পারিজাত পর্ব ১১

0
949

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১১

ওয়াহেদ সেদিনের ঘটনার পর আর বিয়ের কথা বাড়িতে উঠতে দেয়নি। বিয়েটাই ভেঙে ফেলেছে। বিয়ের জন্য পারিজাকে হাত ছাড়া করা অসম্ভব।

বাড়িতে কয়েকদিন যাবত শোকের প্রতীক বহমান। বলী আকবরের শরীর ভালো নেই। ডক্টর বদ্যি কেউই কিছু বলতে পারছে না। বাড়ির সবাই তাঁকে নিয়ে চিন্তিত।

পারিজা ভাবনায় ডুবে রয়েছে। বিয়ে প্রথম কয়েকটা দিন সুগন্ধার কত আদর! কত মায়া কত মমতা! নিজের মেয়ের মতো চোখে হারাতেন। ছেলের বউদের মধ্যে পারিজা ছোট বলে। কোনো কাজে হাত লাগাতে দিতেন না। কিন্তু, সবটা যেন নিমিষেই বদলে গেল! সুগন্ধার মাতৃ স্নেহের পতন ঘটলো। সূচনা হলো খারাপ আচরণের। পারিজা আজও ভেবে পায় না। কেন এমনটা হলো তাঁর সঙ্গে?

সুগন্ধা নিজের স্বামীর কাছে কাছে থাকছে। অসুস্থ মানুষটার কখন কী লাগে। পারিজা নিচে গিয়ে সকলের সঙ্গে কাজে হাত লাগালো। বড় দিদি, মেজো দিদি সবজি কাটছে। পারিজা মশলা বাটছে। সুগন্ধা হঠাৎ রান্নাঘরে চলে এলেন। পারিজাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— বাড়িতে আমি পটের বিবি পুষছি। সব কাজে দেরি! যেমন মা! তেমন তাঁর গুনধর মেয়ে!”

পারিজা মশলা বাটতে বাটতে বললো,
— আম্মা, বাড়িতে একটা অসুস্থ মানুষ রয়েছে। একটু আস্তে কথা বলুন। বাবার সমস্যা হতে পারে।”

সুগন্ধা চোখ কপালে তুলে বললেন,
— মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি! আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে বাড়ি থেকে বের করো। শুনলো কেউ আমার কথা! এখন বোঝো! আমাকে নীতি বাক্য শেখাচ্ছেন তিনি! আমার স্বামী আমি বুঝবো!বাইরের মানুষকে এত নাক না গলালেও চলবে।”

পারিজা আর কথা বাড়ালো না। সকাল সকাল এত চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে ভালো লাগে না তাঁর।

নিজ মাতার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখলো পারিজা। দুপুরের এই সময়টুকুতে সবাই বিশ্রাম নেয়। পারিজা সেটাকেই কাজে লাগালো। কাগজে মায়ের উদ্দেশ্যে সে লিখেছিল,
“আম্মা, আমি তোমার পারিজাত। কখনো আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমার করা কোনো কাজের জন্য তোমাকে কখনোই লজ্জায় পরতে হবে না।ভালো থেকো তুমি। নিজের শরীরের যত্ন নিও। তোমার কিছু হলে আমি ম/রে যাবো। তুমি ছাড়া আর আছে কে আমার?”

পারিজা খামে চিঠিটা ভরে দরজা খুলে বাইরে এলো। টপা তখন পুকুরের ধারে বসে বসে থালা-বাসন মাজছে। পারিজা টপার কাছে গিয়ে টপাকে বললো,
— আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে টপা দিদি?”

টপা থালাবাসন রেখে পারিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— কী ছোট ভাবী?”

পারিজা আঁচলের ভেতর থেকে খামটা বের করে বললো,
— এই চিঠিটা আমি আম্মাকে দিতে চাই। তুমি একটু চিঠিটা দিতে পারবে?”

