পারিজাত পর্ব ১৩

0
898

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৩

সময় নিজের গতিতে বয়ে চলে। সময়ের স্রোতকে কখনো আঁটকে রাখা যায় না। খারাপ সময় কেটে ভালো সময় আসে। আবার কখনো হয় তাঁর উল্টোটা। পারিজা ভেবেছিল হয়তোবা তাঁর দুঃখের সময়টা এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু, ক্ষনে ক্ষনে দুঃখ বেড়েই চললো।

আলী আকবর মারা যাবার পর জমিদারী এসে পরলো এহমাদের ভাগে। বয়সে সবার বড় বলে তাঁর পালাটাই সবার পূর্বে এলো। সবসময় চুপসে থাকা এহমাদও এখন অহংকারী হয়ে উঠলো। ভাইয়ের এহেন কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে মাহমুদ, ওয়াহেদ দুজনেই বিষ্মিত! শক্তি, সামর্থ্যের দৌলতে মানুষ চোখের পলকে বদলে যায়। এহমাদের ক্ষেত্রেও তাঁর বিপরীত হলো না। ছোট দুই ভাইয়ের ওপরে হুকুম দিয়ে দিয়ে অভ্যস্থ সে। দুই ভাই এখন তাঁর সর্বক্ষনের চোখের বিষ।

উমা আর পারিজার দুষ্ট মিষ্টি সম্পর্কটাও কেমন যেন বদলে গেল। উমা দামী শাড়ি আর গহনাতে নিজেকে মানানসই করে তুললো। উমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ হলোঃনিজের স্বামীর বেশি রোজকারের ফসল হিসেবে দিন দুয়েক পরপর গহনা বানানো। পারিজা আর মেজো বউকে কথা শোনানো। উমার অহংকারে পা মাটিতে পরছে না। উমার বদ মেজাজের ভীরে মেজো বউ আর পারিজা দুজনেই উমার কাছ থেকে দূরে থাকে।

ওয়াহেদের গাধার মতো খাটুনি খাটতে হয়। পারিজার সঙ্গে বর্তমানে ওয়াহেদের কোনো মনোমালিন্য নেই। কোনো ঝগড়াঝাটিও নেই। ঝামেলার মধ্যে বলতে গেলে উমা আর এহমাদ। দুজনের কড়া মেজাজে বাড়িতে থাকাটা দায়! সুগন্ধা নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের মতো থাকে সারাদিন।খাওয়া দাওয়া আর মাঝেমধ্যে পাড়া-পড়শীর সঙ্গে একটু কথা বলা। এছাড়া তেমন একটা নিচে নামতে দেখা যায় না তাঁকে। মাহমুদও বেশ শান্ত থাকে আজকাল। আগের মতো বদ মেজাজ দেখানোর সুযোগ নেই। এহমাদ নিজের ভাইয়ের দোষ ছাড়তেও রাজি নয়। কিছুতে কিছু হলেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি!

— বলি কী ছোটবউ, তোমার কী কাজে হাত লাগাতে ইচ্ছে করে না? নাকি পটের বিবির মতো বসে বসে খাবে?”

পারিজা বিরক্ত হয়ে পিছু ফিরলো। উমা রান্নাঘরের সামনে বসে বসে পারিজাকে গালমন্দ করছে। ভেতরে মেজো বউ একা একা কাজ করছে। পারিজা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— কেন বাড়িতে কী শুধু আমরা দুজনেই বউ?”

উমা রাগে চোখ লাল করে বললো,
— তুমি কী আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললে ছোট বউ? আমি কী ঝি নাকি? সারাদিন কাজ করে করে হাড় খোয়াতে পারবো না আমি। তোমাদের কাজ তোমরা করো গিয়ে।”

পারিজা রান্নাঘরে গিয়ে মেজো বউয়ের হাত ধরে বেড়িয়ে এসে বললো,
— তাহলে, আজ এভাবেই থাকলো। আমরাও বাড়িতে ঝিগিরি করতে আসিনি। বাড়িতে বউ তিনজন। সবাইকে মিলেমিশে হাতে হাতে কাজ করতে হবে। আমরা কাজ করবো। আর কেউ কেউ বিছানায় পা তুলে তুলে খাবে। সেটা আর হচ্ছে না। ”

পারিজা মেজো বউকে নিয়ে ওপরের দিকে চললো। উমা নিচে বসে বসে রাগ ফুসলো। মনে মনে পারিজাকে রকম সকমের গালাগাল দিলো। সেই বেলায় রান্নাঘরটা টপাই কোনোমতে সামলে নিলো।

এহমাদ বাড়িতে ফিরতেই উমা কেঁদে কেটে পারিজার নামে ফোঁড়ন কাটলো। এহমাদ ওয়াহেদকে ডেকে নিজের রাগ ঝাড়লো। ওয়াহেদ একেবারে চুপ করে ছিল তা না। যতটুকু পেরেছে সে জবাব দিয়েছে।

