ সুগন্ধাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে চমকে উঠলো। সুগন্ধা পারিজার সামনে এসে পারিজাকে বললো,
— আমার চোখের সামনে থেকে দূর কর এই মেয়েকে! আগুনমুখী যেখানে যায়। সর্বনাশ করে সব শেষ করে ফেলে। দূর হয়ে যা সর্বনাশী! এক্ষুনি চলে যা পোড়ামুখী! আমার সুস্থ সবল স্বামীটাকে গিলে ফেললি। এখন এই সংসারটাকে আস্ত গিলে খাবি! তোকে মে/রে ফেলবো পোড়াকপালি! ”

পারিজা ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে সুগন্ধার দিকে তাকালো। গায়ে কালকের সেই একই শাড়ি। লতা দৌড়ে এসে সুগন্ধাকে সরিয়ে নিলো। রিভু পারিজাকে অনুরোধের স্বরে বললো,
— তুমি কিছু মনে করো না গো ছোট বউ। আম্মা এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পাগলের মতো বিলাপ করছে। মুখে যা আসছে তাই বলে বেড়াচ্ছে। আর কয়েকটা দিন গেলেই আম্মা ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কিছু মনে করো না।”

পারিজা রিভুর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। সুগন্ধার এই আচরণের জন্য আজ একটুও প্রস্তুত ছিল না পারিজা। প্রলাপ বকতে বকতে সুগন্ধা ওপরে চলে যেতেই পারিজা বড়সড় নিঃশ্বাস নিলো। বাড়ির প্রতিটা কাজের জন্য কেন তাকেই দায়ী থাকতে হয়?
ওয়াহেদ দূর থেকে সবটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সত্যি বলতে তাঁর নিজেরও মানসিক ভাবে শোক কাটেনি। কীভাবে কী করবে সবটা এখনও অজানা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here