টপা আঁচলে হাত মুছে পারিজার হাত থেকে চিঠিটা নিলো। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে আঁচলের মধ্যে মুড়িয়ে বেঁধে রাখলো। পারিজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

স্বামীর অসুস্থতায় সুগন্ধা আরো এক ধাপ বেশি গর্জে উঠেছে। আগে তর্কাতর্কি অবধি ঠিক থাকলেও। এখন বিষয়টা হাতাহাতি অবধি চলে গেছে। ওইদিন শুধু শুধুই সুগন্ধা নিজের বড় বউয়ের গায়ে হাত তুলেছে। পারিজার পক্ষপাতিত্য করাই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওয়াহেদও আজকাল খামখেয়ালী হয়ে গেছে। সংসারের তুলনায় তাঁর বাইরের দিকে ঝোঁক বেশি। মাঝখান থেকে পারিজা আঁটকে পরেছে সংসারের জালে। ছেলে বলে ওয়াহেদের সব দোষ মাফ হলেও তাঁর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। সে এই বাড়ির বউ মাত্র। পরের বাড়ির মেয়ে। তাঁর কিছু হলেও কী কারো কিছু যায় আসবে?
এই তো সেদিনের ঘটনা। মাহমুদ কথা প্রসঙ্গে তৃণলতার কথা তুললো। সুগন্ধাও তাতে সায় দিলো। ভাইয়ে ভাইয়ে আবারও দন্ড হলো। ওয়াহেদ খাবারের থালা ফেলে দিয়ে ওপরে চলে গেল। সব রাগ,ক্রোধ সবটাই উপচে পরলো পারিজার ওপরে। পারিজাও ছাড় দেওয়ার মতো মেয়ে ছিল না। শক্ত ভাবে কয়েকটা কথার জবাব দিয়েই সে চুপ হয়েছে। পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
— আমার মায়ের পেশার জন্য আমাকে কেন কথা শুনতে হবে? আমার কী দোষ? যা হয়েছে সব আমার জন্মের পূর্বের কাহিনি। একই কথা একই প্রসঙ্গ বারবার তুলে আমাকে কষ্ট দেওয়াটা কী খুব বেশিই দরকার?”

ওয়াহেদ পারিজার কথার জবাবে বলেছিল,
— তোমার মায়ের সম্পর্কে আমার পরিবার ভুল কিছু কী বলেছে? সত্যই তো বলেছে। তুমি মানো আর না মানো। এসব কিন্তু সত্যি পারিজা।”

পারিজা শান্ত গলায় শুধু বলেছে,
— আমার মানা কিংবা না মানাতে কিছু যায় আসে না ওয়াহেদ। তোমার আম্মা, ভাই তাঁরা বলেছে আমার আম্মা নষ্টা। আমি মেনে নিয়েছি। তাঁরা বলেছেন আমার আম্মা পতিতা। আমি তাতেও দ্বিমত করিনি। কারণ, এগুলোই সত্য। সত্য সবসময়ই সত্য। আমার বলা না বলাতে সেটা মিথ্যা হয়ে যাবে না। তাঁরা বলেছেন আমার আম্মা শরীরের খুদা মেটানোর জন্যই পতিতা হয়েছেন। এক পুরুষে তাঁর চাহিদা মেটে না। কালনাগিনী, বে** আরো কত কী বলেছেন। এসব তো কোনোটাই সত্যি না ওয়াহেদ! আমি মিথ্যা শুনেও চুপ কেন থাকবো? আমার আম্মার পেশার জন্যই আমাকে আর আম্মাকে অনেক কিছুই শুনতে হয়েছে। সত্যিই কী পেশা মানুষের চরিত্র নির্ধারন করতে পারে? আমি কিছু না করেও নিন্দার ভাগীদার হয়েছি। তুমি কখনো সেসব নিয়ে তোমার পরিবারকে প্রশ্ন করেছো? আজ যদি আমি অভাবে পরে চুরি করি। তাহলে, আমি চোর। আমার হৃদয়ের ভালো দিকটা তো তখন কেউ দেখবে না। আমাকেও বুঝবে ন। আমি যে অভাবে খুদার তাড়নায় এমনটা করেছি। সেটা কেউ জানবে না। আমার চরিত্র খারাপ! কীভাবে খারাপ সেটা কেউ খুঁজবে নাহ!”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here