পারিজা শেষে সেখানে উপস্থিত হয়ে এহমাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আগে জানতাম মেয়েতে মেয়েতে ঝগড়া হয়ে চুলোচুলি হয়। এখন দেখছি আপনিও মেয়েদের খাতায় নাম লেখালেন দাদা। তবে,আপনাদের জন্য দুঃখ লাগছে। চুলোচুলি করার মতো ওতো লম্বা চুল আপনাদের নেই। এখন হাতের নখ দিয়েই আচরা আচরি করুন। কখনো আমাদের মতো লম্বা চুল হলে তখন নাহয় চুলোচুলি করবেন।”

পারিজার কথায় পরিবেশ পুরো ঠান্ডা। এহমাদ লজ্জায় ঘরে গিয়ে মুখ লুকিয়েছে। ওয়াহেদ আর মাহমুদ পারিজার কথা শুনে বাইরে গিয়ে হাসাহাসি করছে।

পারিজা রাতে ঘুমাবার আগে ঘরে আসলো। পানির পাত্রটা যথাস্থানে রেখে বিছানায় বসতেই ওয়াহেদ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। পারিজা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে চোখ বুজলো। ওয়াহেদ শান্ত গলায় বললো,
— তুমি একবার আমাদের বাড়িটাকে জাহান্নাম বলেছিলে পারিজা। আজ মনে হচ্ছে বাড়িটা আসলেই জাহান্নাম। কোথাও এক ফোঁটা শান্তি মাত্র নেই। হতাশা, অশান্তি যেন কাটছেই না। তোমার আম্মাকে বলেছিলাম তোমায় কখনো অভাব অনটনে রাখবো না। তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না পারিজা। মৃত্যুর পর আমি কী জবাবদিহি করবো? কষ্ট ছাড়া আমি কী তোমাকে কিছু দিতে পেরেছি?”

পারিজা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওয়াহেদের কাঁধে মাথা রাখলো। ওয়াহেদের ভালো ব্যবহার, সুন্দর আচরণ, মিষ্ট ভাষীতা এটুকুই তাঁর দরকার ছিল। এইটুকু আজ সে পেয়ে গেছে। মনে মনে বেশ কিছুদিন আগেই সে ওয়াহেদকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু, সেটা মুখে প্রকাশ করেনি। ওয়াহেদের প্রতি দূর্বলতা পারিজার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু, ওয়াহেদের খারাপ ব্যবহারই ওয়াহেদকে তাঁর থেকে দূর করে দিয়েছে।

বাড়িতে খবরের কাগজের সঙ্গে আরেকটা চিঠি এলো। টপা চিঠিটা বরাবরের মতোই শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখলো। কেউ দেখে ফেললে পারিজাতের গুষ্টিরপিণ্ডি চটকাবে।

পারিজার হাতে চিঠি পৌঁছাতেই পারিজা সেটা খুলে দেখলো। এরমধ্যে তৃণলতা তাঁকে বহুবার চিঠি লিখেছে। পারিজাও চিঠির উত্তর হিসেবে বহুবার চিঠি লিখেছে নিজের মাকে। কিন্তু, পারিজা নিজের শশুর বাড়ির কোনো খবর আজ অবধি নিজের মা তৃণলতাকে জানায়নি। এই বাড়ির গুটিকয়েক মানুষ তাঁকে পছন্দ করে। বাকিরা সবাই পারিজাকে শত্রুর নজরে দেখে। পারিজা তৃণলতাকে এসব জানাতে চায় না। ছোটবেলা থেকে বহুকষ্টে মা তাঁকে মানুষ করেছে। এখন এইবেলায় এসে মাকে এসব বলে কষ্ট দেওয়াটা বেমানান। সুখের ভাগটুকুই সবার থাক। দুঃখের অংশটুকু শুধুমাত্র পারিজার নিজের।

পারিজা দক্ষিনের ঘরটার বেলকনি থেকে নিচের দিকে উঁকি দিলো। এই ঘরটায় কেউ থাকে না। বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই এই ঘরটায় থাকতে দেওয়া হয়। তাছাড়া এই ঘরটা সচারাচর খালিই পরে থাকে। খোলা বারান্দার দমকা হাওয়ায় পারিজা নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আম্মার কথা আজ তাঁর খুব পরছে। বিয়ের পর থেকে একটাবার দেখা হলো না। মেয়ের সংসারে অশান্তি হবে ভেবে তৃণলতা একবারও মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছে তৃণলতা। শাড়ির আঁচলে চাবি ছড়া বাঁধা। পারিজা আনন্দে চোখ বুজলো। আবার পরমুহূর্তে প্রচন্ড দুঃখ হলো পারিজার। আম্মার কেন সুন্দর একটা সংসার হলো না? সারাজীবন তৃণলতা পারিজাকে সংসারের ধর্ম কর্ম শিখিয়েছেন। কিন্তু, আদতে তিনি নিজেই কখনো সংসার করতে পারেননি। স্বামী সোহাগী হতে পারেননি। এরচেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে? স্বামীর মতো মানুষটা তাঁকে বিক্রি করে দিলো সামান্য টাকার লোভে? হায়রে মানুষরূপী অ/মানুষ!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here